প্রসঙ্গ : শবে বরাত
কাযী মুহাম্মদ মুঈন উদ্দীন আশরাফী
عَنْ معاذ بن جبل رضي الله تعالى عنه عن النبی صلى الله عليه وسلم قال يطلع الله الی جميع
ليلة النصف من شعبان فيغفر لجميع خلقه الا المشرک اومشاحن – } [اخرجه الطبرانی و ابن حبان
অনুবাদ: প্রখ্যাত সাহাবী হযরত মুয়ায ইবনে জবল রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু থেকে বর্ণিত তিনি হুযুর করিম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল করিম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, মহান আল্লাহ্ শা'বানের পনরতম রাতে সমগ্র সৃষ্টির প্রতি মনােনিবেশ করেন এবং মুশরিক ও জঘন্য মুনাফিক ব্যতিরেকে সবাইকে ক্ষমা করে দেন।( তাবরানী ও ইবনু হিব্বান)
শবে বরাত প্রসঙ্গে হাদীস বর্ণনাকারী ইমামগণ
১. ইমাম তিরমিযী, ২. ইমাম ইবনু মাজা, ৩. ইমাম ইবনু হিব্বান, ৪. ইমাম তাবরানী, ৫. ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, ৬. ইমাম বায়হাঁকী, ৭. ইমাম ব্যযার, ৮. ইমাম মুনযেরী ৯. ইমাম ইবনুল আসীর, ১০. ইমাম আবু মুহাম্মদ ইবনে কোতাইবা ১১, ইমাম দারে কুতনী ১২. ইমাম সুয়ূতী ১৩. ইমাম ইবনু খুযায়মা ১৪. ইমাম ইবনু আবি আছেম, ১৫. ইমাম হাইসামী, ১৬. ইমাম আবু নুআইম ইসফাহানী রাহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হিম প্রমুখ।
যেসব সাহাবা কেরাম থেকে এ প্রসঙ্গে হাদিস বর্ণিত
১.হযরত আয়েশা সিদ্দিকা, ২. হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল, ৩. হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আমর, ৪, হযরত আবু মুসা আশআরী, ৫. হযরত আবু মাআলাবা খাশানী ৬. হযরত আবু বকর সিদ্দিক, ৭. হযরত ওসমান ইবনে আবিল আ'স, ৮. হযরত আলী, ৯. হযরত আবু হােরায়রা, ১০. হযরত আউফ ইবনে মালেক, ১১. হযরত কাসীর ইবনে মুররাহ্ ও ১২. হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুম।
শবে বরাতের নামসমূহ
১. আললায়লাতুল মুবারাকা ২. লায়লাতুল কিসমাত, ৩. লায়লাতুত্ তাফসীর, ৪. লায়লাতুল ইজাবা, ৫. লায়লাতুল হায়াত, ৬. লায়লাতুল ঈদিল মালায়েকা, ৭. লায়লাতুশ শাফাআ ৮. লায়লাতুল বারাআত, ৯. লায়লাতুচ্ছাকে, ১০. লায়লাতুল জায়েযা ১১. লায়লাতুর রুজহান ১২. লায়লাতুত্ তাযীম, ১৩. লায়লাতুল কদর, ১৪. লায়লাতুল গােফরান, ১৫. লায়লাতুল ইতকে মিনান নিরান।
এ রাতে যা কিছু হয়ে থাকে
শবে বরাত প্রসঙ্গে বর্ণিত হাদীস শরীফসমূহ থেকে প্রমাণিত হয় যে, এ রাতে মহান আল্লাহ্ তা'আলা প্রথম আসমানে জলওয়া ফরমান। পাপী-অপরাধীদের পাপরাজি ক্ষমা করেন, অপরিসীম রহমত নাযিল করেন- অর্থাৎ ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন, করুনাপ্রার্থীদের বিশেষভাবে অনুগ্রহ করেন, প্রার্থনাকারীদের দোয়া কবুল করেন, বিপদগ্রস্থদের বিপদ দূরীভূত করেন, জাহান্নামী সাব্যস্ত অনেককে পরিত্রাণ দেন, এ রজনীতে সৃষ্টির জীবন-জীবিকা লিপিবদ্ধ করা হয়।
এ রাতে যাদের ক্ষমা করা হবে না
২. মুশাহিন- অর্থাৎ- এমন মুনাফিক দুষ্ট প্রকৃতির মানুষ যে মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করে এবং শত্ৰুতার আগুন জ্বালিয়ে দেয়। ইমাম ইবনুল আসীর মুশাহিন শব্দের এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।
৩. ক্বাতেউর রাহেম- অর্থাৎ- আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী। কারণ, অন্য হাদীসে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীদের সাথে স্বয়ং আল্লাহ্ তা'আলা সম্পর্ক ছিন্নের ঘােষণা দিয়েছেন।
৪, মুসবিল- অর্থাৎ- লুঙ্গি, পায়জামা ও জুব্বা পায়ের গােড়ালির নিচে ঝুলিয়ে পরিধানকারী। এ সম্পর্কে হাদিস শরীফে কঠোর নিষেধাজ্ঞা বর্ণিত হয়েছে। অনেকে মনে করে এতে দোষের কি আছে। আসলে আপত্তির মধ্যেই নিষেধাজ্ঞার কারণ নিহিত। হুযুর করিম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এভাবে কাপড় পরিধান করা পছন্দ করেন নি। সুতরাং উম্মত হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলাে তাঁর নির্দেশ অনুসারে চলা। সেটা না করে এতে দোষের কি বলে প্রশ্ন আরােপ করাই তাে আমাদের মারাত্মক দোষ। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি অহংকারবােধ থেকে এ ধরনের গােড়ালির নিচে ঝুলিয়ে কাপড় পরিধান করবে, আল্লাহ্ তা'আলা কিয়ামত দিবসে তার প্রতি কৃপাদৃষ্টিতে তাকাবেন না। (বুখারী শরীফ, মিশকাত শরীফ ইত্যাদি)।
কাপড় ঝুলিয়ে পড়লে অজ্ঞাতসারে অপবিত্র হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, আর ঐ কাপড়ে নামায হবে না। এ কারণে ও হয়তাে নিষেধ করা হয়েছে। আর অনিচ্ছাকৃতভাবে কারাে কাপড় নিচে ঝুলে পড়ে দৈহিক অবস্থার কারণে, তখন তা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে না। যেমনটি হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর বেলায় বর্ণিত আছে। (বুখারী শরীফ)।
৫. মাতা-পিতার অবাধ্য সন্তান- মাতা-পিতার আনুগত্য ও তাঁদের সাথে সদাচরণ এর গুরুত্ব আল্লাহ্ তা'আলার ইবাদতের পর। মাতা-পিতার অবাধ্যতাকে হাদিস শরীফে 'কবীরা গুনাহ' এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সুতরাং এ জঘন্য অপরাধী অন্তকরণে তওবা না করলে এ পবিত্র রজনীতেও তার গুনাহ ক্ষমা করা হবে না।
৬. মদ্যপায়ী- ইসলাম নেশা সেবনকে হারাম ও নিষিদ্ধ করেছে। পাশাপাশি মাদকসেবীদের শাস্তির বিধানও।করেছে। মদ্যপায়ী ব্যক্তি একাগ্রচিত্তে তওবা না করলে এ পবিত্র রজনীতে তারও ক্ষমা নেই।
আলােচ্য বিষয়গুলাে ইমাম বায়হাক্বী রাহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হি কর্তৃক হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহা থেকে বর্ণিত হাদিস শরীফে বর্ণিত।
৭. মানুষ হত্যাকারী- অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যাকারীকেও এ রাতে ক্ষমা করা হবে না। বিষয়টি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল কর্তৃক হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে উল্লেখ রয়েছে।
৮, যিনাকারী- এ রাতে যিনাকারীকে ক্ষমা করা হবে না। বিষয়টি ইমাম বায়হাকী কর্তৃক হযরত ওসমান ইবনে আবিল আ'স রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসে বিবৃত।
পাপ মার্জনা
তিরমিযী ও ইবনে মাজা শরীফে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে আছে এ রাতে আল্লাহ্ তা'আলা বনী কলব গােত্রের ছাগলের লােমের চেয়ে অধিক গুনাহগারকে ক্ষমা করে দেবেন।
শবে বরাতে করণীয়
হাদীস শরীফ থেকে এ রাতের করণীয় সম্পর্কে তিনটি বিষয় স্পষ্টভাবে বর্ণিত-১. কবর যিয়ারত ২. নফল নামায ৩. নফল রােযা, সাথে অন্য এবাদতও নিশ্চয়ই বৈধ ও সওয়াব।
যেমন- তেলাওয়াতে কারআন, যিকির, দুরূদ, সালাম, মীলাদ- কিয়াম ও কায়মনােবাক্যে দোয়া- মােনাজাত।
শবে বরাতে বর্জনীয়
বাজী ফুঠানাে, একদিকে অর্থের অপচয়, অপরদিকে ইবাদতকারীদের বিঘ্ন ঘটানাে। অনুরূপভাবে সময়ের অপচয় রােধ করা। রাস্তা-ঘাটে, চায়ের দোকানে সময় অপচয় না করে ইবাদত বন্দেগীতে রাত অতিক্রম করা। বর্তমানে শবে বরাত' সম্পর্কে চরম বিভ্রান্তি ছড়ানাে হচ্ছে নানাভাবে প্রচার মাধ্যমণ্ডলােতেও বাতিলপন্থী আলেমগণ এটাকে ভিত্তিহীন বলে অপপ্রচারে লিপ্ত। বস্তুত: আলােচ্য হাদীসটি হাদীস শাস্ত্রের পরিভাষা অনুসারে 'সহীহ' হিসেবে সাব্যস্ত বলে মত প্রকাশ করেছেন ইবনু হিববান, অনুরূপভাবে এ প্রসংগে দুর্বল সূত্রে বর্ণিত একাধিক হাদিস বিদ্যমান। হাদীস বিশারদগণ অভিমত অনুযায়ী আমলের ফযিলতের ক্ষেত্রে এ ধরনের হাদিস গ্রহণযােগ্য। পাশাপাশি একাধিক দুর্বল সূত্রে বর্ণিত হাদীস 'হাসান এর স্তরে উন্নিত হয় বলে তাঁদের মত রয়েছে। অতএব, বাতিলপন্থীদের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে এ পবিত্র রাতে ইবাদাত বন্দেগীর মাধ্যমে আল্লাহ্ ও রসূলের সন্তুষ্টি অর্জনই হবে ঈমানদারের কাজ।
(মাসিক তরজুমান,শাবান ১৪৩২হি:,জুলাই - ২০১১ইং, পৃষ্ঠা - ৭-৮)।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন