মহানবী (ﷺ)-এর মেধা, বুদ্ধিমত্তা, ইন্দ্রিয়শক্তির তীক্ষ্ণতা, বাগ্মিতা, চাল-চলনে পরিমার্জিত আচরণ ও সহজাত (মানসিক) গুণাবলীর শ্রেষ্ঠত্বের দিক দিয়ে তিনি নিঃসন্দেহে সকল মানুষের মাঝে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ এক সত্তা।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মানুষের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ বিষয়াদি এবং সর্বসাধারণের ও (সমাজের) গণ্যমান্য ব্যক্তিদের রাজনীতি যেভাবে সামাল দিতেন সে সম্পর্কে এবং তাঁর বিস্ময়কর গুণাবলী ও বিস্ময়ে ভরা (যাহেরী) জীবন সম্পর্কে, আর তাঁর কাছ থেকে বিচ্ছুরিত জ্ঞানের জ্যোতি ও পূর্ব-নির্দেশনা, পূর্ব-অভিজ্ঞতা, বা বইপত্র পাঠ ব্যতিরেকেই তাঁর দ্বারা শরীয়তের বিধান জারি করার উল্লেখযোগ্য দিকগুলো সম্পর্কে কেউ গভীরভাবে চিন্তা করলে তার মনে মহানবী (ﷺ)-এর মেধার শ্রেষ্ঠত্ব এবং উপলব্ধির গভীরতা ও দৃঢ়তা সম্পর্কে কোনো সন্দেহ-ই থাকবে না। এগুলোর কোনোটিরই সমর্থনসূচক প্রামাণ্য দলিলের দরকার নেই, কেননা এ সম্পর্কে ইতোমধ্যেই পর্যাপ্তভাবে যাচাই করা হয়েছে।
❏ ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বিহ্ (رضي الله عنه) বলেন, “আমি একাত্তরটি বই পড়েছি, আর সেগুলোর সবের মাঝে আমি দেখতে পেয়েছি যে মহানবী (ﷺ)-এরই সর্বশ্রেষ্ঠ ধীশক্তি ও সেরা মতামত (দৃষ্টিভঙ্গি) বিদ্যমান।”
❏ অন্য এক বর্ণনায় ভাষ্যটি নিম্নরূপ: “আমি এসব পুস্তকে দেখেছি যে আল্লাহ (ﷻ) দুনিয়ার সূচনালগ্ন হতে শেষ অবধি মানবজাতিকে যে মেধা/ধীশক্তি দান করেছেন, তা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মেধার তুলনায় এক শস্যদানার মতোই।”
❏ মুজাহিদ (رضي الله عنه) বলেন, “হুযূর পাক (ﷺ) যখন নামাযে (ইমামতি করতে) দাঁড়াতেন, তখন তিনি পেছনে দাঁড়ানো সবাইকেই (স্পষ্ট) দেখতে পেতেন, ঠিক যেমনটি তিনি সামনে দেখতে পেতেন” [ইবনে মুনযির ও আল-বায়হাকী বর্ণিত (মুরসাল)]।
এটা আল্লাহ (ﷻ)'র কালামের ওপর কৃত একটি তাফসীরকে সমর্থন দেয়, যা’তে ঘোষিত হয়েছে:
❏ “যিনি (আল্লাহ) দেখেন নামাযীদের মধ্যে আপনার পরিদর্শনার্থে ভ্রমণকেও।” (আল-কুরঅান, সূরা শুয়ারা, ২১৯ আয়াত)।
❏ ’মুওয়াত্তা’ হাদীসগ্রন্থে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা উদ্ধৃত হয়েছে, যিনি বলেন: “পেছনেও আমি তোমাদেরকে দেখতে পাই।”
❏ বুখারী ও মুসলিম দুটো সহীহ হাদীসগ্রন্থেও অনুরূপ বক্তব্য হযরত আনাস (رضي الله عنه)-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) একই বর্ণনা উদ্ধৃত করার পর নিজ হতে আরো যোগ করেন, “এটা অতিরিক্ত এমন কিছু যা আল্লাহ (ﷻ) তাঁকে সমর্থনসূচক প্রমাণ হিসেবে দান করেছিলেন।”
❏ অপর এক হাদীসে এসেছে এভাবে, “আমি পেছনদিকে ঠিক সেভাবেই দেখতে পাই, যেভাবে সামনে দেখে থাকি।”
❏ আরেকটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, “আমার ঘাড়ের পেছনে অবস্থানরত ব্যক্তিকে ঠিক সেভাবেই দেখতে পাই, যেভাবে সামনে অবস্থানরত জনকে দেখতে পাই।”
❏ বাক্কী ইবনে মুখাল্লাদ (رضي الله عنه) হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন, যিনি বলেন: “মহানবী (ﷺ) অন্ধকারেও তেমনটি দেখতে পেতেন, যেমনটি তিনি দেখতে সক্ষম ছিলেন আলোতে।” [ইবনে আদ ও আল-বায়হাকী কর্তৃক দুর্বল সনদে বর্ণিত]
❏ অনেক সহীহ হাদীসে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কর্তৃক ফেরেশতাবৃন্দকে দেখার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে [আল-বোখারী ও অন্যান্যদের ভাষ্য নিম্নরূপ: “মহানবী (ﷺ) আসমান ও জমিনের মাঝখানে ছয়’শ ডানাসহ হযরত জিবরাঈল আমীন (عليه السلام)-কে একটি সিংহাসনের ওপর উপবিষ্ট দেখতে পেয়েছিলেন, আর তিনি (জিবরাঈল) দিগন্তকে আড়াল করে রেখেছিলেন”।
তিনি শয়তানদেরকেও দেখেছিলেন বলে রেওয়ায়াত করা হয়েছে [আল-বোখারী] বর্ণিত হাদীস:
❏ “এক ইফরিত (বদমাইশ দেও-দানব) গত সন্ধ্যার মাগরেব নামাযের সময় আমার কাছে একটি (কাঠনির্মিত) আগুনের মশাল নিয়ে এসেছিল আমারই মুখ পোড়াবার (অসৎ) উদ্দেশ্যে। আল্লাহ (ﷻ) আমাকে তার ওপর ক্ষমতাবান করে দেন”]।
❏ আবিসিনীয় বাদশাহ নাজ্জাশীর জন্যে যাতে তিনি দোয়া করতে পারেন সেজন্যে ওই বাদশাহকে (আবিসিনিয়ায়) দেখার সামর্থ্য (দিব্যদৃষ্টি) তিনি লাভ করেন।
❏ মুসলিম ও আল-বোখারী বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ ফরমান: “তোমাদের ভাই নাজ্জাশী বেসালপ্রাপ্ত হয়েছেন; অতএব, ওঠো এবং তাঁর জন্যে প্রার্থনা করো”]। একইভাবে তিনি (মে’রাজ রাতের ভ্রমণে) জেরুসালেম নগরী দেখতে পেয়েছিলেন এবং তা কুরাইশদের কাছে বর্ণনাও করেছিলেন [মুসলিম ও আল-বোখারী]।
মদীনা মোনাওয়ারায় মসজিদ (-এ-নববী) নির্মাণ করার সময় তিনি মক্কায় অবস্থিত কা’বা শরীফ-ও দেখতে পেয়েছিলেন।
❏ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله) ও অন্যান্য জ্ঞান বিশারদ বর্ণনা করেন যে, মহানবী (ﷺ) ’আল-তুরাইয়া’ নামের তারকাগুচ্ছের এগারোটি তারকা (খালি চোখে) দেখতে সক্ষম ছিলেন। এটা ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله) ও অন্যান্যদের মতে খালি চোখে দেখা সম্ভব সর্বোচ্চ সংখ্যক তারকা।
❏ এঁদের মধ্যে একজন (ইমাম নববী) বিশ্বাস করেন যে, এটা হুযূর পাক (ﷺ)-এর এতদসংক্রান্ত জ্ঞান (ওয়াকেফহাল অবস্থা) সম্পর্কে ইঙ্গিত করে। তবে এর স্পষ্ট অর্থ ওই মতের সাথে সাংঘর্ষিক, আর মহানবী (ﷺ)-এর এটা করতে না পারার কোনো অসম্ভাব্যতা-ই নেই। কেননা, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিশক্তি আম্বিয়া তথা পয়গম্বর (عليه السلام)-বৃন্দের একটি বিশেষ গুণ এবং তা তাঁদের অনন্য বৈশিষ্ট্যেরই অন্তর্ভুক্ত।
❏ হযরত আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) উদ্ধৃত করেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীস, যিনি বলেন: “সর্বশক্তিমান আল্লাহ (ﷻ) যখন হযরত মূসা (عليه السلام)-এর কাছে নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন, তখন তিনি রাতের অন্ধকারে (প্রায়) ত্রিশ মাইল দূরে পাথরের ওপরে অবস্থিত কোনো পিঁপড়াকেও দেখতে সক্ষম ছিলেন” [ইমাম তাবারানী কৃত ‘আস্ সাগীর’]।
অতএব, নবী করীম (ﷺ)-এর মে’রাজে গমন ও তাঁর রব্বের অন্যতম সেরা নিদর্শন দেখার আশীর্বাদ লাভের পর আমরা এ অধ্যায়ে যা বর্ণনা করেছি, তা তাঁর দ্বারা করা অসম্ভব কোনো ব্যাপারই নয়।
বিভিন্ন হাদীসে জানা যায় যে তিনি তাঁর সময়কার সবচেয়ে বেশি শারীরিক শক্তির অধিকারী আবূ রুকানা নামের ব্যক্তিকে (কুস্তি লড়াইয়ে) আছাড় দিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন এবং তার প্রতি ইসলামের দাওয়াত-ও পৌঁছে দিয়েছিলেন। জাহেলীয়্যা যুগের অতি শক্তিধর হিসেবে খ্যাত এই কুস্তিগীরকে তিনি এভাবে তিনবার পরাস্ত করেন।
❏ হযরত আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মতো আর কাউকেই এতো দ্রুত হাঁটতে দেখিনি। এ যেন দুনিয়া তাঁর জন্যে বিছানো থাকতো। আমরা হয়রান হলেও তিনি একদম ক্লান্ত হতেন না।” [তিরমিযী ও বায়হাকী]
মহানবী (ﷺ)-এর আরেকটি গুণ ছিল তিনি স্মিতহাস্য করতেন। কারো মুখোমুখি দাঁড়ানোর সময় সরাসরি মুখ করে দাঁড়াতেন। আর হাঁটতে থাকলে মনে হতো যেন তিনি কোনো ঢাল হতে নেমে আসছেন।
________________
কিতাবঃ আশ শিফা [অসম্পূর্ণ]
মূল: ইমাম কাজী আয়াজ (رحمة الله)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
সূত্রঃ 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন