মুফাসসিরীনদের মতে 'মওলা’র অর্থ
প্রশ্ন (৩): আপনি 'মওলা’ শব্দের অর্থ সাহায্যকারী লিখেছেন। অন্যান্য মুফাসসিরীনগণও কি এই অর্থের ব্যাপারে একমত!
উত্তর : কেন একমত হবেন না! অবশ্যই একমত। বহু সংখ্যক তফসীরের উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে।
উদাহরণ স্বরূপ ৬টি তফসীরের কিতাবের নাম উপস্থাপন করা হচ্ছে যার মধ্যে এই আয়াতে মুবারকার মধ্যে আসা 'মওলা’ শব্দটির অর্থ বন্ধু এবং সাহায্যকারী লিখেছে,
{(১) তাফসীরে তাবরী, ১২তম খন্ড, পৃ: ১৫৪, (২) তাফসীরে কুরতুবী, ১৮তম খন্ড, পৃ-১৪৩, (৩) তাফসীরে কবীর, খন্ড ১০, পৃ : ৫৭০,
(৪) তাফসীরে বাগবী, ৪র্থ খন্ড, পৃ: ৩৩৭,
(৫) তাফসীরে খাজেন, ৪র্থ খন্ড, পৃ: ২৮৬,
(৬) তাফসীরে নাসফী, পৃ-১২৫৭।
নিম্নে ঐ ৪টি কিতাবের নাম উল্লেখ করা হচ্ছে যার মধ্যে উক্ত আয়াতে মুবারকায় আসা 'মওলা' শব্দটির অর্থ সাহায্যকারী’ করা হয়েছে।
(১) তাফসীরে জালালাইন, পৃ: ৪৬৫,
(২) তাফসীরে রূহুল মাআনী, ২৮ তম খন্ড,
পৃ : ৪৮১,
(৩) তাফসীরে বাইজাভী, ৫ম খন্ড, পৃ : ৩৫৬, (৪)। তাফসীরে আবি সাউদ, ৫ম খন্ড, পৃ: ৭৩৮}
ইয়া খােদা বাহরে জনাবে মুস্তফা ইমদাদ কুন, ইয়া রাসূলাল্লাহ আয বাহরে খােদা ইমদাদ কুন। (হাদায়িকে বখশিশ শরীফ)।
এর সুন্দর ব্যাখ্যা اِيَّاكَ نَسۡتَعِيۡنُ
প্রশ্ন (৪): সুরা ফাতিহায় রয়েছে اِيَّاكَ نَسۡتَعِيۡنُ অর্থাৎ 'আমরা তােমার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি’ সুতরাং অন্য কারাে থেকে সাহায্য প্রার্থনা করাটা শিরক হবে?
উত্তর : উক্ত আয়াতে সাহায্য প্রার্থনা দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রকৃত সাহায্য। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালাকে প্রকৃত মহা শক্তিশালী মনে করে প্রার্থনা করা হচ্ছে যে, “ওহে দয়ালু রব! আমরা তােমার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি, এ বিষয়টি আসলে বান্দা থেকে সাহায্য চাওয়াটা শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলার একান্ত অনুগ্রহের মাধ্যমে (তাদের থেকে চাওয়া) বুঝানাে হচ্ছে, যেমন সূরা ইউসূফ রয়েছে, اِنِ الۡحُكۡمُ اِلَّا لِلّٰه
অনুবাদ কানযুল ঈমান থেকে : “নির্দেশ নেই, কিন্তু আল্লাহরই।” । | (পারা ১২ আয়াত নং ৪০) অন্যত্র সূরা-বাকারা মধ্যে রয়েছে :
لَهٗ مَافِی السَّمٰوٰتِ وَمَافِی الۡاَرۡضِ٭
অনুবাদ কানযুল ঈমান থেকে: “তাঁরই যা কিছু আসমান সমূহে রয়েছেএবং যা কিছু যমীনে।”
(পারা ৩, আয়াত নং ২৫৫)
অবশেষে আমরা বিচারককে ফায়সালাকারী ও মেনে থাকি আবার নিজেদের জিনিস সমূহের মালিকানা ও দাবী করে থাকি। অর্থাৎ আয়াত দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে মূল ফয়সালাকারী ও মূল মালিকানা কিন্তু বান্দাদের ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার দয়াক্রমে উদ্দেশ্য। (জা'আল হক, পৃ-২১৫)
পবিত্র কুরআনে করীমের কতিপয় স্থানে গাইরুল্লাহকে সাহায্যকারী বলে আখ্যা দিয়েছে। এরই আওতায় ৪টি আয়াত আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।
যেমন, (১) وَ اسۡتَعِیۡنُوۡا بِالصَّبۡرِ وَ الصَّلٰوۃِ কানযুল ঈমান থেকে অনুবাদ: “তােমরা ধৈৰ্য্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর।” (পারা: ১, সূরা বাকারা, আয়াত ৪৫)।
ধৈৰ্য্য কি আল্লাহ? যার সাহায্য প্রার্থনার হুকুম দেওয়া হয়েছে? নামায কি আল্লাহ? যার সাহায্য প্রার্থনার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে?
অন্য আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে: (২) وَ تَعَاوَنُوۡا عَلَی الۡبِرِّ وَ التَّقۡوٰی ۪ কানযুল ঈমান থেকে অনুবাদ: “সৎ ও পরহেজগারীর উপর একে অপরকে সাহায্য কর।” (পারা: ৬, সূরা আল মায়িদা, আয়াত ২)।
আল্লাহ ছাড়া অন্যের নিকট সাহায্য চাওয়া যদি সাধারণভাবে অসম্ভব হয়ে থাকে, তা হলে এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার হুকুমের মূল অর্থ কী?
(৩)
اِنَّمَا وَلِیُّکُمُ اللّٰہُ وَ رَسُوۡلُہٗ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا الَّذِیۡنَ یُقِیۡمُوۡنَ الصَّلٰوۃَ وَ یُؤۡتُوۡنَ الزَّکٰوۃَ وَ ہُمۡ رٰکِعُوۡنَ
কানযুল ঈমান থেকে অনুবাদ: “তােমাদের বন্ধুই হল আল্লাহ, তাঁর রসুল আর যারা ঈমান এনেছে যারা নামায কায়েম করে, যাকাত আদায় করে আর আল্লাহর উদ্দেশ্যে অবনত হয়ে থাকে।” (পারা: ৬, সূরা আল মায়িদা, আয়াত ৫৫)
وَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ وَ الۡمُؤۡمِنٰتُ بَعۡضُہُمۡ اَوۡلِیَآءُ بَعۡضٍ (৮)
কানযুল ঈমান থেকে অনুবাদ: “মুসলমান পুরুষ এবং মুসলমান নারীরা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু স্বরূপ।” (পারা: ১০, সূরা আত-তাওবা, আয়াত ৭১)
উক্ত আয়াতটির তাফসীর এভাবে করা হয়েছে: তারা পরস্পর দ্বীনি ভালবাসা ও সদ্ব্যবহার বজায় রাখেন এবং একে অপরের সাহায্যকারী ও ( খাজায়িনুল ইরফান, পারা: ১৩, সূরা তাওবা, আয়াত: ৭১)।
সহীহ ইসলামী আকীদা অনুযায়ী যদি কোন ব্যক্তি এই আকীদা পােষণ করত: নবী-ওলীদের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করে যে, এরা আল্লাহ তায়ালার অনুমােদন ছাড়া নিজে লাভ-ক্ষতির মালিক : এ হল নি:সন্দেহে শিরিক। বরং এর বিপরীতে কেউ যদি বাস্তব।
সাহায্যকারী, লাভ-ক্ষতির আসল মালিক আল্লাহকে মেনে অন্য কাউকে বা কোন বস্তুকে রূপক অর্থে কেবল আল্লাহর দান হিসাবে সাহায্যকারী মনে করত: সাহায্য প্রার্থনা করে তা হলে কখনও শিরিক হবে না। আর আমাদের আকীদাও এটিই।
যাই হােক, সূরা ফাতিহার اِيَّاكَ نَسۡتَعِيۡنُ
‘আমরা তােমারই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি’ আয়াতটি অবশ্যই সত্য। কিন্তু শয়তানের ধ্বংস হােক, শয়তান মানুষের মনের মাঝে কুমন্ত্রণা দিয়ে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি করতে চায়।
লক্ষ্য করুন, আয়াতে মােবারাকাটিতে জীবিত-মৃত বিশেষিত না করে বরং সাধারণভাবে অর্থাৎ সর্বাবস্থায় আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত অন্যের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা নিষেধ করা হয়েছে। আয়াতটির শাব্দিক অর্থের দিক থেকে যা 'কুমন্ত্রণা ওয়ালারা' বুঝেছে অন্যের কথা দূরে থাক তারা নিজেরাও তাে 'শিরক' থেকে বাঁচতে পারে না। যেমন, ভারী কোন বােঝা মাটিতে রাখা হল। উঠানাে সম্ভব হচ্ছে না। কাউকে আহ্বান করে বলল, দয়া করে আমার বােঝাটি একটু উঠিয়ে দেবেন কি? তাদের সেই কুমন্ত্রণা অনুযায়ী এটি শিরক হল কি না? অনুরূপ হাজার হাজার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ব্যস, চতুর্দিকেই তাে আল্লাহ ছাড়া অন্যদের নিকট হতে সাহায্য চাওয়ার অগণিত দৃশ্য রয়েছে।
যেমন, ইনফাক ফি সবিলিল্ল হি’ বা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করার অনেক ক্ষেত্রে মূল দাবীই “পারস্পরিক সহযােগীতা”! এতে সদকা, দান, ফিতরা, যাকাত, মসজিদ ও মাদ্রাসার জন্যে চাঁদা ও দান, কোরবানীর চামড়া উঠানাে, সামাজিক প্রতিষ্ঠান সমূহ ইত্যাদি ইত্যাদি সবগুলাের স্বার্থ হল সাহায্য, সাহায্য এবং সাহায্যই। আরাে একটু সামনে অগ্রসর হলে দেখতে পাবেন, মাজলুমদের সাহায্যার্থে রয়েছে আদালত, অসুস্থদের সাহায্যার্থে রয়েছে হাসপাতাল, দেশের অভ্যন্তরীন বাসিন্দাদের সাহায্যার্থে রয়েছে পুলিশের ব্যবস্থাপনা, বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে নিরাপত্তার জন্যে রয়েছে সামরিক শক্তি, সন্তানদের লালন পালনের সাহায্যার্থে পিতামাতার প্রয়ােজনীয়তা রয়েছে, তাদের শিক্ষা দীক্ষার জন্য শিক্ষাকেন্দ্রের প্রয়ােজন। মােটকথা জীবনে প্রতিটা কদমে আল্লাহ ব্যতিত অন্য কারাে সাহায্য সহযােগীতার প্রয়ােজনীয়তা অপরিসীম। বরং মৃত্যুবরণ করার পর কাফন দাফনের ক্ষেত্রে আল্লাহ ব্যতীত অপরের সাহায্য ছাড়া তা সম্ভব নয়। এরপর কিয়ামত পর্যন্ত ঈসালে সাওয়াব এর মাধ্যমে সাহায্যের প্রয়ােজন এবং আখেরাতেও সব চাইতে বেশি সাহায্যের প্রয়ােজন। আর তা হচ্ছে প্রিয় আকা নবী করিম صَلَّى اللّٰهُ عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم এর শাফায়াত। এগুলাে সবই আল্লাহ ছাড়া অন্যদের সাহায্যের বাস্তব উদাহরণ।
আজ লে উন কি পানাহ আজ মদদ মাঙ্গ উন ছে, ফির না মানেঙ্গে কিয়ামত মে আগর মা-ন গেয়া। (হাদায়িকে বখশিশ শরীফ)
_____________________
হযরত আলী كَرَّمَ اللّٰه تَعَالٰی وَجۡهَهُ الۡكَرِیۡمِ এর কারামত,
লেখক : আমীরে আহলে সুন্নাত মাওলানা মুহাম্মদ বিলাল মুহাম্মদ ইলইয়াস আত্তার কাদেরী রযবীয়া (দা.)
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন