কর্মধার বাহাছ
কর্মধার বাহাছে সৈয়দ আহমদ বেরলভীর মুখোশ উন্মোচন
সংকলনে : মাওলানা হাফিজ তালিব উদ্দিন
আউশকান্দি, নবীগঞ্জ, হবিগঞ্জ।
কর্মধার বাহাছের সূচনা
সিলেট জেলার শ্রীমঙ্গল থানাধীন ভৈরবগঞ্জ বাজার ৫নং কালাপুর ইউনিয়ন অফিসে ৭ পৌষ ১৩৮২ বাংলা এলাকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সহযোগে সুন্নী-ওহাবী আক্বিদা নিয়ে এক আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় সিরাজনগরী সাহেব ওহাবীদের ১৪টি বাতিল আক্বিদা লিখিতভাবে পেশ করেন। এ সময়ে সুন্নি জামায়াতের পক্ষে যিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন, তিনি হলেন নয়ানশ্রী গ্রামের মরহুম আলহাজ্ব মোহাম্মদ আব্দুল গণি সাহেব। তাঁর সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করেন মরহুম হাজী মনোহর আলী চেয়ারম্যান ৫নং কালাপুর ইউপি। মরহুম মনছুর আলী (ভাইস চেয়ারম্যান ৫নং কালাপুর ইউপি) ও মরহুম মছদ্দর আলী (মেম্বার) লামা লামুয়া।
এ সভার সূত্রপাত নিয়েই ঐ ১৪টি বাতিল আক্বিদার উপর পরবর্তীতে ১৯৭৬ইং সনের ১২ ফেব্রুয়ারি মোতাবেক ২৯ মাঘ বৃহস্পতিবার কুলাউড়া থানার ১৩নং কর্মধা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জনাব মরহুম মোহাম্মদ ইয়াকুব আলী সাহেবের ব্যবস্থাপনায় ইলিয়াছী তাবলীগি জামায়াতের সমর্থকদের সাথে কর্মধার বাহাছ অনুষ্ঠিত হয়।
বাহাছের পটভূমি সম্পর্কে সিরাজনগরী হুজুরের বক্তব্য
বেশ কিছুদিন পূর্বে আমি (সিরাজনগরী) জুড়ি বাজারের নিকট এক ওয়াজের মাহফিলে যোগদান করেছিলাম। সেখান থেকে বাড়ি ফেরার পথে কুলাউড়া জামে মসজিদের ইমাম জনাব মাওলানা সৈয়দ রাশিদ আলী সাহেব (মরহুম) এর হুজরায় রাত্রিযাপন করি।
১নং কর্মধা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জনাব মৌলভী ইয়াকুব আলী সাহেব ঘটনাক্রমে সেই হুজরায় উপস্থিত হন। তিনি ১৩নং কর্মধা ইউনিয়ন সংলগ্ন এক ওয়াজ মাহফিলের তারিখ চাইলে ৬/১/১৯৭৬ইং তারিখে ওয়াজের দিন নির্ধারণ করে দিলাম। আমার একজন সাগরিদকে রশিদ কুলাউড়া নিবাসী মাওলানা ফজলুল করিম একখানা পত্র দিলেন, সেই পত্র ওয়াজের নির্দিষ্ট তারিখে সকাল ৯টা ৩০ মিনিট এর সময় আমার নিকট হস্তগত হয়। পত্রে উল্লেখ ছিল ‘দেওবন্দী ওহাবীগণ’ কর্মধার ওয়াজের মাহফিলে বাহাছ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে রয়েছে, সুতরাং বাহাছের প্রয়োজনীয় কিতাবাদীসহ শ্রীমঙ্গল হইতে ১০-৩০ মি. এর ট্রেনে লংলা স্টেশনে পৌঁছা একান্ত প্রয়োজন। উস্তাযুল উলামা আল্লামা ফরমুজ উল্লাহ শায়দা সাহেব কেবলা (আলাইহির রহমত)ও এ ট্রেনে কর্মধা পৌঁছবেন।
পত্রের মর্মানুসারে আমি ট্রেনযোগে লংলা পরে রিকশা দ্বারা গন্তব্য স্থানে পৌঁছে শুনতে পারলাম জনৈক ওহাবী মৌলভী মাইকে লাফালাফি করে বাহাদুরী করতেছে। আল্লাহ জাল্লাশানুহুর অসীম রহমতে আমি রিকশা থেকে নামতেই তার বাহাদুরি শেষ হয়ে গেল।
আছরের নামাযের পর ওয়াজ শুরু করতেই কর্মধা মাদ্রাসার একজন শিক্ষক বাহাছ বাহাছ বলে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমি ওয়াজের মাধ্যমে বর্তমান প্রচলিত নব আবি®কৃত স্বপ্নে প্রদত্ত ইলিয়াছী তাবলীগ জামায়াতের ভ্রান্ত আক্বিদা ও শরিয়তবিরোধী মতবাদগুলি এবং তাদের মুরুব্বিগণের ভ্রান্ত আক্বিদাসমূহের স্বরূপ উপস্থিত জনসভায় তুলে ধরলাম। ফলে জনগণের সামনে তাদের গোমর ফাঁক হয়ে গেল। এতে তারা আরো অস্থির হয়ে পড়ল।
পরিশেষে ১৩নং কর্মধা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জনাব মৌলভী ইয়াকুব আলী মরহুমের নেতৃত্বাধীন বাহাছের সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। এ সময় আমার সঙ্গে ছিলেন মাওলানা ফজলুল করিম ও মাওলানা আব্দুল মালিক তারা উভয়ই তখন ছাত্র ছিলেন।
সুতরাং ৬/১/১৯৭৬ইং তারিখে ১৩নং কর্মধা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জনাব মৌলভী মোহাম্মদ ইয়াকুব আলী সাহেবের নের্তৃত্বাধীন, নিম্নলিখিত শর্তাবলী ও বিষয়াদির উপর ১২/২/১৯৭৬ইং তারিখে বাহাছ অনুষ্ঠিত হবে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।
অধ্যক্ষ শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
বাহাছের শর্তাবলী
১. সালিশকারীগণ উল্লেখিত, উভয়ের লিখিত বাহাছ অনুযায়ী রায় লিখে উভয় পক্ষকে এক এক কপি করে শীল মোহর করে প্রদান করবেন, অথবা সই ও তারিখ দিয়ে প্রদান করবেন।
২. বাহাছের সময় শান্তি রক্ষার জন্য দায়িত্ব চেয়ারম্যান সাহেবের থাকবে এবং তিনি শান্তি রক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
৩. যতক্ষণ পর্যন্ত বাহাছ শেষ না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত কোন বাহাছকারী বাহাছের স্থান হতে যাইতে পারিবে না। যদি কেহ যায় পরাজিত বলে সাব্যস্থ করা হবে।
৪. উভয় পক্ষের সালিশের উপর একজন সভাপতি অর্থাৎ প্রধান নিরপেক্ষ কোন সরকারি অফিসার হতে হবে। যদি রায়ের মধ্যে দুই পক্ষের সালিশগণ একমত না হন তখন বাহাছের রেকর্ড-এর মোতাবেক সেই অফিসারের রায় উভয় পক্ষগণ মানতে বাধ্য থাকবে।
৫. আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকাইদের কিতাব দ্বারা আকাইদসংক্রান্ত মাসআলাসমূহের ফয়সলা হবে এবং ফরুয়ী (আমলী) মাছাঈলের ফয়সলা হানাফী মাযহাবের নির্ভরযোগ্য কিতাব দ্বারা হবে। (অর্থাৎ আকাইদী মাসআলা কেরআন সুন্নাহ ও ইজমা এবং আমলী মাসআলা কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস এ চার দলিলের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে।)
৬. যে পক্ষ বাহাছের রেকর্ড এর খেলাপ বা ব্যতিক্রম ছাপাবে, আইনত দণ্ডনীয় হবে।
(স্বাক্ষর) শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
(স্বাক্ষর) মোহাম্মদ ইব্রাহিম আলী ৬/১/১৯৭৬ ইং
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের পক্ষে বাহাছ করবেন
আল্লামা শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
তাবলীগি জামায়াতের পক্ষে বাহাছ করবেন
মাওলানা মোহাম্মদ ইব্রাহিম আলী
সুন্নীদের পক্ষে সালিশ
১. উস্তাযুল উলামা আল্লামা হরমুজ উল্লাহ শায়দা সাহেব তুরখলি
২. মাওলানা মোহাম্মদ ওমর আলী সাহেব, মৌলভীবাজার।
তাবলীগিদের পক্ষে সালিশ
১. মাওলানা মুফতি আব্দুল হান্নান দিনারপুরী
২. মাওলানা আব্দুন নূর সাহেব ইন্দেশশরী
মধ্যস্ত সালিশ
জনাব আব্দুল ওয়াহিদ সাহেব, চেয়ারম্যান ১২নং ইউনিয়ন
বাহাছের তারিখ
২৯ শে মাঘ ১২ ফেব্রয়ারি ১৯৭৬ ইংরেজি
সময় : সকাল ১০ ঘটিকা।
বাহাছের স্থান:
১৩ নং কর্মধা ইউনিয়ন সংলগ্ন বাজার।
উপজেলা, কুলাউড়া, জেলা: সিলেট, (বর্তমান- মৌলভীবাজার।)
জনাব আল্লামা সিরাজনগরী সাহেবের ১৪ পয়েন্ট (১৪ দফা) এবং জনাব মাওলানা ইব্রাহিম আলী সাহেবের জওয়াব
১৪ দফা
১. নামাযের মধ্যে নবীয়েপাকের খেয়াল করা গরু-গাধার খেয়ালে ডুবে থাকার চেয়েও খারাপ এবং তাঁকে নামাযের মধ্যে ইচ্ছা করে তা’জিমের সঙ্গে খেয়াল করা শিরিক। এবং অনিচ্ছায় নামাযের মধ্যে নবীয়েপাকের খেয়াল এসে পড়লে এক রাকায়াতের পরিবর্তে চার রাকায়াত নফল নামায পড়তে হবে। (ওহাবীদের নেতা) মৌলভী ইসমাইল সিরাতে মুস্তাকিম কিতাবে লিখেছেন।
সুন্নী জামায়াতের উলামাদের মতে উপরোক্ত আক্বিদা কুফুরি। যে ব্যক্তি এরূপ আক্বিদা রাখবে ও এ আক্বিদাকে হক বলে সমর্থন করবে সেও কাফের হবে।
শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী, ৬/১/৭৬ ইং জওয়াব
১. হযরত ইসমাইল (র.) দেহলভীর কিতাব ছিরাতে মুস্তাকিমের মধ্যে হুজুর (দ.) সম্বন্ধে ইহা অপব্যাখ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়।
গরু-গাধার খেয়াল করার কথা তিনি কখনও বলেন নাই। তওহীদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়া যে বর্ণনা উল্লেখ করিয়াছেন ইহা বিকৃত করা হইয়াছে।
স্বাক্ষর: মো: ইব্রাহিম আলী
৬/১/৭৬ইং
২. ইসমাইল দেহলভী উক্ত কিতাবের ৭০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘তাকে (সৈয়দ আহমদ বেরলভীকে) নবীগণের সাগরিদও বলা চলে এবং নবীগণের উস্তাদের সমকক্ষও বলা চলে।’
সুন্নী জামায়াতের মতে নবীগণ উম্মতের ছাত্র হতে পারে না। যে ব্যক্তি নবীগণকে কোন উম্মতের ছাত্র বলবে সে কাফের হবে।
স্বাক্ষর: শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী জওয়াব
২. হযরত ইসমাঈল শহীদ (রা.) কেন কোন ওলি আলেম অথবা যে কোন মানুষ নবীর উস্তাদ হতে পারে না। কিন্তু আলেম বা উম্মত নবীর সাগরিদ বা ছাত্র হতে পারে। ঐ কথাকে বিকৃত করা হয়েছে। নবীগণকে কোন উম্মতের ছাত্র মনে করা কুফুরি।
স্বাক্ষর: মো: ইব্রাহিম আলী
৩. সিরাতে মুস্তাকিম কিতাবের ৭০ পৃষ্ঠায় লেখা আছে ‘নবীদের সঙ্গে (আলেমদের) সম্পর্ক শুধু এতটুকু- যতটুকু সম্পর্ক ছোটভাই ও বড়ভাইয়ের মধ্যে আছে।’ এবং ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ নামক কিতাবের ৬০ পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তা’জিম বড় ভাইয়ের মতে করিতে হইবে।’
সুন্নীদের মতে হুজুরকে বড় ভাইয়ের মত আক্বিদা রাখা কুফুরি।
স্বাক্ষর- শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী জওয়াব
৩. হুজুরকে (আ.) বড়ভাই এর মত বলিয়া তাজিম করা কুফরি। উক্ত কথা উনার কিতাব হইতে অতি রঞ্জিত করিয়া প্রকাশ করা হইয়াছে। তিনি একটি হাদীসের অনুবাদ করিয়া ছিলেন যাহাতে ভাই শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
স্বাক্ষর- মো: ইব্রাহিম আলী
৪. মিলাদশরীফ পাঠ করা কানাইয়ার জন্মের মতো অর্থাৎ কানাইয়া নামক হিন্দুর উৎসবের ন্যায়। (ফাতাওয়ায়ে মিলাদশরীফ, রশিদ আহমদ গাঙুহী (দ্র:)
সুন্নীদের মতে উক্ত আক্বিদা গোমরাহী।
স্বাক্ষর- শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী।
জওয়াব
৪. মৌং রশিদ আহমদ ছাহেব (র.) কিয়ামের হুকুম বয়ান করিতে গিয়া একটি দৃষ্টান্ত পেশ করিয়াছেন। ইহারই অপব্যাখ্যা করা হইয়াছে। মক্বা-মদিনার উলামায়ে কেরাম ইহা সমর্থন করিয়াছেন যে মিলাদের কিয়াম সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছেন তাহা ঠিক। নফছে মিলাদের সম্বন্ধে কোন কথা বলেন নাই।
স্বাক্ষর- মো: ইব্রাহিম আলী
৫. নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইলমে গায়েবের কি বিশেষত্ব থাকতে পারে? এ ধরণের ইলমে গায়েব জায়েদ, আমর, ছেলে ও পাগলের বরং সমস্ত জীবজন্তুরও আছে। ‘হিফজুল ঈমান’ আশরাফ আলী থানবী।
সুন্নীদের মতে হুজুরের ইলমে গায়েবকে গরু-গাধার ইলিমের মতো আক্বিদা রাখা কুফুরি।
স্বাক্ষর- শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
জওয়াব
৫. রাসূলুল্লাহ (দ.)-এর ইলমে গায়েব ইত্তেলায়ে কুল্লী নহে। রাসূলুল্লাহকে কুল্লী আলিমূল গায়েব মনে করা শিরকী। উনার কথা না বুঝিয়া পূর্বাপর মিল না রাখিয়া ভুল বুঝাবুঝির মাধ্যমে রাসূল (দ.)-এর সাথে বেআদবি করা হইয়াছে।
স্বাক্ষর- মো: ইব্রাহিম আলী
৬. আরবের মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব নজদী কাফের, কারণ তার ভ্রান্ত আক্বিদার উপর বিশ্বজগতের মুফতিগণ তাকে কাফের বলে ফতোয়া প্রমাণ করেছেন। যারা মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব নজীর ভ্রান্ত আক্বিদাকে সমর্থন করবে তারা বাতেল ও কাফের হবে।
স্বাক্ষর- শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী।
জওয়াব
৬. আব্দুল ওহাব নজদীর সঙ্গে আমাদের পীরি মুরিদীর কোন সম্পর্ক নাই। তাহার আকায়েদ আমরা আহলে সুন্নাত অল জামাত হানাফী গণের বিরোধী। তাহার ভ্রান্ত আক্বিদা বাতিল ও কুফুরি।
স্বাক্ষর- মো: ইব্রাহিম আলী
৭. শুধুমাত্র নবীগণের স্বপ্নই শরিয়তের দলিলরূপে গণ্য হইবে। নবীগণ ছাড়া অলীর স্বপ্ন ও দলিল রূপে পরিগণিত হবে না। মৌলভী ইলিয়াছ সাহেব যেহেতু স্বপ্ন দ্বারা তাবলীগ বাহির করেছেন সেই জন্য উহা বাতিল ও ভ্রান্ত।
স্বাক্ষর- শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
জওয়াব
৭. এ কথার মধ্যে আমরা একমত যে ওলীগণের স্বপ্ন শরিয়তের কোন দলিল হইতে পারে না। মৌলভী ইলিয়াছ (রা.) স্বপ্ন দ্বারা তাবলীগ বাহির করেন নাই। বরং নবী করিম (দ.) যে তাবলীগ করিয়াছেন ঐ তাবলীগ কয়েকটি নীতি ও নিয়মের মাধ্যমে চালু করিয়াছেন যাহা ইসলামের পঞ্চভিত্তির অন্তর্ভূক্ত।
স্বাক্ষর- মো: ইব্রাহিম আলী
৮. তাবলীগীদের অভিমত কেয়ামত দিবসে সমস্ত মানব যখন কঠিন আযাব দর্শন করিয়া মহাভয়ে কম্পিত হইতে থাকিবে, এমনকি নবীগণ পর্যন্ত নফসী নফসী বলিয়া চিৎকার করিতে থাকিবে তখন এই মোজাহিদ বান্দাগণকে আল্লাহ সম্পূর্ণ ভয়শূন্য করত শান্তির ছায়া দান করিবেন। (দাওয়াতে তাবলীগ ৫৪ পৃষ্ঠা- ১ম খণ্ড)
সুন্নীদের মতে মাও: আম্বর আলীর উপরোক্ত আক্বিদা সম্পূর্ণ শরিয়ত বিরোধী আক্বিদা নবীগণ থেকে উম্মতকে বড় মনে করা কুফুরি।
স্বাক্ষর- শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
জওয়াব
৮. লিখক আম্বর আলী তিনি অপরিচিত। তাবলীগের মূল কিতাবে ইহা নাই। উম্মতগণকে নবীগণের উপর ফজিলত দেওয়া কুফুরি।
তবে যদি উক্ত কিতাবের দ্বারা এই মত প্রমাণিত হয়, নতুবা একটি কথার অনেক মকছুদ থাকতে পারে।
স্বাক্ষর- মো: ইব্রাহিম আলী
৯. হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কোন উম্মতের মত (মিছাল) বলা জায়েজ কি না?
সুন্নীদের মতে কোন উম্মতকে নবীর মত বলা কুফুরি।
স্বাক্ষর- শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
জওয়াব
৯. হুজুর (আ.)কে মানুষের মত বলা যাইতে পারে না, উম্মতের মতো নয়। আলেমকে হাদীস অনুযায়ী নবীগণের নায়েব এবং শুধু তাবলীগ বা ধর্ম প্রচার করার বেলায় নবীর মতো (মিছাল) বলা যাইতে পারে। ঐ আলেম নবী হইতে পারে না। যদি ঐ আলমকে নবী বলা হয় তবে তাহা কুফরি।
স্বাক্ষর- মো: ইব্রাহিম আলী
১০. মলফুজাত (ইলিয়াছ সাহেবের) ৪৬ পৃষ্ঠায় লেখা আছে-
ইলিয়াছ সাহেব বলিয়াছেন ‘যাকাতের দরজা হাদিয়া হইতে নিম্নে।’
সুন্নীদের মতে উপরোক্ত মতবাদ সম্পূর্ণ শরিয়তবিরোধী, এই মতবাদের উপর যে বিশ্বাস করিবে সে পথভ্রষ্ট ও গোমরাহ হইবে।
স্বাক্ষর- শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
জওয়াব
১০. যাকাতের স্থান বা মান হাদিয়ার নিম্নে যাইতে পারে না। যদি নিয়ত সহী করিয়া যাকাত আদায় করিয়া থাকে এবং কিতাব অনুযায়ী তাহা খরচ করিয়া থাকে।
স্বাক্ষর- মো: ইব্রাহিম আলী
১১. যাকাতের মাছারিফ সম্বন্ধে ইলিয়াছ ছাহেবের ‘মলফুজাত’ কিতারেব ৪৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে, ‘যাকাতের সহীহ গ্রহীতা ঐ সমস্ত লোক যাহারা যাকাতের টাকা পাইলে নিজের মধ্যে মালের লোভ পয়দা হয় না।’
আবার ৫৭ পৃষ্ঠায় লেখা আছে ‘আমি (ইলিয়াছ সাহেব) এই রূপ ৪০ জন লোকের নাম লিখিয়া দিয়াছি যাহাদের লোভ-লালসা নাই। তাহাদিগকে যাকাত দিলে তাহাদের মধ্যে লোভ-লালসা পয়দা হইবে না। তাহারা আল্লাহর উপর ভরসা করিয়া তাবলীগের কাজে লাগিয়া আছে।’
সুন্নীদের মতে উপরোক্ত আক্বিদা সম্পূর্ণ শরিয়তবিরোধী ও গোমরাহী।
স্বাক্ষর- শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী।
জওয়াব
১১. যাকাতের মাছারিফ ঐ সমস্ত লোক যাহা কোরআন ও হাদীদ দ্বারা বর্ণিত আছে। তাবলীগের কিতাব ফাজায়েলে যাকাত (কৃত মৌং জাকারিয়া, মুহাদ্দিস মাদ্রাসায়ে মাজহারুল উলুম ছাহারানপুর)।
মৌ ইলিয়াছ (র.) ছাহেব মাছরাফে যাকাতের উল্লেখ করিয়াছেন। যাকাত পাওয়ার উপযুক্ত যে কোন লোকই হউক বা গায়ের তাবলীগি হউক যাকাত দেওয়া যাইতে পারে।
স্বাক্ষর- মো: ইব্রাহিম আলী।
১২. মিলাদশরীফের কিয়াম করা সুন্নীদের মতে জায়েজ বরং মোস্তাহাব। এবং যাহারা মিলাদ শরীফের কেয়ামকে কুফুরি শেরেকী, বেদআত ও নাজায়েয বলে, তাহারা বাতেল ও পথভ্রষ্ট।
স্বাক্ষর- শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী।
জওয়াব
১২. মিলাদশরীফের কিয়াম (প্রচলিত) নাজায়েজ। ইহা হাদীস কোরআনের বহির্ভূত এবং বিশেষ করিয়া হানাফী মাজহাবের মান্যবর ইমাম আবু হানিফা (রা.) এবং তার শাগরিদান ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মদ, ইমাম জাফর , ইমাম হাছান বিন জিয়াদ প্রমুখ ইহা করেন নাই। এবং তাহাদের কিতাবেও ইহা পাওয়া যায় নাই।
স্বাক্ষর- মো: ইব্রাহিম আলী
১৩. ৬ উছুলী তাবলীগ শরিয়তবিরোধী কারণ রাসূলেপাক ও ছাহাবায়ে কেরামের তাবলীগ এরূপ ছিল না। যাহারা ছয় উছুলী তাবলীগ করিবে তাহারা বাতিল হইবে।
স্বাক্ষর- শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
জওয়াব
১৩. ছয় উছুলী নিয়ম অনুসরণ করিয়া যে দ্বীনের কাজ চলিতেছে তাহা রাসূলুল্লাহ (দ.) ও ছাহাবায়ে কেরামগণের আদর্শের বাহিরে নয়।
ছয় উছুল মানা ফরয বা ওয়াজিব নয়।
স্বাক্ষর- মো: ইব্রাহিম আলী।
১৪. আল্লাহ মিথ্যা কথা বলিতে পারেন। ‘ফাতাওয়ায়ে রাশিদিয়া’ রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী।
সুন্নীদের মতে উক্ত আক্বিদা কুফুরি।
স্বাক্ষর- শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
জওয়াব
১৪. আল্লাহ হইতে অধিক সত্যবাদী আর কেহ নাই। ইহা মৌলভী রশিদ আহমদ সাহেবের ফতওয়ার একটি অপব্যাখ্যা মাত্র।
স্বাক্ষর- মো: ইব্রাহিম আলী
জনাব ইব্রাহিম আলী সাহেবের ৫ পয়েন্ট (৫ দফা) এবং আল্লামা সিরাজনগরী সাহেবের জওয়াব
১. গায়রুল্লাহর খিয়াল নামাযের মধ্যে ইচ্ছাপূর্বক আনিলে শিরিক হইয়া যাইবে।
স্বাক্ষর- মো: ইব্রাহিম আলী
৬/১/৭৬ইং
জওয়াব
১. রাসূলে পাকের নাম মোবারক যখন ‘তাশাহুদ’ পড়ার সময় আসবে, রাসূল হিসেবে ইচ্ছা করে তা’জিমের সহিত আসবে, ঠিক তদ্রƒপ নামাযের ভিতর তেলাওয়াতে আসলেও তা’জিমের সাথে খিয়াল করবে।
স্বাক্ষর- শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
২. রাসূলুল্লাহ (দ.)কে ভাই এর বরাবর সম্মান করার দাবি আমরা স্বীকার করি না। ইহা আমাদের প্রতি মিথ্যা অপবাদ। হুজুর (দ.)কে ভাইয়ের বরাবর জানা কুফুরি। তিনি সৃষ্টির সেরা।
স্বাক্ষর- মো: ইব্রাহিম আলী
জওয়াব
২. এই উক্তির ভিতরে আমি ও একমত অর্থাৎ হুজুর (দ.)কে বড় ভাইয়ের মতে মনে করা কুফুরি। যে ব্যক্তি এরূপ আক্বিদা রাখবে সে কাফের হবে।
স্বাক্ষর- শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
৩. প্রচলিত মিলাদের কেয়াম বিদআত। ইহা কুরুনে ছালাছার পরের আবি®কৃত।
স্বাক্ষর- মো: ইব্রাহিম আলী
জওয়াব
৩. মীলাদশরীফের কেয়াম বা দাঁড়াইয়া ছালাত ও সালাম পড়া মুসতাহাব ও মুসতাহসান।
স্বাক্ষর- শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
৪. রাসূলুল্লাহ (দ.)কে আলিমুল গায়েব ও হাজির নাজির বিশ্বাস করা বিলকুল শিরিক।
স্বাক্ষর- মো: ইব্রাহিম আলী
জওয়াব
৪. আল্লাহ তায়ালা একমাত্র আলেমুল গায়েব। আল্লাহতায়ালা তাঁর রাসূলকে অসীম গায়েব থেকে কিছু কিছু গায়েবী ইলিম দান করেছেন। সুতরাং নিশ্চয় রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কিছু কিছু গায়েব জানেন যা আল্লাহ তায়ালা তাঁর হাবীবকে জানিয়ে দিয়েছেন। রাসূলেপাকের সামনে সারা বিশ্বজগত রয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহপাকের সাহায্যে হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সবকিছু দেখেন ও শুনেন।
স্বাক্ষর- শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
৫. প্রচলিত তাবলীগ ইসলামের বহির্ভূত নহে। ইলিয়াছ এর উপর নবুয়তীর মিথ্যা অপবাদ দেওয়া ভুল। তিনি কোথাও নবুয়তীর দাবি করে নাই। তাহার কথাকে বিকৃত করা হইয়াছে।
স্বাক্ষর- মো: ইব্রাহিম আলী
জওয়াব
৫. বর্তমান প্রচলিত স্বপ্নে প্রদত্ত ইলিয়াছি তাবলীগ শরিয়তসম্মত নহে। ইলিয়াছ নবীর সমকক্ষতার দাবিদার। স্বাক্ষর- শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
বহাছের বিষয় ও শর্তাবলীর কপি প্রদান
অদ্য ৬/১/১৯৭৬ইং তারিখে মোহাম্মদ আজিদ আলী সাহেবের সভাপতিত্বে ১৩নং কর্মধা ইউনিয়ন অফিসে বাহাছের পয়েন্টগুলি উভয় পক্ষ প্রদান করেছিলেন।
প্রত্যেক পক্ষকে সভাপতি সাহেব এক এক কপি প্রদান করেন।
(স্বাক্ষর) মো: ইয়াকুব আলী
(স্বাক্ষর) মো: ইব্রাহিম আলী
(স্বাক্ষর) শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
বাহাছের পূর্ব মুহূর্ত
২৯ মাঘ, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬ইং রোজ বৃহস্পতিবার
সময়- সকাল ১০-৩০ মি. হতে বাহাছ আরম্ভ হয়।
উল্লেখ্য যে, পূর্বে সাব্যস্ত করা হয়েছিল বাহাছে উভয়পক্ষের মানীত সালিশ জনাব আব্দুল ওয়াহিদ সাহেব (চেয়ারম্যান ১২নং ইউনিয়ন)
পক্ষান্তরে উপস্থিত বাহাছ সভায় রবিরবাজার জামে মসজিদের ইমাম জনাব মাওলানা আব্দুল মান্নান ছাহেবকে বাহাছ পরিচালনার সভাপতি হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়।
বাহাছের সালিশ-
জনাব আব্দুল ওয়াহিদ সাহেব
বাহাছের পরিচালক-
মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান সাহেব
জ্ঞাতব্য বিষয়- ইলিয়াছি তাবলীগি জামায়াতের পক্ষ অনুরোধপত্র দেওয়া হল যে, আমরা পূর্বে মাওলানা মো: ইব্রাহিম আলী সাহেবকে বাহাছের জন্য মনোনীত করেছিলাম। কিন্তু আমাদের অসুবিধা পড়ে যাওয়ায় মুফতি আব্দুল হান্নান সাহেবকে (যাকে পূর্বে সালিশ হিসেবে মনোনীত করেছিলাম) অদ্যকার বাহাছে মুনাজির হিসেবে মনোনীত করতে চাইতেছি। অবশেষে তাদের এই দাবি মেনে নেওয়া হলো।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের পক্ষে
মুনাজির- সুলতানুল মোনাজিরীন আল্লামা শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী। সাহায্যকারী-
১. মাওলানা মুফতি আবু তাহের হুসাইনী, কুমিল্লা
২. মাওলানা উমর আলী, মৌলভীবাজার
৩. মাওলানা আব্দুল মজিদ খাঁন মির্জানগরী
তত্বাবধানে ছিলেন- শায়খুল ইসলাম আল্লামা সৈয়দ আবিদশাহ মোজাদ্দেদী আলমাদানী আলাইহির রহমত।
ইলিয়াছি তাবলীগি জামাতের পক্ষে
মুনাজির- মাওলানা মুফতি আব্দুল হান্নান সাহেব দিনারপুরী
সাহায্যকারী-
১. মাওলানা আব্দুল বারি সাহেব, প্রিন্সিপাল তালশহর আলিয়া মাদ্রাসা
২. মুফতি রহমত উল্লাহ
৩. মাওলানা ইব্রাহিম আলী
তত্বাবধানে- কর্মধা কামিল মাদ্রাসার শিক্ষক মণ্ডলী।
সুন্নীদের পক্ষে সালিশ
১. আলেমকুল শিরোমণি আল্লামা হরমুজ উল্লাহ শায়দা আলাইহির রহমত তুরখলি
২. মাওলানা আব্দুল ওয়াহিদ, বড়হাট
তাবলীগীদের পক্ষে সালিশ
১. আল্লামা মাওলানা আব্দুন নূর সাহেব ইন্দেশ্বরী
২. মাওলানা মোহাম্মদ ইব্রাহিম আলী সাহেব।
শর্ত নিয়ে মতানৈক্য
বাহাছের শর্তাবলীর মধ্যে ১ম শর্ত ছিল, বাহাছ লিখিতভাবে অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু মুফতি আব্দুল হান্নান সাহেব ও তার দলের লোক ইহা কোন মতেই মানিয়া নিতে রাজি হলেন না। কারণ তারা দেখলেন, লিখিতভাবে যা পেশ করা হবে, তা আর অস্বীকার করার কোন উপায় থাকবে না, ফলে সমাজের সামনে তাদের গোমর ফাঁক হয়ে যাবে, এবং জনগণ তাদের চালাকী বুঝে নিতে সক্ষম হবেন।
আমাদের দাবি ছিল প্রত্যেক মুনাজির নিজ নিজ দাবি ও দলিল লিখিতভাবে পেশ করবেন এবং সাথে সাথে লোকজনকে বুঝিয়ে দিবেন। অপরদিকে মুফতি আব্দুল হান্নান সাহেব এতে রাজি হলেন না বরং তিনি না লিখে শুধু মুখে বাহাছ করার জন্য বারংবার কথা কাটাকাটি করতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল এ অজুহাতের উপরই তারা বাহাছের ময়দান হতে পালিয়ে যেতে চাচ্ছেন। তাই বাধ্য হয়ে মৌখিক বাহাছ মেনে নেওয়া হল।
বাহাছের সারসংক্ষেপ
পূর্বের লেখা অনুযায়ী জনাব সিরাজনগরী সাহেবের ১৪ দফার মধ্যে ১ম দফা নিয়ে বাহাছ শুরু হয়।
দফা- ১
১. নামাযের মধ্যে নবীয়ে পাকের খেয়াল করা গরু-গাধার খেয়ালে ডুবে থাকার চেয়েও খারাপ এবং তাঁকে নামাযের মধ্যে ইচ্ছা করে তা’জিমের সঙ্গে খেয়াল করা শিরিক। এবং অনিচ্ছায় নামাযের মধ্যে নবীয়েপাকের খেয়াল এসে পড়লে এক রাকায়াতের পরিবর্তে চার রাকায়াত নফল নামায পড়তে হবে। (ওহাবীদের নেতা) মৌলভী ইসমাইল সিরাতে মুস্তাকিম কিতাবে লিখেছেন।
সুন্নী জামায়াতের উলামাদের মতে উপরোক্ত আক্বিদা কুফুরি। যে ব্যক্তি এরূপ আক্বিদা রাখবে ও এ আক্বিদাকে হক বলে সমর্থন করবে সেও কাফের হবে।
শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী
৬/১/৭৬ ইং
জওয়াব
১. হযরত ইসমাইল (র.) দেহলভীর কিতাব ছিরাতে মুস্তাকিমের মধ্যে হুজুর (দ.) সম্বন্ধে ইহা অপব্যাখ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। গরু-গাধার খেয়াল করার কথা তিনি কখনও বলেন নাই। তওহীদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়া যে বর্ণনা উল্লেখ করিয়াছেন ইহা বিকৃত করা হইয়াছে।
স্বাক্ষর: মো: ইব্রাহিম আলী
৬/১/৭৬ইং
বাহাছ আরম্ভ
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের পক্ষে- সুলতানুল মোনাজিরীন আল্লামা শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী সাহেব ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ কিতাবখানা হাতে নিয়ে উভয়পক্ষের সালিশ মধ্যস্ত সালিশ, সভার সভাপতি ও জনগণের সামনে পাঠ করে শুনালেন যে, এ কিতাবের ১৫০ পৃষ্ঠা (উর্দু) ১৯৫৬ হিজরি নভেম্বর মাসে প্রকাশিত লাহোর পাকিস্তান থেকে) লেখা রয়েছে-
بمقضاۓ ظلمات بعضها فوق بعض زنا کے وسو ے سے اپنی بی بی کی مجامعت کا خیال بہتر ہے اور شیخ يا اسى جیسے اور بزرگوں کی طرف خواہ جناب رسالت مآب ہی ہوں اپنی ہمت کو لگادینا اپنے بیل اور گدھے کی صورت میں مستغرق ہوںنے سے زیادہ برا ہے کیونکہ شیخ کا خیال تو تعظیم اور بزرگی کے ساتھ انسان کے دل میں چیٹ جاتا ہے اور بیل اور گدھے کے خیال کو نہ تو اسقدر چسپید گی ہوتی ہے اور نہ تعظیم بلکہ حقیر اور ذلیل ہوتا ہے اور غیر کی یہ تعظیم اور بزرگی جو نماز میں ملحوظ ہو وہ شرک کی طرف کھیچ کرلی جاتی ہے ـ
সিরাতে মুস্তাকিম ফারসি ৮৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-
ظلمات بعضها فوق بعض از وسوسہ از زنا خیال مجامعت زوجہ خود بہتراست وصرف ہمت بسوی شیخ وامثال آں از معظمین گو جناب رسالتمآب باشند بچند ین مرتبہ بدتراز استغراق در صورت گاؤخر خوداست کہ خیال آن با تعظیم واجلال بسوید ای دل انسان می چسپد بخلاف خیال گاؤ وخرکہ نہ آسقدر چسپید گی می بود ونہ تعظیم بلکہ مہان ومحقر میبود واین تعظیم واجلال غیر کہ در نماز ملحوظ ومقصود میشود بشرک میکشد ـ
ভাবার্থ ‘কোন অন্ধকার কোন অন্ধকারের উপরে। (অর্থাৎ অন্ধকারের মধ্যেও যেমন কম বেশি পার্থক্য থাকে, ওয়াছ ওয়াছাও অল্প খারাপ ও বেশি খারাপের পার্থক্য আছে) যেমন নামাযে যিনার ওয়াসওয়াসা বা ধারণা হতে নিজের স্ত্রীর সাথে সহবাসের খেয়াল কিছুটা ভাল। পীর বা কোন বুজুর্গানের প্রতি, এমনকি রাসূল (দ.)র স্মরণে নিজের হিম্মত বা নিজের অন্তরকে ঐদিকে ধাবিত করা নিজের গরু-গাধার সুরতে (আকৃতির খেয়ালে) ডুবে থাকার চেয়েও অধিক খারাপ। কেননা পীরের খেয়াল (এমনকি রাসূলেপাকের খেয়াল) তো শ্রদ্ধা ও সসম্মানে মানুষের অন্তরে এসে থাকে।
পক্ষান্তরে গরু-গাধার খেয়ালে এ ধরণের আকর্ষণ ও তাজিম আসে না। বরং এগুলো তুচ্ছ ও ঘৃণার সাথে খেয়াল এসে থাকে। তাই নামাজের মধ্যে এ ধরনের অন্যের (বুজুর্গান) এমনকি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)র তা’জিম বা সম্মান শিরকের দিকে ধাবিত করে নিয়ে যায়।’ العياذ بالله উক্ত কিতাবের (সিরাতে মুস্তাকিম কিতাবের) ১৫১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-
بلکہ بعض تو حضور کے ساتھ خیالات سے خالی پڑھی تھیں اور بعض خیالات سے آلودہ ہوگئ تھی تو وسوسے والی رکعتوں میں سے ہر ایک رکعت کے بدلے چار رکعتیں ادا کرے ـ
অর্থাৎ ‘কোন কোন মুসল্লী হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)র খেয়াল ছাড়াই নামায আদায় করে থাকেন। আবার কারো অনিচ্ছা সত্ত্বেও হুজুরের খেয়াল নামাযে এসে পড়ে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নামাযে হুজুরের খেয়াল এসে গেলে শয়তান তাকে ওয়াসওয়াসা দিয়েছে বলে মনে করতে হবে। ওয়াসওয়াসার দরুণ যে রাকাতে হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)র খেয়াল এসে পড়ে, এমন এক রাকাআত নামাযের পরিবর্তে চার রাকাআত আদায় করতে হবে।’ (নাউজুবিল্লাহ)
‘সিরাতে মুস্তাকিম’ নামক কিতাবের উপরোল্লেখিত এবারতের সারসংক্ষেপ হল এই-
ক) নামাযে যিনার ধারণার চেয়ে স্ত্রী-সহবাসের খেয়াল ভাল। (নাউজুবিল্লাহ)
খ) নামাযের মধ্যে রাসূলেপাকের খেয়াল করলে নামাযি মুশরিক হবে বরং নামাযে রাসূলেপাকের খেয়াল
করার চাইতে গরু-গাধার খেয়াল করা ভাল।
গ) স্বেচ্ছায় নামাযের মধ্যে রাসূলেপাকের খেয়াল করলে নামাযতো হবেই না বরং শিরিক হবে। অনিচ্ছাকৃতভাবে নামাযে হুজুরেপাকের খেয়াল এসে গেলে, এক রাকাআতের পরিবর্তে চার রাকাআত নামায পড়তে হবে। (নাউজুবিল্লাহ)
সাথে সাথে আল্লামা সিরাজনগরী সাহেব হিজরি পঞ্চ ও ষষ্ঠ শতকের পঞ্চম মুজাদ্দিদ হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী (আলাইহির রহমত) এর লিখিত ‘এহইয়ায়ে উলুমিদ্দিন’ নামক কিতাবের ১ম জিলদের ৯৯ পৃষ্ঠা খুলে দেখালেন, ইমামে গাজ্জালী বলেন-
واحضر فى قلبك النيى صلى الله عليه وسلم وشخصه الكريم وقل السلام عليك ايها النبى ورحمة الله وبركاته-
অর্থাৎ ‘তোমার কলবে হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে হাজির কর এবং তাঁর পবিত্র সুরত মোবারককে উপস্থিত জানিবে এবং বলবে হে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তোমার উপর সালাম, আল্লাহর রহমত ও বরকত।
আবার তৎক্ষণাৎই আল্লামা আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) তদীয় ‘মাদারিজুন নবুয়ত’ নামক কিতাবের ১ম জিলদের ১৬৫ পৃষ্ঠা খুলে দেখালেন ইহাতে লেখা রয়েছে-
ازجملہ خصائص این رانیز ذکر کردہ اندکہ مصلی خطاب میکند انحضرت راصلی اللہ علیہ وسلم بقول خود السلام علیک ایھا النبی وخطاب نمیکند غیر اورا ـ
অর্থাৎ ‘রাসূলেপাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ফাযায়েলের বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, মুসল্লীগণ নামাযের মধ্যে আসসালামু আলাইকা আইয়ুহান্নাবীউ’ পাঠকালে হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে সম্বোধন করবে অন্য কারো প্রতি নয়। (অর্থাৎ হুজুরে পাকের খেয়াল করেই ছালাম পেশ করবে।’)
উপরন্তু ‘আশিয়াতুল লোমআত শরহে মিশকাত’ এর ১ম জিলদের ৪০১ পৃষ্ঠায় শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) আরো উল্লেখ করেছেন বলে কিতাব পাঠ করে শোনান আল্লামা সিরাজনগরী-
بعضے از عارفاء گفتہ اند کہ ايں خطاب بجھت سریان حقیقت محمدیہ است در ذرائر موجودات وافراد ممکنات پس انحضرت در ذات مصلیان موجود وحاضراست ـ
অর্থাৎ ‘কোন কোন আরিফ ব্যক্তিগণ বলেছেন, নামাযে আসসালামু আলাইকা আইয়ু হান্নাবীউ, বলে নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লা)কে সম্বোধন রীতির প্রচলন এজন্যই করা হয়েছে যে, হাকীকতে মোহাম্মদীয়া বা হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর মূল সত্ত্বা সৃষ্টিকুলের অনুপরমাণুতে এমনকি সম্ভবপর প্রত্যেক কিছুতেই ব্যাপৃত। সুতরাং হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নামাযীগণের সত্ত্বার মধ্যে বিদ্যমান ও হাজের আছেন।’
অতঃপর আল্লামা সিরাজনগরী সাহেব ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’ ২য় জিলদের ৩০ পৃষ্ঠা খুলে দেখান, বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস শাহ ওলী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) বলেন-
ثم اختار بعده السلام على النبى صلى الله عليه وسلم تنويها بذكره واثباتا للاقرار برسالته واداء لبعض حقوقه-
অর্থাৎ ‘অতঃপর আত্তাহিয়াতের মধ্যে নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)র প্রতি সালাম পাঠ করাকে নির্ধারণ করেছেন যে, যেন নবীর জিকির তা’জিমের সাথে হয়, তাঁর রিসালতের স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তার কিছু হক আদায় হয়।’ অর্থাৎ ছালাম হলো নবীর জিকির বা স্মরণ এবং নবীর স্মরণ তা’জিমের সঙ্গে করতে হবে।
তারপর সিরাজনগরী সাহেব বিশ্ববিখ্যাত শামী কিতাবের হাশিয়া দুররে মুখতার’ ১/৪৭৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করে বলেন- নামাযে তাশাহহুদ পাঠকালে আল্লাহর হাবীবকে সালাম দেওয়ার ব্যাপারে উল্লেখ রয়েছে-
ويقصد بالفاظ التشهد الانشاء كانه يحي على الله ويسلم على نبيه نفسه لا الاخبار-
ভাবার্থ ‘ নামাযে ‘‘তাশাহহুদ’ পাঠকালে মুসল্লীগণ উদ্দেশ্যে নিবে ‘ইনশা’ এখবার নয়। অর্থাৎ কথাগুলি যেন মুসল্লী নিজেই বলতেছেন এবং নিজেই যেন আপন প্রতিপালকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন, এবং স্বয়ং নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে উদ্দেশ্য করে সালাম আরজ করছেন।’
উক্ত এবারতের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে ‘ফাতাওয়ায়ে শামীতে বলা হয়েছে-
اى لا يقصد الاخبار والحكاية عما وقع فى المعراج منه صلى الله عليه وسلم ومن ربه سبحانه ومن الملائكة عليهم السلام
অর্থাৎ ‘তাশাহহুদ’ পাঠের সময় নামাযীর যেন এ নিয়ত না হয় যে, তিনি শুধুমাত্র মে’রাজের অলৌকিক ঘটনাটি স্মরণে করে সে সময়কার মহা প্রভু আল্লাহ হুজুরেপাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও ফেরেশতাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত কথোপকথনের বাক্যগুলো প্রকাশ করে যাচ্ছেন। বরং তাঁর নিয়ত হবে কথাগুলো যেন তিনি নিজেই বলছেন।’
স্বনামধন্য ফকীহগণের উপরোল্লেখিত ভাষ্য থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হল যে, নামাযে ‘তাশাহহুদে সালাম পেশ করাকালীন তা’জিমের সাথে একমাত্র হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর প্রতি খেয়াল করতে হবে। অন্য কারো প্রতি নয়।
তাবলীগ জামাতের পক্ষে মুফতি আব্দুল হান্নান সাহেব
মুফতি সাহেব বলেন, সিরাতে মুসতাকিম’ কিতাবে লেখা রয়েছে, নামাযে রাসূলেপাকের খেয়াল করলে নামাজিকে শিরকের দিকে নিয়ে যায়। নামাযী মুশরিক হবে এ কথা লেখা নেই।
(এ বলে একটি বর্ণনা দেন কিন্তু ‘সিরাতে মুসতাকিম’ ছাড়া অন্য কোন কিতাবের হাওয়ালা বা রেফারেন্স দিয়ে কোন কথা বলেন নাই। তাই তার পূর্ণ বিবরণ উদ্ধৃত করা হয় নাই।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের পক্ষে আল্লামা শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী সাহেব
উত্তরে সিরাজনগরী সাহেব বলেন, মুফতি সাহেব কি বুঝাইতে চাচ্ছেন। যে কাজ শিরকের দিকে নিয়ে যায়, সে কাজেইতো মানুষ মুশরিক হয়। যে কাজ মানুষকে শিরকের দিকে নিয়ে যায় সেই কাজে কি মানুষ ঈমানদার হবে? আশ্চর্যের বিষয়।
অতঃপর সিরাজনগরী সাহেব মিশকাতশরীফের ১০২ পৃষ্ঠা হতে একখানা হাদীসের শেষাংশ পাঠ করে শুনালেন-
অর্থাৎ ‘ হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন- হুজুরেপাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর রোগের সময় সিদ্দিকে আকবর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর নিকট লোক পাঠালেন তিনি যেন লোকদের নামায পড়িয়ে দেন। বার্তাবাহক আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর নিকট পৌঁছে বললেন, হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আপনাকে নামায পড়িয়ে দিতে আদেশ করেছেন। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাদিয়াল্লাহু আনহু) যেহেতু একজন কোমল হৃদয় লোক ছিলেন, এজন্য তিনি নামায পড়াতে অক্ষমতা প্রকাশ করলেও অবশেষে নামায পড়াতে বাধ্য হলেন। সুতরাং আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) সতের দিনের নামায পড়ালেন। তারপর একদিন হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কিছুটা সুস্থতাবোধ করলেন এবং দুই ব্যক্তির কাঁধে ভরদিয়ে মাটিতে পা মোবারক ছেছড়াতে ছেছড়াতে মসজিদে প্রবেশ করলেন-
فاردا ابو بكر ان يتاخر فاوما اليه النبى صلى الله عليه وسلم ان مكانك ثم اتى به حتى جلس الى جنبه فقيل للاعمش فكان النبى صلى الله عليه وسلم يصلى وابوبكر يصلى بصلاته والناس يصلون بصلوة ابى بكر فقال برأسه نعم ... الى ان ... وزاد ابو معاوية جلس عن يسار الى ابى بكر فكان ابو بكر يصلى قائما (بخارى ص۱/ ۹۱)
মিশকাত শরীফের ১০২ পৃষ্ঠায় আরো বর্ণিত আছে-
حتى جلس عن يسار ابى بكر فكان ابو بكر يصلى قائما وكان رسول الله صلى الله عليه وسلم يصلى قاعدا يقتدى ابو بكر بصلوة رسول الله صلى الله عليه وسلم والناس يقتدون بصلوة ابى بكر متفق عليه وفى رواية لهما يسمع ابو بكر الناس التكبير
অর্থাৎ ‘যখন হযরত আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আগমনের পদধ্বনি শুনতে পেয়ে নিজে পিছনে সরতে উদ্যোত হলেন তখন হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) না সরতেই ইঙ্গিত করলেন। অতঃপর তিনি অগ্রসর হয়ে আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর বামদিকে বসে পড়লেন।
এমন সময় হযরত আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) দাঁড়িয়েই নামায পড়ছিলেন। আর হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বসে (ইমাম হিসেবে) নামায পড়তে থাকলেন। অর্থাৎ হযরত আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর নামাযের এক্তেদা করলেন এবং সাহাবায়ে কেরাম রেদওয়ানুল্লাহি আলাইহিম আজমাঈন হযরত আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর অনুসরণ করলেন।’
‘বোখারী ও মুসলিমের অপর বর্ণনায় আছে- হযরত আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) মুকাব্বির হয়ে লোকদিগকে হুজুরের তাকবীর শুনাতে লাগলেন।’
উপরোক্ত হাদীস শরীফের স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হল যে, নামায পড়া অবস্থায় হুজুরেপাকের খেয়াল করতে হবে। তা’জিম ও করতে হবে। যেমন সিদ্দিকে আকবর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) নামাযের ভিতরে ছরকারে কায়েনাতের সম্মান করতে গিয়ে পিছনে সরতে উদে্যুাত হয়েছিলেন।
নামায পড়া অবস্থায় সাহাবায়ে কেরামগণ হুজুরেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেয়াল তা’জিমের সঙ্গে করলেন। এমনকি হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু সহ সমস্ত সাহাবাগণ নামায পড়া অবস্থায় নিয়ত পরিবর্তন করে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ইমামরূপে গণ্য করে নামায আদায় করলেন। অথচ নামাযের পর ছরকারে কায়েনাত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিদ্দিকে আকবর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর উপর শিরকের ফতোয়া দেননি।
দেখুন ইসমাইল দেহলভীর ফতোয়া ‘নামাযে রাসূলেপাকের খেয়াল তা’জিমের সঙ্গে করা শিরিক’ তার এ ফতোয়া অনুযায়ী সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম মুশরিক হয়ে গেলেন। (নাউজুবিল্লাহ)
তাবলীগ জামাতের পক্ষে মুফতি আব্দুল হান্নান সাহেব
মুফতি সাহেব বলেন, সিরাতে মুসতাকিম’ কিতাব হক্ব, যা স্বয়ং সৈয়দ আহমদ বেরলভী (র.) এর মলফুজাত বা ভাষ্য এবং মাওলানা ইসমাঈল দেহলভী লিখেছেন অর্থাৎ সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেব তার শাগরিদ ও খলিফা মাওলানা ইসমাঈল দেহলভী দ্বারা সিরাতে মুস্তাকিম কিতাবখানা লিখাইয়াছেন।
অতঃপর মুফতি সাহেব তার দাবির সপক্ষে তারই বিশিষ্ট খলিফা ও সাগরিদ মাওলানা কেরামত আলী জৈনপুরী সাহেবের লিখিত ‘জখিরায়ে কেরামত’ কিতাবখানা হাতে নিয়ে উহার ১ম জিলদের ২০ পৃষ্ঠা (মুকাশাফাতে রহমত) খুলে দেখালেন যে, উহাতে লেখা রয়েছে, জৈনপুরী সাহেব বলেন-
اور صراط المستقیم کہ اسکے مصنف حضرت سید صاحب اور اسکے کاتب مولانا محمد اسمعیل محدث دہلوی ہیں
অর্থাৎ ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ এর মুছান্নিফ বা মূল গ্রন্থকার হযরত সৈয়দ আহমদ সাহেব (সৈয়দ আহমদ বেরলভী) এবং এর লিখক মাওলানা মোহাম্মদ ইসমাঈল মুহাদ্দিসে দেহলভী।’
অতঃপর মুফতি সাহেব বলেন- জখিরায়ে কেরামত ৩/১৬২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-
سید احمد قدس سرہ کی کتاب صراط مستقیم کو جسکو مولانا محمد اسمعیل رحمہ اللہ نے لکھاہے
অর্থাৎ ‘সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেবের কিতাব ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ যা মাওলানা মোহাম্মদ ইসমাঈল দেহলভী সাহেব লিখেছেন।’
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের পক্ষে শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী সাহেব
মুফতি সাহেবের জওয়াবে সিরাজনগরী সাহেব ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ কিতাবখানা হাতে নিয়ে দেখালেন যে, উক্ত কিতাবের কভার পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে (مصنفه ) মুছান্নিফহু ইসমাঈল শহীদ অর্থাৎ সিরাতে মুস্তাকিম কিতাবখানা ইসমাঈল দেহলভী লিখেছেন।’
তাবলীগ জামাতের পক্ষে মুফতি আব্দুল হান্নান সাহেব
মুফতি সাহেব আর একখানা সিরাতে মুস্তাকিম কিতাব হাতে নিয়ে দেখালেন, সে কিতাব ইসলামী একাডেমী ৪০ উর্দু বাজার লাহোর থেকে প্রকাশিত তার কভার পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে-
(شاہ اسمعیل شہید ـ سید احمد شہید)
সৈয়দ আহমদ শহীদ ও শাহ ইসমাঈল শহীদ উভয়ের নাম কভার পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের পক্ষে শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী সাহেব
সিরাজনগরী সাহেব বলেন আমার হাতে সিরাতে মুস্তাকিম কিতাবের যে নুছকা আছে সে কিতাব থেকে বলছি।
এভাবে উভয়ের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয় অবশেষে মাওলানা আব্দুন নুর ইন্দেশ্বরী, আল্লামা হরমুজ উল্লাহ শায়দা সাহেব ও উভয়ের পক্ষের সালিশ জনাব আব্দুল ওয়াহিদ সাহেব ও সভাপতি মাওলানা আব্দুল মান্নান সাহেবসহ কয়েকজন বিশিষ্ট আলেম সাহেবান এক নিরালা ঘরে প্রবেশ করে নিম্নে প্রদত্ত রায়টি লিখে প্রকাশ করেন, এবং রবিরবাজার হাফিজিয়া মাদ্রাসা প্রধান শিক্ষক জনাব হাফেজ আনছার উদ্দিন সাহেব উক্ত রায়টি জনগণের সামনে পাঠ করে শুনান।
রায়নামা
৭৮৬
ছিরাতে মুস্তাকিম নামক কিতাব নামাযের মধ্যে হুজুর (দ.)এর খেয়াল গরু-গাধার খেয়াল অপেক্ষা আরও খারাপ। এই কথাটি নেহাত খারাপ এবং দোষনীয়। কিতাবের লেখক যেই হউক না কেন সে দোষী এবং কিতাবও দোষী।
এই কথাটি যাহার দ্বারাই লিখা হইয়াছে তিনি দোষী বটে। দায়ী বটে।
স্বাক্ষর- মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান
ইমাম, রবিরবাজার জামে মসজিদ
১২/২/৭৬ইং
আ: ওয়াহিদ
১২/২/৭৬ইং
অতঃপর শায়দা সাহেবের নিকট প্রশ্ন করা হল ১ম মাসআলার ফয়সলা দ্বারা বুঝা গেল মাওলানা শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম
সিরাজনগরী সাহেবের দাবি সত্য কিন্তু অন্যান্য আর ১৩টি মাসআলার ফয়সলা কি জানতে বাসনা।
উত্তরে উস্তাযুল উলামা আল্লামা শায়দা সাহেব বলেন বাকি ১৩টি মাসআলার ফয়সলা অনুরূপ বুঝে নিবেন।
রায়নামা প্রকাশ হওয়ার পর মাওলানা ইব্রাহিম আলী সাহেব, মুফতি আব্দুল হান্নান সাহেব ও তাদের দল তখনই সভা হতে চলে যেতে দেখা যায়।
তারপর পুলিশ ইনচার্জ সাহেবের অনুরোধে শায়খুল ইসলাম আল্লামা সৈয়দ আবিদশাহ মোজাদ্দেদী আল মাদানী সাহেব আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকাইদের মাসআলার উপর এক মখতছর ভাষন দান করেন। অবশেষে মিলাদশরীফ ও দোয়া পাঠান্তে মাহফিল সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়।
সংকলক
হাফিজ মাওলানা তালিব উদ্দিন।
উপসংহার:
নামাযে রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেয়াল তা’জিমের সাথে করাই আল্লাহপাকের বন্দেগী এ সম্পর্কে হাদিসে কারীমা লক্ষ্য করুন-
حدثنا ابو اليمان قال اخبرنا شعيب عن الزهرى قال اخبرنى انس بن مالك الانصارى وكان تبع النبى صلى الله عليه وسلم وخدمه وصحبه ان ابا بكر كان يصلى لهم فى وجع النبى صلى الله عليه وسلم الذى توفى فيه حتى اذا كان يوم الاثنين وهم صفوف فى الصلوة فكشف النبى صلى الله عليه وسلم ستر الحجرة ينظر الينا وهو قائم كان وجهه ورقة مصحف ثم تبسم يضحك فهممنا ان تفتتن من الفرح برؤية النبى صلى الله عليه وسلم فنكص ابو بكر على عقبيه ليصل الصف وظن ان النبى صلى الله عليه وسلم خارج الى الصلوة فاشار الينا النبى صلى الله عليه وسلم ان اتموا صلاتكم وارخى الستر فتوفى من يومه صلى الله عليه وسلم. (بخارى شريف ص ۱/۹۳-۹۴)
ভাবার্থ: ‘হযরত আনাস ইবনে মালিক আনসারী রাদিয়াল্লাহু আনহু যিনি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর (আক্বিদা ও আমলের) পূর্ণ অনুসারী ছিলেন এবং একাধারে দশ বৎসর আল্লাহর হাবীবের খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন আর তিনি তাঁর একজন জলিল কদর সাহাবিও ছিলেন।
তিনি বলেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অন্তিম রোগ থাকাকালীন অবস্থায় হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু সাহাবায়ে কেরামগণকে নিয়ে (ইমাম হয়ে) নামায আদায় করতেন।
অবশেষে সোমবার দিনে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু এর ইমামতিতে সাহাবায়ে কেরামগণ নামাযরত অবস্থায় কাতারবন্দী ছিলেন। তখন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুজরা শরীফের পর্দা উঠিয়ে দাঁড়ানো অবস্থায় আমাদের দিকে তাকালেন। এ সময়ে তাঁর (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের) চেহারা মোবারক মাসহাফ তথা কোরআন কারীমের স্বচ্ছ পৃষ্ঠার ন্যায় ঝলমল করছিল। অতঃপর তিনি মুচকি হাসছিলেন।
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নূরানী চেহারা মোবারক দর্শনে আমরা (সাহাবায়ে কেরামগণ) স্বেচ্ছায় আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম।
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (হুজরা মোবারক থেকে) নামাযের জামায়াতে আসবেন এ ভেবে হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু (ইমামতির স্থান থেকে) পিছন দিকে সরে নামাযের প্রথম কাতারে প্রত্যাবর্তন করলেন। তখন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে ইশারায় বললেন اتموا صلاتكم তোমরা তোমাদের অসম্পূর্ণ নামাযকে পূর্ণ করে নাও। অতঃপর আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্দা মোবারক ফেলে দিলেন।
সে দিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওফাত শরীফ হয়েছিল। (বোখারী শরীফ ১/৯৩ পৃ.)
উপরোক্ত হাদিসশরীফের মাধ্যমে শরিয়তের যে কয়েকটি মাসআলা প্রমাণিত হলো তা নিম্নরূপ-
১. হুজুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন অন্তিম বিমার শরীফে শয্যা শায়িত ছিলেন তখন হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু সতের মতান্তরে একুশ ওয়াক্তের নামাযের জমায়াতে আল্লাহর হাবীবের নির্দেশ মোতাবেক ইমামতি করেছেন এজন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওফাত শরীফের পর হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু ই হলেন তাঁর সর্বপ্রথম খলিফা। যাকে খলিফাতুর রাসূল বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। (اصح السير ‘আছাহহুছ ছিয়র’)
২. সাহাবায়ে কেরামগণ যখন আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু এর ইমামতিতে সোমবার দিনে ফজরের ফরয নামাযের জামায়াতে কাতারবন্দী অবস্থায় ছিলেন। ঝুলন্ত পর্দা আবৃত হুজুর পুরনুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়ানো অবস্থায় পর্দা উঠিয়ে উক্ত জামায়াতের দিকে নূরানী হাস্যেজ্জ্বল চেহারা মোবারক নিয়ে তাকালেন। এমতাবস্থায় সাহাবায়ে কেরামগণ স্বপ্রণোদিত হয়ে নামাযের কাজকর্ম স্থগিত রেখে আল্লাহর হাবীবের দিকে মনোনিবেশ করলেন এবং আনন্দে আত্মহারা হলেন। আর আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু আল্লাহর হাবীবের দর্শনে ইমামতির স্থান থেকে পিছনের দিকে প্রথম কাতারে প্রত্যাবর্তন করলেন।
এ থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো-
হাবীবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেয়াল ও তা’জিম সাহাবায়ে কেরামগণ নামাযের ভিতরেই করেছেন কেননা নামাযের ভিতরে তা’জিমের সঙ্গে রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেয়াল করাই আল্লাহর বন্দেগী।
৩. যখন নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুজরা মোবারকে পর্দার ভিতরে ছিলেন, এমতাবস্থায় সাহাবায়ে কেরামগণ মসজিদে নববীতে ফজরের ফরয নামাযের জমায়াত হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু এর ইমামতির মাধ্যমে পড়তে ছিলেন।
যে মুহূর্তে হাবীবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্দা উঠিয়ে নামাযের জামায়াতের দিকে তাকালেন এবং সাহাবায়ে কেরামগণ আল্লাহর হাবীবকে দেখতে পেলেন, তখন সাহাবায়ে কেরামগণ নামাযের কাজকর্ম স্থগিত করে নবীর তা’জিমে তাঁর দিকে মুখ ফিরে নবীর মহব্বতে স্বেচ্ছায় আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লেন।
আবার যখন আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্দা মোবারক ফেলে দিলেন এবং অসম্পূর্ণ নামায আদায়ের নির্দেশ দিলেন, তখনই সাহাবায়ে কেরামগণ বাকী নামায সম্পূর্ণ করলেন।
এতে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো-
নবীকে দেখতে না পেলে নামায রাসূলের ইমামতি ব্যতিরেকই আদায় করবে। এতে কোন ত্রুটি বিচ্যুতি নেই। আর যখনই রাসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখা যাবে নামায স্থগিত রেখে রাসূলের ইমামতি গ্রহণ করতে হবে এটাই আদব।
মোদ্দাকথা: আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নেককার সালেহীন উম্মতের যানাযায় হাজির হয়ে উক্ত নামাযে যানাযাকে মহান আল্লাহর দরবারে কবুল ও মঞ্জুর করিয়ে নেন। (আল হাবী লিল ফাতাওয়া) এটাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদা।
এ প্রসঙ্গে কোন কোন বাতিলপন্থীরা প্রশ্ন তোলে যে, যদি আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নেককারের যানাযায় হাজির হয়ে থাকেন, তাহলে হাবীবে খোদার ইমামতি ছাড়া নামায পড়া হয় কেন?
এর উত্তরে আমরা বলব- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাজির হওয়া স্বত্ত্বেও আমরা চাক্ষুস তাঁকে দেখি না, তাই নিজেদের ইমামতির মাধ্যমে নামায সম্পন্ন করি। যদি আমরা আল্লাহর হাবীবকে চাক্ষুস দেখতাম, তাহলে নামাযে যানাযা স্থগিত করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইমামতিতে নামায আদায় করতাম।
যেমনিভাবে আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জামায়াতের অতি নিকটবর্তী হুজরা মোবারকে পর্দা আবৃত অবস্থায় হাজির থাকা সত্ত্বেও হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু এ ইমামতিতে সাহাবায়ে কেরামগণ মসজিদে নববীতে নামায পড়তেছিলেন। আর আল্লাহর নবী যখন পর্দা মোবারক সরিয়ে জামায়াতের দিকে তাকালেন এবং সাহাবায়ে কেরামগণ আল্লাহর হাবীবের দর্শনে ধন্য হলেন তখনই সকল সাহাবায়ে কেরাম নামাযের কাজকর্ম স্থগিত করে আল্লাহর হাবীবের নূরানী চেহারা মোবারক দেখে দেখে আত্মহারা হয়ে পড়লেন, অপরদিকে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু আল্লাহর হাবীবের ইমামতির মাধ্যমে নামায আদায় করবেন ধারণায় ইমামতির স্থান ছেড়ে পেছনের কাতারে প্রত্যাবর্তন করলেন।
আবার যখন হাবীবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসম্পূর্ণ নামায সম্পন্ন করার জন্য নির্দেশ দিয়ে হুজরা মোবারকের পর্দা ফেলে দিলেন এবং সাহাবায়ে কেরামগণ চাক্ষুসভাবে নবীকে দেখতে পেলেন না, এমতাবস্থায় সাহাবায়ে কেরামগণ আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু ইমামতিতে নামায সম্পন্ন করলেন। সুতরাং নেককারের যানাযাতে নবীর আগমন সত্য যেহেতু আমরা নবীকে চর্ম চক্ষুতে দেখি না, এজন্য আমরা নিজেদের ইমামতিতেই নামায আদায় করে থাকি। যদি নবীকে চাক্ষুসভাবে দেখার নসীব আমাদের হয়ে যেত তাহলে সাহাবায়ে কেরামগণের অনুকরণে নবীর ইমামতিতেই আমারা নামায আদায় করে নিতাম।
অপর একটি হাদিস
عن ابى حازم بن دينار عن سهل بن سعد الساعدى ان رسول الله صلى الله عليه وسلم ذهب الى بنى عمرو بن عوف ليصلح بينهم فحانت الصلوة فجاء المؤذن الى ابى بكر فقال اتصلى للناس فاقيم قال نعم فصلى ابو بكر فجاء رسول الله صلى الله عليه وسلم والناس فى الصلوة فتخلص حتى وقف فى الصف فصفق الناس وكان ابوبكر لايلتفت فى صفوته فلما اكثر الناس التصفيق التفت فراى رسول الله صلى الله عليه فاشار اليه رسول الله صلى الله عليه وسلم ان امكث مكانك فرفع ابوبكر يديه فحمد الله على ما امره به رسول الله صلى الله عليه وسلم من ذلك ثم استاخر ابو بكر حتى استوى فى الصف وتقدم رسول الله صلى الله عليه وسلم فصلى فلما انصرف قال يا ابا بكر ما منعك ان تثبت اذا امرتك فقال ابو بكر ما كان لابن ابى قحافة ان يصلى بين يدى رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم مالى رأيتكم اكثر ثم التصفيق من نابه شئ فى صلاته فليسبح فانه اذا سبح التفت اليه وانما التصفيق للنساء. (بخارى شريف ۱/۹۴)
ভাবার্থ: ‘হযরত সাহাল ইবনে সা’দ সাঈদী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- নিশ্চয় একদা রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমর ইবনে আউফ গোত্রের একটি বিবাদ মিমাংসার জন্য তাদের বস্তিতে তাশরীফ নিয়েছিলেন, এদিকে নামাযের ওয়াক্ত হয়ে গেল। তখন মোয়াজ্জিন হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু এর নিকট গিয়ে অবস্থা ব্যক্ত করে বললেন, আপনি জামায়াত পড়াইয়া নিন। এতে আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু সম্মতি জ্ঞাপন করে বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। তখন আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু ইমাম হয়ে নামায আরম্ভ করলেন।
এমতাবস্থায় রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তথায় তাশরীফ আনলেন, যখন সাহাবায়ে কেরাম নামাযরত অবস্থায় ছিলেন।
আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পিছনের কাতারগুলো অতিক্রম করে প্রথম কাতরে এসে দাঁড়ালেন, সে সময় (হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহুকে রাসূলেপাকের আগমন অবগত করানো জন্য) কিছু সংখ্যক মুসল্লী (সাহাবায়ে কেরাম) হাতের উপর হাত মেরে শব্দ করলেন (হাততালি দিলেন)।
(উল্লেখ্য যে) হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু নামাযরত অবস্থায় কোন দিকে ফিরে তাকাতেন না। কিন্তু অধিকাংশ সাহাবায়ে কেরাম নামাযরত অবস্থায় যখন হাততালি দিতে লাগলেন তখন তিনি (আবু বকর) ফিরে তাকিয়ে আল্লাহর হাবীবকে দেখতে পেলেন। (এবং তৎক্ষণাৎই তিনি পিছনের দিকে সরে যেতে লাগলেন)
(এমতাবস্থায়) রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে (আবু বকরকে) নিজের অবস্থানে স্থির থাকতে ইশারায় নির্দেশ দিলেন। রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইশরার কৃতজ্ঞতা স্বরূপ দুইহাত উত্তোলন করে আল্লাহপাকের প্রশংসা করে পিছনে ফিরে প্রথম কাতারে এসে দাঁড়ালেন।
তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সামনে এগিয়ে গিয়ে ইমামতি করে নামায আদায় করলেন। নামায শেষ করে তিনি বললেন হে আবু বকর! আমার নির্দেশ পালনে কিসে তোমাকে বাধা দিয়েছিল? আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু জবাবে বললেন, আবু কুহাফার পুত্রের জন্য আল্লাহর হাবীবের সামনে দাঁড়িয়ে (নিজে ইমাম হয়ে) নামায আদায় করা শোভা পায় না।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামগণের উদ্দেশ্যে বললেন- আমি তোমাদেরকে (নামাযের ভিতরে) হাতে তালি দিতে দেখলাম, ব্যাপার কি? শোন! নামাযের মধ্যে যদি কাউকে কোন কিছু থেকে ফিরাতে হয় তাহলে (পুরুষগণ) ‘সুবহানাল্লাহ’ বলবে। সুবহানাল্লাহ বললেই তার দিকে দৃষ্টি দেওয়া হবে। আর হাতে তালি দেওয়া তো মহিলাদের জন্য। (কেননা মহিলাদের কণ্ঠস্বর বেগানা পুরুষদের শুনানো অনুচিত। (বোখারশরীফ ১/৯৪ পৃ.)
উপরোক্ত হাদিসশরীফ দ্বারা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো-
১. নামাযরত অবস্থায় সাহাবায়ে কেরামগণ রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেয়াল তা’জিমের সাথে ইচ্ছা করেই করেছেন। কারণ হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কাতার ভেদ করে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তখন সাহাবায়ে কেরাম নামাযরত অবস্থায় কাতার ফাঁক করে দিয়েছিলেন যাতে সামনে অগ্রসর হওয়া সহজ হয়।
২. নামাযের ভিতরে ইচ্ছা করে তা’জিমের সাথে রাসূলেপাকের খেয়াল করাই সাহাবায়ে কেরামগণের আক্বিদা ও আমল। এজন্যই তো হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু নিজ ইমামতির স্থান ছেড়ে পিছনের কাতারে স্বেচ্ছায় তা’জিম রক্ষার জন্য এসে দাঁড়ালেন এবং নামাযের ভিতরেই নিজের ইমামতি স্থগিত করে আল্লাহর হাবীবকে ইমামতি দিয়ে দিলেন, আর আল্লাহর হাবীবও স্বেচ্ছায় ইমামতি করে নামায সমাপন করলেন।
দেখুন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রথমে ছিলেন ইমাম, আল্লাহর হাবীব নামাযের জামায়াতে আসার দরুণ নিজে ইমামতি ছেড়ে আল্লাহর হাবীবকে ইমামতি দিয়ে দিলেন সুবহানাল্লাহ! দেখলেন তো নামাযের ভিতরে সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহর হাবীবকে কিভাবে স্বেচ্ছায় তা’জিম করলেন।
এতে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো- নামাযের ভিতরে আল্লাহর হাবীবের তা’জিমই আল্লাহর বন্দেগী।
৩. সুতরাং যারা বলে নামাযে ইচ্ছা করে তা’জিমের সাথে আল্লাহর রাসূলের খেয়াল করলে মুশরিক হবে এবং অনিচ্ছায় খেয়াল এসে পড়লে যে রাকাআতে খেয়াল আসল এ এক রাকাতের স্থলে চার রাকাআত নফল নামায আদায় করতে হবে।
এ রকম বিভ্রান্তিকর ফতওয়া দ্বারা সাহাবায়ে কেরামগণ মুশরিক সাব্যস্থ হয়ে যান। (নাউজুবিল্লাহ) যা ইসলামবিরোধী আক্বিদা।
এরূপ ঘৃণ্য ফতওয়া দিয়েছেন মাওলানা কেরামত আলী জৈনপুরী জখিরায়ে কেরামত ১/২৩১ পৃষ্ঠা, বাংলা জখিরায়ে কেরামত ১ম খণ্ড ২৯-৩০ পৃষ্ঠা। সৈয়দ আহমদ বেরলভীর মলফুজাত এবং মাওলানা ইসমাঈল দেহলভীর লিখিত কিতাব সিরাতে মুস্তাকিম ১৬৭-১৬৮ পৃষ্ঠা।
_______________
ইজহারে হক্ব
লেখক : অধ্যক্ষ শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী (মা:জি:আ:)
🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন