তকবীন সম্পর্কে

 

তকবীন সম্পর্কেঃ তকবীন বা সৃষ্টিকরণ আল্লাহতায়ালার একটি হাকীকি সিফাত বা মূল গুণ। হজরত আবুল হাসান আল আশআরীর অনুসারীগণ তকবীনকে একটি ‘সিফাতে-ইযাফীয়া' বা অতিরিক্ত গুণ হিসাবে মনে করেন এবং তারা ‘কুদরত্ বা শক্তি ও ‘ইরাদা' বা ইচ্ছাকে, বিশ্বসৃষ্টির জন্য যথেষ্ট মনে করেন। কিন্তু সঠিক ব্যাপার হলো-কুদরত ও ইরাদা ছাড়াও তকবীন একটি পৃথক হাকীকি সিফাত বা মূল গুণ। এর ব্যাখ্যা এই যে ,কুদরতের অর্থ হলাে- ওতে কোনাে কাজ করা এবং না করা উভয়ই সঠিক । আর ইরাদার অর্থ হলাে কুদরতের উক্ত দুইটি দিকের অর্থাৎ করা এবং না করার একটি দিককে নির্ধারিত করা। সুতরাং কুদরতের দরজা, ইরাদার দরজার উপরে । বস্তুতঃ তকবীন যাকে আমরা হাকীকি সিফাত হিসাবে মনে করি, তার দরজা ‘কুদরতভ ও ইরাদার দরজাসমূহের পরে অবস্থিত । এই সিফাত বা গুণের কাজ হলাে-নির্ধারিত  দিককে ‘অজুদ' বা অস্তিত্বে আনা। সুতরাং কুদরত কাজকে সঠিক ভাবে চিহ্নিতকারী সিফাত বা গুণ এবং ইরাদা কাজকে খাস্ বা নির্দিষ্ট কারী সিফাত ; আর ‘তকবীন' কাজকে অস্তিত্বে আনয়নকারী সিফাত । কাজেই , তকবীনের সিফাতকে স্বীকার করা ছাড়া, আর কোনাে গত্যন্তর নেই । এর অবস্থা কর্ম সম্পাদনে সামর্থ্যের ন্যায়, যাকে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা'আতের আলেমগণ বান্দাদের জন্য স্থির করেছেন। আর এ ব্যাপারে কোনাে সন্দেহ নেই যে , এই সামর্থ্য ‘কুদরত' স্থির হওয়ার পরে হতে পারে । বরং ইরাদার সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়ার পরেই হয়। আর অস্তিত্ববান হওয়ার দৃঢ়তা, এই সামর্থ্যের সাথে সম্বন্ধিত। বরং এই সামর্থ্যই কাজের দিকে জরুরী মনে করে এবং এর বিপরীত কাজ না করার দিকটি সেখান অনুপস্থিত । তকবীন সিফাতের অবস্থাও এইরূপ। অস্তিত্ববান হওয়ার দৃঢ়তা তার সঙ্গে থাকা একান্ত প্রয়োজন । কিন্তু এই ‘ইজাব' (প্রয়োজন মনে করা) আল্লাহ্তায়ালার যাতের মধ্যে কোনাে রূপ পরিবর্তন সৃষ্টি করে না; কেননা , তার স্থিতি, ‘সিফাতকে কুদরত' ও ‘সিফাতকে ইরাদার' স্থির হওয়ার পরে হয়। বস্তুতঃ ‘কুদরতরভ প্রকৃত অর্থ কোনাে কাজ করা এবং না করাকে সঠিক ভাবে নির্ধারণ করা এবং ‘ইরাদা' তার একটি দিক অর্থাৎ করা বা না করাকে নির্দিষ্ট করে । এই বক্তব্যটি বিজ্ঞ দার্শনিকদের অভিমতের বরখেলাফ বা বিপরীত । প্রথম শর্তটিকে (অর্থাৎ যদি ইচ্ছা করেন , তবে সৃষ্টি করতে পারেন ) সত্যের উপযোগী মনে করেন এবং দ্বিতীয় শর্তটিকে (অর্থাৎ যদি না চান, তবে সৃষ্টি করেননা) সত্যের অপালাপ হিসাবে মনে করেন এবং ‘সিফাতের ইরাদা'কে অস্বীকার করেন । এই বক্তব্য হিসাবে‘ইজাবে সরীহ' বা স্পষ্ট প্রয়োজন বাধ্যতামূলক হয়। আল্লাহ সুবহানুহু ওয়া তায়ালার যাত বা সত্তা এ অবস্থা থেকে অনেক ঊর্ধ্বে ।ঐ ‘ইজাব'বা প্রয়োজন, যা ইরাদা বা ইচ্ছার সাথে যুক্ত এবং কুদরতের দু'টি দিকের একটি কে স্থির করণের পর সৃষ্টি হয়, তা ইখতিয়ারকে বাধ্যতামূলক করে; তাকে অস্বীকার করে না। ফতুহাত গ্রন্থের লেখক (শায়েখ মহীউদ্দীন ইবনুল আরাবী) এর কাশফও দার্শনিকদের মতের অনুরূপ। তিনি কুদরতের ব্যাপারে প্রথম শর্তটিকে সত্যের উপযোগী মনে করেন  এবং দ্বিতীয় শর্তটিকে  সত্যের অপলাপ হিসাবে বিবেচনা করেন । কিন্তু এরকম হলে তো ইজাব বা বাধ্যকরণকে মেনে নেয়া হয়। যার ফলে ইরাদার কোনাে ভূমিকাই থাকে না। কেননা , দুইটি একই ধরনের বিষয় থেকে একটিকে নির্দিষ্ট করা অবস্থা এখানে পাওয়া যায় না। কিন্তু , যদি তকবীনের সিফাতের মধ্যে ইজাবকে নির্দিষ্ট করা হয়, তবে এর সুরাহা হতে পারে । কেননা , তা এই প্রয়োজনের তাগিদের ঊর্ধ্বে । এই পার্থক্যটা খুবই সূক্ষ্ম, যা আমার আগে আর কেউই বর্ণনা করেননি । যদিও মাতুরীদিয়া  সম্প্রদায়ের আলেমগণ এই সিফাত বা তকবীনকে স্বীকার করেছেন , কিন্তু তাঁরা এই সূক্ষ্ম ব্যাপারটির আলাচেনা করেননি ।

 রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সুন্নতের অনুসরণই তাঁদেরকে , সমস্ত মুতাকাল্লেমীনদের মধ্যে , এই মারেফাত বা গুপ্ত তত্ত্বের দ্বারা বৈশিষ্ট মণ্ডিত করেছে। এই অধমও উক্ত বুজুর্গদের উত্তরসূরী। 

আল্লাহ্ সুবহানুহু ওয়া তায়ালা আমাদেরকে , সাইয়্যেদুল মুরসালীনের তোফায়েলে, তাঁর সঠিক ও সত্য আকায়েদের উপর সুদৃঢ় রাখুন।

_______________

কিতাব: মাবদা ওয়া মা'আদ

কৃত: হজরত মুজাদ্দেদে আলফে সানী রহমাতুল্লাহি  আলাইহি

অনুবাদ: ড. আ ফ ম আবু বকর সিদ্দীক

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন