রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা


মহানবী (ﷺ)-এর পবিত্র শরীরের পরিপূর্ণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, তাঁর শরীর ও ঘাম হতে নির্গত মিষ্টি সুগন্ধ, আর অপরিচ্ছন্নতা ও শারীরিক ত্রুটি হতে তাঁর মুক্ত থাকা আল্লাহ (ﷻ) কর্তৃক তাঁকে দানকৃত এক বিশেষ গুণেরই অন্তর্ভুক্ত যা অন্য কারো নেই; আর এগুলো অধিকতর পূর্ণতা পেয়েছে সেই পরিচ্ছন্নতা দ্বারা, যা শরীয়ত ও ‘ফিতরা’ তথা স্বাভাবিক আচরণের দশটি অনুশীলনীয় প্রথা অনুযায়ী অবশ্য পালনীয়। [হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) বর্ণিত ও মুসলিম শরীফে লিপিবদ্ধ এক হাদীস অনুসারে এগুলো হচ্ছে মোচ ছেঁটে ফেলা বা ছোট করা, দাড়ি বড় করা, খিলাল ব্যবহার করা, নাকের ভেতরে পানি দেয়া, নখ কাটা, হাতের কব্জি ধোয়া, বগলের লোম কাটা, তলপেটের লোম কাটা, (স্নানাগারে) নিজেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা। রেওয়ায়াতকারিনী (মা আয়েশা) দশমটি ভুলে গিয়েছিলেন, তবে ভেবেছিলেন এটা মুখে কুলি হতে পারে। অপর এক বর্ণনায় দাড়ি বৃদ্ধির পরিবর্তে খতনা এসেছে]


❏ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ ফরমান: “দ্বীন তথা ধর্ম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ওপর ভিত্তিশীল।” [হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) হতে ইবনে হিব্বান; যয়ীফ তথা দু্র্বল]


❏ হযরত আনাস (رضي الله عنه) বলেন, “মহানবী (ﷺ)-এর সুগন্ধের চেয়ে অধিক সুগন্ধময় মেশকে আম্বর বা অন্য কোনো কিছুর ঘ্রাণ আমি গ্রহণ করিনি।” [মুসলিম শরীফ ও তিরমিযী শরীফ] 


❏ হযরত জাবের ইবনে সামুরা (رضي الله عنه) বলেন যে, হুযূর পূর নূর (ﷺ) তাঁর গাল স্পর্শ করেন। তিনি আরো বলেন, “আমি এক শীতল পরশ অনুভব করি এবং তাঁর হাত মোবারক এমন-ই সুগন্ধিময় ছিল যেন তিনি তাঁর পবিত্র হাত কোনো সুগন্ধিভর্তি থলে থেকে বের করেছিলেন।” [মুসলিম]


❏ অন্য কেউ একজন বলেন, “তাঁর পবিত্র হাতে সুগন্ধি ব্যবহার করুন বা না-ই করুন, তিনি কারো সাথে মুসাফাহা (করমর্দন) করলে ওই ব্যক্তির হাতে সুগন্ধ সারা দিন বিরাজ করতো। কোনো শিশুর মাথায় তিনি হাত মোবারক রাখলে ওই শিশুকে সুগন্ধের কারণে অন্যান্য শিশুদের মাঝে আলাদাভাবে চেনা যেতো।”


❏ একবার রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হযরত আনাস (رضي الله عنه)-এর বাড়িতে ফরাশের ওপর ঘুমিয়েছিলেন এবং তিনি (গরমে) ঘামছিলেন। হযরত আনাস (رضي الله عنه)-এর মা সাহেবা একটি লম্বা মুখবিশিষ্ট বোতল আনেন যাতে তাঁর ঘাম সংরক্ষণ করা যায়। মহানবী (ﷺ) তাঁকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তর দেন, “আমরা এগুলো আমাদের সুগন্ধিতে মেশাই, যার দরুন তা সেরা সুগন্ধিতে পরিণত হয়।” [মুসলিম ও বোখারী শরীফ]


❏ ইমাম বোখারী (رحمة الله) তাঁর ‘মহা ইতিহাস’ গ্রন্থে হযরত জাবের (رضي الله عنه)-কে উদ্ধৃত করেন, যিনি বলেন: “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কোনো রাস্তা ধরে গেলে তাঁকে অনুসরণকারী যে কেউ বুঝতে পারতেন তিনি এ রাস্তা ধরে গিয়েছেন।”


❏ ইসহাক ইবনে রাহাওয়াইহ (رضي الله عنه) উল্লেখ করেন, যে মহানবী (ﷺ)-এর এই সুগন্ধ কোনো সুগন্ধির ব্যবহার ছাড়াই হতো।


❏ আল-মুযানী (رحمة الله) ও আল-হারবী (رحمة الله) বর্ণনা করেন হযরত জাবের (رضي الله عنه)-এর কথা, যিনি বলেন: “হুযূর পূর নূর (ﷺ) একবার আমাকে সওয়ারে তাঁর পেছনে বসতে দেন। এমতাবস্থায় আমি তাঁর পিঠে অবস্থিত মোহরে নবুওয়্যতে হাত রাখি, আর মেশকে আম্বরের সুগন্ধি আমার মাঝেও ছড়িয়ে পড়ে।”


মহানবী (ﷺ) ও তাঁর বৈশিষ্ট্যসম্পর্কিত হাদীসশাস্ত্রের এক জ্ঞান বিশারদ (মুহাদ্দীস) বর্ণনা করেন যে, হুযূর পাক (ﷺ) যখন মল-মূত্র ত্যাগ করতে চাইতেন, তখন মাটি দু’ভাগ হয়ে যেতো এবং তা অভ্যন্তরে গ্রহণ করতো; আর তা থেকে সুগন্ধ বের হতো।


❏ আল-ওয়াকিদী (رحمة الله)'র কাতেব/লেখক মুহাম্মদ ইবনে সা’আদ বর্ণনা করেন যে, হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি আরয করেন, “হে আল্লাহর নবী (ﷺ), আপনি মল-মূত্র ত্যাগ করে ফিরলে আমরা কোনো অনিষ্টকর কিছু আপনার কাছ থেকে দেখি না।” হুযূর করীম (ﷺ) উত্তর দেন, “আয়েশা, তুমি কি জানো না আম্বিয়া (عليه السلام)-বৃন্দের মল-মূত্র মাটি খেয়ে ফেলে, যাতে ওগুলোর কিছুই দেখা না যায়।” 

[আদ-দারাকুতনী বর্ণিত এই হাদীসটির যদিও এসনাদ সুদৃঢ়, তবুও এটা প্রসিদ্ধ তথা বহুল পরিচিত নয়]


এই হাদীসটি প্রসিদ্ধ না হলেও (হক্কানী) আলেম-উলামাবৃন্দ হুযূর পাক (ﷺ)-এর মল-মূত্রের পবিত্রতার কথা উল্লেখ করে থাকেন। 


❏ ইমাম শাফেঈ (رحمة الله)-এর জনৈক সহচর এটা বলেছেন এবং ইমাম আবূ নাসর সাব্বাগ এটা তাঁর সংকলনে বর্ণনা করেছেন। ‘উলামা-এ-কেরাম’ ওপরের দুটো বক্তব্য-ই বর্ণনা করেছেন। আবূ বকর ইবনে সাবিক আল-মক্কী তাঁর কৃত মালেকী মযহাবের ফেকাহ’র শাখাবিষয়ক ‘আল-বাদী’ বই, যা’তে মালেকী মযহাবের অংশ নয় বরং শাফেঈ উলামাদের অমুখ্য সিদ্ধান্ত হতে নিঃসৃত বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাতে এসব বর্ণনা অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, মহানবী (ﷺ)-এর কাছ থেকে আপত্তিকর বা অপ্রীতিকর কোনো কিছুই আগমন করেনি।


এই বিষয়ের সাথে সংযুক্ত আরেকটি রেওয়ায়াত (বর্ণনা) আমরা দেখতে পাই, 


❏ যা হযরত আলী (رضي الله عنه) হতে এসেছে; তিনি বলেন: “আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে (বেসালের পরে) গোসল দেই, আর আমি তা-ই খুঁজতে থাকি, যা কোনো মরদেহে স্বাভাবিকভাবে পাওয়া যায়। কিন্তু আমি কোনো কিছুই খুঁজে পাইনি। (অতঃপর) আমি বলি, ‘আপনি (প্রকাশ্য) হায়াতে জিন্দেগীতে ছিলেন খাঁটি ও নির্মল, আর বেসালেও তা-ই’।” 

❏ হযরত আলী (رضي الله عنه) আরো যোগ করেন, “রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছ থেকে (ওই সময়) এক মিষ্টি সুগন্ধ ছড়াচ্ছিল, যার অভিজ্ঞতা আমি আগে কখনোই লাভ করিনি।” [ইবনে মাজাহ, আবূ দাউদ, আল-হাকীম ও আল-বায়হাকী]


❏ হযরত আবূ বকর (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বেসালের পরে বুসা দিলে তিনিও অনুরূপ এক অভিজ্ঞতার বিবরণ দেন। [হযরত উমর (رضي الله عنه) হতে সহীহ সনদে আল-বাযযার বর্ণিত]


❏ আরেকবার হযরত মালেক ইবনে সিনান (رضي الله عنه) উহুদের জ্বেহাদে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর রক্ত মোবারক পান করেন এবং তা চেটে খান। মহানবী (ﷺ) তাঁকে তা করতে দেন এবং এরপর বলেন, “দোযখের আগুন তোমাকে স্পর্শ করবে না।”


[হযরত আবূ সাঈদ আল-খুদরী (رحمة الله) হতে আত্ তাবারানী এবং হযরত উমর ইবনে আস্ সা’ইব (رضي الله عنه) হতে আল-বায়হাকী বর্ণিত]


❏ হুযূর পাক (ﷺ)-এর শিঙ্গা অস্ত্রোপচারের সময় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়র (رضي الله عنه) তাঁর রক্ত পান করলে একই রকম ঘটনা ঘটে। মহানবী (ﷺ) ইরশাদ ফরমান, “মানুষের কাছ থেকে তোমার প্রতি দুঃখ, আর তোমার কাছ থেকেও মানুষের প্রতি দুঃখ।” কিন্তু তিনি ওই সাহাবী যা করেছেন, তাতে আপত্তি করেননি। 

[সহীহ সনদে এটা বর্ণনা করেন সর্ব-ইমাম আল-হাকাম, আল-বাযযার, আদ্ দারাকুতনী, আল-বায়হাকী, আল-বাগাবী ও আত্ তাবারানী]


❏ এ রকম আরেকটি বর্ণনা এসেছে এক মহিলা সম্পর্কে, যিনি নবী করীম (ﷺ)-এর প্রস্রাব মোবারক পান করেছিলেন। তিনি ওই মহিলাকে বলেন, “তুমি আর কখনোই পেটের ব্যথায় (পীড়ায়) ভুগবে না।” [আল-হাকীম বর্ণিত এবং আয-যাহাবী ও আদ্ দারাকুতনী কর্তৃক সমর্থিত]


মহানবী (ﷺ) এসব সাহাবী (رضي الله عنه)-এর কাউকেই মুখ ধুয়ে ফেলতে বলেননি, অথবা একাজ আর করতে নিষেধও করেননি।


প্রস্রাব পানকারিনী মহিলার হাদীসটি সহীহ। 


❏ আদ্ দারাকুতনী সর্ব-ইমাম বোখারী ও মুসলিমের অনুসরণ করে সহীহ’তে বর্ণনা করেন। এই মহিলার নাম বারাকা, তবে তাঁরা (মুহাদ্দেসীন) তাঁর বংশের ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন এ মহিলা উম্মে আয়মান (رضي الله عنه), যিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খেদমত করতেন। তিনি (উম্মে আয়মান) বলেন যে, মহানবী (ﷺ)-এর একটি কাঠের পাত্র ছিল, যেটা তাঁর খাটের নিচে থাকতো এবং রাতে যেটাতে তিনি প্রস্রাব করতেন। এক রাতে তিনি তাতে প্রস্রাব করেন এবং সকালে পরীক্ষা করে তা শূন্য দেখতে  পান। তিনি বারাকাকে এব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “আমি ঘুম থেকে জেগে উঠে তৃষ্ণার্ত ছিলাম। তাই না জেনেই তা পান করেছি।” এই হাদীস ইবনে জুরায়জ ও অন্যান্য হাদীসবেত্তা বর্ণনা করেন।


মহানবী (ﷺ)-এর বেলাদত (ধরাধামে শুভাগমন) খতনা অবস্থায় হয় এবং তাঁর নাড়িও কাটা ছিল। বর্ণিত আছে যে, তাঁর মা আমিনা (আল্লাহ তাঁকে পরকালীন শান্তি দিন) বলেন, “রাসূল (ﷺ)-এর বেলাদত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন অবস্থায় হয়েছিল। তাঁর শরীরে কোনো অপবিত্রতা বা অপরিচ্ছন্নতা ছিল না।”


❏ হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, “আমি কখনোই মহানবী (ﷺ)-এর গোপন অঙ্গ দেখিনি।” [আল-বাযযার ও আল-বায়হাকী]


❏ হযরত আলী (رضي الله عنه) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে বলেন যেন আমি ছাড়া আর কেউই তাঁর বেসালের পরে তাঁকে গোসল না দেন। তিনি বলেছিলেন, ‘কেউই আমাকে বিবস্ত্র অবস্থায় দেখে অন্ধ না হয়ে যায়নি’।” [প্রাগুক্ত আল-বাযযার ও আল-বায়হাকী]


❏ হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে, হযরত ইকরামা ইবনে আবদিল্লাহ (رضي الله عنه) বর্ণিত, একটি হাদীস অনুযায়ী মহানবী (ﷺ) একবার এমন নিদ্রাগত ছিলেন যে তাঁর গভীর নিঃশ্বাস নেয়ার আওয়াজ শোনা গিয়েছিল। অতঃপর তিনি ঘুম থেকে জেগে বিনা ওযূতে নামায আদায় করেন [আল-বোখারী ও মুসলিম]। 


❏ হযরত ইকরামা (رضي الله عنه) বলেন, “এটা এ কারণে যে তিনি রক্ষাপ্রাপ্ত ছিলেন।”

________________

কিতাবঃ আশ শিফা [অসম্পূর্ণ]

মূল: ইমাম কাজী আয়াজ (رحمة الله)

অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন


সূত্রঃ 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন