মাযারে ইমারত ও গম্বুজ নির্মাণে আপত্তিসমূহের খন্ডন

 

মাযারে ইমারত ও গম্বুজ নির্মাণে আপত্তিসমূহের খন্ডন


এখন আমরা পর্যালোচনা করবো আপনার প্রশ্নে উল্লেখিত হাদিসসমূহ নিয়ে। উল্লেখিত প্রথম দু’টি হাদিস হলো-

 ১নং হাদিস:

عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ لَمَّا اشْتَكَى النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَكَرَتْ بَعْضُ نِسَائِهِ كَنِيسَةً رَأَيْنَهَا بِأَرْضِ الْحَبَشَةِ يُقَالُ لَهَا مَارِيَةُ وَكَانَتْ أُمُّ سَلَمَةَ وَأُمُّ حَبِيبَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا أَتَتَا أَرْضَ الْحَبَشَةِ فَذَكَرَتَا مِنْ حُسْنِهَا وَتَصَاوِيرَ فِيهَا فَرَفَعَ رَأْسَهُ فَقَالَ أُولَئِكِ إِذَا مَاتَ مِنْهُمْ الرَّجُلُ الصَّالِحُ بَنَوْا عَلَى قَبْرِهِ مَسْجِدًا ثُمَّ صَوَّرُوا فِيهِ تِلْكَ الصُّورَةَ أُولَئِكِ شِرَارُ الْخَلْقِ عِنْدَ اللَّهِ

-“হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (ﷺ)’র অসুস্থতাকালে তাঁর এক সহধর্মিণী হাবশা দেশে তাঁর দেখা ‘মারিয়া’ নামক একটি গীর্জার কথা আলোচনা করলেন। (উম্মাহাতুল মু’মিনীনের মধ্যে) উম্মে সালমা এবং উম্মে হাবিবা (رضي الله عنه) হাবশায় গিয়েছিলেন। তাঁরা ঐ গীর্জাটির সৌন্দর্য এবং তাতে রক্ষিত চিত্রসমূহের বিবরণ দিলেন। তখন নবী (ﷺ) তাঁর মাথা তুলে বললেন- সে-সব দেশের লোকেরা তাদের কোন পূন্যবান ব্যক্তি মারা গেলে তার সমাধিতে মসজিদ নির্মাণ করত এবং তাতে এসব চিত্র অঙ্কন করত। তারা হলো আল্লাহর দরবারে নিকৃষ্ট মাখলুক।” ২৮

২৮ - ইমাম বুখারি, আস-সহিহ, কিতাবুল জানাইয, বাবু বিনাইল মাসজিদি আলাল ক্বাবর, হাদিস নং- ১২৭৬; ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ, হাদিস নং- ১২০৯; কিছু শব্দগত পার্থক্যসহ ইমাম বুখারি তাঁর আস-সহিহ গ্রন্থে হাদিসটি আরো কয়েক স্থানে বর্ণনা করেছেন।


 ২নং হাদিস:

عَنْ عُرْوَةَ عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي مَرَضِهِ الَّذِي لَمْ يَقُمْ مِنْهُ لَعَنَ اللَّهُ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ لَوْلَا ذَلِكَ أُبْرِزَ قَبْرُهُ غَيْرَ أَنَّهُ خَشِيَ أَوْ خُشِيَ أَنَّ يُتَّخَذَ مَسْجِدًا

-“হযরত আয়িশা (رضي الله عنه) থেকে বর্নিত। তিনি বলেন, রাসুল (ﷺ) অন্তিম রোগ শয্যায় বলেন ইয়াহুদি ও নাসারাদের প্রতি লা‘নত হোক। কারণ, তারা নিজেদের নবীগণের কবরকে সিজদার স্থানে পরিণত করেছে। (বর্ণনাকারী বলেন) এরূপ আশঙ্কা না থাকলে রাসুল (ﷺ)-এর কবরকে (ঘরের বেষ্টনীতে সংরক্ষিত না রেখে) খোলা রাখা হতো।” ২৯


২৯ -


(ক) ইমাম বুখারি, আস-সহিহ, কিতাবুল জানাইয, বাবু মা জা-আ ফী ক্বাবরিন নাবিয়্যি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওয়া আবী বাকরিও ওয়া উমারা (رضي الله عنه), হাদিস নং- ১৩২৪;


(খ) ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ, হাদিস নং- ১২১২; কিছু শব্দগত পার্থক্যসহ হযরত আয়েশা থেকে এবং ভিন্ন সনদেও ইমাম বুখারি তাঁর আস-সহিহ গ্রন্থে হাদিসটি কয়েক স্থানে বর্ণনা করেছেন।



উপর্যুক্ত এ হাদিস দু’টি ছাড়াও হযরত জুনদুব বিন জুনাদাহ (رضي الله عنه) হতে আরেকটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে যে,



وَإِنَّ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ كَانُوا يَتَّخِذُونَ قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ وَصَالِحِيهِمْ مَسَاجِدَ أَلاَ فَلاَ تَتَّخِذُوا الْقُبُورَ مَسَاجِدَ إِنِّى أَنْهَاكُمْ عَنْ ذَلِكَ



-“বিশিষ্ট সাহাবি হযরত জুনদুব বিন জুনাদাহ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি মহানবী (ﷺ) থেকে এ কথা বলতে শুনেছি যে, হে মুসলমানগণ! জেনে রেখ! নিশ্চয় তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতগণ তাদের নবী ও বুযর্গগণের কবরসমূহকে মসজিদে পরিণত করতেন। সাবধান! তোমরা তাঁদের কবরসমূহকে মসজিদে বানাইও না। আমি তোমাদেরকে এরূপ কাজ থেকে বারণ করছি।” ৩০


৩০ - ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ, কিতাবুল মাসাজিদ, বাবুন্ নাহয়ি ‘আন বিনাইল মাসাজিদি ‘আলাল ক্বুবূর, হাদিস নং- ১২১৬; মিশকাত, হাদিস নং- ৭১৩



একটু লক্ষ্য করলেই দেখবেন যে, উল্লেখিত এ হাদিস তিনটিসহ এ ধরনের আরো যত বর্ণনা রয়েছে, সবগুলো রিওয়ায়াতেই পূর্ববর্তী উম্মত বা ইহুদি-নাসারা তথা বিধর্মীদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে এবং তাদের প্রতিই লা‘নত করা হয়েছে-



✦        যারা কি-না আম্বিয়ায়ে কিরাম ও নেককার বুযর্গানে দ্বীনের কবর-মাযারকে পূজা করত বা কবরকে কিবলা বানিয়ে ইবাদাত করত,



✦        কিংবা ঠিক কবরেরই উপরে মসজিদ-গীর্জা-সিজদার স্থান বানিয়ে নিত।



সামান্য জ্ঞান সম্পন্ন লোকগণ এটুকু বুঝে নিতে পারবেন যে, নবী ও ওলিগণের মাযারসমূহের সহিত অত্র হাদিসসমূহের কোন সম্পর্ক রয়েছে কি-না? নবী ও বুযর্গগণের কবর-মাযার সমূহকে মসজিদে পরিণত করার দায়ে ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের উপর যে অভিশাপ প্রদান করা হয়েছে, তার কারণ কী? হাদিসগুলো সম্পর্কে বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফকিহগণের ব্যাখ্যামূলক আলোচনা অবতারণা করার পূর্বে ১নং হাদিসখানার প্রতি আবারও দৃষ্টিপাত করুন। দয়াল নবী (ﷺ) সেখানে ইরশাদ করেন: ‘তখনকার মানুষের নিয়ম ছিল- যদি তাদের মধ্যে কোন একজন নেককার ব্যক্তি মারা যেত, তাহলে-



"উক্ত ব্যক্তির কবরের উপর মসজিদ নির্মাণ করতো এবং তারা সেখানে বিভিন্ন ছবি আঁকতো। আর কিয়ামতের দিনে এ সকল লোকগণই হবে আল্লাহর নিকৃষ্টতম সৃষ্টি।’



এ আলোচ্য হাদিস থেকে বুঝা যায়, নবীগণের মাযারের উপর মসজিদ নির্মাণ করা এবং তাঁদের কবরসমূহ বা ছবিসমূহ তৈরী করার অর্থ হলো- এগুলোর পূজা করা। এরই ফলশ্রুতিতে মানব গোষ্ঠী অভিশাপের অধিকারী হয়।



এ প্রসঙ্গে নিম্নোক্ত হাদিসটি আরো স্পষ্ট বর্ণিত হয়েছে যে,



عَنْ عَطَاءِ بْنِ يَسَارٍ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ اللَّهُمَّ لَا تَجْعَلْ قَبْرِي وَثَنًا يُعْبَدُ اشْتَدَّ غَضَبُ اللَّهِ عَلَى قَوْمٍ اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ



-“হযরত আতা’ ইবনু ইয়াসার থেকে বর্ণিত। নবীজি (ﷺ) ইরশাদ করেন: হে আল্লাহ্! আমার কবরকে মূর্তিতে পরিণত কর না, যার পূজা করা হবে। ওই কওমের জন্য খোদার কঠিন গযব আছে, যারা স্বীয় নবীদের কবরসমূহকে মসজিদে পরিণত করেছে।” ৩১


৩১ - ইমাম মালিক, আল-মুয়াত্তা, হাদিস নং- ৫৯৩; খতিব তিবরিযি, মিশকাত, কিতাবুল মাসাজিদ, হাদিস নং- ৭৫০; ইমাম মালিক হাদিসটি মুরসাল সূত্রে বর্ণিনা করেন।



এ হাদিস থেকে বুঝা যায়, কবরকে মসজিদে পরিণত করার অর্থ এই যে- ‘তাঁদের পূঁজা করা, অথবা অন্ততঃ পক্ষে তাঁদেরকে কিবলা বানিয়ে তাঁদের অভিমুখে নামায পড়া।’ যেমন অন্য হাদিসে এসেছে:



عَنْ بُسْرِ بْنِ عُبَيْدِ اللَّهِ قَالَ سَمِعْتُ وَاثِلَةَ بْنَ الأَسْقَعِ يَقُولُ سَمِعْتُ أَبَا مَرْثَدٍ الْغَنَوِىَّ يَقُولُ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لاَ تَجْلِسُوا عَلَى الْقُبُورِ وَلاَ تُصَلُّوا إِلَيْهَا



-“হযরত আবু মারছাদ আল-গানাভিয়্যা বলেন, হুযুর আকরাম (ﷺ) ঘোষণা করেন- ‘তোমরা কবরের উপর বসিও না এবং এর দিকে (কিবলা বানিয়ে) নামায পড়ো না।” ৩২


৩২ - ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, কিতাবুল জানায়িয, হাদিস নং- ৩২৩১



এখানে খাস করে কবরের উপর নামায পড়াকে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা নামায পড়তে হলে কবরের উপর উপবিষ্ট হতে হবে। অথচ কবর হলো সমাহিত ব্যক্তিরই হক। এ কারণেই নবী পাক (ﷺ) ইহুদি ও নাসারাদের উপর অভিশাপ প্রদান করেছেন এবং তিনি স্বীয় উম্মতগণকে এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য সর্তক করেছেন। প্রত্যেক মুসলমান দৃঢ়ভাবে একথা বিশ্বাস করেন যে, প্রত্যেক মু’মিনের কবর পূজা করা শিরক। (মা‘আযাল্লাহ)! যারা কবরকে মা‘বুদ বা উপাস্য হিসাবে মনে করে, তারা কোন ধরনের মু’মিন? যে সকল হাদিসের মধ্যে কবরের উপর গৃহ নির্মাণ করাকে নিষেধ করা হয়েছে, তাতে এ ধরনের গৃহ নির্মাণের কথাকে বুঝানো হয়েছে। আর এটাই হলো হাদিসের উত্তম ব্যাখ্যা।



মূলকথা, উপরে বর্ণিত হাদিসগুলো দ্বারা গম্বুজ নির্মাণ হারাম প্রমাণিত হওয়া তো দূরের কথা, এমন কি গম্বুজ সম্পর্কিত কোন আলোচনাই হাদিসসমূহে উল্লেখ নেই। সুতরাং আল্লাহর ইবাদতের জন্য যে সকল মসজিদসমূহ কবরের পার্শ্বে নির্মিত হয়েছে, তা কখনো হারাম হবে না। অভিজ্ঞ ইমাম ও হাদিস বিশারদগণ উক্ত হাদিসসমূহ দ্বারা এ অর্থই নিয়েছেন।



প্রশ্নে উত্থাপিত প্রথম দু’টি হাদিসের মতই আরো দু’টি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। যথা-



সুপ্রসিদ্ধ সাহাবি হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত,



عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم زَائِرَاتِ الْقُبُورِ وَالْمُتَّخِذِينَ عَلَيْهَا الْمَسَاجِدَ وَالسُّرُجَ



-“হযরত রাসুলুল্লাহ (ﷺ) কবর জিয়ারতকারিনী মহিলাগণ এবং কবরের উপর বাতি স্থাপনকারী ও মসজিদ নির্মাণকারীগণের উপর অভিশাপ প্রদান করেছেন।” ৩৩


৩৩ - ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, কিতাবুল জানায়িয, হাদিস নং- ৩২৩৮; আলবানি হাদিসটিকে দ্ব‘ঈফ বলেছেন



 ইমাম মুসলিম (رحمة الله)' বর্ণনা করেন:



عَنْ جَابِرٍ قَالَ نَهَى رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَنْ يُجَصَّصَ الْقَبْرُ وَأَنْ يُقْعَدَ عَلَيْهِ وَأَنْ يُبْنَى عَلَيْهِ



-“হযরত জাবির (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হুযুর (ﷺ) কবরের উপর চুনকাম করা, ইমারত তৈরী করা এবং এর উপর বসতে নিষেধ করেছেন।” ৩৪


৩৪ -


(ক) ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ, কিতাবুল জানায়িয, হাদিস নং- ২২৮৯;


(খ) খতিব তিবরিযি, মিশকাত, হাদিস নং- ১৬৭০



আবার অধিকাংশ ফকিহগণ يكره البناء علي القبور-কবরের উপর ইমারত তৈরী করাকে অপছন্দ করেছেন।



উপল্লেখিত হাদিসসমূহ এবং ফকিহগণের এমন ইবারতের দ্বারাও আপত্তি পেশ করা হয় যে, কবর পাকা করা, কবরের উপর ইমারত তৈরী করা এবং কবরের পাশে খাদিম বনে অবস্থান করা হারাম।



এর জবাবে বলব, মূলতঃ তারা হাদিসগুলোর ব্যাখ্যা না জানার কারণে, কিংবা একগুঁয়েমিতা বশতঃ নির্দিষ্ট দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য, অথবা নবী-ওলিগণের সাথে শত্রæতা বশতই অপব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়ে বিধর্মীদের জন্য প্রয়োগ হওয়া বিধানকে মুসলমানদের উপর আরোপ করে মাযার ভাঙ্গার মত জঙ্গি তৎপরতাকে উস্কে দিতেই এ ধরণের ফাতওয়াবাজি করে থাকে। আল্লাহ্ আমাদেরকে এদের ঈমান নাশক খপ্পর থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন।

________________

কিতাবঃ মাযারে ইমারত ও গম্বুজ নির্মাণের ফায়সালা

গ্রন্থনা ও সংকলন: মুফতি মুহাম্মদ আলমগীর হোসাইন আন-নাজিরী

 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন