আল খুৎবাতুল ইয়াকুবিয়ার বাতিল আক্বিদা

 

আল খুৎবাতুল ইয়াকুবিয়ার বাতিল আক্বিদা

 ফুলতলী সাহেবের লিখিত ‘আল খুতবাতুল ইয়াকুবিয়া’ কিতাব ১৯৯৮ইং ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম প্রকাশিত হয়। (প্রকাশক মোহাম্মদ হুছামুদ্দিন চৌধুরী, পরওয়ানা পাবলিকেন্স, ১৭৩ ফকিরাপুল, চতুর্থ তলা- ঢাকা-১০০০) উক্ত খুতবাতুল ইয়াকুবিয়ার ১৭ পৃষ্ঠা মহররমের ২য় খুতবায় আশুরার ফজিলত বর্ণনা প্রসঙ্গে লেখা রয়েছে-


 وفيه غفر لداؤد


 এইদিনে হযরত দাউদ আলাইহিস সালামকে ক্ষমা করেছেন।


 وفيه غفر لنبينا محمد صلى الله عليه وسلم وعليهم اجمعين


 এইদিনে আমাদের শিরতাজ নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সকলকে পরিপূর্ণরূপে ক্ষমা করেছেন।

 এ খুতবায় উল্লেখিত বক্তব্যে সুন্নি আক্বিদাবিরোধী ২টি আপত্তিকর উক্তি রয়েছে- যা সাধারণ মুসল্লিয়ানদের ঈমান আক্বিদা বিনষ্ট হওয়ার আশংকা রয়েছে।

 ১. এতে বলা হয়েছে- ‘এইদিনে হযরত দাউদ আলাইহিস সালামকে ক্ষমা করেছেন।’ 

 প্রশ্ন জাগে কী ক্ষমা করেছেন। গোনাহে কবীরা নাকি গোনাহে সগীরা। হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম কি সত্যিকার কোন গোনাহ করেছিলেন? এ ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের কী অভিমত?

 ২. খুতবায় তাও উল্লেখ রয়েছে- ‘এইদিনে (আশুরার দিনে) আমাদের শিরতাজ নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সকলকে পরিপূর্ণরূপে ক্ষমা করেছেন।

 এতে প্রশ্ন জাগে আমরাতো গোনাহগার, আমাদের গোনাহ মাফ করানোর জন্য আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাফায়াতের প্রয়োজন রয়েছে, যেহেতু তিনি শাফিউল মুজনেবীন।

 উপরোক্ত বক্তব্যে প্রমাণিত হচ্ছে, আমাদেরকে যেমনি মাফ করা হয়েছে, তেমনি আল্লাহর হাবীবকেও মাফ করা হয়েছে। ক্ষমার দিক দিয়ে নবী ও উম্মতের মধ্যে কোন প্রকার পার্থক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

 আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদা আমাদের নবী মা’সুম বা নিষ্পাপ, অর্থাৎ আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর হাবীবকে গোনাহ সংঘটিত হওয়া থেকে পূর্ণ হেফাজত রেখেছেন। ফলে আল্লাহর হাবীবের কোন গোনাহ সংঘটিত হয় নাই।

 এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা কোরআনে পাকে নিজেই এরশাদ করেছেন-

 ليغفرلك الله ماتقدم من ذنبك 

 এ আয়াতে কারীমার তাফসিরে আল্লামা ফখরুদ্দিন রাজী রাদিয়াল্লাহু আনহু তদীয় ‘তাফসিরে কবীর’ নামক কিতাবের ১৩তম খণ্ড ২৬ পাড়া ১৯৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন-

 انا معناه ان الله تعالى يغفرلك ولاجلك ماتقدم من ذنب امتك

 ‘উপরোক্ত আয়াতে কারীমার ভাবার্থ হল- নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা আপনার কারণে আপনার পূর্ববর্তী উম্মতের গোনাহ মাফ করে দিয়েছেন।

 এতে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোন গোনাহ নেই বরং আল্লাহর হাবীবের উসিলায় আল্লাহপাক তাঁর উম্মতের গোনাহ মাফ করে দিয়েছেন। কিন্তু খুৎবার ভাষ্যে প্রতীয়মান হয়- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মাফ করা হয়েছে এবং উম্মতগণকেও মাফ করা হয়েছে।

 এখানে নবী ও তাঁর উম্মতগণ সকলকে একাকার করে ব্যক্ত করা হয়েছে। এতে আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহান মর্যাদাকে ক্ষুণœ করা হয়েছে। যা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদার সম্পূর্ণ পরিপন্থি।

 আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদা হচ্ছে-الانبياء معصومون (আল আমবিয়াউ মা’সুমুন) নবীগণ নিষ্পাপ। নবীগণকে আল্লাহ গোনাহ সংঘটিত হওয়া থেকে মুক্ত বা পূর্ণ হেফাজত রেখেছেন। 

 জনাব ফুলতলীর পীর সাহেব তদীয় ‘আল খুৎবাতুল ইয়াকুবিয়ায় উপরোক্ত মওজু বা জাল ও বানোয়াট হাদিস পেশ করে আল্লাহর নবীর গোনাহ আশুরার দিনে আল্লাহপাক ক্ষমা করেছেন উক্তি দ্বারা আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহান মর্যাদাকে ক্ষুণœ করা হয়েছে। যা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদার সম্পূর্ণ পরিপন্থি। 

 ক) আল্লামা ইবনে জাওযী রাদিয়াল্লাহু আনহু কিতাবুল মাওজুয়াত গ্রন্থের ২য় জিলদের ১৯৯ পৃষ্ঠা থেকে ২০১ পৃষ্ঠাব্যাপী অপর একখানা দীর্ঘ মাওজু হাদিস বর্ণনা করেন। এতে রয়েছে-

 وهو اليوم الذى غفر الله لمحمد ذنبه ماتقدم وماتاخر

 অর্থাৎ আশুরার দিনে আল্লাহপাক হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী গোনাহ ক্ষমা করেছেন। উক্ত মাওজু হাদিসটি বর্ণনা করে আল্লামা ইবনে জাওযী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন-

 هذا حديث لايشك عاقل فى وضعه

 অর্থাৎ এই হাদিসটি মাওজু বা মিথ্যা হওয়ার ব্যাপারে কোন বিবেকবান ব্যক্তি সন্দেহপোষণ করতে পারে না। খ) উপমহাদেশের বিখ্যাত হাদিস বিশারদ আল্লামা শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী রাদিয়াল্লাহু আনহু ও উপরে বর্ণিত মিথ্যা হাদিসটি তদীয় ‘মাসাবাতা মিনাস সুন্নাহ’ নামক কিতাবে আশুরার দিনের আলোচনায় উল্লেখ করেছেন- যার মধ্যে রয়েছে-

 وهو اليوم الذى غفر الله فيه لمحمد ذنبه ماتقدم وماتاخر

 অর্থাৎ আশুরার দিনে আল্লাহপাক হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী গোনাহ ক্ষমা করেছেন। অতঃপর তিনি বলেন-

 كلهم ذكره ابن الجوزى فى الموضوعات وقال رجاله ثقات فاالظاهر ان بعض المتاخرين وضعه وركبه على هذا الاسناد انتهى

 অর্থাৎ আল্লামা শেখ মোহাম্মদ আব্দুল হক মোহাদ্দিসে দেহলভী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন এ সকল হাদিসকে আল্লামা ইবনে জাওযী রাদিয়াল্লাহু আনহু মাওজুয়াত বা জাল হাদিসের মধ্যে গণ্য করেছেন এবং বলেছেন পরবর্তীকালে কিছুসংখ্যক লোক সেকাহ রাবীগণের নাম এর সনদের মধ্যে সংযুক্ত করে তাদের হীন উদ্দেশ্য হাসিল করেছে। (নাউজুবিল্লাহ)

 উপরোল্লেখিত আলোচনার দ্বারা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গেল যে, আলোচ্য হাদিসটি মিথ্যা বা জাল হাদিস। সুতরাং এই মিথ্যা হাদিসকে কেন্দ্র করে আল্লাহর হাবীব হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গোনাহ ছিল এবং আশুরার দিনে ক্ষমা করা হয়েছে এই বক্তব্য দেওয়া সম্পূর্ণ অযুক্তিক ও গোমরাহী।

 উল্লেখ্য যে, প্রখ্যাত উসূলবিদ আল্লামা মোল্লা জিউন রাদিয়াল্লাহু আনহু তাফসিরাতে আহমদীয়া নামক কিতাবের ২৭ পৃষ্ঠায় لا ينال عهد الظالمين আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন-

 واذا تقرر هذا فما نقل عن الانبياء مما يشعر بكذب او معصية فما كان منقولا بطريق الاحد فمردود. وما كان منقولا بطريق التواتر فمصروف عن ظاهره ان امكن والا محمول على ترك الاولى او كونه قبل البعثة. 

 অর্থাৎ যখন কোন রেওয়ায়েত দ্বারা নবীগণের গোনাহ সাব্যস্ত হয়। তখন দেখতে হবে সেই রেওয়ায়েতটি আহাদসূত্রে বর্ণিত না তাওয়াতুর সূত্রে বর্ণিত। যদি আহাদসূত্রে বর্ণিত হয়ে থাকে তাহলে উহা পরিত্যজ্য হবে।

 আর যদি তাওয়াতুরসূত্রে বর্ণিত হয়ে থাকে তাহলে যথা সম্ভব নবীগণের মর্যাদানুযায়ী জাহেরী অর্থ পরিবর্তন করতে হবে। অন্যথায় তরকে আউলা বা উত্তমতার ব্যতিক্রম ধরে নিতে হবে, যা পাপ বা গোনাহ নয় অথবা তা নবুয়ত প্রকাশ হওয়ার পূর্বের বিষয় হিসেবে প্রযোজ্য হবে।

 প্রকাশ থাকে যে, قبل البعثة বা নবুয়ত প্রকাশ হওয়ার পূর্বের বিষয় কথা দ্বারা ঐ দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন ওহী বা শরিয়তের আদেশ নিষেধ কোন কিছু জারি হয়নি। সুতরাং ঐ সময়ের কোন কিছুই পাপ নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ইসলামের প্রাথমিক যুগে সাহাবায়েকেরাম মদ পান করেছেন কিন্তু তাঁদের কোন গোনাহ হয়নি। কারণ তখনও মদ পান করা নিষেধ সম্বলিত আয়াত নাজিল হয়নি।

 অতঃপর আল্লামা মোল্লা জিউন রাদিয়াল্লাহু আনহু উক্ত তাফসিরাতে আহমদীয়ার ২৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-

 فالحق انه لاخلاف لاحد فى ان نبينا عليه السلام لم يرتكب صغيرة ولا كبيرة طرقة عين قبل الوحى وبعده كما ذكره ابو حنيفة فى الفقه الاكبر. 

 অর্থাৎ এ কথাই সত্য যে, নিশ্চয়ই আমাদের প্রিয়নবী ওহী প্রাপ্তির পূর্বে ও পরে এক মুহূর্তের জন্যেও কবিরা সগিরা কোন প্রকার গোনাহ করেননি। এতে কারো দ্বিমত নেই। যেমন ইমাম আবু হানিফা রাদিয়াল্লাহু আনহু ফেকহে আকবর কিতাবে উল্লেখ করেছেন।

 আল্লামা শেখ আব্দুল হক মোহাদ্দিসে দেহলভী রাদিয়াল্লাহু আনহু তদীয় মাদারিজুন নবুয়ত নামক কিতাবের ১ম খণ্ড ১০৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন-


 خصوصا سید انبیاء وافضل رسل صلوۃ وسلامہ علیہ وعلیہم کہ عصمت اواتم واکمل ورتبہ اواعلی وارفع است وہرکہ بجناب وی چیزی بہ بندد وپسندد وبخلاف ادب دم زند ساقط است ذرہموۃ درک اسفل ضلالت ازانجاکہ خبر نداردووی از اول پاک واراستہ وپراستہ آمدہ است کہ دست ہیچ عیب ونقص رابدامان عزت وجلال او مجال وصول نیست بیت بہ تعلیم وادب او راچہ حاجت

 کہ او خود زآغاز آمد مؤدب


 অর্থাৎ ‘বিশেষত আমাদের প্রিয়নবী সায়্যিদুল আম্বিয়া সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বেলায় ইসমত বা গোনাহ থেকে পাক থাকা সর্বাধিক পরিপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ এবং তার মর্যাদার অধিকতর উন্নত।

 যে ব্যক্তি আল্লাহর হাবিবের শানে আদবের পরিপন্থি নিজের মনগড়া মতে কোন মন্তব্য করবে নিঃসন্দেহে সে পরিত্যজ্য হবে, নিশ্চয়ই সে মূর্খতার নিম্নতম অন্ধকারের গভীরতম গহব্বরে নিমজ্জিত রয়েছে।

 হুজুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র সত্ত্বা প্রথম থেকেই এমন পবিত্র এবং সুসজ্জিত ছিল যে, কোন রকম দোষক্রটির হস্ত তাঁর ইজ্জত ও বুজুর্গির আঁচল স্পর্শ করতে পারেনি। যেমন কবি বলেছেন ‘তা’লিম ও আদব গ্রহণ করার তো তাঁর কোন প্রয়োজন নেই। কেননা তিনি সক্রিয় আদবশীল হয়ে আবির্ভূত হয়েছেন।’ 

_______________

ইজহারে হক্ব

লেখক : অধ্যক্ষ শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী (মা:জি:আ:)

 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]



1 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন