শানে রিসালাত
মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান
আগন্তুক ও গাছের সাক্ষ্য
হযরত ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বলেছেন, একদিন আমি আমার পিতা হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহুকে বললাম, "আববাজান, নবী-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর কিছু ফযীলত বর্ণনা করুন!" তখন হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বলেছেন, "হাসান, যদি উভয় জাহান নবী-ই আকরামের ফাযাইল (গুণাবলী) বর্ণনা করতে থাকে, তবে তারাও হুযুর-ই আকরামের গুণাবলী যথাযথভাবে বর্ণনা করতে পারবাে না। তবুও তোমাকে শুধু একটি ফযীলত শুনাচ্ছি।
(হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বলেন) "আল্লাহ্তা 'আলা যখন তাবুকের যুদ্ধের নির্দেশ দিলেন, তখন হুযূর-ই আকরামের মােকাবেলায় অসংখ্য কাফির সমবেত হয়ে।গেলাে। আল্লাহ তা'আলা আপন মাহবুবের উপর দয়া।করলেন। শত্রুরা লাঞ্ছিত-অপমানিত হলোে। ওই দিনগুলােতে হুযুর-ই আকরামের দরবারে এক দীর্ঘকায় লােক আসলাে।।এতাে লম্বা-চওড়া মানুষ আমি জীবনে কখনাে দেখিনি।"
হুযুর-ই আকরাম ওই আগন্তুকের উদ্দেশে বললেন, "তুমি কে?" সে বললাে, "হুযূর আমি হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম -এর ওই সম্প্রদায়ের একজন লােক, যাদের সম্পর্কে কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে-
یَا مُوۡسٰى اِنَّ فِيۡهَا قَوۡمًا جَبَّارِيۡن
[হে মূসা, তাতে রয়েছে জাব্বারীন' সম্প্রদায়)
হুযুর-ই আকরাম বললেন, "তােমার এতাে দীর্ঘ জীবন?" সে বললাে, "জ্বী-হাঁ! আমি দু'হাজার একশ' পঞ্চাশ বছর যাবৎ।আল্লাহর ইবাদত করেছি।"
হুযুর এরশাদ করলেন, "এতাে দীর্ঘ জীবনের রহস্য কি?" সে বললাে, 'এয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার ও আপনার উম্মতের প্রতি আমার ভালবাসার কারণে আমি এতদীর্ঘ জীবন লাভ করেছি।"
আগন্তুক আরাে বললাে "যখন হযরত মূসা আলায়হিস সালাম-এর ওফাত হলাে, তখন আল্লাহ্ তা'আলা হযরত ইয়ুশা' আলায়হিস্ সালামকে প্রকাশ করলেন। আমি তাঁর সেনাবাহিনীতে ছিলাম। তাঁর সেনাবাহিনীতে চারশ' এমন পতাকা ছিলাে, যেগুলাের প্রত্যেকটির উপর লিখা ছিলাে-
لَا اِلٰهَ اِلَّا ا للّٰهُ مُحَمَّدٌ رَّسُوۡ لُ اللّٰهِ
(লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু মুহাম্মদু রাসূ-লুল্লা-হ]
হযরত ইয়ুশ' আলায়হিস্ সালাম দো'আ করলেন, "হে আল্লাহ, হযরত মুহাম্মদ ও হযরত মুহাম্মদ মােস্তফার উম্মতের ওসীলায় আমাদেরকে বিজয় দান করাে!" সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম দো'আ করার পর তিনি পতাকাগুলাে শহরের চতুর্দিকে গেড়ে ছিলেন। তীব্র বেগে বাতাস চলছিলাে। বাতাসে পতাকাগুলাে পতপত্ করে উড়তে লাগলাে। শুধু তা নয়, পতাকাগুলাে থেকে দুরূদ শরীফের আওয়াজ আসতে লাগলাে। ফলে আমাদের মনে দারুন সাহসের সঞ্চার হলাে। আমাদের জানা হয়ে গেলাে যে, এটা তাে হযরত মুহাম্মদ মােস্তফা সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নামেরই বরকত। কাঙ্ক্ষিত শহরের দরজা খুলে গেলাে। হযরত ইয়ূশ আলায়হিস্ সালাম তাঁর সৈন্যদল সহকারে শহরে ঢুকে পড়লেন। শহর জয় হয়ে গেলাে। কাফিরগণ পরাজিত ও লাঞ্ছিত হলাে।
অতঃপর হযরত ইয়ূশা' ওই শহর থেকে বের হয়ে গেলেন। আমিও তাঁর সাথে ছিলাম। আমি, হে আল্লাহর রাসূল, তখনই মনেপ্রাণে আপনার উপর ঈমান নিয়ে এসেছিলাম। আর সব সময় আপনার সাক্ষাতের আরজু করছিলাম। আল্লাহ।তা'আলার দরবারে দোআ করছিলাম যেন আমার এ আরজু পূরণ হয়। আল্লাহ্ আমার দো'আ কবুল করলেন। আমাকে দীর্ঘজীবন দান করেছেন। ফলে আমি আজ আপনার কদম শরীফে হাযির হতে পেরেছি। আল-হামদুলিল্লাহ!"
হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বলেন, আমরা বিভোর চিত্তে লােকটির কথা শুনছিলাম। এরপর আগন্তুক আরেক আশ্বর্যজনক কথা শােনালাে।
তা নিম্নরূপ- "হে আল্লাহর রাসূল, এক জায়গায় এক বৃক্ষ ছিলাে। আমি অনেকবার সেটার নিচে শয়ন করেছি। ওই বৃক্ষ একাধিক পয়গাম্বরের সালাম আপনার দরবারে পৌছিয়েছিলাে। সেটার পাতাগুলাের উপর আপনার সমস্ত উম্মতের নাম লিপিবদ্ধ রয়েছে।" আগম্ভক এ কথাগুলাে বলছিলাে; ইত্যবসরে হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালাম হাযির হলেন আর আরয করলেন, 'এয়া রসূলাল্লাহ্। লােকটি সত্য বলছে।"
হুযূর-ই আকরাম হযরত জিব্রাঈলকে বললেন, "আমি ওই বৃক্ষটি দেখতে চাই। সুতরাং আল্লাহ্ তা'আলা হযরত জিব্রাঈলকে বললেন, "আমার মাহবুবকে বলাে, অমুক পাহাড়ের উপর গিয়ে বৃক্ষটিকে ডেকে বলতে। সেটা তাঁর সামনে এসে হাযির হয়ে যাবে।"
হযরত আলী বললেন, হুযূর পাহাড়ের উপর তাশরীফ নিয়ে গেলেন। হুযূরের সাথে ছিলেন হযরত আবূ বকর, হযরত ওমর, হযরত ওসমান আর আমি ও হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহুম। হুযুর গাছটিকে ডাকলেন। অমনি সেটা ওই পাহাড়ের উপর আত্মপ্রকাশ।করলাে।
আল্লামা বূসীরী রাহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হিও তাঁর কসীদা-ই বােদাহ্ শরীফে বলেছেন- অর্থাৎ তিনি (সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) গাছগুলােকে ডেকেছেন। সেগুলােতাে আপন আপন শাখা-প্রশাখাগুলােকে ঝুঁকিয়ে দিয়ে সাজদাকারীদের মতাে এমতাবস্থায় এসেছে যে, সেগুলাে আপন আপন কাণ্ডের উপর ভর করে কোন পা ছাড়াই চলছিলাে। (কাসীদা-ই বাের্দাহ্ শরীফ)।
হুযূর সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়া সাল্লাম এবার গাছটির উদ্দেশে বললেন, "তুমি কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে বলা।" গাছটি থেকে আওয়াজ আসলাে। সেটা স্পষ্ট ভাষায় বলছিলাে- এয়া রসূলাল্লাহ্! হযরত আদম আলায়হিস্ সালামকে জান্নাত থেকে বাইরে এনে যমীনের উপর নামিয়ে দিলেন। তখন তিনি খুব কান্নাকাটি করেছেন। তাঁর প্রথম অশ্রু-ফোটা যখন যমীনের উপর পড়লাে, তখন তা থেকে আমি জন্মে মাটির আত্মপ্রকাশ করেছিলাম। তখন আমি অতিমাত্রায় ক্ষীণ ও শক্তিহীন ছিলাম।"
বৃক্ষটি থেকে এ আওয়াজও আসলাে- "এয়া রসূলাল্লাহ্ আমার পাতাগুলাে ও শাখা-প্রশাখার দিকে দেখুন!" হুযূরতাকালেন। দেখলেন সেগুলাের উপর লিপিবদ্ধ ছিলাে- "মুবারক হােক ওই ব্যক্তি, যে আল্লাহ্ ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর ঈমান এনেছে।
মুবারক হােক ওই ব্যক্তি, যে ফরযগুলো সম্পন্ন করেছে। হুযূর মুহাম্মদ মােস্তফার উম্মতের মধ্যে যে ব্যক্তি রজব, শা'বান ও রমযান মাসে রােযা পালন করে সে ধন্য হােক!"
গাছটি আরাে আরয করলাে-
এয়া রসূলাল্লাহ, হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম থেকে আপনি পর্যন্ত প্রত্যেক নবী আমার ছায়ায় ইবাদত করেছেন। প্রত্যেক নবী আমাকে একথাই বলেছেন, "হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়া সাল্লাম-এর দরবারে আমার সালাম পৌছিয়ে দিও! তাঁর পবিত্র দরবারে আরয করিও যেন তিনি আমাদের জন্য দোআ করেন!" গাছের এসব কথা শুনে হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ্ তা'আলার শােকর আদায় করলেন। তারপর হুযুর গাছকে বললেন, "তুমি আপন জায়গায় চলে যাও!" (জামে'উল মু'জিযাত)।
সুতরাং সেটা চোখের আড়াল হয়ে গেলো।
১৪-১৫
(মাসিক তরজুমান,শাবান ১৪৩২হি:,জুলাই - ২০১১ইং, পৃষ্ঠা - ১৪-১৫)।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন