হুযূর পূর নূর (ﷺ) এর তাঁর সৎ সঙ্গ, শিষ্ট আচার-ব্যবহার ও সৎ স্বভাব


সব ধরনের মানুষের সাথে মহানবী (ﷺ)-এর সৎ সঙ্গ, উত্তম আচার-ব্যবহার ও হাসি-খুশি আচরণ অনেকগুলো সহীহ হাদীসে বিবৃত হয়েছে। 


❏ হযরত আলী (কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ) তাঁর সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, “তিনি ছিলেন মানুষের মাঝে সবচেয়ে উদার, সত্যবাদী, দয়ালু এবং তাঁর সঙ্গীদের প্রতি সহৃদয়।” [ইমাম তিরমিযী বর্ণিত সহীহ হাদীস]


❏ হযরত কায়স ইবনে সা’আদ (رضي الله عنه) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একবার আমাদের বাসায় আসেন। তিনি যখন বিদায় নিতে চান, তখন আমার বাবা হযরত সা’আদ (رضي الله عنه) একটি গাধা নিয়ে আসেন যার ওপর একখানা কাপড়ের জিন ছিল। নবী করীম (ﷺ) তাতে উঠে বসেন। এমতাবস্থায় হযরত সা’আদ (رضي الله عنه) আমাকে বলেন, ‘কায়স, তুমি হুযূর পূর নূর (ﷺ)-এর সাথে যাও।’ মহানবী (ﷺ) আমাকেও তাঁর সাথে (গাধার পিঠে) চড়ে বসতে বলেন। আমি অম্বীকৃতি জানাই। অতঃপর তিনি বলেন, ‘হয় তুমি আমার সাথে বসো, না হয় চলে যাও (মানে সাথে এসো না)।’ তাই আমি প্রস্থান করি।” আরেকটি বর্ণনায় এসেছে এভাবে, “আমার সামনে বসো, (কেননা গাধার) মালিকেরই সামনে বসার অধিকার বেশি।” [আবূ দাউদ ও নাসাঈ। 


বঙ্গানুবাদকের নোট: হযরত কায়স (رضي الله عنه) এই ঘটনায় সর্বোচ্চ পর্যায়ের সম্মান প্রদর্শন করেছেন। একই জিনের ওপর তিনি বসেননি। হুযূরের আদেশের প্রতি এটা কোনোক্রমেই বেয়াদবি নয়]     


রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সকল মানুষকে কাছে টানতেন, দূর করে দিতেন না। যে কোনো গোত্রের মর্যাদাবান নেতৃস্থানীয়দের তিনি শ্রদ্ধা করতেন এবং তাঁদেরকে গোত্রপ্রধান হিসেবে নিয়োগ করতেন। তিনি মানুষের প্রতি হাসি-খুশি ভাব ও উত্তম আচরণপূর্ণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পরিত্যাগ না করেই তাদের ব্যাপারে সাবধান ও যত্নবান ছিলেন। তাঁর সাহাবা (رضي الله عنه)-বৃন্দের প্রতি তিনি যথাযথ মনোযোগ দিতেন এবং তাঁর সোহবত তথা সাহচর্য যাঁর যতোটুকু প্রাপ্য, তা-ই তিনি তাঁদেরকে দিতেন। ফলে তাঁর সান্নিধ্যে ধন্য প্রত্যেকেই মনে করতেন তাঁর চেয়ে বেশি সম্মান আর কেউই পাননি।


হুযূর পাক (ﷺ) তাঁর সান্নিধ্যে উপবেশনকারী বা কোনো কিছুর প্রত্যাশায় সাহচর্য লাভকারী যে কারো প্রতি অত্যন্ত দৈর্যশীল ছিলেন, যার দরুন ওই ব্যক্তি-ই সর্বপ্রথম বিদায় নিতেন। কেউ মহানবী (ﷺ)-এর কাছে কিছু চাইলে তিনি হয় তা তাকে দিতেন, না হয় দয়াপূর্ণ কিছু একটা বলতেন। তাঁর উত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি সবাইকে এমনভাবে জড়িয়ে ফেলতো (মনে হতো) যেন তিনি তাঁদের বাবার মতোই কোনো সত্তা। তিনি তাঁদের প্রতি যে সম্মান প্রদর্শন করতেন, তাঁরাও সমান পর্যায়ের শ্রদ্ধা তাঁকে প্রদর্শন করতেন।


❏ ইবনে আবি হালা (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, “তিনি ছিলেন সহজ, সরল মন-মেজাজসম্পন্ন সর্বদা হাসি-খুশি এক মহাত্মা। তিনি নম্র স্বভাবের ছিলেন; বদমেজাজি বা রূঢ় অথবা শোরগোলকারী কিংবা অশ্লীল বা ছিদ্রান্বেষণকারী অথবা তোষামোদকারী ছিলেন না। তিনি যে খাবার খেতে চাইতেন না, তা কোনো অভিযোগ ছাড়াই পরিত্যাগ করতেন।”[শামায়েলে তিরমিযী]


❏ আল্লাহ (ﷻ) ইরশাদ ফরমান: “অতঃপর কেমন-ই আল্লাহর কিছু দয়া রয়েছে যে, হে মাহবূব! আপনি তাদের জন্যে কোমল-হৃদয় হয়েছেন। আর যদি আপনি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হতেন, তবে তারা নিশ্চয় আপনার আশপাশ থেকে পেরেশান হয়ে যেতো।” [আল-কুরআন, ৩:১৫৯; মুফতী আহমদ ইয়ার খাঁন (رحمة الله)-এর কৃত ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’]


❏ আল্লাহ (আরো) ইরশাদ ফরমান: “মন্দকে ভালো দ্বারা প্রতিহত করো! তখনই ওই ব্যক্তি, তোমার সাথে যার পারস্পরিক শত্রুতাভাব ছিল, সে এমন হয়ে যাবে যেন অন্তরঙ্গ বন্ধু।” [আল-কুরআন, ৪১:৩৪; প্রাগুক্ত ‘নূরুল এরফান’]


কেউ মহানবী (ﷺ)-কে দাওয়াত করলে তিনি তা গ্রহণ করতেন এবং উপহার-ও নিতেন, এমন কি তা যদি খাবার হিসেবে ভেড়ার পা-ও হতো; আর তিনি সেটার প্রতিদানস্বরূপ উপযুক্ত পুরস্কার-ও দিতেন।


❏ হযরত আনাস্ (رضي الله عنه) বলেন, “আমি দশ বছর যাবত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খেদমত করেছি, কিন্তু তিনি কখনো আমার প্রতি ‘উফ!’ শব্দটিও উচ্চারণ করেননি। আমার কৃত কোনো কর্ম সম্পর্কে তিনি এমন কথা বলেননি যে ‘কেন তুমি এটা করেছো?’ অথবা, আমার না করা কোনো কিছু সম্পর্কে বলেননি, ‘কেন তুমি এটা করোনি?’ “ [মুসলিম ও বুখারী]  


❏ হযরত মা আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, “চরিত্র বৈশিষ্ট্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চেয়ে উত্তম আর কেউই ছিলেন না। তাঁর সাহাবা (رضي الله عنه)-মণ্ডলীর কেউ কিংবা তাঁর পরিবার-সদস্যদের কেউ তাঁকে ডাকলে তিনি উত্তর দিতেন, ‘(আমি) আপনার সেবায় হাজির!’ “ [আবূ নুয়াইম]


❏ হযরত জাবের ইবনে আবদিল্লাহ (رضي الله عنه) বলেন, “আমি মুসলমান হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কখনোই আমার কাছ থেকে নিজেকে পৃথক করে রাখেননি; আর যখন-ই তিনি আমাকে দেখতে পেতেন, তৎক্ষণাৎ স্মিত হাসতেন।” [মুসলিম ও আল-বুখারী]


মহানবী (ﷺ) তাঁর সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-এর সাথে মজাক (কৌতুক) করতেন এবং তাঁদের সাথে মিশতেন ও আলাপ করতেন; আর তাঁদের বাচ্চাদের সাথেও খেলতেন। তিনি তাঁদের সবাইকে নিজ কক্ষে বসাতেন এবং মুক্ত, স্বাধীন ব্যক্তির পাশাপাশি গোলাম ও দাসী এবং গরিব মানুষেরও ফরিয়াদ শুনতেন (তথা প্রতিবিধান দিতেন)। শহরের দূরবর্তী অংশে অবস্থিত অসুস্থদেরও তিনি দেখতে যেতেন এবং কেউ কোনো ওজর পেশ করলে তিনি তা গ্রহণ করতেন।


❏ হযরত আনাস (رضي الله عنه) বলেন, “কেউ হুযূর পূর নূর (ﷺ)-এর কানে কানে কিছু বল্লে তিনি প্রথম নিজ শির মোবারক সরাতেন না, যতোক্ষণ না ওই ব্যক্তি আপন শির সরাতেন। যখন কেউ তাঁর হাত মোবারক ধরতেন, তখন তিনি তা ছাড়াতেন না, যতোক্ষণ না ওই ব্যক্তি আপন হাত ছাড়াতেন। তাঁর পাশে বসে থাকা কারো সামনে হাঁটু ছড়িয়ে বসতে তাঁকে কখনোই দেখা যায়নি।” [আবূ দাউদ, তিরমিযী ও আল-বায়হাক্বী; ইবনে আল-বাযযার এটা বর্ণনা করেছেন সর্ব-হযরত আবূ হুরায়রাহ (رضي الله عنه) ও ইবনে উমর (رضي الله عنه)-এর সূত্রে]  


মহানবী (ﷺ)-এর কারো সাথে সাক্ষাৎ হলে তিনি-ই সর্বপ্রথম সালাম দিতেন। সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-এর সাথে করমর্দন-ও তিনি-ই প্রথম করতেন। তাঁদের মাঝে অবস্থানকালে তাঁদেরকে সীমাবদ্ধ করে এমনভাবে পা মেলে রাখতেন না তিনি। যে কেউ তাঁর সামনে হাজির হলে তিনি তাকে সম্মান করতেন। কখনো কখনো তিনি অন্যদের জন্যে তাঁর বস্ত্র মেলে ধরতেন যাতে তিনি যেখানে বসেছিলেন সেখানে অন্যরা আরামে বসতে পারেন, আর এতে তিনি নিজের চেয়ে অন্যদেরকে বেশি মূল্যায়ন করতেন। তারা না বসতে চাইলেও তিনি তাদের বসতে দেয়ার ব্যাপারে নাছোড়বান্দা হতেন। তিনি তাঁর সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-কে কুনিয়া প্রদান করেন এবং তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তাঁদেরকে সবচেয়ে  সেরা সেরা নামে ডাকতেন। কারো সাথে আলাপকালে তিনি তা চালিয়ে যেতেন যতোক্ষণ না তা নিঃশেষ হতো; এরপর তিনি তা শেষ করতেন, নতুবা উঠে যেতেন। বর্ণিত আছে যে, তিনি প্রার্থনা করার সময় কেউই তাঁর সোহবত (সান্নিধ্য) পেতেন না, তবে তাঁদের কার কী প্রয়োজন তা জানতে তিনি তাঁর প্রার্থনা সংক্ষিপ্ত করতেন। তাঁদের আরযি পেশ শেষ হওয়ামাত্র তিনি আবার প্রার্থনায় ফিরে যেতেন।

তিনি সকল মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্মিত হাসতেন এবং উৎফুল্ল চিত্তের ছিলেন। অবশ্য এর ব্যতিক্রম ঘটতো যখন আল-কুরআন অবতীর্ণ হতো, অথবা তিনি কাউকে সদুপদেশ বা কোনো ভাষণ দিতেন। 


❏ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আল-হারিস্ (رضي الله عنه) বলেন, “মহানবী (ﷺ)-এর চেয়ে বেশি স্মিত হাস্যকারী আর কাউকে আমি (জীবনে) দেখিনি।” [ইবনে হাম্বল (رضي الله عنه) ও আল-তিরমিযী (رحمة الله)] 


❏ হযরত আনাস (رضي الله عنه) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ভোরে (ফজরের) নামায পড়ার সময় মদীনার সেবকবৃন্দ পাত্রভর্তি পানি নিয়ে তাঁর সান্নিধ্যে আসতেন। তাঁর সামনে যখনই (এরকম) পাত্র আনা হতো, তৎক্ষণাৎ তিনি তাঁর হাত মোবারক তাতে চুবাতেন; আর কখনো কখনো (শীতের) সকালগুলো ঠাণ্ডা হতো। তাঁরা এভাবে (তাঁর কাছ থেকে) তাবাররুক (বরকত/আশীর্বাদ) অন্বেষণ করতেন।”[মুসলিম]।

________________

কিতাবঃ আশ শিফা [অসম্পূর্ণ]

মূল: ইমাম কাজী আয়াজ (رحمة الله)

অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন


সূত্রঃ 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন