সুলূকের প্রারম্ভঃ যখন কোনো তালেব কোনো শায়েখের খেদমতে হাজির হবে, তখন শায়েখের উচিৎ, তাকে ইস্তিখারা করতে বলা। তিন থেকে সাতবার পর্যন্ত ক্রমাগত ইস্তিখারা করাতে হবে। ইস্তিখারা করানোর পর তালেবের মধ্যে যদি কোনোরূপ অস্থিরভাব না দেখা যায়, তখন তার তরবীয়াত বা প্রতিপালনের কাজ শুরু করতে হবে। প্রথমেই তাকে তওবা করার পদ্ধতি শিক্ষা দিতে হবে এবং দুই রাকা’আত তওবার নামায আদায় করতে বলতে হবে। কেননা, তওবা হাসিল ব্যতীত এই পথে অগ্রসর হওয়া আদৌ ফলদায়ক নয়। প্রথমে সংক্ষিপ্ত তওবাকেই যথেষ্ট মনে করবে এবং পূর্ণ তওবাকে আগামী দিনের উপর সোপর্দ করবে। কেননা, আজকাল মানুষের হিম্মত খুবই কম। যদি প্রথমেই মানুষের উপর ব্যাপক তওবা হাসিল করার তক্লীফ দেওয়া হয়, তবে অবশ্যই তা হাসিলের জন্য অনেক সময়ের প্রয়োজন। আর সম্ভবতঃ এই সময়ে তাঁর অন্বেষণে ভাটা পড়তে পারে এবং আসল মাকসুদ থেকে সে বিরত থাকতে পারে। এমনও হতে পারে যে, সে ব্যক্তি আসলে ঠিকমত তওবাও করতে পারবে না।
অতঃপর যে তরীকাটি তালেবের যোগ্যতা অনুযায়ী উপযুক্ত মনে হবে, তাকে সেই তরিকায় তা’লীম বা শিক্ষা দিতে হবে। আর যে জিকির তার যোগ্যতানুসারে ভালো মনে হবে, সেই জিকিরেরই তালকীন দিবে এবং তার ব্যাপারে পূর্ণ মনোযোগী হতে হবে। তার হালের বা অবস্থার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে এবং এই রাস্তার আদব ও শর্তগুলি তাঁকে জানাতে হবে। কোরআন, সুন্নাহ্ ও সালফে সালেহীনদের অনুসরণের জন্য তাকে অনুপ্রাণিত করা চাই। কেননা, এই পায়রবী বা অনুসরণ ব্যতীত কাঙ্খিত বস্তু লাভ করা সম্ভব নয়। তাকে এটাও জানিয়ে দিতে হবে, যে সমস্ত কাশফ এবং অবস্থা সংঘটিত হবে, তা যদি সামান্য পরিমাণ কোরআন ও সুন্নাহর বিপরীত হয়, তবে তার দিকে আদৌ ভ্রূক্ষেপ করবে না; বরং তার থেকে তওবা ও ইস্তিগফার করবে। একই সাথে তাকে এই নসীহতও করা প্রয়োজন, যেনো সে নাজাতপ্রাপ্ত দল অর্থাৎ আহলে সুন্নাহ্ ওয়াল জামাআতের মতানুযায়ী আকীদাগুলি দুরস্ত করে নেয় এবং ফিকাহের জরুরী হুকুম আহকামগুলি
১.পূর্ববর্তী নেক্কারগণ, ২. অন্তর চক্ষুদ্বারা অবলোকন।
জেনে নিয়ে তদনুয়ায়ী আমল করে। কেননা, ইতিকাদ বা দৃঢ়বিশ্বাস এবং আমল এই দুইটি ডানা ব্যতীত, এই রাস্তায় ভ্রমণ করা সম্ভব নয়। এছাড়া আরো তাগিদ করবে, যেন হারাম ও সন্দেহযুক্ত খাবার থেকে পূর্ণরূপে সর্তকতা অবলম্বন করে। খাদ্য হিসাবে যা মিলবে এবং যেখান থেকে মিলবে— তাই যেনে ভক্ষণ না করে; যতোক্ষণ না সে খাদ্য শরীয়তের স্পষ্ট দলিল অনুসারে হালাল হয়। মূলকথা, সব ব্যাপারে এই আয়াতে কারীমাকে চলার দিশা হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। যেমন আল্লাহরনির্দেশঃ ‘আল্লাহর রসূল তোমাদেরকে যা করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন, তা প্রতিপালন করো এবং যা নিষেধ করেছেন, তা থেকে দূরে থাকো।’ (৫৯:৭)
তরীকার অন্বেষণকারীদের হালত দুই ধরনেরঃ হয়তো সে কাশফ ও মারেফাতধারী হবে, নয়তো অজ্ঞ ও হতবুদ্ধিসম্পন্ন হবে। কিন্তু সুলূকের রাস্তা অতিক্রম করার পর এবং পর্দাসমূহ অপসারিত হওয়ার পর উভয় দলই লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে যায়। লক্ষ্যস্থলে পৌঁছানোর ব্যাপারে কোনো দলই বিশেষ মর্যাদার দাবীদার নয়। যেমন, ঐ দুই ব্যক্তি, যারা দূর দূরান্তের রাস্তা অতিক্রম করে কাবা শরীফে পৌঁছায়। এদের মধ্যে একজন রাস্তার পার্শ্বের দর্শনীয় বস্তু দেখতে দেখতে যায় এবং নিজের যোগ্যতানুযায়ী তা অনুধাবন করে এবং দ্বিতীয় জন চোখ বন্ধ করে গমন করে এবং পথিমধ্যেকার কোনো দৃশ্যই অবলোকন করে না। কাবা শরীফে পৌঁছানোর ব্যাপারে এই দুজনই সমান মর্যাদাসম্পন্ন এবং সেখানে পৌঁছানোর ব্যাপারে কেউ কারো চেয়ে অধিক মর্যাদার হকদার নয়। যদিও রাস্তার মঞ্জিলসমূহ চেনা ও দেখার ব্যাপারে উভয়ের মধ্যে বিরাট ব্যবধান বিদ্যমান, কিন্তু উদ্দিষ্ট স্থানে পৌঁছানোর পর উভয়ের জন্য অজ্ঞতা জরুরী হয়ে পড়ে। কেননা, আল্লাহর জাত সম্পর্কে পরিচয় লাভ করার অর্থই হলো মারেফাত থেকে অজ্ঞ এবং অক্ষম হওয়া।
সুলূকের মঞ্জিল বা স্তরঃ জানা দরকার যে, সুলূকের মঞ্জিলসমূহ অতিক্রম করার অর্থই হলো— ১০টি মাকাম বা স্থান অতিক্রম করা। এই দশটি মাকাম অতিক্রম করা তিন প্রকার তাজাল্লী যথা— তাজাল্লীয়ে আফ’আল, তাজাল্লীয় সিফাত ও তাজাল্লীয়ে যাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
১. দশটি মাকাম : ১. তওবা-পাপকাজ পরিহার; ২. ইনাবাত-আল্লাহরদিকে প্রত্যাবর্তন; ৩. জোহদ-কামনা বাসনা পরিত্যাগ; ৪. অরা-আল্লাহ ভীতি; ৫. শোকর-কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, ৬. তাওয়াক্কুল-আল্লাহরপ্রতি নির্ভরশীলতা; ৭. তাসলীম- আল্লাহরআদেশ নিষেধ সর্বান্তকরণে গ্রহণ; ৮. রিযা-সর্বাবস্থায় আল্লাহরইচ্ছায় সন্তুষ্ট থাকা; ৯. ছবর- বিপদাপদে ধৈর্যধারণ এবং ১০. কানাআত- অল্পে তুষ্ট থাকা।
এই দশটি বিষয়কে ১০টি মাকাম বলা হয়। এই মাকামগুলি দশ লতিফা যথা- কলব, রূহ, সের, খফী, আখফা, নফস, আব, আতশ, খাক ও বাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত- উক্ত দশ লতিফায় তাজাল্লীয়ে আফ’আল, তাজাল্লীয়ে সিফাত ও তাজাল্লীয়ে যাতের ফয়েজ পতিত হয়ে-উপরোক্ত ১০টি গুণে গুণান্বিত হলে, বেলায়েত বা ওলীত্বের মর্যাদা লাভ হয়।
রিযার মাকাম ব্যতীত অন্যান্য সমস্ত মাকাম তাজাল্লীয়ে আফ’আল ও তাজাল্লীয়ে সিফাতের সঙ্গে সম্পর্কিত। কেবলমাত্র রিযার মাকামটি তাজাল্লীয়ে যাতে হকতায়ালা ও তাকাদ্দাসা এবং মহব্বতে যাতীর সঙ্গে সম্পৃক্ত, যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলো— প্রেমাস্পদের দিক থেকে সুখ বা দুঃখ যাই-ই আসুক না কেনো, প্রেমিকের জন্য উভয়ই সমান। এমতাবস্থায় পূর্ণ রিযা হাসিল হয় এবং অসন্তুষ্টি বিদূরিত হয়ে যায়। একইরূপে, অন্যান্য মাকামের পূর্ণতাপ্রাপ্তি তাজাল্লীয়ে যাতি হাসিল করার পরই সম্ভব। কেননা, পূর্ণ ফানা বা লয় প্রাপ্তি এই তাজাল্লির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। বস্তুতঃ অবশিষ্ট নয়টি মাকাম তাজাল্লীয়ে আফ’আল ও তাজাল্লীয়ে সিফাতের মধ্যেই হাসিল হয়ে থাকে। যেমন যখন কেউ নিজের ও যাবতীয় বস্তুর উপর হকতায়া’লা সুবহানুহুর কুদরতকে প্রত্যক্ষ করে, তখন সে সাথে সাথেই তওবার প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে তাক্ওয়া বা পরহেজগারী ইখতিয়ার করে। আর আল্লাহর কুদরতের উপর ধৈর্য ধারণ করে, অধৈর্য ও অক্ষমতা হতে মুক্তিলাভ করে। আর সে তখন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে পারে যে, নেয়ামতের একমাত্র মালিক আল্লাহ এবং কিছু দেওয়া ও না দেওয়া একমাত্র তাঁরই ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল, এমতাবস্থায় সে ব্যক্তি শোকরের মাকামে উন্নীত হয় এবং তাওয়াককুলের ক্ষেত্রে দৃঢ়চিত্তের অধিকারী হয়। আর যখন হক তায়া’লার করুণা ও মেহেরবানির ফয়েয তার উপর আপতিত হয়, তখন সে রিযার মাকামে প্রবেশ করে। অতঃপর যখন সে আল্লাহতায়ালার আজমত ও মহত্বকে অনুধাবন করে, তখন তাঁর দৃষ্টিতে এই দুনিয়াটি হেয় ও নিকৃষ্ট মনে হয়। এমতাবস্থায়, দুনিয়ার প্রতি তার অনুরক্তি হ্রাস পায় এবং কৃচ্ছতা ও জোহদ ইখতিয়ার করে। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, এই মাকামগুলি বিস্তারিতভাবে হাসিল করা সালেক মাজযুবের জন্যই নির্ধারিত। অপরপক্ষে মাজযুব সালেক এই মাকামগুলি সংক্ষেপে অতিক্রম করেন।
কেননা আল্লাহরআকর্ষণ তাকে এমনভাবে বিভোর রাখে যে, সে এই মাকামগুলির বিস্তারিত অবস্থার প্রতি দৃষ্টি দিতে পারে না। সে মহব্বতের ছত্রছায়ায় এই মাকামগুলির সারবস্তু ও মঞ্জিলসমূহের পূর্ণতা হাসিল করে, যা বিস্তারিতভাবে অতিক্রমকারীর জন্য লাভ করা সম্ভব হয় না।হেদায়েতের অনুসারীদের প্রতি সালাম।
_______________
কিতাব: মাবদা ওয়া মা'আদ
কৃত: হজরত মুজাদ্দেদে আলফে সানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি
অনুবাদ: ড. আ ফ ম আবু বকর সিদ্দীক
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন