মহানবী (ﷺ)-কে শাহেদ (সাক্ষী) হিসেবে আল্লাহর দেয়া বর্ণনা এবং এর সাথে সম্পৃক্তপ্রশংসা ও মর্যাদা


❏ আল্লাহ (ﷻ) ইরশাদ ফরমান: “হে অদৃশ্যের সংবাদদানকারী (নবী)! নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রেরণ করেছিশাহেদ তথা উপস্থিত পর্যবেক্ষণকারী (হাযের–নাযের) করে, শুভ সংবাদ দানকারী ও সতর্ককারীস্বরূপ” [সূরা আহযাব, ৪৫ আয়াত]। 


এ আয়াতে করীমায় আল্লাহ (ﷻ) তাঁর হাবীব (ﷺ)-কে শ্রেষ্ঠত্বপূর্ণ সকল পদমর্যাদা ও প্রশংসনীয় প্রতিটি গুণ দ্বারা বিভূষিত করেছেন। তিনি তাঁকে উম্মতের জন্যে একজন সাক্ষী বানিয়েছেন এ বাস্তবতার আলোকে যে তিনি তাদের কাছে ঐশী বাণী পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁকে মান্যকারী মানুষের জন্যে তিনি হলেন শুভ সংবাদ দানকারী, আর তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণাকারী লোকদের জন্যে তিনি হলেন সতর্ককারী। তিনি আল্লাহর একত্ববাদ ও তাঁরই এবাদত-বন্দেগীর প্রতি আহ্বানকারী এবং তিনি হলেন একটি প্রোজ্জ্বল প্রদীপ, যা দ্বারা মানুষজন সত্যের দিকনির্দেশনা পায়।


❏ আতা ইবনে ইয়াসার (رحمة الله) ❏  বলেন, “আমি আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আল-আস্ (رحمة الله) ❏  এর সাক্ষাৎ পেয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম: আমাকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সম্পর্কে বিবরণ দিন। তিনি জবাব দিলেন: নিশ্চয়ই! শপথ আল্লাহর নামে, কুরআন মজীদে বর্ণিত হুযূর পূর ‍নূর (ﷺ)-এর কতিপয় বৈশিষ্ট্য তৌরাতেও পাওয়া যায়। তৌরাত ঘোষণা করে: ‘হে নবী (ﷺ)! আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি সাক্ষী, শুভ সংবাদ দানকারী ও সতর্ককারী এবং নিরক্ষরদের জন্যে আশ্রয় হিসেবে। আপনি আমার বান্দা ও রাসূল। আমি আপনাকে মানুষের আস্থার পাত্র হিসেবে আখ্যা দিয়েছি। আপনি এমনই একজন যিনি অমার্জিত কিংবা অশিষ্ট নন, যিনি বাজার এলাকায় হৈচৈ করেন না এবং যিনি মন্দের প্রতিদানে মন্দ কিছু করেন না, বরং ক্ষমা করেন। আল্লাহ তাঁকে ততোক্ষণ নিজের কাছে ফেরত নেবেন না, যতোক্ষণ না বদমায়েশ সমাজ তাঁর দ্বারা সিধা হয় এবং ঘোষণা করে – ”আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মা’বূদ নেই।” নবী (ﷺ)-এর মাধ্যমেই অন্ধ চক্ষু, বধির কান ও কলুষিত অন্তর আবার সক্রিয় হয়ে ওঠবে’।” আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (رحمة الله) ❏  ও কা’আব আল-আহবার (رحمة الله) ❏  হতেও অনুরূপ একটি বর্ণনা এসেছে।


❏ ইবনে ইসহাক (رحمة الله) (رحمة الله)  থেকে একটি বর্ণনায় ইরশাদ হয়: “যিনি বাজার এলাকায় হৈচৈ করেন না এবং অশালীন ভাষা প্রয়োগ কিম্বা গালিগালাজ করেন না। আমি তাঁকে সমস্ত মহৎ গুণাবলী ও মর্যাদাপূর্ণ বৈশিষ্ট্যে বিভূষিত করেছি। আমি শান্তিকে তাঁর ভূষণ, উৎসর্গিত হওয়াকে তাঁর নীতি, খোদাভীরুতাকে তাঁর বিবেক, জ্ঞানকে তাঁর উপলব্ধি, সত্যবাদিতা ও আনুগত্যকে তাঁর স্বভাব, ক্ষমা ও সঠিক আচরণকে তাঁর চরিত্র, ন্যায়বিচারকে তাঁর আচরণ, সত্যকে তাঁর শরীয়ত, হেদায়াতকে তাঁর দিক-নির্দেশক, ইসলামকে তাঁর ধর্ম এবং আহমদকে তাঁর নাম হিসেবে পছন্দ করে সৃষ্টি করেছি। আমি পথভ্রষ্টতার পরে তাঁর হেদায়াতকে এবং অজ্ঞতার পরে তাঁর জ্ঞানকে প্রকাশ করবো। বিস্মৃতির পরে আমি তাঁকে বুলন্দ্ তথা সমুন্নত করবো। অস্বীকৃতির পরে আমি তাঁর নাম মোবারককে সর্বত্র জ্ঞাত করবো। অভাবের পরে আমি তাঁকে অধিক (পরিমাণে) দান করবো। গরিবীর পরে আমি তাঁকে সমৃদ্ধ করবো। বিচ্ছেদের পরে আমি তাঁকে মিলিত করবো। তাঁর মাধ্যমেই আমি বিচ্ছিন্ন অন্তরগুলো ও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রেরণাকে এবং বিচ্ছিন্ন সমাজগুলোকে একত্রিত করবো। আমি তাঁর সমাজ (উম্মত)-কে মানবের কল্যাণকারী সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজ হিসেবে আবির্ভূত করবো।”


❏ আরেকটি হাদীস শরীফে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তৌরাতে তাঁর সম্পর্কে যা যা বর্ণিত হয়েছে, সে সম্পর্কে আমাদের কাছে বিবৃত করেন: “আমার বান্দা আহমদ, পছন্দকৃত জন যিনি মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করবেন; তিনি মদীনা নগরীতে হিজরত করবেন, কেননা তিনি তৈয়্যবাত (কলেমা) পড়েছিলেন; তাঁর উম্মত হবেন তাঁরাই, যাঁরা সকল অবস্থায় আল্লাহর প্রশংসা করবেন।” [কা’আব হতে আদ্ দারিমী বর্ণিত; ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) হতে তাবরানী ও আবূ নুয়াইম বর্ণিত]


❏ আল্লাহ (ﷻ) ইরশাদ ফরমান: “ওই সব মানুষ, যারাগোলামী করবে এ পড়াবিহীন অদৃশ্যের সংবাদ দানকারীরাসূলের, যাঁকে লিপিবদ্ধ পাবে নিজেদের নিকটতাওরীত ও ইনজীলের মধ্যে; তিনি তাদেরকে সৎকর্মেরনির্দেশ দেবেন এবং অসৎ কাজে বাধা দেবেন, আরপবিত্র বস্তুগুলো তাদের জন্যে হালাল করবেন এবংঅপবিত্র বস্তুসমূহ তাদের প্রতি হারাম করবেন; আরতাদের ওপর থেকে ওই কঠিন কষ্টের বোঝা ও গলারশৃঙ্খল যা তাদের ওপর ছিল, নামিয়ে অপসারিতকরবেন। সুতরাং ওইসব মানুষ যারা তাঁর প্রতি ঈমানআনে, তাঁকে সম্মান করে, তাঁকে সাহায্য করে এবং ওইনূরের অনুসরণ করে, যা তাঁর সাথে অবতীর্ণ হয়েছে, তারাই সফলকাম হয়েছে।” [সূরা আ’রাফ, ১৫৭ আয়াত; মুফতী আহমদ ইয়ার খান কৃত ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’ বাংলা সংস্করণ]


❏ আল্লাহ (ﷻ) ঘোষণা করেন: “আল্লাহর তরফ থেকে এএক দয়া ছিল যে আপনি, হে হাবীব (ﷺ), তাদের জন্যেকোমল–হৃদয় হয়েছেন। আর যদি আপনি রূঢ় ওকঠোর চিত্ত হতেন, তবে তারা নিশ্চয় আপনার আশপাশথেকে পেরেশান হয়ে যেতো। সুতরাং আপনি তাদেরকেক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্যে সুপারিশ করুন। আর(বিভিন্ন) কার্যাদিতে তাদের সাথে পরামর্শ করুন। এবংযখন কোনো কাজের ইচ্ছা পাকাপোক্ত করবেন, তখনআল্লাহর ওপর নির্ভর করুন। নিঃসন্দেহে (এরকম) নির্ভরকারীরা আল্লাহর প্রিয়ভাজন।” [সূরা আলে ইমরান, ১৫৯ আয়াত; ইমাম আহমদ রেযা খান কৃত ‘কানযুল ঈমান’ বাংলা সংস্করণ]


❏ ইমাম আবু লাইস আস্ সামারকান্দী (رحمة الله) বলেন, “আল্লাহ তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে তাঁর প্রিয়নবী (ﷺ) মো’মেন মুসলমানদের প্রতি ক্ষমাশীল, করুণাশীল ও কোমল। তিনি যদি ভাষণে কঠোর ও রূঢ় হতেন, তাহলে তারা তাঁকে ছেড়ে যেতো। তবে আল্লাহ তাঁকে বিশাল অন্তরের অধিকারী, দয়ালু, নম্র, হাসি-খুশি ও সহজ-সরল বানিয়েছেন।” আদ্ দাহহাক-ও অনুরূপ এক বর্ণনা দিয়েছেন।


❏ আল্লাহ (ﷻ) ইরশাদ ফরমান: “এবং কথা হলো এরকমই যে, আমি তোমাদেরকে সব উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠকরেছি যাতে তোমরা মানব জাতির জন্যে সাক্ষী হও।আর এ রাসূল (ﷺ) তোমাদের রক্ষক ও সাক্ষী হন” [সূরা বাকারা, ১৪৩ আয়াত; তাফসীরে কানযুল ঈমান]। 


❏ আবূল হাসান আল-কাবিসী বলেন, “এ আয়াতে করীমায় আল্লাহ (ﷻ) আমাদের মহানবী (ﷺ)-এর শ্রেষ্ঠত্ব ও তাঁর উম্মতের শ্রেষ্ঠত্ব পরিস্ফুট করেছেন।”


❏ আরেকটি আয়াতে করীমায় আল্লাহ (ﷻ) ঘোষণা করেন:“যাতে রাসূল (ﷺ) তোমাদের রক্ষক ও সাক্ষী হন এবংতোমরা অন্যান্য লোকদের ব্যাপারে সাক্ষ্য দাও” [সূরাহ্জ্জ্ব, ৭৮ আয়াত; কানযুল ঈমান]। 


❏ তিনি আরো ইরশাদ ফরমান: “তবে কেমন হবে যখন আমি প্রত্যেকউম্মত থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করবো, এবং হেহাবীব, আপনাকে তাদের সবার জন্যে সাক্ষী ওপর্যবেক্ষণকারী হিসেবে উপস্থিত করবো?” [সূরা নিসা, ৪১ আয়াত]


আল্লাহ (ﷻ) যখন একটি ‘মধ্যমপন্থী সমাজ’ সম্পর্কে বলেন, তখন তিনি বোঝান ভারসাম্যপূর্ণ ও ভালো। আয়াতটির অর্থ হলো, আমি (আল্লাহ) যেমন তোমাদেরকে হেদায়াত দিয়েছি, তেমনি আমি তোমাদের পছন্দ করে নিয়েছি এ মর্মে যে তোমাদেরকে একটি চমৎকার ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ বানিয়ে দিয়েছি এবং পয়গম্বরবৃন্দের পক্ষ হয়ে তাঁদের উম্মতদের ব্যাপারে সাক্ষ্য দিতে তোমাদেরকে অনুমতিও দিয়েছি। আর মহানবী (ﷺ)-ও সততার সাথে তোমাদের পক্ষে সাক্ষ্য দেবেন।


❏ এ কথা বলা হয়েছে, যখন আল্লাহ (ﷻ) পয়গম্বরবৃন্দকে জিজ্ঞেস করবেন – “আপনারা কি (ঐশী বাণী) পৌঁছেদিয়েছেন?” তখন তাঁরা উত্তর দেবেন – “হ্যাঁ, আমরাপৌঁছে দিয়েছি।” অতঃপর তাঁদের উম্মতবর্গ বলবে, “আমাদের কাছে কোনো সুসংবাদ দানকারী (নবী) ওসতর্ককারী আসেননি” [সূরা মায়েদা, ১৯ আয়াত]। 


এমতাবস্থায় উম্মতে মুহাম্মদী (পূর্ববর্তী) পয়গম্বরবৃন্দের পক্ষে সাক্ষ্য দেবেন এবং রাসূলে খোদা (ﷺ) তাঁর উম্মতের পক্ষে সাক্ষী হবেন (আল-বোখারী ও অন্যান্যদের বর্ণিত)। এ কথাও বলা হয়েছে যে, এই আয়াতে করীমার অর্থ হচ্ছে: (শেষ বিচারে) তোমরা (উম্মতে মুহাম্মদী) তোমাদের বিরোধিতাকারীদের বিরুদ্ধে এক (জোরালো) যুক্তি এবং মহানবী (ﷺ) হলেন তোমাদের পক্ষে এক (জোরালো) যুক্তি।


❏ আল্লাহ (ﷻ) ইরশাদ ফরমান: “ঈমানদার (মুসলমান)-দের সুসংবাদ দিন যে তাদের জন্যে তাদেরপ্রতিপালকের কাছে সত্যের মর্যাদা রয়েছে” [সূরা ইউনুস, ২ আয়াত]। 


❏ সর্ব-হযরত কাতাদা (رضي الله عنه), হাসান বসরী (رحمة الله) এবং যায়দ ইবনে আসলাম বলেন, “এই ‘সত্যের মর্যাদা’ হলেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যিনি তাদের জন্যে সুপারিশ করবেন।” 


❏ হাসান আল-বসরী (رحمة الله) আরো বলেন, “এটা তাদের প্রতি তাদেরই মহানবী (ﷺ)-এর মঞ্জুর হওয়াকে বোঝায়।” 


❏ আবূ সাঈদ আল-খুদরী (رضي الله عنه) বলেন, “এটা হলো রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শাফায়াত। আল্লাহ (ﷻ)'র দরবারে তিনি-ই হলেন তাদের পক্ষে নিশ্চিত সুপারিশকারী।” 


❏ সাহল্ আত্ তুসতরী (رحمة الله) বলেন, “এটা আল্লাহ (ﷻ) কর্তৃক রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মাঝে স্থাপিত পুর্বনির্ধারিত রহমত (করুণা)।”


মুহাম্মদ ইবনে আলী আত্ তিরমিযী (رحمة الله) বলেন, “তিনি-ই হলেন সত্যবাদীদের ও সত্যের ইমাম, গৃহীত সুপারিশকারী, সাড়াপ্রাপ্ত (খোদার) আহ্বানকারী হযরত মুহাম্মদ (ﷺ)।” এটা বর্ণনা করেছেন আস্ সুলামী।


পরিচ্ছেদ – ৩/ মহানবী (ﷺ)-এর প্রতি আল্লাহ (ﷻ)'রদয়া ও নম্র মনোভাব


এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে খোদায়ী কালাম – “আল্লাহআপনাকে ক্ষমা করুন; আপনি তাদেরকে কেন অনুমতিদিলেন, যতোক্ষণ পর্যন্ত আপনার কাছে স্পষ্ট হয়নিসত্যবাদীরা এবং প্রকাশ পায়নি মিথ্যেবাদীরাও” [সূরা তওবা, ৪৩ আয়াত]। আওন ইবনে আবদিল্লাহ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, “আল্লাহ (ﷻ) মহানবী (ﷺ)-কে তাঁর সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কিছু বলার আগেই তাঁকে ক্ষমা করার ঘোষণা দিয়েছেন।”


❏ ইমাম আবু লাইস আস্ সামারকান্দী (رحمة الله) বর্ণনা করেন এ মর্মে যে জনৈক আলেম এর অর্থ করেছেন, “হে হৃদ-স্পন্দনের ধ্বনি, আল্লাহ আপনাকে রক্ষা করেছেন। তাহলে আপনি কেন তাদেরকে অনুমতি দিলেন?” যদি প্রথমেই এ কথা বলা হতো – “আপনি কেন তাদেরকে অনুমতি দিলেন?” – তাহলে রাসূলে পাক (ﷺ)-এর চিত্ত ভয়ে দুরু দুরু করতো। কিন্তু আল্লাহ পাক প্রথমেই ক্ষমা করার কথা বলে তাঁর অন্তরকে শান্ত রেখেছেন এবং তারপর জিজ্ঞেস করেছেন – “আপনার কাছে কে সত্যবাদী এবং কে মিথ্যেবাদী তা স্পষ্ট হবার আগে কেন আপনি তাদেরকে অনুমতি দিলেন?”


এতে আল্লাহর সাথে মহানবী (ﷺ)-এর উচ্চ মকাম পরিস্ফুট হয়, যা ন্যূনতম বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাছেও গোপন থাকতে পারে না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে পাক পরওয়াদেগারে আলম কী পরিমাণ সম্মান করেন এবং তাঁর প্রতি কী রকম দয়াবান তা এতে পরিস্ফুট হয়, যা সম্পূর্ণ জ্ঞাত হলে অন্তর বিগলিত হতো (সবার)।


❏ নিফতাওয়াইহ্ (رحمة الله) বলেন, “কিছু লোক মনে করে হুযূর পূর নূর (ﷺ)-কে এ আয়াতে তিরস্কার করা হয়েছে। বিষয়টি তা থেকে যোজন যোজন দূরে! বস্তুতঃ তাঁকে এর দরুন পছন্দ করা হয়েছে। যখন তিনি তাদেরকে অনুমতি দিলেন, তখন আল্লাহ জ্ঞাত করলেন যে তিনি (রাসূল) যদি তাদেরকে অনুমতি না দিতেন, তাহলে তারা এমনিতেই তাদের মোনাফেকীর মধ্যে বসে থাকতো; অতএব, তাঁর অনুমতি দেয়ার প্রতি কোনো আপত্তি উত্থাপন-ই  করা যায় না।”


যে মুসলমান-ব্যক্তি নিজের নফসের সাথে সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছেন এবং নিজ আচার-আচরণ ও স্বভাব-চরিত্রে শরীয়তকে আঁকড়ে ধরেছেন, তিনি তাঁর কথাবার্তায়, কাজ-কর্মে, উদ্দেশ্য সাধনে ও আলাপচারিতায় কুরআন মজীদের আদব-কায়দা (শিষ্টাচার)-কে ধারণ করতে বাধ্য। এটাই দ্বীন ও দুনিয়ায় প্রকৃত জ্ঞান ও সঠিক আচরণের মূলভিত্তি। সকল মনিবের মহাপ্রভু, যিনি সবাইকে আশীর্বাদ দেন, যাঁর কিছুরই প্রয়োজন নেই, তাঁর কাছে চাওয়া-পাওয়ার বেলায় এই অনন্য সাধারণ নম্রতা ও দয়াকে অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। আয়াতে ধারণকৃত ফায়দাগুলোকে অন্তরে গ্রহণ করে নিতে হবে এ বাস্তবতার আলোকে যে, আল্লাহ (ﷻ) জিজ্ঞেস করার আগে সম্মান প্রদর্শন করেছেন এবং ক্ষমা করতে আনন্দ অনুভব করেছেন। অতঃপর তিনি জিজ্ঞেস করেছেন, যদিও এর মধ্যে ত্রুটিজনিত জবাবদিহিতার কিছু আছে কি না সন্দেহ।


❏ আল্লাহ (ﷻ) ইরশাদ ফরমান: “যদি আমি আপনাকেঅবিচলিত না রাখতাম, তবে এ কথা নিশ্চিত ছিল যেআপনি তাদের প্রতি সামান্য কিছু ঝুঁকে পড়তেন” [সূরা বনী ইসরাঈল, ৭৪ আয়াত; তাফসীরে কানযুল ঈমান]। জনৈক মোতাকাল্লেমূন (কালাম-শাস্ত্র) পণ্ডিত বলেন, “অন্যান্য নবী (عليه السلام)-বৃন্দের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে আল্লাহ (ﷻ) (গঠনমূলক) দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু তিনি আমাদের প্রিয়নবী (ﷺ)-এর কোনো কর্মের আগেই (গঠনমূলক) দিকনির্দেশনা দিয়েছেন যাতে তা ভালোবাসার কার্যকর ও সর্বোত্তম নিদর্শন হয়। এতে তাঁর ভালাইয়ের প্রতি খোদাতা’লার সর্বান্তকরণের আভাস পাওয়া যায়।


লক্ষ্য করুন কীভাবে আল্লাহ (ﷻ) মহানবী (ﷺ)-এর অবিচলিত ভাব সম্পর্কে উল্লেখ করে তারপর দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি এ ব্যাপারে সজাগ যে মহানবী (ﷺ) হয়তো এ বক্তব্যে ভীত হতে পারেন। তাই তাঁর এ বক্তব্যে তিনি মহানবী (ﷺ)-এর নিষ্কলুষ মর্যাদা বজায় রেখেছেন। এ বক্তব্য কোনোক্রমেই তাঁর (খোদাপ্রদত্ত) মর্যাদা ও নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করে না।


একই কথা প্রযোজ্য আরেকটি আয়াতে করীমার ক্ষেত্রে, 


❏ যা’তে আল্লাহ পাক ইরশাদ ফরমান: “আমি জানি, আপনাকে (রাসূলকে) কষ্ট দিচ্ছে ওই কথা যা তারাবলছে। অতঃপর তারা তো আপনাকে অস্বীকার করছেনা; বরং যালেমরাই আল্লাহর আয়াতগুলোর অস্বীকারকরছে।” [সূরা আনআম, ৩৩ আয়াত]


❏ হযরত আলী (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে, আবূ জাহেল হযরত রাসূলে করীম (ﷺ)-কে বলেছিল, “আমরা তোমাকে মিথ্যেবাদী আখ্যা দেই না। আমরা বলি, তুমি যা নিয়ে এসেছো, তা একটা ডাহা মিথ্যে।” এ পরিপ্রেক্ষিতে আয়াতে করীমাটি আল্লাহ (ﷻ) নাযিল করেন।


❏ এ কথাও বর্ণিত হয়েছে যে, মহানবী (ﷺ) অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছিলেন যখন তাঁর জাতি (মক্কার কুফফার) তাঁর প্রতি মিথ্যের অপবাদ দিয়েছিল। এমতাবস্থায় জিবরীল (عليه السلام) তাঁর কাছে এসে বলেন, “আপনি কেন এতো পেরেশান?” তিনি জবাব দেন, “আমার জাতি আমাকে মিথ্যেবাদী আখ্যা দিয়েছে।” জিবরীল (عليه السلام) বলেন, “তারা ভালো করেই জানে আপনি সত্য কথা বলেছেন।” অতঃপর আল্লাহ এ আয়াতখানা নাযিল করেন।


হুযূর পূর নূর (ﷺ)-কে নরম সুরে সান্ত্বনা দেয়া এবং তাঁর সাথে স্নেহভরে কথা বলাই হচ্ছে আয়াতটির লক্ষ্য, যা তাঁর জাতির মাঝে বিবেচিত তাঁরই সত্যবাদী ব্যক্তিত্বকে ও তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে তাদের অস্বীকার না করার কথাকে সমর্থন দেয়। তারা স্বীকার করে যে তিনি কথা ও বিশ্বাসে সত্যবাদী। তিনি নবী হওয়ার আগে তারা তাঁকে ‘আল-আমিন’ (বিশ্বাসভাজন) বলে ডাকতো। তাঁকে ‘মিথ্যেবাদী’ বলে ডাকাতে তাঁর অনুভূত দুঃখকষ্ট (আয়াতোক্ত) এই সমর্থন দ্বারা দূর হয়েছিল।


অতঃপর আল্লাহ (ﷻ) তাঁর প্রিয়নবী (ﷺ)-এর জাতিকে সমালোচনা করেছেন এই বলে যে, তারা অস্বীকারকারী ও মন্দ-কর্ম সংঘটনকারী। তিনি ইরশাদ ফরমান: “বরংযালেমরাই আল্লাহর আয়াত (নিদর্শন)-গুলো অস্বীকারকরছে।”


আল্লাহ (ﷻ) তাঁর প্রিয়নবী (ﷺ)-এর ওপর থেকে সমস্ত অসম্মানের মিথ্যে অপবাদ অপসারণ করেছেন এবং এর পরে তাঁর নিদর্শনগুলোকে অস্বীকার করার দোষে রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর জাতিকে একগুঁয়ে বলে চিহ্নিত করেছেন। অস্বীকৃতি সে ব্যক্তির কাছ থেকেই আসতে পারে, যে কিছুটুকু জানে এবং তারপর অস্বীকার করে। যেমনঃ 


❏ আল্লাহ বলেন: “এবং সেগুলোকে অস্বীকার করলো, অথচতাদের অন্তরগুলোতে সেগুলোর (সত্যতার) নিশ্চিতবিশ্বাস ছিল, যুলুম ও অহঙ্কারবশতঃ (তারা তা অস্বীকারকরলো)” [সূরা নামল, ১৪ আয়াত]


অতঃপর আল্লাহ পাক তাঁর হাবীব (ﷺ)-কে সান্ত্বনা দিয়েছেন এবং তাঁকে খুশি করেছেন তাঁর পূর্ববর্তীদের কথা বলে, আর তিনি আপন সাহায্যের আশ্বাসও দিয়েছেন এ কথা ঘোষণা করে – 


❏ “এবং আপনার আগেও বহুরাসূলকে অস্বীকার করা হয়েছে। তখন তাঁরা ধৈর্য ধারণকরেছিলেন এ অস্বীকার ও দুঃখকষ্টের ব্যাপারে, যেপর্যন্ত না তাঁদের কাছে আমার সাহায্য এসেছে” [সূরা আনআম, ৩৪ আয়াত; প্রাগুক্ত কানযুল ঈমান]


রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর প্রতি আল্লাহর দয়া ও মহানবী (ﷺ)-এর বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কে উল্লেখিত বিষয়গুলোর মধ্যে একটি এই যে, 

আল্লাহ (ﷻ) সকল পয়গম্বরকে তাঁদের নাম ধরে সম্বোধন করেছেন; যেমন – 

‘হে আদম’ [২:২৩], 

‘হে নূহ’ [১১:৪৮], 

’হে ইবরাহীম’[৩৭:১০৪-৫], 

‘হে মূসা’ [২০:১৪], 

‘হে দাউদ’ [৩৮:২৬], 

‘হে ঈসা’ [৩:৫৫], 

‘হে যাকারিয়্যা’ [১৯:৭], 

‘হেইয়াহইয়া’ [১৯:১২]। 

কিন্তু তিনি মহানবী (ﷺ)-কে সম্বোধন করেছেন – 

‘হে রাসূল’ [৫:৬৭], 

‘হে নবী’[৩৩:৪৫], 

‘হে বস্ত্রাবৃত’ [৭৩:০১], 

‘হে চাদর আবৃত’[৭৪:০১]।

________________

কিতাবঃ আশ শিফা [অসম্পূর্ণ]

মূল: ইমাম কাজী আয়াজ (رحمة الله)

অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন


সূত্রঃ 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন