ইলমে জাহির , ইলমে বাতিন -পীর ও উস্তাদের সম্মান

 

ইলমে জাহির , ইলমে বাতিন -পীর ও উস্তাদের সম্মান সম্পর্কেঃ ইলমের ফযীলত, জ্ঞাত বিষয়ের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা অনুসারে হয়ে থাকে।জ্ঞাত বিষয়টি যতোই মর্যাদাসম্পন্ন হবে , তার 'ইলম' বা জ্ঞানও ততো উঁচু স্তরের হবে । সুতরাং ইলমে বাতিন , যার সাথে সুফীয়ায়ে কিরামদের বিশেষ সম্পর্ক, তা ইলমে জাহির হতে উত্তম যা জাহিরী আলেমদের অংশ। ইলমে জাহির (কোরআন হাদীসের প্রকাশ্য বিদ্যা ) ক্ষৌর বিদ্যা ও তন্তু বিদ্যা হতে শ্রেষ্ঠ ।

কাজেই , পীরের মর্যাদার দিকে খেয়াল  রাখা, যার নিকট হতে বাতিনী ইলম শিক্ষা করা হয়, ঐ উস্তাদের মর্যাদা হতে কয়েক গুণ অধিক , যার নিকট হতে জাহিরী ইলম শিক্ষা করা হয়। একইরূপে জাহিরী ইলমের উস্তাদের মর্যাদার প্রতি খেয়াল  রাখা, ঐ উস্তাদের মর্যাদার চাইতে অনেক অধিক — যার নিকট হতে ক্ষৌর বিদ্যা ও তন্তু বিদ্যা শিক্ষা করা হয়। এমন পার্থক্য জাহিরী ইলমের প্রতিটি শাখায় বিদ্যমান ।

বস্তুতঃ ইলমে কালাম এবং ফিকাহ্ শাস্ত্রের উস্তাদ, ইলমে নুহ ও সরফের (ব্যাকরণ ও বাক্যলংকার শাস্ত্রের) উস্তাদের চাইতে অধিক সম্মানিত । নুহ ও সরফের উস্তাদ, দর্শনের উস্তাদের চাইতে অধিক শ্রেয় । এটা এই জন্য যে , দর্শনশাস্ত্র বিশ্বস্ত ইলম সমূহের  মধ্যে গণ্য নয়। এই জ্ঞানের অধিকাংশ আলোচ্য বিষয় বেহুদা ও অপ্রয়োজনীয় এবং এতে অনেক কম বিষয় আছে , যা ইসলামী গ্রন্থসমূহ হতে নেওয়া হয়েছে । তারা এতে এমন পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেছে যে, যার ফলে তারা পণ্ডিত মূর্খ (?)  ব্যতীত আর কিছুই হয়নি । কেননা , এখানে জ্ঞানের কোনাে স্থান নেই । নবুয়তের ধারায় প্রাপ্ত জ্ঞান, ‘আকলে নজরী্' বা দর্শনীয় জ্ঞান হতে সম্পূর্ণ আলাদা।

এখানে উল্লেখ্য যে , পীরের হক অন্য সকলের হকের চাইতে অধিক । বরং বলা যায় যে ,পীরের হকের সাথে অন্য কারো হকের  তুলনাই হতে পারে না। হক সুবহানুহুর অনুগ্রহরাজী এবং তাঁর রসুল সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের ইহসানের পরেই পীরের হকের দর্জা। বরং সকলেরই হাকীকি পীর তো স্বয়ং রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম। যদিও জাহিরী জন্ম মাতাপিতার মাধ্যমে হয়ে থাকে ,কিন্তু প্রকৃত জন্ম পীরের সাথে সংশ্লিষ্ট । বাহ্যিক জন্মের হায়াত তো মাত্র কিছু দিনের জন্য। কিন্তু প্রকৃত জন্মের হায়াত চিরস্থায়ী। পীর তো তিনিই, যিনি মুরীদের বাতিনী অপবিত্রতা পরিষ্কারকারী এবং কলব ও রূহের দ্বারা মুরীদের অভ্যন্তরের অপবিত্র জিনিস সমূহ পরষ্কিার করে তিনি তার আত্মাকে পরিশুদ্ধ করেন । কোনাে মুরীদকে তাওয়াজজুহ দেওয়ার সময় অনুভূত হয় যে , তার বাতিনী অপবত্রিতা সমূহ তাওয়াজ্জুহ্ প্রদানকারী ব্যক্তির উপরও মলিনতার প্রভাব বিস্তার করে , যা তন্মধ্যে বহুক্ষণ পর্যন্ত স্থায়ী থাকে । পীরই একমাত্র ব্যক্তি , যার অসীলায় মানুষ মহিমান্বিত আল্লাহ্ পর্যন্ত পৌঁছে থাকে ; যা দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট। পীরের অসীলাতেই ‘নফসে আম্মারা'— যা সৃষ্টিগতভাবে ‘খাবাস' বা কলুষিত , তা পবিত্রতা হাসিল করে এবং পরিশুদ্ধ হয় এবং ‘আম্মারা' বা কলুষতা হতে ইতমিনান বা প্রশান্তির মাকামে উন্নীত হয় এবং সৃষ্টিতে কুফরী হতে হাকীকি বা প্রকৃত ইসলামে সমুন্নত হয়। যেমন কোনাে কবির ভাষায়ঃ

করি যদি আমি মূল ব্যাখ্যা ইহার,

জানিবে নিশ্চয়ই  এযে, হবে বেশুমার।

বস্তুতঃ যদি কোনাে পীর কোনাে মুরীদকে গ্রহণ করেন , তবে মুরীদের উচিৎ তাকে নিজের সৌভাগ্য মনে করা। অপরপক্ষে , কোনাে পীর যদি কোনাে মুরীদকে প্রত্যাখ্যান করেন , তবে মুরীদের উচিৎ তাকে নিজের ‘বদবখতী' বা দুর্ভাগ্য হিসাবে গণ্য করা। আমি এরকম অবস্থা থেকে আল্লাহর নিকট পানাহ চাই। হক সুবহানুহু তায়া'লার ‘রিযা বা সন্তুষ্টিকে, পীরের ‘রিযা' বা সন্তুষ্টির পশ্চাতে রাখা হয়েছে । যতক্ষণ না মুরীদ নিজেকে স্বীয় পীরের সন্তুষ্টির মধ্যে বিলীন করে দেয় , ততক্ষণ পর্যন্ত সে হক সুবহানুহুর ‘রিযামন্দী' বা সন্তুষ্টি লাভে সক্ষম হবে না। মুরীদের সব চাইতে বড় বিপদ হলাে — পীরের অসন্তুষ্টি। সব রকমরে ত্রুটি বিচ্যুতির ক্ষতিপূরণ সম্ভব, কিন্তু পীরের অসন্তুষ্টির কারণে যে ক্ষতি হয়, তা পূরণ করা কোনাে ভাবেই সম্ভব নয়, পীরের অসন্তুষ্টি মুরীদের জন্য দুর্ভাগ্যের কারণ। এ অবস্থা থেকে হক সুবহানুহু তায়া'লার নিকট পানাহ চাই। এর ফলশ্রুতিতেই মুরীদের দীনি আকীদায় ত্রুটি বিচ্যুতি  এবং শরীয়তের হুকুম আহকাম প্রতিপালনের মধ্যে অলসতা এসে পড়ে ।বাতিনী হাল এবং উচ্চ মাকামসমূহ উত্তীর্ণের প্রশ্নই আসে না। পীরের অন্তরের কষ্ট দেওয়ার পরেও যদি মুরীদের মধ্যে কোনাে প্রকার হালের প্রভাব অবশিষ্ট থাকে , তবে তাকে ইসতিদরাজ বা ছলনা মনে করবে । কেননা শেষ পর্যন্ত তার প্রতিফল খারাপই হবে এবং তার পরিণতি ক্ষতি ব্যতীত আর কিছুই নয়। হেদায়েতের  অনুসারীদের উপর সালাম।

_______________

কিতাব: মাবদা ওয়া মা'আদ

কৃত: হজরত মুজাদ্দেদে আলফে সানী রহমাতুল্লাহি  আলাইহি

অনুবাদ: ড. আ ফ ম আবু বকর সিদ্দীক

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন