হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম গোনাহ থেকে মুক্ত

 

হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম গোনাহ থেকে মুক্ত

 জনাব ফুলতলী সাহেবের লিখিত ‘আল খুৎবাতুল ইয়াকুবিয়া’ দ্বিতীয় সংস্করণ ২০০৪ ইংরেজি সনের মার্চ মাসে প্রকাশিত হয়। উক্ত কিতাবের ১৭ পৃষ্ঠা মহররম মাসের দ্বিতীয় খুৎবায় আশুরার ফজিলত সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে- وفيه غفر لداؤد এই দিনে হযরত দাউদ আলাইহিস সালামকে ক্ষমা করেছেন। 

 উক্ত খুৎবার বয়ানের দ্বারা হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম গোনাহগার সাব্যস্ত হয়ে যান। কারণ এতে প্রশ্ন জাগে-

 ক) কী ক্ষমা করেছেন। গোনাহে কবিরা না গোনাহে সগিরা, প্রথম দুই অবস্থাই মানছাবে নবুয়ত বা নবুয়তের মর্যাদার পরিপন্থি।

 খ) খুতবায় কোন কিছু আলোচনা করতে হলে কোরআন সুন্নাহর আলোকে বলতে হবে।

 আশুরার দিনে হযরত দাউদ আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করেছেন। এ বক্তব্যের স্বপক্ষে কোন আয়াতে কারীমা বা কোন সহীহ হাদীস শরীফ কি রয়েছে? কষ্মিনকালেও নেই। হ্যাঁ এ ব্যাপারে একখানা মাওজু বা জাল ও বানোয়াট হাদিস পাওয়া যায়। যা মুহাদ্দিসিনে কেরামগণ প্রত্যাখান করেছেন।

 আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদা হচ্ছে- الانبياء معصومون (আল আম্বিয়াউ মা’সুমুন) নবীগণ নিষ্পাপ। নবীগণকে আল্লাহ গোনাহ সংঘটিত হওয়া থেকে মুক্ত বা পূর্ণ হেফাজতে রেখেছেন।

 একটি মাওজু বা বানোয়াট জাল হাদিসের উপর ভিত্তি করে হযরত দাউদ আলাইহিস সালামকে আশুরার দিনে আল্লাহতায়ালা ক্ষমা করেছেন, এরূপ অমূলক বক্তব্য খুতবায় লিখে প্রকাশ করলে মুসল্লিয়ানগণের কাছে হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের প্রতি বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হবে, এতে তারা বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

 এ প্রসঙ্গে আরিফ বিল্লাহ আল্লামা শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী রাদিয়াল্লাহু আনহু তদীয় ‘মাসাবাতা মিনাস সুন্নাহ’ ما ثبت من السنه নামক কিতাবে شهر المحرم (শাহরুল মুহাররাম) মহররম মাসের খুৎবার আলোচনায় উল্লেখ করেন- وغفر ذنب داؤد يوم عاشوراء (ওয়াগাফারা জামবা দাউদা ইয়াওমা আশুরাআ) অর্থ আশুরার দিনে হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের গোনাহ ক্ষমা করেছেন’ তিনি (শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী রাদিয়াল্লাহু আনহু) নিজ খুৎবায় এ উক্তি উল্লেখ করে সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলেন-


 موضوع ذكره ابن الجوزى عن ابن عباس رضى الله عنه وفيه حبيب بن ابى حبيب وهو افة


 অর্থাৎ ‘হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে উপরের যে হাদিসখানা বর্ণিত আছে, ইবনে জাওযী এ হাদিসখানাকে মাওজু বা জাল বানোয়াট হাদিস বলে উল্লেখ করেছেন। কেননা এই হাদিসের সনদের মধ্যে রয়েছে হাবিব বিন আবি হাবিব নামে একজন রাবী, যে মিথ্যা হাদিস রচনা করতো।’ 

 উল্লেখ্য যে, হাদিস বিশারদ আল্লামা ইমাম আব্দুর রহমান ইবনে আলী ইবনে আল জাওযী আলকুরশী রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৫৯৭ হিজরি) তদীয় ‘কিতাবুল মওজুয়াত’ كتاب الموضوعات নামক গ্রন্থের ২য় জিলদ ২০২ পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় ‘বাবু ফি জিকরে আশুরা’ باب فى ذكر عاشوراء অধ্যায়ে একখানা দীর্ঘ হাদীস বর্ণনা করেছেন। এ হাদিসের মধ্যে রয়েছে- وغفر ذنب داؤد فى يوم عاشوراء (আশুরার দিনে দাউদ আলাইহিস সালামের গোনাহ ক্ষমা করেছেন)

 অতঃপর তিনি (ইবনে জাওযী) বলেন-


 هذا حديث موضوع بلا شك قال احمد بن حنبل كان حبيب بن ابى حبيب يكذب وقال ابن عدى كان يضع الحديث. 


 অর্থাৎ ‘এ হাদিসটি নিঃসন্দেহে মাওজু বা জাল হাদিস। ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন- এ হাদিসের রাবী বা বর্ণনাকারী হাবিব বিন আবি হাবিব মিথ্যুক এবং ইবনে আদি বলেছেন- হাবিব বিন আবি হাবিব মিথ্যা হাদিস রচনা করতো।’ 

 উপরোক্ত দলিলভিত্তিক আলোচনার দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হল যে, প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ আল্লামা ইবনে জাওজী রাদিয়াল্লাহু আনহু ও শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী রাদিয়াল্লাহু আনহু বিশেষ করে আহমদ ইবনে হাম্বল রাদিয়াল্লাহু আনহু ও ইবনে আদী রাদিয়াল্লাহু আনহু সহ মুহাদ্দিসীনগণ এ হাদিসকে মাওজু বা জাল হাদিস প্রমাণ করেছেন। সুতরাং এই জাল বা মিথ্যা হাদিসকে কেন্দ্র করে আল্লাহর জলিল কদর নবী হযরত দাউদ আলাইহিস সালামকে গোনাহগার বা তাঁকে আশুরার দিনে ক্ষমা করেছেন বলে লিখিত বা অলিখিত বক্তব্য প্রদান করা কোন আলেমের পক্ষে আদৌ সমীচীন হবে না। বরং সাধারণ মুসলমানগণ এ এ বক্তব্যে বিপথগামী হওয়ার রাস্তা খুলে যাবে।

 সমস্ত নবীগণ গোনাহ থেকে পাক ও পবিত্র الانبياء معصومون (আল আম্বিয়াউ মা’সুমুন) এ প্রসঙ্গে ইলমে কালাম বা আক্বাঈদ শাস্ত্রের সুপ্রসিদ্ধ কিতাব ‘শরহে আক্বাঈদে নাসাফী’ নামক গ্রন্থের ৯৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-


 واذا تقرر هذا فما نقل عن الانبياء عليه السلام مما يشعر بكذب او معصية فما كان منقولا بطريق الاحد فمردود. وما كان بطريق التواتر فمصروف عن ظاهره ان امكن والا فمحمول على ترك الاولى او كونه قبل البعثة. 


 অর্থাৎ যখন এই কথা (আম্বিয়ায়ে কেরাম মা’সুম বা নিষ্পাপ) সাব্যস্ত হয়, যখন নবীগণ আলাইহিমুস সালামের ব্যাপারে এমন সব কথার বর্ণনা পাওয়া যায়, যা মিথ্যা অথবা গোনাহের আভাস দেয়। উহা যদি خبر واحد খবরে ওয়াহিদ সূত্রে বর্ণিত হয়ে থাকে, তাহলে তা গ্রহণযোগ্য নয়। আর যদি তা متواتر সূত্রে বর্ণিত হয়ে থাকে, এমতাবস্থায় তার জাহেরী বা প্রকাশ্য অর্থ হতে অন্য অর্থে (নবীর শান মোতাবেক) রূপান্তর করতে হবে যদি সম্ভব হয়। আর যদি সম্ভব না হয়, তাহলে তাকে এমন অর্থে প্রয়োগ করতে হবে, যাতে বুঝা যায় যে, তাঁরা اولى (আউলা) বা উত্তমতা বর্জন করেছেন। অথবা উহা নবুয়ত প্রকাশ হওয়ার পূর্বের বিষয় হিসেবে প্রযোজ্য হবে।

 প্রকাশ থাকে যে, قبل البعثة (কাবলাল বা’ছাত) বা নবুয়ত প্রকাশ হওয়ার পূর্বের বিষয়, কথা দ্বারা ঐ দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, যখন আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে কোন ওহী বা শরিয়তের আদেশ নিষেধ কোন কিছু জারি হয়নি। সুতরাং ঐ সময়ের কোন কিছুই পাপ নয়।

 উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে যে, ইসলামের প্রাথমিক যুগে সাহাবায়ে কেরাম মদ্যপান করা নিষেধ সম্বলিত আয়াত নাজিল হয়নি।

 উপরোক্ত দলিলভিত্তিক আলোচনার দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো-

 ১. কোন খবরে ওয়াহিদ خبر واحد হাদিসের মর্ম যদি আম্বিয়ায়ে কেরামের শানবিরোধী হয়, তবে তা মরদুদ বা পরিত্যজ্য হবে। উপরুন্তু মাওজু বা জাল হাদিস তো প্রকৃতপক্ষে হাদিস হিসেবে অগ্রহণযোগ্য। মাওজু হাদিসকে কোন অবস্থাতেই দলিলরূপে গ্রহণ করা যাবে না।

 ২. যদি মুতাওয়াতির متواتر সূত্রেও এরূপ আয়াতে কারীমা অথবা হাদিসশরীফের ভাবার্থ (মানছাবে নবুয়ত) منصب نبوت বা নবীর শানবিরোধী অর্থ প্রকাশ করে, তাহলে এ আয়াতে কারীমা বা হাদিসশরীফের প্রকাশ্য অর্থকে পরিবর্তন করে নবীর শান মোতাবেক অর্থে রূপান্তর করতে হবে যদি সম্ভব হয়।

 আর যদি সম্ভব না হয় তাহলে খেলাফে আওলা উত্তমতা বর্জন বা নবুয়তের পূর্বের বিষয় হিসেবে গণ্য করতে হবে।

 এজন্যই মুফতিয়ে বাগদাদ আল্লামা আবুল ফজল শাহাবুদ্দিন সৈয়দ মাহমুদ আল আলুছী রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ১২৭০ হিজরি) তদীয় ‘তাফসিরে রুহুল মা’য়ানী’ ৮ম খণ্ড ২৩ পারায় উল্লেখ করেন-


 (فظن داؤد انما فتناه) ونعلم قطعا ان الانبياء عليه السلام معصومون من الخطايا لا يمكن وقوعهم فى شئ منها ضروة انا لو جوزنا عليهم شيئا من ذلك بطلت الشرائع ولم يوثق بشى مما يذكرون انه وحى من الله تعالى فما حكى الله تعالى فى كتابه يمر على ما اراده الله تعالى وماحكى القصاص مما فيه نقص لمنصب الرسالة طرحناه ونحن كما قال الشاعر-

 ونؤثر حكم العقل فى كل شبهة

 اذا اثر الاخبار جلاس قصاص ... 


 অর্থাৎ ‘وظن داؤد انما فتناه (এখন বুঝতে পেরেছেন দাউদ আলাইহিস সালাম কে আমি পরীক্ষা করেছি) (এ আয়াতে কারীমার তাফসিরে আল্লামা আলুছী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন)-

 তরজমা : আমরা অকাট্য দলিলের মাধ্যমে অবগত হয়েছি, নিশ্চয়ই নবীগণ আলাইহিমুস সালাম সকল খাতা বা ভুলত্রুটি থেকে মুক্ত বা মা’সুম। কোন প্রয়োজনে তাঁদের থেকে কোন গোনাহ সংঘটিত হওয়া সম্ভব নয়।

 পক্ষান্তরে (বিল ফরযজ ও তকদির) আমরা যদি তাঁদের থেকে (নবীদের থেকে) কোন গোনাহ সংঘটিত হওয়া সম্ভব বলে ধরে নেই, তাহলে শরিয়তের যাবতীয় বিধি-বিধান বাতিল সাব্যস্ত হয়ে পড়বে এবং আল্লাহ তা’য়ালার পক্ষ থেকে যে সমস্ত ওহী নাজিল হয়েছে তা অনির্ভর হয়ে পড়বে। অতএব যে সমস্ত ঘটনাবলী আল্লাহ তা’য়ালা কালামে পাকে বর্ণনা করেছেন এগুলোর মুরাদ বা সঠিক ভাবার্থ আল্লাহ তা’য়ালার উপর ন্যস্ত করতে হবে এবং এ প্রসঙ্গে যে সব কাসাস বা ঘটনাবলী মানসাবে রিসালাত (منصب رسالت) বা নবুয়ত মর্যাদা ক্ষুণ হয়, এ সমস্ত ঘটনাবলীকে আমরা প্রত্যাখ্যান করি। (কেননা নবীর মর্যাদা হানিকর এসব বর্ণনা আদ্যোপান্তই ইসরাঈলী মনগড়া কাহিনী থেকে সংগৃহীত)

 কবি যেভাবে বলেছেন এরূপ আমরাও বলব-


 ونؤثر حكم العقل فى كل شبهة

 اذا اثر الاخبار جلاس قصاص


 তরজমা ‘এবং আমরা আক্বলে সলিমের হুকুমকে (রায়কে) অগ্রাধিকার দেব, এমনসব সন্দেহপূর্ণ বিষয়ে- যা বেছে নেওয়া হয়েছে এমন সব খবর থেকে যেগুলো শুধু অলিক কেচ্ছা-কাহিনীর সাথে সংশ্লিষ্ট।’ (অর্থাৎ কবি বলেন নবীগণ আলাইহিমুস সালামের শানবিরোধী যেসব ঘটনাবলী রয়েছে এগুলো ইসরাইলী মনগড়া কাহিনী থেকে গৃহীত) এসব ঘটনা আদৌ আল্লাহর হাবিব থেকে রেওয়ায়েত নেই। তাই এ সকল সন্দেহপূর্ণ কথা হতে আক্বলে সলিমের রায়ই প্রাধান্য পাবে। কারণ নবীগণকে আল্লাহ তায়ালা পূর্ণ হেফাজতে রেখেছেন। তাই তাঁদের থেকে গোনাহ সংঘটিত হয় নাই, এজন্যইতো নবীগণকে মা’সুম বলা হয়ে থাকে।


নবীগণ আলাইহিমুস সালাম যে মা’সুম বা বেগোনাহ এ কারণেই এই বর্ণনাটি সামঞ্জস্যপূর্ণ। বর্ণনা হল এই- নিশ্চয় কোন এক সম্প্রদায় হযরত দাউদ আলাইহিস সালামকে শহীদ করার সংকল্প করল, অতঃপর মেহরাব বা দেওয়াল টপকিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল, অতঃপর তারা দাউদ আলাইহিস সালামের নিকট আরও কয়েকটি সম্প্রদায়কে পেল। সুতরাং তারা যা কিছু সংঘটিত করতে চেয়েছিল, তা আল্লাহ তায়ালা বিশদভাবে বর্ণনা করেছিলেন। ফলে দাউদ আলাইহিস সালাম তাদের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত হলেন। অতঃপর দাউদ আলাইহিস সালাম তাদের প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছাপোষন করলেন। এমতাবস্থায় তিনি ধারণা করলেন যে, নিশ্চয় ইহা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে একটি পরীক্ষা। আর সেই পরীক্ষাটি হলো এই যে, তিনি রাগান্বিত হলেন নিজের জন্য, না অন্যের জন্য। তিনি আল্লাহর দরবারে ইস্তেগফার তথা রুজু করলেন, এই কাজ থেকে যা তিনি দৃঢ় প্রত্যয় নিয়েছিলেন যে, তাদের থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এবং তাদেরকে শায়েস্তা করার জন্য স্বীয় ন্যায়পরায়ণ অভিমতের ভিত্তিতে কেননা ক্ষমা করা তার মহান মর্যাদার অনুকূলে।

 আর বর্ণিত আছে, ক্ষমা প্রার্থনা হল ঐ ব্যক্তির জন্য যে ব্যক্তি ভিড় বা শোরগোল জমাল হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের নিকট। এখানে আল্লাহ তায়ালার বাণী فغفرنا له (ফাগাফারনা লাহু) এ আয়াতে কারীমার অর্থ হলো فاغفرنا لاجله (ফাগাফারনা লি আজলিহী) অর্থাৎ দাউদ আলাইহিস সালামের কারণে তাকে ক্ষমা করেছি এবং হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম সংক্রান্ত সকল কাহিনী বা ঘটনাসমূহের বর্ণনাকে যদি বর্জন করা হয়, তাও ইনসাফের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয় বলে আমি (আলুছী) মনে করি। হ্যাঁ আবার নবুয়তের মর্যাদার কোন প্রকার বিঘœ সৃষ্টি হয় তাও অগ্রহণযোগ্য।

 আর এমন তাভীল বা ব্যাখ্যাও গ্রহণযোগ্য নয় যা নবীগণ আলাইহিমুস সালামের ইসমত (গোনাহ থেকে মুক্ত হওয়া) বিদূরিত হয়ে পড়ে।

 এ ব্যাপারে অতীব জরুরি কথা হচ্ছে এই, আল্লাহর নবীগণ আলাইহিমুস সালাম থেকে কোন প্রকারের দোষত্রুটি ও গোনাহ প্রকাশ হওয়া কোন অবস্থাতেই সম্ভবপর নয়। তবে নবীর শান মোতাবেক যা (اولى) আউলা (উত্তম) তা খেলাফ হতে পারে। আর এ থেকে নবী আলাইহিমুস সালামের ইস্তেগফারও হতে পারে এবং ইহা নবী আলাইহিস সালামের ইসমত বা গোনাহ থেকে পবিত্র হওয়ার মধ্যে কোন ব্যঘাতও ঘটায় না।’ অনুরূপ আবু হাইয়ান উন্দুলুসী রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৭৫৪ হিজরি) তদীয় ‘তাফসিরে বাহরুল মুহীত’ নামক কিতাবের ৯ম জিলদের ১৫১ পৃষ্ঠায় وظن داؤد انما فتناه(ওয়া যান্না দাউদা আন্নামা ফাতান্নাহু) আয়াতে কারীমার তাফসিরে উল্লেখ করেছেন-


 ويعلم قطعا ان الانبياء عليهم السلام معصومون من الخطايا الخ -


 অর্থাৎ অকাট্য দলিলের মাধ্যমে অবগত, নিশ্চয়ই নবীগণ আলাইহিমুস সালাম সকল খাতা বা ভুলত্রুটি হতে মুক্ত।

 এভাবে ইমাম আল্লামা ফখরুদ্দিন রাজী (রা.) ওফাত ৬০৪ হিজরি) তদীয় ‘তাফসিরে কবীর’ নামক কিতাবের ১৩ নং জিল্দ ২৬ পারা ১৯৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-


 فداؤد عليه السلام استغفرلهم واناب- اى رجع الى الله تعالى فى طلب مغفرة ذلك الداخل القاصد للقتل- قوله (فغفرنا له ذلك) اى غفرنا له ذلك الذنب لاجل احترام داؤد ولتعظيمه -


 অর্থাৎ ‘অতএব হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম তাদের জন্য (কওমের জন্য) ইস্তেগফার করলেন এবং ফিরে আসলেন অর্থাৎ যারা হযরত দাউদ আলাইহিস সালামকে শহীদ করার হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, তাদের মাগফিরাত তলবের জন্য আল্লাহ তায়ালার মহান দরবারে রুজু করলেন। আল্লাহ তায়ালার বাণী (فغفرنا له ذلك) অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম এর মহত্ত্ব ও সম্মানে তাদের ঐ অপরাধকে ক্ষমা করেছেন।’ 

 ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী রাদিয়াল্লাহু আনহু ‘তদীয় ‘তাফসিরে কবীর’ নামক কিতাবের ১৩ নং জিল্দ ২৬ পারা ১৯২ পৃষ্ঠায় এবং আল্লামা শায়খ ইসমাঈল হাক্বী রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ১১৩৭ হিজরি) তদীয় ‘তাফসিরে রুহুল বয়ান’ নামক কিতারেব ৮ম খণ্ড ২০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-


 ولذلك قال على رضى الله عنه من حدث بحديث داؤد عليه السلام على ما يرويه القصاص جلدته مائة وستين وذلك حد الفرية على الانبياء صلوات الله عليهم اجمعين – وفى الفتوحات المكيه فى الباب السابع والخمسين بعد المائة ينبغى للواعظ ان يراغب الله فى وعظه ويجتنب عن كل ما كان فيه تجر على انتهاك الحرمات فما ذكره المؤرخون عن اليهود من ذكر زلات الانبياء كداؤد ويوسف عليهما السلام مع كون الحق اثنى عليهم واصطفاهم-


 অর্থাৎ ‘ হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়িব রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নিশ্চয় হযরত আলী ইবনে আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু ঘোষণা করেছেন যে কেউ হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের কাহিনী গল্পগুজবের ন্যায় বর্ণনা করবে, আমি তাকে ১৬০ দোররা মারবো। অর্থাৎ অপবাদের শাস্তি হয়েছে ৮০ দোররা কিন্তু এ ক্ষেত্রে দ্বিগুণ শাস্তি দেওয়া হবে।

 এজন্য হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন- যে ব্যক্তি হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের কাসাস সংক্রান্ত হাদীস বা অপবাদ সংক্রান্ত ঘটনা বর্ণনা করবে, আমি তাকে ১৬০ (একশত ষাট) টি বেত্রাঘাত করব। আর এটা হচ্ছে নবীগণ আলাইহিমুস সালামের উপর অপবাদকারীদের শাস্তি।

 ফতুহাতে মক্কীয়া নামক কিতাবের সপ্তম বাবে একশত বেত্রাঘাত এর পরে আর পঞ্চাশটি বেত্রাঘাতের কথা উল্লেখ রয়েছে।

 ওয়াইজ বা নসিহতকারী বক্তাগণের জন্য লক্ষ্য রাখা উচিত, আল্লাহতায়ালা যেন তাঁদের ওয়াজ ও নসিহতে ফলপ্রসূ দান করেন।

 ওয়াইজ বা বক্তাগণ যেন সম্পূর্ণরূপে অমূলক কথা থেকে বিরত থাকেন, যে সমস্ত ঘটনা যা হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম ও হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের ব্যাপারে ইহুদি-নাসারাদের ঐতিহাসিকগণ বর্ণনা করে নবীগণ আলাইহিমুস সালাম এর যাল্লত বা পদস্খলন সংক্রান্ত মিথ্যা ঘটনাবলী উল্লেখ করেছেন এ থেকে বিরত থাকেন।

 বক্তাগণের জন্য উচিত হক কথা প্রকাশ করে নবীগণের শান মান বর্ণনা করে তাদের গুণগান বর্ণনা করবেন।

 প্রকাশ থাকে যে, হাফেজ আবুল ফেদা ইমামুদ্দিন ইবনে কাসির দামেস্কী রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৭৭৪ হিজরি) স্বরচিত সুপ্রসিদ্ধ ‘তাফসিরে ইবনে কাসির’ নামক কিতাবের ৪র্থ খণ্ড ৩১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-


 قد ذكر المفسرون ههنا قصة اكثرها ماخوذ من الاسرائيليات ولم يثبت من المعصوم حديث يجب اتباعه 


 অর্থাৎ ‘ এস্থলে তাফসিরকারকগণ এমন একটি কেচ্ছা বর্ণনা করেছেন, যার অধিকাংশই ইসরাঈলী মনগড়া কাহিনী হতে গৃহীত। প্রকৃতপক্ষে এ সম্মন্ধে মা’সুম তথা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে একটি হাদিস ও রেওয়ায়েত করা হয়নি। যার অনুসরণ করা জরুরি হতে পারে।’ 

 অনুরূপ হাফেজ ইবনে কাসির রাদিয়াল্লাহু আনহু স্বরচিত ইতিহাস গ্রন্থ ‘আল বেদায়া ওয়ান নেহায়াহ’ প্রথম ভলিয়ম ২য় জুজ ১২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-


 وهذا ذكر كثير من المفسرين السلف والخلف ههنا قصصا واخبارا اكثرها اسرائيليات ومنها ما هو مكذوب لا محالة تركنا ايرادها فى كتابنا قصدا اكتفاء واقتصارا على مجرد تلاوة القصة من القران العظيم والله يهدى من يشاء الى صراط مستقيم -


 অর্থাৎ ‘সলফ ও খলফ বা প্রাচীন ও আধুনিক বহু তাফসিরকারকগণ এস্থলে (দাউদ আলাইহিস সালামের ব্যাপারে) কয়েকটি গল্প ও কাহিনী নকল করেছেন। তাদের অধিকাংশই ইসরাইলী মনগড়া কাহিনী। এর মধ্যে কতক গল্প তো নিশ্চিতরূপে মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন। এ কারণে আমি ইচ্ছা করেই এ সমস্ত অলিক কেচ্ছাগুলি আমার কিতাবে বর্ণনা করিনি। আল্লাহর কালামে ঘটনাটির যতটুকু বর্ণনা রয়েছে, আমিও ততটুকু বর্ণনা করেই ক্ষান্ত হলাম, আর আল্লাহ তায়ালা যাকে ইচ্ছা করেন সরলপথে তাকে পরিচালিত করেন।’ 

 উল্লেখ্য যে, হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের এ ঘটনা জিলহজ্ব মাসে সংঘটিত হয়েছে। মহররম মাসে বা আশুরার দিনে হয়নি। আল্লামা ইসমাইল হাক্বী রাদিয়াল্লাহু আনহু তদীয় ‘তাফসিরে রুহুল বয়ান’ নামক কিতাবের ৮ম জিলদের ১৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-


 (فغفرنا له ذلك) اى ما استغفر منه كان فى شهر ذى الحجة كما فى بحر العلوم -


 অর্থাৎ ‘এ ঘটনা সংক্রান্ত ইস্তেগফার সংঘটিত হয়েছিল জিলহজ্জ্ব মাসে যেমন বাহরুল উলুম নামক কিতাবে বর্ণিত আছে।’ 

 অতএব যারা বলেন- আশুরার দিনে হযরত দাউদ আলাইহিস সালামকে ক্ষমা করেছেন তা একেবারেই অবাস্তব অবান্তর ও ভিত্তিহীন।

 মোট কথা হলো

 ১. হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম ইস্তেগফার করেছেন কওমের পক্ষ থেকে নিজের জন্য নয়।

 ২. আল্লাহ তায়ালা হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের মহত্ত্ব ও সম্মান রক্ষার জন্য তার কওমকে ক্ষমা করেছেন।


 فداؤد عليه السلام استغفرلهم – اى غفرنا له ذلك الذنب لاجل احترام داؤد ولتعظيمه - تفسير كبيرص۱۹۳ ياره ۲۶ جلد ۱۳ 

_______________

ইজহারে হক্ব

লেখক : অধ্যক্ষ শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী (মা:জি:আ:)

 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন