জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম মাহবুবে খোদার শিক্ষক নন

 

জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম মাহবুবে খোদার শিক্ষক নন

 ফুলতলীর পীর সাহেব ‘খুৎবাতুল ইয়াকুবিয়া’ ২য় সংস্করণ ৫৭ পৃষ্ঠায় রবিউল আউয়াল চাঁদের চতুর্থ খুৎবায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মু’জিযা প্রসঙ্গে علمه شديد القوى (আল্লামাহু শাদিদুল কুওয়া) আয়াতে কারীমার ভাবার্থকে বিকৃত করে যা লিখেছেন তা নিম্নরূপ-

 ‘তাকে (নবীকে) সুঠামদেহী শক্তিশালী (জিব্্রাঈল) তা (কোরআন) শিক্ষা দিয়েছেন।’ 

 তার এ বক্তব্য সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল যে, হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উস্তাদ বা শিক্ষক এবং আল্লাহর হাবীব হচ্ছেন জিব্রাঈল আলাইহিস সালামের ছাত্র। (নাউজুবিল্লাহ) এ আক্বিদা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদার সম্পূর্ণ পরিপন্থি।

 এ প্রসঙ্গে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মু’তাবর বা নির্ভরযোগ্য আক্বাঈদের কিতাব شرح العقائد النسفية (শরহে আক্বাঈদে নাসাফী) নামক কিতাবে মানুষের রাসূল উত্তম না ফেরেশতাদের রাসূল উত্তম শীর্ষক আলোচনায় ইলমে কালাম বা আকাঈদ শাস্ত্রের সুমহান পণ্ডিত আল্লামা সায়াদ উদ্দিস মাসউদ বিন উমর তাফতাজানী রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ৭৯১ হিজরি) উল্লেখ করেন-


 وذهب المعتزلة والفلاسفة وبعض الاشاعرة الى تفضيل الملائكة وتمسكوا بوجوه ... الثانى ان الانبياء مع كونهم افضل البشر يتعلمون ويستفيدون منهم بدليل قوله تعالى علمه شديد القوى ... ولا شك ان المعلم افضل من المتعلم. الجواب : ان التعليم من الله تعالى والملائكة انما هى المبلغون. 


 ভাবার্থ- বাতিল দলসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মু’তাজিলী এবং দার্শনিক ও আশায়েরা নামধারী কোন কোন ব্যক্তি এই অভিমত পোষণ করেন যে, মানুষের চেয়ে ফেরেশতাগণ উত্তম। তারা এ দাবির স্বপক্ষে কয়েকটি দলিলও পেশ করেছেন। এর মধ্যে তাদের দ্বিতীয় দলিল হচ্ছে- নবীগণ মানুষের মধ্যে আফজল বা উত্তম হওয়া সত্ত্বেও তারা ফেরেশতাদের নিকট হতে শিক্ষালাভ করেন এবং এতে উপকৃতও হয়ে থাকেন। মু’তাজিলী ও দার্শনিক তাদের এ দাবি প্রমাণ করতে গিয়ে علمه شديد القوى (আল্লামাহু শাদিদুল কুওয়া) এ আয়াতে কারীমার বিকৃত অর্থ করে হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালামকে রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উস্তাদ বা শিক্ষক বানাতে চায় এবং তারা যুক্তি পেশ করে বলে- لا شك ان المعلم افضل من المتعلم নিঃসন্দেহে শিক্ষক ছাত্র থেকে উত্তম। জিব্রাঈল আলাইহিস সালামকে শিক্ষক ও আল্লাহর হাবীবকে ছাত্র বানানোর পায়তারা করে নবী থেকে জিব্রাঈলকে উত্তম ঘোষণা দিয়ে নবীর সুমহান মর্যাদাকে ক্ষুণœ করেছে। মু’তাজিলী ও দার্শনিকদের উপরোক্ত দলিলগুলি যে ভ্রান্ত এবং আয়াতে কারীমার যে অপব্যাখ্যা করা হয়েছে এর খণ্ডন করতে গিয়ে আল্লামা তাফতাজানী এই কিতাবে উল্লেখ করেন-


 الجواب : ان التعليم من الله تعالى والملائكة انما هى المبلغون. (شرح العقائد النسفية) 


 অর্থাৎ ‘মু’তাজিলী ও দার্শনিকদের উক্তি ভ্রান্ত। আয়াতে কারীমার সঠিক ভাবার্থ ও ইসলামী সঠিক আক্বিদা হলো নিশ্চয় এখানে কোরআন শিক্ষা দেওয়া হয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে। আর ফেরেশতাগণ শুধু পৌঁছিয়ে দিয়েছেন।’ ইহাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের বিশুদ্ধ অভিমত।

 আল্লাহর হাবীবকে ছাত্র এবং জিব্রাঈল আলাইহিস সালামকে শিক্ষক খুতবায় লিপিবদ্ধ করা এবং মুসল্লিয়ানদেরকে ইমাম সাহেবানগণ পড়িয়ে শুনানো যে কত বড় মারাত্মক অপরাধ তা ঈমানদার মুসলমানগণ নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করলেই সঠিক মাসআলা বুঝতে সক্ষম হবেন।

 প্রকাশ থাকে যে, জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম আল্লাহর হাবীবকে কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন বলে দাবি করা বিদআতী, মু’তাজিলী ও ভ্রান্ত দার্শনিক সম্প্রদায়ের আক্বিদা, সুন্নি আক্বিদা নয়।

 উল্লেখ্য যে, হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম নিজেই উক্তি করেছেন كيف علمت مالم اعلم (ইয়া রাসূলাল্লাহ আমি যা জানি না আপনি তা কেমন করে জানলেন?) এ প্রসঙ্গে আল্লামা শায়খ ইসমাঈল হাক্বী রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ১১৩৭ হিজরি) তদীয় ‘তাফসিরে রুহুল বয়ান’ নামক কিতাবের পঞ্চম জিলদের ৩১৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-


 ما روى فى الاخبار ان جبريل عليه السلام نزل بقوله تعالى (كهيعص) فلما قال كاف قال النبى عليه السلام (علمت) فقال ها فقال (علمت) فقال يا فقال (علمت) فقال عين فقال (علمت) فقال صاد فقال (علمت) فقال جبريل كيف علمت مالم اعلم. 


 অর্থাৎ ‘বিশিষ্ট তাফসিরকারক আল্লামা ইসমাইল হাক্বী রাদিয়াল্লাহু আনহু كهيعص (কাফ, হা, ইয়া, আইন, ছোয়াদ) এর শানে নুযুল প্রসঙ্গে একখানা সহীহ হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ওহী নিয়ে আল্লাহর হাবীবের দরবারে এসে যখন বললেন- كاف (কাফ) তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- علمت (আলিমতু) আমি বুঝে গেছি। যখন তিনি বললেন ها (হা) আল্লাহর হাবীব বললেন- علمت আমি বুঝে গেছি। যখন তিনি বললেন- يا (ইয়া) আল্লাহর হাবীব বললেন علمت আমি বুঝে ফেলেছি। যখন তিনি বললেন عين (আইন) হাবীবে খোদা বললেন علمت আমি বুঝেছি। যখন তিনি বললেন- صاد (ছোয়াদ) তখন মাহবুবে খোদা বললেন علمت আমি বুঝেছি।

 অতঃপর জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম আরজি পেশ করলেন كيف علمت مالم اعلم ইয়া রাসূলাল্লাহ আপনি কেমন করে এ হরূফে মুকাত্তায়াত এর অর্থ বুঝে ফেললেন যা আমি জিব্রাঈল আমিন এর অর্থ সম্মন্ধে অবগত নই। অর্থাৎ আমি ওহী নিয়ে আসলাম অথচ আমি এ হরূফে মুকাত্তায়াতের অর্থ জানি না আপনি পূর্ব থেকেই জানেন? (সুবহানাল্লাহ)

 উপরোল্লেখিত হাদিসভিত্তিক তাফসিরের আলোকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হল যে, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহপাক কোন মাধ্যম ছাড়াই কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন। হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম শুধুমাত্র আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে আল্লাহর হাবীবের দরবারে ওহী পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। দেখুন পূর্বেই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বাঈদের গ্রহণযোগ্য কিতাব শরহে আক্বাইদে নাসাফীর এবারত উল্লেখ করা হয়েছে-


 ان التعليم من الله تعالى والملائكة انما هى المبلغون. 


 কোরআন শিক্ষা দেয়া হয়েছে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এবং ফেরেশতাগণের শুধুমাত্র পৌঁছিয়ে দেয়ার দায়িত্ব।

 আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদা

 মানুষের রাসূলগণ ফেরেশতার রাসূলগণ হতে আফজল বা উত্তম

 আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মু’তাবর বা গ্রহণযোগ্য ‘শরহে আকাইদে নসফী’ নামক কিতাবে এ বিষয়ে দলিলভিত্তিক সবিস্তার আলোচনা করা হয়েছে, তা নিম্নরূপ-


 ورسل البشر افضل من رسل الملائكة ورسل الملائكة افضل من عامة البشر وعامة البشر من عامة الملائكة ... واما تفضيل رسل البشر على رسل الملائكة وعامة البشر على عامة الملائكة فبوجوه ... الثانى ان كل واحد من اهل اللسان يفهم من قوله تعالى وعلم ادم الاسماء كلها الاية ان القصد منه الى تفضيل ادم على الملائكة وبيان زيادة علمه واستحقاقه التعظيم والتكريم - 


 অর্থাৎ ‘মানুষের রাসূলগণ ফেরেশতার রাসূলগণ হতে উত্তম অপরদিকে সাধারণ মানুষ হতে ফেরেশতার রাসূলগণ উত্তম এবং সাধারণ মানুষ সাধারণ ফেরেশতা হতে উত্তম।

 উল্লেখ্য যে, মানুষের রাসূল ফেরেশতার রাসূল হতে যে উত্তম এবং সাধারণ মানুষ সাধারণ ফেরেশতা হতে উত্তম হওয়া বিভিন্ন দলিল আদিল্লাহ দ্বারা প্রমাণিত।

 ফেরেশতার রাসূল হতে মানুষের রাসূল যে উত্তম তার দ্বিতীয় দলিল হচ্ছে- প্রত্যেক ভাষাবিদ আল্লাহ তায়ালার কালাম علم ادم الاسماء كلها الاية (আল্লাহ তায়ালা আদম আলাইহিস সালামকে সকল বস্তুর নাম শিখিয়ে দিয়েছেন) এই কালাম দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, তার উদ্দেশ্য ছিল হযরত আদম আলাইহিস সালামকে ফেরেশতাদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করা এবং হযরত আদম আলাইহিস সালামের ইলিম বা জ্ঞান যে ফেরেশতাদের চাইতে অধিক এ প্রমাণ করা এবং এ কারণেই তিনি সিজদা ও সম্মানের উপযুক্ত হয়েছেন সাব্যস্ত করা।’ 

 উপরোল্লেখিত দলিলের ভিত্তিতে আল্লাহতায়ালা হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সকল বস্তুর নাম শিখিয়ে দিয়েছেন, এর দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল, হযরত আদম আলাইহিস সালামের উস্তাদ বা শিক্ষক হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত জিব্্রাঈল আলাইহিস সালাম নন এবং এর দ্বারা তাও প্রমাণিত হল হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালামসহ সমস্ত ফেরেশতাগণের চেয়ে হযরত আদম আলাইহিস সালামের ইলিম অধিক।

 সূরা আন নজমের ৫নং আয়াত علمه شديد القوى (আল্লামাহু শাদিদুল কুওয়া) এর সঠিক অনুবাদ ও তাফসির নিম্নরূপ-

 আলা হযরত আল্লামা শাহ আহমদ রেজা খাঁন বেরলভী রাদিয়াল্লাহু আনহু তদীয় ‘কানযুল ঈমান ফি তরজমাতিল কোরআন’ তরজমা করেছেন এরুপ-


 انھیں سکھا یاسخت قوتوں والے طاقتورنے 


 তরজমা: ‘তাঁকে শিক্ষা দিয়েছেন প্রবল শক্তিসমূহের অধিকারী।’ 

 অর্থাৎ প্রবল শক্তিসমূহের অধিকারী যাকে কোরআনের ভাষায় বলা হয়েছে شديد القوى (শাদিদুল কুওয়া) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শিক্ষা দিয়েছেন।

 ‘শাদিদুল কুওয়া’ দ্বারা মুরাদ আল্লাহ তায়ালা না জিব্রাঈল আমীন, এ নিয়ে মুফাসসিরীনে কেরাম বিভিন্ন মত পোষণ করেছেন। একদল মুফাসসিরীনে কেরাম شديد القوى (শাদিদুল কুওয়া) দ্বারা আল্লাহ তায়ালা মুরাদ নিয়েছেন। অপরদিকে অন্য একদল মুফাসসিরীনে কেরাম ‘শাদিদুল কুওয়া’ দ্বারা জিব্রাঈল আমীনকে মুরাদ নিয়েছেন।

 যারা ‘শাদিদুল কুওয়া’ দ্বারা আল্লাহ মুরাদ নিয়েছেন:

 তাফসিরে জালালাইন শরীফ ৪৩৭ পৃষ্ঠা ১৬ নং হাশিয়া বা পার্শ্বটীকায় উল্লেখ রয়েছে-


 قوله علمه شديد القوى الخ قال الحسن البصرى رحمه الله وجماعة علمه شديد القوى اى علمه الله وهو وصف من الله نفسه بكمال القدرة والقوة – 



অর্থাৎ হযরত হাসান বসরী রাদিয়াল্লাহু আনহু ও একদল মুফাসসিরীনে কেরাম شديد القوى ذومرة (শাদিদুল কুয়া জুমিররাতিন) আয়াতে কারীমার তাফসিরে বলেছেন, এ দ্বারা আল্লাহ তায়ালার কথা বুঝানো হয়েছে। তিনি স্বীয় জাতকে এ গুণ দ্বারা উল্লেখ করেছেন কেননা তিনি অসীম কুদরত ও অসীম শক্তির অধিকারী। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কোন মাধ্যম ছাড়াই শিক্ষা দিয়েছেন।

 অনুরূপ تفسير الحسن البصرى (তাফসিরে হাসান বসরী) (ওফাত ১১০ হিজরি) ৫ম জিলদের ৮২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-


 (علمه شديد القوى) الاية ۱۵۵۹ قال الحسن : اى : الله تعالى قوله تعالى : (ذومرة) الاية ۱۵۶ – قال الحسن : (ذومرة) ذوقوة من صفات الله تعالى - 


 অর্থ ‘ علمه شديد القوى(আল্লামাহু শাদিদুল কুয়া) এ আয়াতের মর্মে ইমাম হাসান বসরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন- এ দ্বারা মুরাদ আল্লাহ তায়ালা এবং তিনি আরও বলেন ذومرة (প্রবল শক্তিশালী) দ্বারা আল্লাহর সিফাত বা গুণ বুঝানো হয়েছে।

 হাসান বসরী এবং তাফসিরের আলোকে আয়াতে কারীমার ভাবার্থ হল এই- আল্লাহ তায়ালা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কোন মাধ্যম ছাড়াই শিক্ষা দিয়েছেন।

 পক্ষান্তরে যারা شديد القوى (শাদিদুল কুয়া) দ্বারা জিব্রাঈল আমীন মুরাদ নিয়েছেন:

 মুফতিয়ে বাগদাদ আল্লামা আবুল ফজল শাহাবুদ্দিন সৈয়দ মাহমুদ আলুছী বাগদাদী রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ১২৭০ হিজরি) তদীয় তাফসিরে রুহুল মায়ানী নামক কিতাবের ৯ম জিলদের ২৭ পারা ৪৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন-


 (شديد القوى) هو جبريل عليه السلام كما قال ابن عباس وقتادة والربيع – فانه الواسطة فى ابداء الخوارق – 


 অর্থাৎ ‘ইবনে আব্বাস, কাতাদা ও রাবী রেদওয়ানুল্লাহী আলাইহিমুস সালাম আজমাঈন মুফাসসিরগণ شديد القوى (শাদিদুল কুয়া) আয়াতে কারীমার তাফসিরে বলেছেন, এর দ্বারা হযরত জিব্রাঈল আমীনের কথা বুঝানো হয়েছে। কেননা অলৌকিকতা প্রকাশের ক্ষেত্রে হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালামের মধ্যস্থতা রয়েছে।’ 

 মুদ্দাকথা হল হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর কোরআন নাজিল করেছেন অথবা আল্লাহ তায়ালা হযরত জিব্রাঈল আমীনের মাধ্যমে তাঁর হাবিবের ক্বলব মোবারকে ইলহাম পৌছিয়ে দিয়েছেন। এখানে تعليم (তা’লিম) تبليغ (তাবলীগ) তথা পৌঁছানো অর্থে প্রযোজ্য। অথবা এ অর্থও হতে পারে জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর হাবিবকে কোরআন জানিয়ে দিয়েছেন। আয়াতে কারীমায় বর্ণিত ( আল্লামা) শব্দের অর্থ জিব্রাঈল আমীন শিক্ষা দিয়েছেন এরূপ অর্থ করা সঠিক নয়।

 ‘তানভীরুল মিকবাস মিন তাফসিরে ইবনে আব্বাস’ নামক কিতাবের ৪৪৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে (علمه) اى اعلمه جبريل অর্থাৎ ‘হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর হাবিবকে কোরআন জানিয়ে দিয়েছেন।

 এখানে শিক্ষা দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়নি বরং জানিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

 প্রখ্যাত মুফাসসিরে কোরআন আল্লামা শায়খ ইসমাইল হাক্বী রাদিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ১১৩৭ হিজরি) তদীয় ‘তাফসিরে রুহুল বয়ান’ নামক কিতাবের নবম জিলদের ২১৪ পৃষ্ঠায় উক্ত আয়াতে কারীমা علمه شديد القوى (আল্লামাহু শাদিদুল কুয়া) এর তাফসিরে উল্লেখ করেছেন-


 (علمه) اى القران الرسول اى نزل به عليه وقراه عليه وبينه له هذا على ان يكون الوحى بمعنى الكتاب وان كان بمعنى الالهام فتعليمه بتبليغه الى قلبه فيكون كقوله نزل به الروح الامين على قلبك (شديد القوى) من اضافة الصفة الى فاعلها مثل حسن الوجه والموصوف محذوف اى ملك شديد قواه وهو جبريل فانه الواسطة فى ابداء الخواق – 


 ভাবার্থ: ‘হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর কোরআন নাজিল করেছেন, এবং ইহা তেলাওয়াত করেছেন তদুপরি তাঁর জন্য ইহা বর্ণনাও করেছেন। যদি ওহী দ্বারা মুরাদ কিতাব হয়ে থাকে। আর যদি ওহী দ্বারা ইলহাম মুরাদ হয়, তাহলে تعليم (তালীম) শব্দটি تبليغ (তাবলীগ) বা পৌঁছিয়ে দেওয়ার অর্থে প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্বলব মোবারকে ইলহাম পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ তায়ালার বাণী- نزل به الروح الامين على قلبك ইহাকে (কোরআনে কারীমকে) রুহুল আমীন (হযরত জিব্রাঈল আমীন) আপনার (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের) ক্বলব মোবারকের উপর অবতরণ করেছেন।

 شديد القوى(শাদিদুল কুয়া) দ্বারা মুরাদ হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম কেননা অলৌকিকতা প্রকাশের ক্ষেত্রে হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালামের মধ্যস্ততা রয়েছে।’ 

 আল্লাহ তায়ালা তাঁর হাবিবকে নিজেই শিক্ষা দিয়েছেন, আল্লাহর বাণী- خلق الانسان علمه البيان এ আয়াতে কারীমার ব্যাখ্যায় تفسير معالم التنزيل নামক কিতাবের ৪র্থ জিলদের ১১৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-


 قال ابن كيسان : خلق الانسان يعنى محمدا صلى الله عليه وسلم علمه البيان يعنى بيان ما كان وما يكون لانه كان يبين عن الاولين والاخرين وعن يوم الدين – 


 অর্থাৎ ‘প্রখ্যাত মুফাসসির ইবনে কায়সান বলেন- আল্লাহ তা’য়ালা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে ما كان وما يكون যা হয়েছে এবং যা হবে এ সব ইলিম আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর হাবীবকে শিক্ষা দিয়েছেন কেননা তিনি (আল্লাহর হাবীব) পূর্ববর্তী ও পরবর্তী এমনকি কিয়ামতের ঘটনাবলী সবিস্তার বর্ণনা করেছেন।’ 

 মুদ্দাকথা হলো হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম রাসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন বলে, বাংলা ভাষায় লিখে যারা প্রচার করছেন, তারা মারাত্মক ভুলের মধ্যে রয়েছেন। কারণ ইহা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। বিদআতী মু’তাজিলী ও বাতিল দার্শনিকদের ভ্রান্ত আক্বিদা।

 কিতাবুল ফেকহে আ’লা মাজাহিবিল আরবায়া’ নামক কিতাবের ৫ম জিলদের ৪২২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-


 ويكفر ان عرض فى كلامه بسب نبى او ملك ... او الحق بنبى او ملك نقصا – ولو ببدنه – كعرج وشلل- اور طعن فى وفور علمه- اذ كل نبى اعلم اهل زمانه- وسيدهم صلى الله عليه وسلم اعلم الخلق اجمعين- او طعن فى اخلاق نبى او فى دينه – ويكفر اذا ذكر الملائكة بالاوصاف القبيحه- او طعن فى وفور زهد نبى من الانبياء عليهم الصلوة والسلام – كتاب الفقه على مذاهب الاربعة ص ۵/۴۲۲ 


 অর্থাৎ ‘যদি কারও বক্তব্যে কোন নবী অথবা কোন ফেরেশতার প্রতি গালী প্রকাশ পায় তবে সে ব্যক্তি কাফের হবে।...

 নবী অথবা ফেরেশতার সাথে যদি কেহ কোন ত্রুটি সংযুক্ত করে, যদিও তা নবীর পবিত্র শরীর মোবারকের প্রতি কোন ঘৃণিত রোগের প্রতি আরোপ করে যেমন খোঁড়া ও প্রতিবন্ধী ইত্যাদি অথবা কোন সম্মানিত নবীর পূর্ণাঙ্গ ইলিমের অবজ্ঞা করে এমতাবস্থায়ও সে কাফের হবে। কেননা প্রত্যেক নবী তাঁর যুগের অধিক ইলিমের অধিকারী হয়ে থাকেন। পক্ষান্তরে নবীদের সর্দার হযরত মুহাম্মদ মোস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমগ্র সৃষ্টিজগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী। (অমান্যকারীগণ কাফের সাব্যস্ত হয়)

 অথবা কোন নবীর চরিত্রের বা দ্বীনের উপর কালিমা লেপন করে। এমতাবস্থায়ও সে কাফের হবে। এমনকি যদি কোন ফেরেশতাকে মন্দ কাজের দ্বারা অভিহিত করে অথবা নবীগণের মধ্যে কোন নবীর অধিক বন্দেগীর উপর সমালোচনা করে, সেও কাফের হবে।

 ‘আশ শিফা বি তা’রীফে হুকুকিল মোস্তফা’ নামক কিতাবের দ্বিতীয় জিলদের ২১৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-


 من سب النبى صلى الله عليه وسلم او عابه او الحق به نقصا فى نفسه او نسبة او دينه او خصلة من خصاله او عرض به او شبهه بشى على طريق السب له او الا زراء عليه او التصغير لشانه او الغض منه والعيب له فهو ساب له والحكم فيه حكم الساب يقتل كما نبينه - 


 তরজমা : ‘যে ব্যক্তি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালমন্দ করবে অথবা দোষারূপ করবে অথবা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র সত্তায় বা বংশে বা ধর্মে, বা তাঁর মহান চরিত্রাবলীর মধ্যে কোন চরিত্রে কোন প্রকার ত্রুটিযুক্ত করবে অথবা তাঁর মহান শান ক্ষুন্ন করবে অথবা এমন কথা বলবে যা তাঁর শানে গালির সাথে সামাঞ্জস্য রাখে অথবা তাঁর প্রতি কোন ত্রুটির বুঝা চাপাইয়া দিবে অথবা তাঁর মহান শানকে খাটো করবে অথবা তাঁর থেকে অনীহা প্রকাশ করবে ও তাঁর প্রতি দোষারোপ করবে এমতাবস্থায় সে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালিদাতা হিসেবে গণ্য হবে এবং তার হুকুম গালিদাতার হুকুমের অন্তর্ভূক্ত হবে, এরূপ গালিদাতাকে হত্যা করতে হবে যেমন আমরা এ বিষয়ে ইতোপূর্বে বর্ণনা করেছি।’ (শিফা শরীফ ২/২১৪ পৃ:)।

_______________

ইজহারে হক্ব

লেখক : অধ্যক্ষ শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী (মা:জি:আ:)

 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন