মাজারের উপর গম্বুজ ও পাশে ঘর তৈরি করা
মাজারের উপর বা পাশে যিয়ারত কারীদের সুবিধার্থে ঘর তৈরী করা বা তাবু টাঙ্গানাে জায়েয। বিষয়টি পবিত্র কোরআন ও একাধিক সহিহ রেওয়াত দ্বারা প্রমাণিত। কেননা যিয়ারত কারীরা সেখানে বসে কবরবাসীদের উছিলায় বরকত হাছিল করবে এবং তাদের যিয়ারত ও দোয়া করবে। পূর্বযুগেও আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ এরূপ করতেন বলে প্রমাণিত আছে। যেমন নিচের দলিল গুলাে লক্ষ্য করুন:-পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ পাক এরশাদ করেন,
قال الذين غلبوا على أمرهم ليرد عليهم مسجدة
-"তারা যে কাজে (ইবাদতে) নিয়ােজিত ছিল তাঁদের সেই স্মৃতির উদ্দেশ্যে মসজিদ নির্মান করবে।"(সূরা কাহাফ: ২১ নং আয়াত।
এই আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়, নেক বান্দাহ গণের মাজারের পাশে মসজিদ নির্মান করা পবিত্র কোরআনের শিক্ষা। কারণ ‘ আসহাবে কাহাফ ' যেখানে শায়িত ছিলেন ঐ স্থানের পাশেই মসজিদ নির্মান করা হয়েছিল। যারা মসজিদ নির্মান করেছিল তারাও ইমানদার ছিলেন। মাজারের পাশে মসজিদ তৈরী কেন হয়েছিল এর জবাবে এই আয়াতের তাফছিরে উল্লেখ আছে,
يصلى فيه المسلمون ويتبركون بمكانهم .
(ইউছাল্লি ফিহিল মুসলিমুন ওয়া ইয়াতাবারুরাকুনা বিমাকানিহিম) "লােকজন সেখানে (মসজিদে) নামাজ আদায় করবে ও তাদের কাছে। থেকে বরকত লাভ করবেন।"(তাফছিরে জামখসারী, ২ য় খন্ড, ৭৭১ পৃ: তাফছিরে নাছাফী, ২ য় খন্ড, ২৯৩ পৃ ; তাফছিরে নিছাপুরী, ৪ র্থ খন্ড, ৪১১ পৃঃ ; তাফছিরে রুহুল বয়ান, ৫ ম খন্ড, ২৩২ পূ ; তাফছিরে মাজহারী, ৬ ষ্ঠ খন্ড, ২৩ পৃঃ ;।
সুতরাং আল্লাহর প্রিয় বান্দাহগণের মাজারের কাছে (মসজিদে) নামাজ আদায় করা এবং যিয়ারতের মাধ্যমে বরকত হাছিল করা সম্পূর্ণ জায়েয ও কোরআন সম্মত। এই সুবাধেই ইমামগণ একে অপরের মাজার যিয়ারত করতেন ও তাদের উছিলায় বরকত হাছিল করতেন। যেমন ফাতওয়ায়ে শামী কিতাবে উল্লেখ আছে,
إلى تبارك بأبي حنيفة وجيء إلى قبي ، إذا عرضت لي حاجه لیت ركعتين وألت اللللہ تعالی عند قبره فقضى شريعا .
-"ইমাম শাফেয়ী (رحمة الله) বলেন, আমি যখন কোন সমস্যায় পরতাম তখন ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) এর মাজারে যাইতাম ও বরকত হাছিল করতাম এবং সেখানে দু'রাকাত নামাজ আদায় করতাম। অত: পর তাঁর মাজারের পাশে দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম ফলে আমার হাজত পুরা হয়ে যাইত।"(আল্লামা ইবনে আবেদীন: ফাতওয়ায়ে শামী, ১ ম খন্ড, ১৪৯ পৃ:)
সনদ সহকারে খতিবে বাগদাদী (رحمة الله) তদীয় তারিখের কিতাবে এভাবে উল্লেখ করেছেন,
أخبارنا القاضي أبو عبد الله الحسين بن علي بن محمد الصيمري ، قال: أخبرنا عمر بن إبراهيم المقرئ ، قال: مما مكرم بن أحمد ، قال: حدا عمر بن إسحاق بن إبراهيم ، قال: كنا علي بن میمون ، قال: سمعت الشافعي ، يقول: إني لأتبرك بأبي حنيفة وأجيء إلى قبره في كل يوم ، يعني زائرا ، فإذا عرضت لي حاجة صليت ركعتين ، وجئت إلى قبره وسألت الله تعالى الحاجة عنده ، فما تبعد عني حتى تقضى .
-"আলী ইবনে মাইমুন বলেন, আমি ইমাম শাফেয়ী (رحمة الله) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন: আমি অবশ্যই ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) এর উছিলায় বরকত হাছিল করতাম এবং তার মাজারে প্রতিদিন যেয়ারতের উদ্দেশ্যে আসতাম। আমার যখন কোন হাজত থাকত তখন দুই রাকাত নামাজ আদায় করতাম এবং তার মাজারের কাছে যাইতাম ও আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতাম। ফলে আমার হাজত বা চাহিদা দ্রুত পূরণ হয়ে যেত।"(খতিবে বাগদাদী: তারিখে বাগদাদ, ১ ম খন্ড, ৪৪৫ পৃ:)
সুতরাং নেক বান্দাহ গণের মাজারের পাশে দাঁড়িয়ে বরকত হাছিল করা ও আল্লাহর কাছে দোয়া করা জায়েয ও মুস্তাহাব। কারণ যে কোন আমলের জন্য একজন মুজতাহিদ এর অনুসরণই যথেষ্ট আর ইমাম শাফেয়ী (رحمة الله) ছিলেন ‘ মুজতাহিদ ফিশ শারিয়াত তথা প্রথম তার মুজতাহিদ। খাজা মইনুদ্দিন চিস্তী (رحمة الله) একাধারে ৪০ দিন দাতা গঞ্জেবখশ (رحمة الله) এর মাজারে মােরাকাবা করেছিলেন। হজরত আবুল হাছান খেরকানী (رحمة الله) বরকত হাছিলের জন্য একাধারে ১২ বছর হজরত বায়েজিদ বােস্তামী (رحمة الله) এর মাজার যিয়ারত করেছিলেন। খাজা বাহাউদ্দিন নক্সাবন্দী (رحمة الله) বহু বৎসর যাবৎ বিভিন্ন আউলিয়াগণের মাজার যিয়ারত করেছিলেন বরকত হাছিলের উদ্দেশ্যে। ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক্ব ফাকেহী (رحمة الله) ওফাত ২৭২ হিজরী, ইমাম তাবারানী (رحمة الله) ও ইমাম আব্দুর রাজ্জাক ছানআনী (رحمة الله) সনদ সহকারে উল্লেখ করেছেন,
حدثنا إسحاق بن إبراهيم البري ، عن عبد الراق ، عن الگوري ، عن عمران بن أبي عطاء قال: هذ محمد ابن الخيرية حين مات ابن عباس بالطائف ، فكبر عليه أبها ، وذه من قبل القبلة چين أذله القبر ، وضرب عليه فسطاطا ثلاثة أيام
-"ইমরান ইবনে আবী আত্বা (رحمة الله) বলেন, যখন ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) তায়েফে ইন্তেকাল করেন তখন মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়্যা (رحمة الله) এর সাথে ছিলাম। তখন তিনি ৪ তাকবীরে জানাযা আদায় করলেন এবং কেবলার দিক থেকে লাশ কবরে নামালেন। ৩ দিন পর্যন্ত মাজারের উপর তাবু টাঙ্গিয়ে রাখলেন।"
(ইমাম তাবারানী: মুজামুল কবীর, হাদিস নং ১০৫৭৩ ; মুছান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদিস নং ৬২০৬ ; ইমাম হায়ছামী: মাজমুয়ায়ে জাওয়াইদ, হাদিস নং ৪১৮৫ ; ইমাম ফাকেহী: আখবারে মক্কী, হাদিস নং ১৬৩৮)
এই হাদিসের সনদ প্রসঙ্গে ইমাম হায়ছামী (رحمة الله) বলেন,
رواه الطبراني في الكبير ، ورجاله رجال الصحيح
-"ইমাম তাবারানী তার কবীরে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন এবং ইহার বর্ণনাকারী সকলেই বিশুদ্ধ।"(ইমাম হায়ছামী: মাজমুয়ায়ে জাওয়াইদ, হাদিস নং ৪১৮৫)
এ বিষয়ে নিচের হাদিসটি উল্লেখযােগ্য,
حدثنا أبو بكر قال: ثنا وكيع ، عن أبي معشر ، عن محمد بن المنكدر ، أن غمر ، ضرب على قبر زينب فسطاطا
-"মুহাম্মদ ইবনে মুনকাদির (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, নিশ্চয় উমর ইবনুল খাত্তাব (رضي الله عنه) হজরত যায়নব (رضي الله عنه) এর মাজারের উপর তাবু টাঙ্গিয়ে ছিলেন।"(মুছান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ, হাদিস নং ১১৭৫১ ; ইমাম আইনীঃ উমদাতুল নারী শরহে বুখারী, ৮ ম খন্ড, ১৩৪ পৃঃ ১৩৩০ নং হাদিসের পূর্বে) সনদ সহিহ।
ইমাম বুখারী (رحمة الله) তদীয় সহিহ গ্রন্থে উল্লেখ করেন,
ولما مات الحسين بن الحسن بن علي رضي الله تعالى عنهم بين امرأه الفنية على قبره سنة
-"যখন হাছান ইবনে হাছান ইবনে আলী (رضي الله عنه) ইন্তেকাল করেছিলেন তাঁর স্ত্রী (ফাতেমা বিনতে হুছাইন ইবনে আলী রাঃ) তাঁর মাজারের উপর একটি তাবু খাটাইলেন এবং এক বৎসর রেখেছিলেন।"(সহিহ বুখারী, ১৩৩০ নং হাদিসের পূর্বে ইমাম বাগভী: শরহে সুন্নাহ, ৫ ম খন্ড, ৪০৬ পূ ; তারিখে ইবনে আসাকির, ৭০ তম খন্ড, ২০ পৃঃ ; মেসকাত শরীফ, ১৫০ পৃঃ ; ইমাম মােল্লা আলী: মেরকাত শরহে মেসকাত, ৩ য় খন্ড, ২০৫ পৃ:)
সহিহ বুখারীর হাদিস দ্বারা প্রমাণ হয়, সাহাবীগণের জামানায় মাজারের উপর তাবু বা ঘর তৈরী হয়েছিল কিন্তু কোন সাহাবী বাধা দেননি এবং ইমাম বুখারী (رحمة الله) এর মত একজন মােহাদ্দেছ এই হাদিস বর্ণনা করেছেন। আরেকটি বিষয় লক্ষ্যনীয় যে, হজরত হাছান ইবনে হাছান ইবনে আলী (رضي الله عنه) এর মাজারে পাশে খাদেম হিসেবে স্বীয় স্ত্রী অবস্থান করেছিলেন। এমনকি স্বয়ং আল্লাহর হাবীব হুজুর (ﷺ) এর রওজা মােবারকে আম্মাজান আয়েশা ছিদ্দিকা (রাঃ) খাদেম হিসেবে ছিলেন। সুতরাং আউলিয়া কেরামের মাজারের পাশে খাদেম থাকলে দোষের কিছুই নেই। উল্লেখিত হাদিস গুলাে পূর্ব যুগের মুহাদ্দেছিনে কেরাম তাদের স্ব স্ব কিতাবে এভাবে উল্লেখ করেছেন। যেমন,
وقد ضربه عمر على قبر يزينب بنت خښ ورته عائية على قبر أخيها عبد المني وبه محمد بن الحنفية على قبر ابن عباس
-'হজরত উমর (رضي الله عنه) যয়নব বিনতে জাহাসের মায়ের উপর, হজরত আয়েশা (রাঃ ) স্বীয় ভাই আব্দুর রহমান (رضي الله عنه) এর মাজারের উপর, মুহাম্মদ ইবনে হানিফা (رضي الله عنه) যিনি হজরত আলী (رضي الله عنه) এর ছেলে ছিলেন তিনি হজরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) এর মাজারের উপর গুম্বুজ তৈরী করেছিলেন। (আল-মুস্তকা শরহে মােয়াত্তা, ২ য় খন্ড, ২৩ পৃ ; ইবনে বাত্তাল: শরহে বুখারী, ৩ য় খন্ড, ৩১২ পৃঃ ; ইমাম আইনী: উমদাতুল ক্বারী শরহে বুখারী, ৮ ম খন্ড, ১৩৪ পৃ:)
এ ব্যাপারে আরেকটি বর্ণনা হানাফী মাজহাবের অন্যতম ফকিহ ইমাম আলাউদ্দিন কাছানী (رحمة الله) এভাবে বর্ণনা করেছেন,
وروي أين عبد الله بن عباس رضي الله عنهما لما مات بالای صلی عليه محمد بن الحتة ، وكبر عليه أبعا ، وجعل له لخدا وأذله القبر من قبل القبلة ، وجعل قبره سما وضرب عليه فسطاطا ؛
-"যখন ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) তায়েফে ইন্তেকাল করলেন, মুহাম্মদ ইবনে হানিফা (رضي الله عنه) তার চার তাকবিরে জানাযা আদায় করলেন, তাকে কিবলার দিক হতে নামানাে হয়েছিল এবং মাজারের উপর তার বা গুম্বুজ তৈরী করলেন।"(ইমাম কাছানী কিতাবুল বাদাউছ ছানায়ে, ১ ম খন্ড, ৩২০ পৃ: ও ৬৫ পৃঃ)
সুতরাং আল্লাহর প্রিয় বান্দাহ গণের মাজারের উপর গুম্বুজ তৈরী করা স্বয়ং সাহাবীগণের সুন্নাত। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (رضي الله عنه), নবী পত্নি আম্মাজান আয়েশা (رضي الله عنه) ও হজরত আলীর (رضي الله عنه) ছেলে মুহাম্মদ ইবনে হানিফা (رضي الله عنه) মাজারের উপর গুম্বুজ তৈরীর পক্ষে ছিলেন। অথচ এ যুগের কিছু জাহেল ও অজ্ঞ লােকেরা এর বিরােধিতা করেন (নাউজুবিল্লাহ। হ্যা, ঢালাও ভাবে সবার কবরে গুম্বুজ তৈরী করা যাবেনা বরং আউলিয়া কেরামের মাজারের উপরই গুম্বুজ তৈরী করার অনুমতি রয়েছে।
হজরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) ও ইবনে উমর (رضي الله عنه) কবরের উপর তাবু টাঙ্গানাের পক্ষপাতি ছিলেন না। কিন্তু হজরত উমর (رضي الله عنه), মা আয়েশা (رضي الله عنه) তাবু টাঙ্গানাের পক্ষে ছিলেন। সেক্ষেত্রে হজরত উমর (رضي الله عنه) খােলাফায়ে রাশেদীনের অন্তর্ভুক্ত বিধায় এই বিষয়টিই অগ্রাধিকার পাবে। তবে এ বিষয়ে অতিরঞ্জিত করা ও অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করা মােটেই উচিৎ হবেনা। উল্লেখযােগ্য ব্যক্তি হলে তার মাজারের উপরে তাবু টানানাে যাবে কিন্তু ঢালাওভাবে সকলের কবরের উপর তাবু টানানাে উচিৎ হবেনা।
_______________
সহিহ হাদিসের আলােকে মাজার যিয়ারত পূজা নয় ও কদমবুছির সমাধান
গ্রন্থনায়ঃ মুফতি মাওলানা মুহাম্মদ আলাউদ্দিন জিহাদী
🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন