আল্লাহর ওলীগণ মানবীয় গুণের উর্ধ্বে নন

 আল্লাহর ওলীগণ মানবীয় গুণের উর্ধ্বে নন- এ সম্পর্কে:  আল্লাহতায়ালার ওলীদের পর্দা এবং আবরণ হলাে— তাঁদের মানবীয় গুণাবলী। সব লােকেরা যে সমস্ত জিনিসের মুখাপেক্ষী হয়, তাঁরাও ঐ সব জিনিসের মুহতাজ বা মুখাপেক্ষী। বেলায়েত বা ওলীত্ব তাদের এই সব প্রয়ােজন থেকে বেনিয়া বা অমুখাপেক্ষী করে না। তাদের ক্রোধও অন্যান্যদের ক্রোধের ন্যায় হয়ে থাকে। যখন নবী করীম সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এইরূপ ইরশাদ করেনঃ আমিও ঐরূপ রাগান্বিত হই, যেমন অন্যান্য লােকেরা রাগান্বিত হয়; তখন আল্লাহর ওলীগণ এ অবস্থায় কিরূপে মুক্তি পেতে পারেন? একইভাবে, এই বুজুর্গরা পানাহার, পরিবার পরিজনদের সাথে মেলামেশা, আচার-আচরণের ক্ষেত্রে অন্যান্যদের মতােই মানুষ। মানবীয় বিভিন্ন প্রয়ােজনের ক্ষেত্রে তারা সাধারণ মানুষের সমতুল্য। এ পর্যায়ে আল্লাহতায়ালা স্বীয় নবী আলায়হিমুস সালামদের সম্পর্কে ইরশাদ করেনঃ ‘আমি তাদের শরীরকে এমন বানাইনি, যাতে তারা খাদ্য ভক্ষণ করবে না। অপরপক্ষে, কাফেররা প্রকাশ্যে এরকম বলতাে যে, এই রসুলদের কি হয়েছে যে, তারা খাদ্য ভক্ষণ করে এবং বাজারেও চলাফেরা করে?' কাজেই, যাদের দৃষ্টি আহলুল্লাহ বা আল্লাহর পরিজনের বাহ্যিক দিকে পড়েছে, তারা বঞ্চিত হয়েছে এবং দুনিয়া ও আখেরাতে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এই প্রকাশ্য দর্শন— আবু জেহেল ও আবু লাহাবকে ইসলামের সম্পদ থেকে বঞ্চিত করেছে এবং তাদেরকে চিরস্থায়ী ক্ষতির সম্মুখীন করেছে। তারাই সৌভাগ্যের অধিকারী, যারা আহলুল্লাহদের বাহ্যিক অবস্থার প্রতি দৃষ্টিপাত করে না; বরং তাদের দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা, ঐ সমস্ত বুজুর্গদের বাতিনী সিফাত বা গােপন গুণাবলী পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এরা মিশরের নীলনদ সমতুল্য যে, মাহজুবীন বা পর্দায় আবরিত ব্যক্তিদের জন্য যে পানি বিপদ সংকুল-তুফান সদৃশ্য এবং মাহ্বুবীন বা প্রিয় লােকদের জন্য তাই-ই জীবন দানকারী সলিল। 

মানবীয় গুণাবলী বড়ই আশ্চর্য ধরনের। মানবীয় স্বভাব আহলুল্লাহদের মধ্যে যতটুকু প্রকাশ পায়, অন্যদের মধ্যে তা প্রকাশিত হয় না। এর কারণ এই যে, ময়লা এবং আবর্জনা যদি কমও হয়, সেটা সমতল এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন স্থানে অধিক দৃষ্টিগােচর হয়। অপরপক্ষে, অসমতল ও অপরিষ্কার স্থানে ময়লা-আবর্জনা যদি অধিকও হয়, তবুও তা দেখা যায় না।  বস্তুতঃ মানবীয় গুণাবলীর অসৎ ও অন্ধকারময় দিকগুলাে, সাধারণ লােকদের মধ্যে পূর্ণরূপে প্রবেশ করে এবং শরীরসহ কলব ও রূহতেও আধিপত্য বিস্তার করে। পক্ষান্তরে, বিশেষ লােকদের মধ্যে এই অন্ধকার, কেবল তাদের শরীর ও নফসের মধ্যে সীমিত থাকে এবং খাসসুল-খাস্ বা বিশিষ্টতর ব্যক্তিদের নফসও এই জুলমাত বা অন্ধকার হতে বিমুক্ত থাকে। কেবলমাত্র তাদের শরীরই এর দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়। 

লক্ষ্যণীয় যে, এই জুলমাত সাধারণ লােকদের জন্য ধ্বংস ও ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে এবং বিশেষ লােকদের জন্য তা পূর্ণতা ও সজীবতার কারণ হয়। বিশেষ ব্যক্তিদের এই অন্ধকার- সাধারণ লােকদের অন্ধকারসমূহকে দূরীভূত করে। তাদের কলবসমূহে পবিত্রতা আনে এবং নফসসমূহকে তাযকীয়া বা পরিচ্ছন্নতা প্রদান করে। যদি এই জুলমাত না হতাে, তাহলে বিশেষ ব্যক্তিদের সাধারণ লােকদের সঙ্গে কোনাে সম্পর্কই থাকতাে না এবং ইফাদাহ বা উপকার দেওয়া ও ইফতিফাদা বা উপকার গ্রহণ করার রাস্তা বন্ধ হয়ে যেতাে। আর এই জুলমাত বিশেষ ব্যক্তিদের মধ্যে এই পর্যায়ের থাকে না, যা তাদের কলুষিত করে । বরং এই কারণে যে অনুশােচনা ও ইস্তিগফার তারা করেন সেটা এমনই হয় যে, যার ফলশ্রুতিতে সমস্ত ময়লা-আবর্জনা দূরীভূত হয়ে যায় এবং আরাে অধিক তরক্কী বা উন্নতি লাভ করে। এই জুলমাত বা অন্ধকার ফিরিশতাদের মধ্যে নেই। যার ফলে তাদের উন্নতির রাস্তাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। একে জুলমাত বলাতাে এমনই প্রশংসা— যা দুর্নামের সঙ্গে সম্পৃক্ত। চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায় বে-খবর সাধারণ লােকেরা, আহলুল্লাহদের মানবীয় গুণাবলীকে, নিজেদের মানবীয় গুণাবলীর মতাে মনে করে এবং এই কারণে, তারা বঞ্চিত এবং অপমানিত হয়ে থাকে। অদৃশ্য বস্তুকে দৃশ্যমান মনে করাতেই এই রকম ভুলের সৃষ্টি হয়। প্রত্যেক মাকামের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য হয় এবং প্রত্যেক জায়গার জন্য ভিন্ন ভিন্ন সামগ্রীর প্রয়ােজন হয়। তাঁদের উপর শান্তি বর্ষিত হােক, যারা হেদায়েতের অনুসারী এবং হজরত মােহাম্মদ মােস্তফা সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর পরিবার পরিজনদের অনুসরণ ও অনুকরণ করাকে যারা কর্তব্য বলে মেনে নিয়েছে, তাঁদের উপরও শান্তি নাযিল হােক। 

_______________

কিতাব: মাবদা ওয়া মা'আদ

কৃত: হজরত মুজাদ্দেদে আলফে সানী রহমাতুল্লাহি  আলাইহি

অনুবাদ: ড. আ ফ ম আবু বকর সিদ্দীক

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন