রূহের মাকাম সম্পর্কে

 

রূহের মাকাম সম্পর্কেঃ রূহ আলমে বেচুঁনী বা দৃষ্টান্তহীন জগতের সঙ্গে  সম্পর্কিত। রূহের জন্য লা-মাকান বা কোনো স্থান না হওয়াই বোঝা যায়। যদিও  রূহের বেচুঁনী বা দৃষ্টান্তহীন হওয়া, জাতে হক তায়া’লার তুলনায় ‘আইনে-চুঁ’ বা  দৃষ্টান্তের মতো এবং তার লা মাকানী হওয়া হক তায়া’লার নেসবতে, আইন মাকান  বা স্থানের মতো। ‘আলমে আরওয়াহ’, বা রূহের জগত, এই দুনিয়া এবং মর্তবায়ে  বেচুঁনী বা দৃষ্টান্তহীন জগতের মাঝে একটি বরজখ বা পর্দাস্বরূপ।  

আর এভাবেই ‘আলমে আরওয়াহ’ বা রূহের জগতের মধ্যে দুইটি রঙ-ই  পাওয়া যায়। অবশ্য আলমে-চুঁ’ বা দৃষ্টান্তের জগত তাকে দৃষ্টান্তহীন বা বেচুঁ মনে  করে। অপরপক্ষে, মর্তবায়ে বেঁচুনী বা দৃষ্টান্তহীন জগতের দিক থেকে দৃষ্টিপাত  করলে রূহকে ‘আইনে চুঁ বা দৃষ্টান্তের মতো মনে হয়। বস্তুতঃ রূহের এই বরজখ  হবার যোগ্যতা, তার স্বভাবসুলভ কারণেই হাসিল হয়েছে।  

রূহের অবতরণ সম্পর্কেঃ রূহের সম্পর্ক এই জড়দেহের সংগে হওয়ার পর  এবং এই অন্ধকারময় খাঁচায় আবদ্ধ হওয়ার পর- রূহ ঐ বরজখ স্থান থেকে নির্গত  হয়ে পূর্ণরূপে এই ‘আলমে চুঁ’ বা দৃষ্টান্তের জগতে অবতরণ করেছে। ফলে, বে চুঁনী বা দৃষ্টান্তহীনতার রঙ তার মধ্য থেকে দূরীভূত হয়েছে। তার অবস্থা হারুত  এবং মারুত ফিরিশতাদ্বয়ের মতো। বিশেষ কোনো হিকমত ও প্রয়োজনে  ফিরিশতাদের রূহ মনুষ্যত্বের নিম্নস্তরে নেমে আসে। তফসীরকার ও  ঐতিহাসিকদের অভিমত এরকমই।  

রূহের আরোহণ সম্পর্কেঃ অতঃপর আল্লাহ জাল্লা শানুহুর অনুগ্রহে, এই সফরে,  এক ধরনের প্রত্যাবর্তন হাসিল হয় এবং এই অবতরণ হতে আরোহণ নসীব হয়।  এমতাবস্থায় নফসে জুলমানী বা অন্ধকারময় নফসের এবং বদনে ‘আনসারী বা  জড়দেহেরও রূহের অনুসরণের ফলে, এক ধরনের ‘উরুজ’ বা ঊর্ধারোহণ নসীব  হয় এবং তা বিভিন্ন মনজিল অতিক্রম করে। এই সময়, রূহের এই সম্পর্ক এবং  তার অবতরণের উদ্দেশ্য প্রকাশ পায় এবং নফসে আম্মারা (পাপকর্মে উদ্বুদ্ধ করে  যে প্রবৃত্তি) নফসে মুতমাইন্না বা পরিশুদ্ধ ও প্রশান্ত নফসে রূপান্তরিত হয়। সঙ্গে  সঙ্গে অন্ধকারময় স্থান আলোয় রূপান্তরিত হয়। রূহ যখন তার সফর সম্পন্ন করে এবং তার অবতরণের উদ্দেশ্য যখন সম্পূর্ণ হয়, তখন সে স্বীয় বরজখে পৌঁছে  যায়। আর এইভাবেই সে স্বীয় সৃষ্টির মূলের দিকে প্রত্যাবর্তিত হয়ে, শেষ বিন্দুতে  পৌঁছে যায়।  

বস্তুতঃ কলবও ‘আলমে আরওয়াহ্ বা রূহের জগতের অন্তর্ভুক্ত। কাজেই, তার  অবস্থানও ‘আলমে বরজখে।’  

বস্তুতঃ নফসে মুতমাইন্না বা প্রশান্ত নফস, যার উপর আলমে আমর বা  সূক্ষ্মজগতের একটি রঙ আছে, তা কলব এবং দেহের মধ্যে একটি বরজখ স্বরূপ;  তার অবস্থানের স্থানও একই, কিন্তু জড়দেহ, যা চারটি মৌলিক পদার্থের সমন্বয়ে  গঠিত (আগুন, পানি, মাটি ও বাতাস) তার অবস্থান এই সৃ’ জগতের সঙ্গে; যা  অনুসরণ ও ইবাদতে লিপ্ত হয়।  

নফসে মুতমাইন্না হাসিলের পর, উক্ত নফসের মধ্যে যদি কোনো অবাধ্যতা ও  বিরোধীভাব প্রকাশ পায়, তা, ঐ সমস্ত মৌলিক পদার্থের স্বভাবগত কারণে সৃষ্ট  বলে ধারণা করতে হবে। যেমন— আগুনের অংশ স্বভাবগতভাবে বিদ্রোহ ও  কলহপ্রিয়। সুযোগমতো সেও ইবলিসের মতো— আমি তার (আদমের আ.)  চাইতে শ্রেষ্ট— এই কথা উচ্চারণ করে।  

প্রকৃতপক্ষে নফসে মুতমাইন্না বা প্রশান্ত নফস অবাধ্যতা হতে বিরত থাকে।  কেননা, সে হক তায়া’লা জাল্লা শানুহুর প্রতি রাজী বা সন্তুষ্ট এবং হক সুবহানুহুও  তার প্রতি সন্তুষ্ট। সুতরাং, যারা একে অপরের প্রতি সন্তুষ্ট, তাদের মধ্যে অবাধ্য  আচরণের কোনো অবকাশ নেই। যদি অবাধ্যতা প্রকাশ পায়ই, তবে তা ‘কালেব’  বা জড়দেহসম্ভূত। এই জন্য সাইয়্যেদুল বাশার সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম,  জড়দেহবিশিষ্ট এই ইবলিসী-অবাধ্যতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করাকে জিহাদে আকবর  বলেছেন। আর তার স. এই বাণীঃ আমার শয়তান মুসলমান হয়ে গিয়েছে, তার  অর্থ- প্রকাশ্য শয়তান, যে নবী পাকের স. সংগী। কিন্তু যে শয়তানের বিরুদ্ধে  সংগ্রাম করাকে জিহাদে আকবর বলা হয়েছে, তার অর্থ ‘শয়তানে আনফুসী’ বা  নফসের শয়তান। যদিও এই শয়তানের শক্তি নষ্ট হয় এবং সে অবাধ্য আচরণ  থেকে বিরত থাকে; কিন্তু যা তার স্বভাবজাত- তা কখনোই বিদূরিত হয় না। যেমন, কোনো কবির ভাষায়-  

হাবশীর কালো রং - নিজস্ব তাহার  

কখনো কি দূর হয় - আশ্চর্য ব্যাপার।  

এও হতে পারে যে, শয়তানের অর্থ ‘শয়তানে আনফুসী’ বা আভ্যন্তরীণ  শয়তান। কিন্তু তার ইসলাম কবুল করা মানে এই নয় যে, তাঁর মধ্যে  বিরুদ্ধাচরণের কোনো ক্ষমতাই থাকবে না। তাঁর মুসলমান হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও যদি কেউ কষ্টসাধ্য আমলের পথ পরিহার করে এবং সহজসাধ্য আমলের পথ অনুসরণ  করে— তা অবশ্যই সম্ভব। যদি ঐ ব্যক্তির দ্বারা কোনো সগীরা গুনাহ্ অনুষ্ঠিত  হয়— তাও সম্ভব। বস্তুতঃ নেক্কার লোকদের নেকী, আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্তদের জন্য  বদী বা গোনাহের পর্যায়ভুক্ত। এই সমস্ত বিরুদ্ধাচরণের শামিল। তাঁর মধ্যে  বিরুদ্ধাচরণের শক্তি অবশিষ্ট থাকা তাঁর ইসলাহ বা সংশোধন এবং উন্নতির জন্যই।  

কেননা, এই অবস্থা অর্জনের পর ঐ ব্যক্তির জন্য এমন লজ্জা, অনুশোচনা,  তওবা ও ইস্তিগফার নসীব হয়, যা তাঁর অশেষ উন্নতির কারণ হয়ে থাকে।  তারপর যখন জড়দেহ স্বীয় মাকামে স্থিতি লাভ করে, তখন ছয় লতীফা তার  কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলমে আমর বা সূক্ষ্মজগতে আরোহণ করা সত্ত্বেও,  দুনিয়াতে এই শরীরই তার স্থলাভিসিক্ত থাকে এবং দেহকেই তাদের সকল কাজ  সম্পন্ন করতে হয়। পরে যদি কোনো ইলহাম বা ঐশী নির্দেশ আসে, তখন তা  এই গোশতের টুকরা অর্থাৎ কলবের প্রতি আসে, যা হাকীকতে জামেআ কলবীয়া  হিসাবে খ্যাত। এ সম্পর্কে নবী করীম সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের হাদীছে  বর্ণিত আছেঃ যে ব্যক্তি ইখ্লাসের সাথে চল্লিশ দিন আল্লাহ তায়া’লার জিকির ও  ইবাদতে মশগুল থাকে, হিকমতের প্রস্রবণসমূহ তার কলব থেকে উৎসারিত হয়ে  জবানে প্রকাশ পেতে থাকে। এ হাদীছে বর্ণিত উক্ত কলবের অর্থ— এই  গোশতের টুকরা। আল্লাহ সুবহানুহুই এ সম্পর্কে সমধিক জ্ঞাত। 

অন্যান্য হাদীছেও এ মর্ম পরিষ্কার এবং স্পষ্ট। যেমন নবী করীম সল্লাল্লাহু  আলায়হি ওয়া সাল্লামের ইরশাদঃ ‘অবশ্যই আমার কলব মলিনতায় আচ্ছন্ন হয়’।  বস্তুতঃ এই মলিনতা বা কলুষতা ঐ গোশতের টুকরার উপরই পড়ে থাকে।  কলবের মূল সত্তার উপর নয়। কেননা তা তো এই মলিনতা ও কলুষতা হতে  সম্পুর্ণ মুক্ত।  

অন্যান্য হাদীছে কলবের পরিবর্তনের কথাও বলা হয়েছে। যেমন রসুলুল্লাহ  সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ ‘মুমিনের কলব, আল্লাহ রহমানুর  রাহীমের অংগুলীসমূহের দুইটি আংগুলের মধ্যে।’  

রসুলেপাক সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আরো ইরশাদ করেছেনঃ ‘মুমিনের  কলব পাখির ঐ পালকের মতো যা কোনো জংগল বা প্রান্তরে পড়ে থাকে’। নবী  করীম সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আরো ইরশাদ করেনঃ ‘হে আল্লাহ! হে কলব  সমূহের পরিবর্তনকারী! আমার কলবকে আপনার অনুসরণ ও অনুকরণের উপর  স্থির রাখুন।’  

বস্তুতঃ কলবের এই পরিবর্তন ঐ গোশতের টুকরার জন্য নির্ধারিত। কেননা,  তার মূল সত্তার জন্য এই ধরনের পরিবর্তনের খেয়াল আদৌ করা যায় না। যেহেতু  তা মুতমাইন বা প্রশান্ত এবং তাতে সুদৃঢ়। হজরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ আলায়হিস সালাম যখন কলবের প্রশান্তির জন্য দোয়া করেছিলেন, তখন তারও উদ্দেশ্য ছিলো  এই গোশতের টুকরা; অন্যকিছু নয়। কেননা তাঁর হাকীকি বা মূল কলব তো ছিলো  মুতমাইন বা শান্ত। বরং তাঁর নফস, তাঁর হাকীকি কলবের অনুশাসনে অবশ্যই  প্রশান্ত ছিলো।  

আত্তারিফ্ গ্রন্থ প্রণেতার বক্তব্য সম্পর্কেঃ সাহেবুল আত্তারিফ কাদ্দাসা সিররুহুল্  আযীয বর্ণনা করেছেনঃ ‘ইলহাম ঐ নফসে মুতামাইন্নার সিফাত বা গুণ, যা কলবের  মাকামে উন্নীত হয়। এমতাবস্থায়, সমস্ত রংয়ের মিশ্রণ এবং পরিবর্তন, নফসে  মুতমাইন্নার বা প্রশান্ত নফসের গুণ হয়।’  

‘আত্তারিফ’ গ্রন্থ প্রণেতার এই উক্তি, যেমন তুমি দেখছো, উপরোক্ত হাদীসের  খেলাফ। যদি হজরত শায়েখের এই মাকাম থেকে ঊর্ধ্বারোহণ সম্ভব হতো, যা  সম্পর্কে তিনি উক্তি করেছেন, তবে অবশ্যই তিনি হাকীকতে হাল বা প্রকৃত অবস্থা  সম্পর্কে অবহিত হতে পারতেন এবং আমার বক্তব্যের সত্যতা তিনি বুঝতে সক্ষম  হতেন। এমতাবস্থায় তাঁর কাশফ, ইলহাম- নবী করীম সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া  সাল্লামের হাদীছের অনুরূপ হতো।  

তুমি আমার বক্তব্য সম্পর্কে অবহিত আছ যে, এই গোশতের টুকরা (কলবের  হাকীকতে জামেআ’) খলীফা বা প্রতিনিধি হয়ে যায় এবং তার উপরেই ইলহাম  হয়; আর সে-ই বিভিন্ন হাল বা অবস্থার অধিকারী এবং বিভিন্ন রঙধারী হয়ে যায়।  এই সমস্ত কথা গোঁড়া, মূর্খ এবং প্রকৃত ব্যাপার সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তিদের কাছে  খুবই অপ্রিয় মনে হয়। আমার জানা নেই, তারা নবী করীম সল্লাল্লাহু আলায়হি  ওয়া সাল্লামের এই হাদীছ সম্পর্কে কি বলবেন ‘নিশ্চয় বনী আদমের শরীরের মধ্যে  এক টুকরা গোশত আছে, যখন তা ঠিক হয়ে যায়, তখন সমস্ত শরীর সুস্থ থাকে  এবং যখন তা খারাপ হয়ে যায়, তখন সমস্ত শরীর খারাপ হয়ে যায়। জেনে  রাখো। এই গোশতের টুকরাটির নাম কলব।’  

এই পবিত্র হাদীছে, রসুলেপাক সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম, দৃঢ়তার সঙ্গে এই  গোশতের টুকরাটিকে কলব হিসাবে নির্ধারিত করেছেন এবং শরীরের সুস্থতা ও  অসুস্থতাকে কলবের সুস্থতা ও অসুস্থতার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছে। সুতরাং কলবে  হাকীকি বা প্রকৃত কলবের জন্য যা কিছু সঠিক, তা এই গোশতের টুকরার জন্যও  সঠিক। যদিও এই অবস্থা খেলাফত বা প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে হয়ে থাকে।  

১. সোহরাওয়ার্দী সিল্সিলার বিশিষ্ট শায়েখ-ওমর শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী, স্বীয় চাচা আবু  নজীর সোহ্রাওয়ার্দীর মুরীদ এবং খলীফা ছিলেন। তিনি ৫২৯ হিজরীতে বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন  এবং হিজরী ৬৩২ সনে সেখানেই ইনতিকাল করেন। এই উপমাহাদেশে তাঁহার খলীফা ছিলেন  হজরত বাহাউদ্দীন যাকারিয়া মুলতানী র. শায়েখ শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়াদীর গ্রন্থ ‘আত্তারিফুল  মা’আরিফ’ তাসাউফের অন্যতম গ্রন্থ হিসাবে পরিচিত এবং তা সর্বযুগে সমস্ত সূফিয়ায়ে- কিরামের  নকট খুবই গ্রহণীয়। 

জেনে রাখো! রূহ্ যখন স্বীয় শরীর থেকে ঐ মৃত্যুর দ্বারা, যা প্রচলিত মৃত্যুর  আগে সম্পন্ন হয়, বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়; তখন ‘আরেফে আসেল’ বা সাক্ষাৎকারী ওলী  স্বীয় রূহকে এইরূপ মনে করে যে, রূহ শরীরের সঙ্গে মিলিত নয় এবং শরীর  থেকে পৃথকও নয়; শরীরের মধ্যে প্রবিষ্টও নয় এবং শরীর বহির্ভূতও নয়। আর সে  মনে করে যে, রূহের সম্পর্ক স্বীয় শরীরের সাথে অবশ্যই থাকে, যার উদ্দেশ্য  হলো— শরীরের সুস্থতা। বরং আরো একটি উদ্দেশ্য থাকে, তা হলো— রূহের  পূর্ণতাপ্রাপ্তি এবং এই সম্পর্কটি শরীরের মধ্যে সুস্থতা ও সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। যদি  এই সম্পর্ক না থাকতো তবে শরীর স্বীয় প্রয়োজনীয় উপাদানের প্রেক্ষিতে ক্ষতিগ্রস্ত ও মূল্যহীন হতো।  

যাত পাকের সঙ্গে রূহ ও অন্যান্য লতীফার সম্পর্ক এই ধরনেরই। বস্তুতঃ যাত  পাক না ‘আলম বা সৃষ্টিজগতের মধ্যে প্রবিষ্ট, না সৃষ্টিজগতের বহির্গত, না সৃষ্টির  সঙ্গে মিশ্রিত এবং না সৃষ্টি থেকে পৃথক। বরং ‘আলম বা সৃষ্টিজগতের সঙ্গে হক  তায়া’লা সুবহানুহুর একটি বিশেষ সম্পর্ক আছে এবং সে সম্পর্ক হলো— সৃষ্টিকে  সৃষ্টি করা, স্থায়ী রাখা, রূহের পূর্ণতা বিধানের জন্য ফয়েয প্রদান করা এবং  নেয়ামত ও নেককাজের উপযোগী করা।  

একটি জিজ্ঞাসা এবং তার জওয়াবঃ যদি তুমি প্রশ্ন করো যে, উলামায়ে আহলে  হক বা সত্যের অনুসারী ‘আলেমগণ রূহ সম্পর্কে এ ধরনের কোনো কথা বলেননি,  বরং এ ধরনের বক্তব্যকে তাঁরা নাজায়েয বলেছেন। আর আপনিও সর্বক্ষেত্রে  তাঁদের অনুসরণ ও অনুকরণকে জরুরী মনে করেন। তা সত্ত্বেও আপনার এ  ধরনের উক্তির কারণ কি?  

এই প্রশ্নের জওয়াবে আমার বক্তব্য হলোঃ এ ধরনের লোক খুব কমই আছেন,  যাঁরা রূহের হাকীকত সম্পর্কে অবহিত। নিজেদের জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে, তাঁরা  রূহের চরম উৎকর্ষতার প্রকাশ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছুই বলেন নাই বরং সংক্ষেপে  বর্ণনা করাকে যথেষ্ট মনে করেছেন। সাধারণ লোকদের ভ্রম এবং গুমরাহীতে লিপ্ত  হওয়ার আশংকায়, তাঁরা এ প্রসঙ্গ পরিহার করেছেন। কেননা, রূহানী কামালাত  (বিশেষ একটি স্তরে) বাহ্যতঃ কামালাতে ওয়াজেবুল ওজুদের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ বলে মনে হয়। এই দুয়ের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে, যা উলামায়ে রাসেখ বা  দ্বীনের সঠিক জ্ঞানপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ব্যতীত আর কেউ জানেন না। এই জন্য তাঁরা  সংক্ষেপে বর্ণনা করাকেই যুক্তিযুক্ত মনে করেছেন এবং এর হাকীকত বর্ণনাকারীকে  অস্বীকার করা ভালো মনে করেছেন। বস্তুতঃ ঐ সমস্ত বুজুর্গরা এই কামালাতকে  অস্বীকার করেননি, যার বর্ণনা আগে করা হয়েছে। এই দুর্বল ব্যক্তি (আমি) রূহের  বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ স্বীয় সহীহ ইলম বা সত্য জ্ঞান এবং কাশফে  সুরীহ বা স্পষ্ট কাশফের উপর নির্ভর করে হক সুবহানুহু তায়া’লার সাহায্য ও সহযোগিতায় এবং তাঁর হাবীব আলায়হিস্ সালাত্ ওয়াস্ সালামের দানে বর্ণনা  করেছে। এতদসংগে এই সন্দেহের অবসানও করা হলো, যা এই বিবরণ প্রকাশের  রাস্তায় অন্তরায় ছিলো। কাজেই ব্যাপারটি গভীরভাবে বুঝতে চেষ্টা করো।  

জানা প্রয়োজন যে, শরীর যেমন রূহের দ্বারা প্রচুর উপকার লাভ করে, তদ্রুপ  রূহও শরীরের দ্বারা প্রভুত কল্যাণ হাসিল করে থাকে। এই শরীরের মাধ্যমে রূহ  শ্রবণকারী, দর্শনকারী, কথোপকথনকারী এবং শরীরের মধ্যে একটি ভিন্ন সত্তায়  পরিণত হয়। যার ফলে, রূহ এমন সব কাজকর্ম নিজেই করে, যা আলমে  আজসাম বা জড়জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ শরীরের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়া  ব্যতীত, রূহের জন্য এটা অসম্ভব।)  

আকলে মা’আদ বা পারলৌকিক জ্ঞানঃ উপরে বর্ণিত হয়েছে যে, নফসে  মুতমাইন্না বা প্রশান্ত নফস আলমে আরওয়াহের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আলমে-আজসাদ  বা জড়জগতে আকল তার খলীফা বা প্রতিনিধি হয় এবং আকলে মা’আদ বা  পারলৌকিক জ্ঞান নাম ধারণ করে। এমতাবস্থায় তার যাবতীয় চিন্তা-ভাবনা  আখেরাতের জন্য খাস্ হয়ে যায় এবং দুনিয়ার জিন্দেগী অতিবাহিত করার দুশ্চিন্তা  থেকে সে মুক্ত হয়। আল্লাহতায়ালার তরফ থেকে যে নূর তাঁকে প্রদান করা হয়  তার সাহায্যে সে অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী হয়। এটাই জ্ঞানের চূড়ান্ত মর্তবা।  

একটি অভিযোগ এবং তার জওয়াবঃ অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন কোনো লোক যেনো  এখানে এমন প্রশ্ন না করে যে, জ্ঞানের পূর্ণতার শেষ সীমা এটাই হওয়া উচিত যে,  সে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উভয় বিষয় সম্পর্কে একেবারে সম্পর্করহিত হবে।  কেননা, প্রাথমিক পর্যায়ে তার চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু থাকে কেবলমাত্র হক্ সুবহানাহু  তায়া’লা, দুনিয়া বা আখেরাত নয়।  

এর জবাবে আমার বক্তব্য এই যে, সালেক ফানা ফিল্লাহর মাকামে এই  বিস্মৃতি হাসিল করে। কিন্তু জ্ঞানের পূর্ণতার ব্যাপারে যে আলোচনা এখানে করা  হচ্ছে, তা ঐ মাকাম থেকে বহু মনযিল ঊর্ধ্বে অবস্থিত। এই মাকামে অজ্ঞতার পর  জ্ঞানলাভ হয়, স্থিতিলাভের পর বিচ্ছিন্নতা আসে এবং কুফরে তরীকতের পর (যা  সম্মিলনের ক্ষেত্রে হাসিল হয়) হাকীকি বা প্রকৃত ইসলাম হাসিল হয়। বেওকুফ  দার্শনিকগণ আকলের মধ্যে চারটি স্তর নির্ধারণ করেছেন এবং তারা জ্ঞানের  পূর্ণতার ব্যাপারে একে চারভাগে বিভক্ত করেছেন। এটা তাদের পরিপূর্ণ  অজ্ঞতাপ্রসুত ধারণা। আকল বা জ্ঞানের মূলতত্ত্ব, তার পূর্ণতাপ্রাপ্তি সত্ত্বেও জ্ঞান ও  কল্পনা দ্বারা হাসিল করা সম্ভবপর নয়। এই মূলতত্ত্ব জানার জন্য এমন সহীহ  কাশফ ও স্পষ্ট ইলহামের প্রয়োজন, যা নবুওয়াতের নূরের প্রদীপ থেকে সংগ্রহ  করতে হয়। আল্লাহ্তায়ালার রহমত ও সালাম সমস্ত নবীদের উপর এবং খাস্  করে তাঁর হাবীবের উপর বর্ষিত হোক। 

একটি প্রশ্ন এবং তার উত্তরঃ যদি কেউ একথা জিজ্ঞাসা করে যে, মাশায়েখরা  বলেছেনঃ ‘আকল বা জ্ঞান রূহের অনুবাদক’ তবে তার প্রকৃত অর্থ কি? 

এর উত্তরে আমার বক্তব্য হলোঃ যে ইলম ও মারেফাত রূহানীভাবে তার উৎস  থেকে জারী হয়, কলব তা গ্রহণ করে— যার সম্পর্ক হলো আলমে আরওয়াহ্ বা  রূহের জগতের সঙ্গে। এই কলবের ব্যাখ্যাতা হলো আকল বা জ্ঞান, যে তাকে  নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার পর ঐ ব্যক্তিদের বোধগম্য করায়— যাদের সম্পর্ক এই  জড়জগতের সঙ্গে। কেননা, আকল যদি ব্যাখ্যা না করে, তবে কোনো বিষয় বুঝা  মোটেও সম্ভব হয় না। বস্তুতঃ কলবের গোশতের টুকরা হাকীকতে জামেআ’  কলবীয়া বা কলবের মূলসত্ত্বার একত্রিতকারী। কাজেই, তা-ও আসলের গুণে  গুণান্বিত। সেই হেতু তার গ্রহণ ক্ষমতা রূহের ক্ষমতার অনুরূপ এবং তা  অনুবাদকের প্রত্যাশী।  

প্রকাশ থাকে যে, ‘আকলে মা’আদের উপর একটি সময় এমন আসে, যখন তা  নফসে মুতমাইন্নার প্রতিবেশী হতে আগ্রহী হয় এবং এই আগ্রহ এতদূর বেড়ে যায়  যে আকলে মাআ’দকে নফসে মুতমাইন্না মাকাম পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। এমতাবস্থায়,  আকলে মাআ’দ শরীরকে শূন্যভাবে পরিত্যাগ করে। তখন জ্ঞানের ও স্মরণের  যোগ্যতা (আকলে মাআ’দের পরিবর্তে) এ কলব রূপ গোশতের টুকরার মধ্যে স্থান  লাভ করে। এই বর্ণনার মধ্যে তাদের জন্য অবশ্যই নসীহত আছে, যাদের কলব  আছে। এই সময় কলব স্বীয় ব্যাখ্যাদানকারী হয় এবং আরেফের মুআ’মিলা বা  সম্পর্ক শরীরের সংগে হয়। ‘আমি তার থেকে শ্রেষ্ঠ’— শরীরের আগুনজাত এই  বিদ্রোহী স্বভাবও এই অবস্থায় অনুগত হয়ে যায় এবং হাকীকি ইসলাম লাভ হয়।  তখন তার ইবলিসের পোশাক খসে পড়ে এবং তাকে আসল নফসে মুতমাইন্নার  মাকামে পৌঁছানো হয় এবং তার স্থলাভিসিক্ত করা হয়। বস্তুতঃ শরীরের মধ্যে  কলবে হাকীকি বা প্রকৃত কলবের খলীফা হয় গোশতের টুকরা কলব এবং নফসে  মুতমাইন্নার স্থলাভিষিক্ত হয়- আগুনের অংশ। যেমন কোন কবির ভাষায়- 

ইশকের পরশ যদি পড়েও তামায়  

স্পর্শের কারণে তামা সোনা হ’য়ে যায়।  

মানবদেহের দ্বিতীয় অংশ হলো— বাতাস। বাতাসও রূহের সঙ্গে সম্পর্কিত।  কাজেই, সালেক যখন বাতাসের মাকামে পৌঁছে, তখন সে বাতাসকে হক্ প্রাপ্তি বা  খোদাপ্রাপ্তি হিসাবে ধারণা করে এবং সেখানেই আবদ্ধ হয়ে পড়ে। যেমন রূহের  মাকামেও এই ধরনের ত্র“টিপূর্ণ মুশাহিদা বা দর্শন হাসিল হয়ে থাকে। সালেক এই  দর্শনে বিভোর হয়ে যায়। কোনো একজন বুজুর্গ বর্ণনা করেছেনঃ আমি দীর্ঘ  তিরিশ বৎসর ধরে রূহকে আল্লাহ মনে করে ইবাদত করেছি। অতঃপর এই মাকাম অতিক্রমের পর, হক বাতিল পার্থক্য ধরা পড়ে। এই বায়ুর অংশ— রূহের  মাকামের সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকার কারণে শরীরের মধ্যে রূহের স্থলাভিসিক্ত হয় এবং  কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা রূহের মতো হয়ে যায়।  

মানবদেহের তৃতীয় অংশ হলো পানি। পানি ‘হকীকতে জামেআ কল্বীয়া’ বা  কলবের মূলসত্তার একত্রিতকারীর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এজন্য এর ফয়েয সকল  বস্তুর উপর পৌঁছে। যেমন আল্লাহতায়ালার ইরশাদঃ ‘আমি পানি হতে প্রত্যেক  বস্তুর জীবনদান করেছি।’ এর প্রত্যাবর্তনস্থানও হলো— এই কলব, যা গোশতের  টুকরা মাত্র।  

মানবদেহের চতুর্থ অংশ হলো মাটি। মাটিই শরীরের প্রধানতম অংশ। স্বীয়  সত্তার নীচতা ও হীনতা সত্ত্বেও (যা এর স্বভাবগত) পবিত্রতা হাসিলের পর এটাই  এই দেহের উপর আধিপত্য বিস্তার করে এবং এর রঙ ধারণ করে। মাটির এই  আধিপত্য, এর পরিপূর্ণ আধিক্যের কারণে হয়ে থাকে। কেননা, দেহের প্রতিটি  অংশ প্রকৃতপক্ষে মাটিরই অংশ। আর একারণেই, এই পৃথিবী সমস্ত মূল পদার্থ ও  নভোমণ্ডলের কেন্দ্রস্থল এবং এই পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল এবং সমস্ত জাহানের  কেন্দ্রবিন্দু। এমতাবস্থায় শরীর এর মূল লক্ষ্যে পৌঁছায় এবং এর জন্য সর্বশেষ  বিন্দুতে উরুজ বা ঊর্ধ্বারোহণ এবং নুযুল বা অবতরণ স্থির হয়। এই সময় সে পূর্ণ কামালিয়াত হাসিল করে। এটাই ঐ নেহায়েত বা শেষপ্রান্ত, যা বেদায়েত বা  প্রারম্ভের দিকে প্রত্যাবর্তিত হয়।  

ফরক বা’আদুল জমআ’ বা একত্রিত হওয়ার পর বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কেঃ জানা  প্রয়োজন যে, যদিও রূহ স্বীয় মর্তবা অনুযায়ী তার অধীনস্থদের সঙ্গে ঊর্ধ্বাগমন  দ্বারা নিজের মাকামে পৌঁছে, তথাপি তা দেহের তারবীয়াত বা প্রতিপালনের  উদ্দেশ্যে এই দুনিয়ার প্রতি মনোনিবেশ করে। তারপর শরীরের কাজ যখন  পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়, তখন রূহ অন্যান্য লতীফা, সের, খফী, আখফা, কলব নফস এবং  আকলসহ আল্লাহতায়ালার প্রতি পূর্ণরূপে মনোযোগী হয় এবং দেহের সাথে সম্পর্ক  বিচ্ছিন্ন করে। এমতাবস্থায়, শরীর পূর্ণরূপে ‘উবুদিয়াত বা দাসত্বের মাকামে  পৌঁছে। অবশেষে রূহ স্বীয় মর্তবার সঙ্গে মাকামে শুহুদ বা দর্শনের স্থানে স্থিত হয়  এবং আল্লাহ দর্শন ব্যতীত অন্য সব কিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। অন্যদিকে,  শরীরও পূর্ণরূপে অনুসরণের মাকামে স্থির ও অটল হয়। এই হলো- ফরক বা’  আদুল জামআ’র মাকাম বা একত্রিত হওয়ার পর বিচ্ছিন্নের মাকাম। আল্লাহ  সুবহানুহুই কামালাত বা পূর্ণতা প্রদানের মালিক। এই ফকীর এই মাকামে  বিশেষভাবে বিচরণ করেছে। এই মাকামে রূহ স্বীয় সমস্ত মর্যাদা সহকারে ‘আলমে  খালক্’ বা সৃষ্টিজগতের দিকে প্রত্যাবর্তন করে, যাতে লোকদিগকে আল্লাহ জাল্লা  শানুহুর দিকে দাওয়াত দিতে পারে। এই সময় রূহ কালেব্ বা শরীরের ন্যায় হয়ে যায় এবং তার অনুসারী হয়। আর অবস্থা এমন হয় যে, যদি শরীর হাজির থাকে  তবে রূহও হাজির বা মনোযোগী থাকে এবং শরীর যদি গাফেল থাকে, তবে রূহও  গাফেল বা অমনোযোগী থাকে। অবশ্য নামাজ আদায়কালে রূহ স্বীয় সমস্ত মর্তবানুযায়ী আল্লাহতায়ালার দিকে মুতাওয়াজ্জাহ বা মনোযোগী হয়, যদিও শরীর  গাফেল বা অমনোযোগী থাকে। কেননা, নামাজ তো মুমিনের জন্য মি’রাজস্বরূপ।  

দাওয়াতের মাকামঃ স্মর্তব্য যে, (আল্লাহর সঙ্গে) মিলিত ব্যক্তির এই  প্রত্যাবর্তন, দাওয়াতের জন্য সর্বোত্তম মাকাম। এই গাফলত বা অমনোযোগিতা  একটি বিরাট জামা’আতের মনোযোগিতার কারণ হয়। গাফেল ব্যক্তিরা এই  অমনোযোগিতার হাকীকত সম্পর্কে অজ্ঞ। অপরপক্ষে, যারা মনোযোগী, তারা এই  রুজু বা প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে ওয়াকিফহাল নয়। প্রকৃতপক্ষে এই মাকামটি প্রশংসা  পাওয়ার যোগ্য, কিন্তু বাহ্যতঃ তা নিন্দার যোগ্য বলে মনে হয়। স্বল্পজ্ঞানসম্পন্ন  কোনো ব্যক্তি বিষয়টি উপলব্ধি করতে সক্ষম নয়। আমি যদি এই গাফলাত বা  অমনোযোগিতার কামালাত সম্পর্কে বর্ণনা করি, তখন অবশ্য কেউই কখনো  মনোযোগী হওয়ার খাহেশ বা আশা করবে না।  

এটা সেই গাফলাত- যা মানব প্রকৃতিকে ফিরিশতার উপর ফযীলত বা শ্রেষ্ঠত্ব  দিয়েছে। এটা তো সেই গাফলাত যা মোহাম্মদ রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া  সাল্লামকে সমস্ত জাহানের জন্য রহমত স্বরূপ করেছে। এটা ঐ গাফলাত- যা  বেলায়েতের দরজা থেকে নবুয়তের দরজায় পৌঁছে দেয়। আর এটা তো সেই  গাফলাত- যা নবুয়ত হতে রেসালাতের দরজায় পৌঁছে দেয়। এটা তো ঐ  গাফলাত- যা মানুষের মধ্যে বসবাসকারী আল্লাহর ওলীদিগকে নির্জনবাসী  ওলীদের উপর শ্রেষ্ঠ করেছে। এটাতো সেই গাফলত যা হজরত মোহাম্মদ  সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে, হজরত সিদ্দীকে আকবরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান  করেছে। অথচ তাদের অবস্থা ছিলো একটি ঘোড়ার দুইটি কানের মতো। এটা তো  সেই গাফলাত যা হুঁশকে বেহুঁশীর উপর প্রাধান্য দেয়। এটা তো সেই গাফলাত-  যা নবুওতকে বেলায়েতের উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করে। স্বল্পজ্ঞানী ব্যক্তিদের  খেয়ালের বরখেলাফ এটা ঐ গাফলত- যার কারণে কুতুবে ইরশাদ, কুতুবে  আবদালের উপর প্রাধান্য পায়। এটা ঐ গাফলত যা সিদ্দীকে আকবর রদ্বিয়াল্লাহু  আনহু কামনা করতেন। যেমন তিনি বলতেন— হায় আক্ষেপ! আমি যদি  মোহাম্মদ স. এর একটি ভুল বা বিস্মৃতি সদৃশ হতে পারতাম। এটা সেই  গাফলত- যার সামনে মনোযোগিতা, তুচ্ছ খাদেমের মতো। অবশ্যই এটা ঐ  গাফলত যা মনজিলে মাকসুদে পৌঁছাবার জন্য অগ্রদূত স্বরূপ। হাঁ, এটা সেই  গাফলত- যা বাহ্যতঃ নিন্দনীয় মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে সম্মানিত। অবশ্যই এটা  সেই গাফলত যা বিশেষ ব্যক্তিকে, সাধারণ ব্যক্তির পর্যায়ভুক্ত করে এবং সাধারণ লোকদের জন্য এই অবস্থা কামালাত প্রাপ্তির রাস্তায় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। যেমন  কোনো কবি বলেন, ‘বলি যদি ব্যাখ্যা এর হবে যে অনেক।’ কম কথায় অনেক  কিছু জানা যায়। এক ফোঁটা পানি তো অথৈ সমুদ্রেরই অংশ। তাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক, যারা হেদায়েতের অনুসারী এবং হজরত মোহাম্মদ মোস্তফা  সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের পূর্ণ অধীন।  

_______________

কিতাব: মাবদা ওয়া মা'আদ

কৃত: হজরত মুজাদ্দেদে আলফে সানী রহমাতুল্লাহি  আলাইহি

অনুবাদ: ড. আ ফ ম আবু বকর সিদ্দীক

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন