ইমামের পিছনে কিরাআত পাঠ

 ইমামের পিছনে কিরাআত পাঠ সম্পর্কেঃ বহুদিন পর্যন্ত আমি এরূপ আকাংখা করছিলাম যে, যদি হানাফী মাজহাবে এমন কোনাে গ্রহণযােগ্য কারণ বেরিয়ে আসতাে, যাতে ইমামের পিছনে সুরা ফাতিহা পড়া যেতে পারে। কেননা, নামাজের মধ্যে কিরাআত পড়া ফরয। এমতাবস্থায়, হাকীকি কিরাআত পরিত্যাগ করে, হুকমী কিরাআতের অনুসরণ করা সংগত মনে হয় না। পক্ষান্তরে, নবী করীম সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের ইরশাদঃ 'সুরা ফাতেহা ব্যতীত কোনাে নামাজ নামাজ-ই নয়।' কিন্তু হানাফী মাজহাবের অনুসরণ ও অনুকরণের খাতিরে সুরা ফাতিহা পড়া পরিত্যাগ এবং একে রিয়াত এবং মুজাহিদার অনুরূপ মনে করতে থাকি। কেননা, একটি মাজহাব পরিত্যাগ করে অন্য মাজহাবে গমন এক ধরনের ইলহাদ বা অস্বীকার। অবশেষে, হক সুবহানুহু তায়া'লা হানাফী মাজহাবের অনুসরণের বরকতে, ইমামের পিছনে মুক্তাদীর কিরাআত না পড়ার ব্যাপারটি আমার নিকট প্রকাশ করেন এবং অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে হুকমী কিরাআত যে হাকিকী কিরাআতের চাইতে উত্তম, একথা বুঝতে পারি। কেননা ইমাম এবং মুকতাদী সবাই সম্মিলিতভাবে মুনাজাতের মাকামে দণ্ডায়মান হন। যেমন বলা হয়, অবশ্যই নামাযী স্বীয় রবের সংগে গােপন আলাপ করে। নামাযের সময় মুকতাদীরা ইমামকে দলপতি হিসাবে নির্বাচিত করে। কাজেই এ সময় ইমাম যা পাঠ করেন, তা সমস্ত কওমের পক্ষ থেকে পাঠ করেন। বিষয়টি এরকম যে, কিছু লােক কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে আলাপ আলােচনার জন্য, কোনাে একজন প্রতিপত্তিশালী বাদশাহের সম্মুখে উপনীত হয় এবং নিজেদের একজনকে দলপতি নির্বাচন করে; যাতে সে তাদের মুখপাত্র হিসাবে বাদশাহের নিকট সবকিছু পেশ করতে পারে। এমতাবস্থায়, দলপতি বক্তব্য পেশের সময়, অন্য কেউ যদি কিছু বলে, তবে তা বেআদবী হিসাবে পরিগণিত হয় এবং বাদশাহের নারাজীর কারণ হতে পারে। কাজেই, এই জামাআতের হুকমী কথাবার্তা, যা তাদের দলপতির মুখ থেকে বের হয়: তা তাদের সকলের হাকীকি কথাবার্তা অপেক্ষা উত্তম। একই অবস্থা ইমামের সঙ্গে মুকতাদীর কিরাআত পাঠ করা। কেননা, এর ফলে হৈচৈ ও চেঁচামেচির সৃষ্টি হয়, যা আদবের খেলাফ এবং একাত্মতার পরিবর্তে বিছিন্নতার সৃষ্টি করে। হানাফী ও শাফী মাজুহাবের অধিকাংশ ইখতিলাফী মাসায়েল বা মতভেদী মাসআলাসমূহ এই ধরনের; যার বাহ্যিক সুরত ইমাম শাফীর দিকে মনে হয়, কিন্তু তার বাতিন বা প্রকৃত অবস্থা হানাফী মাজহাবের অনুরূপ। | আল্লাহ রব্বুল আলামীন এই ফকীরের নিকট প্রকাশ করেন যে, ইলমে কালাম বা যুক্তিবিদ্যার মধ্যে যে মতভেদ, তার হক বা সত্যটি হানাফী মাজহাবের অনুরূপ। যেমন— হানাফী মাজহাবে তকবীন বা সৃষ্টিকে, সিফাতে হাকীকি বা আসল গুণ হিসাবে গণ্য করা হয়। যদিও বাহ্যতঃ মনে হয়, এটা কোনাে হাকীকি সিফাত নয়, বরং এর পরিণতি কুদরত এবং ইরাদা বা ইচ্ছার সিফাত। কিন্তু সূক্ষ্মদর্শিতা ও অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে জানা যায় যে, তকবীন প্রকৃতপক্ষে একটি স্থায়ী আলাদা সিফাত বা গুণ। এই নিরীখে অন্যগুলির কিয়াস বা ধারণা করা যেতে পারে। বস্তুতঃ ফিকাহ শাস্ত্রের মধ্যে যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়, তার অধিকাংশ মাসআলা মাসায়েলের সত্যটি হানাফী ফিকাহর অনুকূলে। এমন খুব কম মাসলাই আছে, যাতে সন্দেহের অবকাশ আছে।

মাতুরীদি মতবাদের সংরক্ষণঃ সুলুকের রাস্তায় চলাকালীন সময়ে একদা নবী করীম সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এই ফকীরকে বলেনঃ “আপনি ইলমে কালামের মুজতাহিদদের মধ্যে একজন।" এ ঘটনার পর থেকে ইলমে কালাম বা যুক্তিবিদ্যার প্রত্যেক মাসআলা মাসায়েলে, আমার একটি বিশেষ অভিমত প্রতিফলিত হতে থাকলাে। অধিকাংশ মাসআলা মাসায়েল যন্মধ্যে মাতুরীদিয়া ও আশাইরাহদের মধ্যে মতভেদ আছে, যখন প্রথমে তা সামনে আসে, তখন মনে হয়- হাকীকত আশাইরাহদের অনুকূল। কিন্তু যখন সূক্ষ্মদর্শিতা ও অন্তদৃষ্টির মাধ্যমে অবলােকন করা হয়, তখন প্রতীয়মান হয় যে, হক বা সত্যটি মাতুরীদিয়াদের অনুকূলে। ইলমে কালামের সমস্ত মতভেদী মাসআলাসমূহে এই ফকীরের অভিমত উলামায়ে মাতুরীদিয়াদের ন্যায়। আর সত্য ব্যাপার এই যে, এই বুজুর্গগণ নবী করীম সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের পূর্ণ পায়রবী বা অনুসরণের কারণে, এই মহামর্যাদায় বিভূষিত হয়েছেন, যা তাদের বিরােধীদের পক্ষে হাসিল করা সম্ভব হয়নি। কেননা, তাঁরা দার্শনিক দৃষ্টিভংগীকে প্রাধান্য দিয়েছেন। যদিও এই দুটি দলই সত্যের অনুসারী।

ইমাম আজমের মহত্ত্বঃ সমস্ত বুজুর্গদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বুজুর্গ ইমাম ও প্রথম পথ প্রদর্শক— ইমাম আবু হানীফা র. ((১. তাঁর আসল নাম নু'মান ইব্‌ন ছাবিত। কুনিয়াত আবু হানীফা। ইমাম আ'জম এবং ইমাম সাহেব তাঁর লকব বা উপাধি। তিনি ৮০ হিজরীতে কুফায় জন্মগ্রহণ করেন, এবং ১৫০ হিজরীতে আব্বাসীয় শাসক মনসুরের রাজত্বকালে বাগদাদে ইনতিকাল করেন। তাঁর প্রকৃত উস্তাদ ছিলেন ইমাম হাম্মাদ। তিনি ব্যতীত অন্যান্য বুজুর্গ ও তাবেঈনদের নিকট হতে তিনি ফয়েজ হাসিল করেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে ইমাম আবু য়ুসুফ র. ইমাম শায়বানী র. এবং ইমাম যাফর র. সমধিক প্রসিদ্ধ। ফিকাহ শাস্ত্রের চারজন প্রসিদ্ধ ইমামের মধ্যে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ। সমস্ত ইসলামী দুনিয়াতে,আহলে- সুন্নাহ্-ওয়াল-জামাআতের অনুসারীরা তাঁর অনুসারী।)  এর শান ও মর্যাদা সম্পর্কে আমি আর কি লিখব? তিনি সমস্ত মুজতাহিদদের মধ্যে, যথা ইমাম শাফী, ইমাম মালেক এবং ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল র. এর চাইতে অধিক জ্ঞানী, মুত্তাকী এবং আল্লাহভীরু ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে ইমাম শাফী র. বলেনঃ “সমস্ত ফিকাহ শাস্ত্রবিদ আলেম আবু হানীফা র. এর বংশধর।" 

কথিত আছে যে, যখন ইমাম শাফী র. ইমাম আজম র. এর মাযার যিয়ারতে যেতেন, তখন তিনি নিজের ইজতিহাদ পরিত্যাগ করতেন এবং নিজের রায়ের বা মতের উপর আমল করতেন না। বরং এ সময় তিনি বলতেনঃ 'তাঁর সম্মুখে আমার ঐ মতের উপর আমি আমল করবাে যা তাঁর মতের বিপরীত এইরূপ করতে আমার লজ্জাবােধ হয়।' এ সময় তিনি ইমামের পশ্চাতে সুরা ফাতিহা পড়া পরিত্যাগ করতেন এবং ফজরের নামাযে দোয়া কুনুত পড়াও পরিহার করতেন। প্রকৃতপ্রস্তাবে বলা যায় যে, ইমাম আবু হানীফা র. এর মর্যাদা, ইমাম শাফী র,-ই অধিক বুঝতেন। ভবিষ্যতে যখন হজরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম অবতরণ করবেন, তখন তিনি ইমাম আজম র. এর মাজহাবের উপর আমল করবেন। যেমন, খাজা মােহাম্মদ পারসা কাদ্দাসা সিররুহু (হজরত খাজা মােহাম্মদ পারসা র, এর আসল নাম-মােহাম্মদ ইবন মােহাম্মদ ইবন মাহমুদ আল হাফেজী এবং তার লকব বা উপাধি ছিলাে-পারসা। তিনি হজরত খাজা নকশবন্দ র, এর খলীফা ছিলেন। তিনি হিজরী ৭৪৯ সনে জন্মগ্রহণ করেন, হজ্জ সমাপনের পর তিনি মদীনাতে ৮২২ হিজরীর ২৪ শে জিলহজ্জ তারিখে ইনতিকাল করেন। জান্নাতুল বাকীতে, হজরত আব্বাস রা, এর পার্শ্বে তার রওজা মােবারক অবস্থিত।) তাঁর কিতাব ‘ফুসুলে সিত্তাতে’ বর্ণনা করেছেন যে, 'তার মর্যাদার শ্রেষ্ঠত্বের জন্য এটাই যথেষ্ট যে, একজন উলুল আজম পয়গম্বর তাঁর মাজহাবের উপর আমল করবেন। অন্যান্য হাজারাে বুজুর্গী এই একটি বুজুর্গীর মুকাবিলায় কিছুই নয়।' 

 আমাদের বুজুর্গ হজরত খাজা বাকীবিল্লাহ কাদ্দাসা সিররুহু বলতেন, কিছুদিন আমিও নামাজের মধ্যে ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়তে থাকি। অবশেষে একদিন রাত্রিতে আমি ইমাম আজম র. কে স্বপ্নে দেখি। তিনি মর্যাদাপূর্ণ পােশাকে সুসজ্জিত অবস্থায় আমার নিকট আগমন করে একটি কবিতা পাঠ করছিলেন, যার অর্থ ছিলাে এরকম— আমার মাজহাবের মধ্যে অসংখ্য লােক আল্লাহর ওলী হয়েছেন। এই ঘটনার পর থেকে আমি নামাজের মধ্যে ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়া পরিত্যাগ করি। 

_______________

কিতাব: মাবদা ওয়া মা'আদ

কৃত: হজরত মুজাদ্দেদে আলফে সানী রহমাতুল্লাহি  আলাইহি

অনুবাদ: ড. আ ফ ম আবু বকর সিদ্দীক

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন