মাযার নির্মাণ বিষয়ে আপত্তি : ফিক্বহ’র কিতাবাদি ও উলামায়ে কিরামের উক্তি হতে দলিল

 

 মাযার নির্মাণ বিষয়ে আপত্তি :  ফিক্বহ’র কিতাবাদি ও উলামায়ে কিরামের উক্তি হতে দলিলঃ


১. হানাফি মাযহাবের ব্যারিস্টার খ্যাত আল্লামা মুল্লা আলি ক্বারি বলেন:

قد اباح السلف البناء علي قبور المشائخ والعلماء والمشهورين ليزورهم الناس ويستريحوا بالجلوس

-“পূর্বসূরী আলিমগণ মাশায়িখ, উলামা ও প্রসিদ্ধ বুযর্গানে কিরামের কবর বা মাযারসমূহের উপর ইমারত তৈরী করা জায়িয বলেছেন, যাতে লোকেরা যিয়ারত করে এবং বসে আরাম পায়।” ২০


২০ - মুল্লা আলি ক্বারি, মিরকাত শরহে মিশকাত, কিতাবুল জানায়িয, ৪/৬০



২. শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভি বলেন:



در آخر زمان بجہت اقتصار نظر عوام بر ظاهر مصلحت در تعمير وترويج مشاهد ومقابر مشائخ وعظماء ديده چیزہا افزوزندتا آنجا ہیبت وشوکت اہل اسلام واہل اصلاح پیدا آید خصوصا در دیار ہند کہ اعداۓ دین از ہنود وکفار بسیار اند وترویج واعلاء شان ایں مقامات باعث رعب وانقیاد ایشاں است وبسیار اعمال وافعال واوضاع کہ در زمان سلف از مکروہات بودہ اندر رآخر زمان از مستحسنات گشتہ



-“শেষ জামানায় সাধারণ মানুষ যখন বাহ্যিক বেশভুষার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে গেল, তখন মাশায়িখ ও বুযুর্গানে কিরামের কবরসমূহের উপর ইমারত তৈরী করার প্রতি বিশেষ অভিপ্রায়ে জোর দেয়া হয়, যেন মুসলমান ও আওলিয়া কিরামের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ প্রকাশ পায়। বিশেষ করে হিন্দুস্থানে- যেথায় হিন্দু, কাফির ও অনেক শত্রæর অবস্থান, তথায় পুণ্যাত্মা মনীষীদের শান-মান প্রকাশ, সেসব কাফিরদের মনে ভীতি ও আনুগত্য সৃষ্টির সহায়ক। অনেক কাজ আগের যুগে মাকরূহ ছিল, কিন্তু শেষ জামানায় মুস্তাহাবে রূপান্তরিত হয়েছে।” ২১


২১ - সাফারুস্ সা‘আদাত, বাবু যিয়ারাতিল ক্ববর, পৃষ্ঠা-২৭২



৩. ফাতাওয়ায়ে শামীতে এসেছে-



وَقِيْلَ لَايَكْرَهُ الْبِنَاءُ اِذَا كَانَ الْمَيِّتَ مِنَ الْمَشَائِخِ والعُلَمَاءِ وَالسَّادَاتِ



-“যদি কবরবাসী মাশায়িখ, উলামা বা সায়্যিদ বংশ থেকে কেউ হয়ে থাকেন, তাঁর কবরের উপর ইমারত তৈরী করা মাকরূহ নয়।” ২২


২২ - আল্লামা ইবনু আবেদিন শামী, রদ্দুল মুহতার, কিতাবুল জানায়িয, ১/৬৬২



৪. ইবনু আবেদিন শামী আরো বলেন:



لَايَرْ فَعُ عَلَيْهِ بِنَاء وَقِيْلَ لَابَأسَ بِه وَهُوَ الْمُخْتَارُ



-“কবরের উপর ইমারত তৈরী করা অনুচিত। কেউ কেউ বলেছেন, এতে কোন ক্ষতি নেই। আর এ অভিমতটি (ইমারত তৈরীতে ক্ষতি নেই)-ই পছন্দনীয় (এ মতের উপরই ফাতওয়া)।” ২৩


২৩ - আল্লামা ইবনু আবেদিন শামী, রদ্দুল মুহতার, কিতাবুল জানায়িয, ১/৬৬২



কতেক লোক বলেন যে, শামী ও দুররে মুখতারে ইমারতের বৈধতার কথাটা যেহেতু قِيْلَ শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করেছেন, সেহেতু এ অভিমতটা দুর্বল। কিন্তু এটা ভুল ধারণা। ফিকহ শাস্ত্রে قِيْلَ শব্দ ব্যবহারটা দূর্বলতার লক্ষণ নয়, বরং কোন কোন স্থানে একটি মাসআলার জন্য দু’টি মতামত ব্যক্ত করা হলে উভয় মতামতই قِيْلَ শব্দ দ্বারা অর্থাৎ পরোক্ষভাবে প্রকাশ করা যায়। তবে হ্যাঁ, ইলমে মানতিকে (যুক্তিবিদ্যায়) قِيْلَ শব্দটা দূর্বলতার নিদর্শন।



৫. তাহতাভী ‘আলাল মরাকিল ফালাহ্ গ্রন্থে এসেছে:



وقد اعتاد اهل المصر وضع الاحجار حفظا للقبور عن الاندراس والنبش ولا بأس به وفي الدرر ولا يجصص ولا يطين ولايرفع عليه بناء وقيل لابأس به هو المختار



-“মিসরের লোকেরা কবরসমূহের উপর পাথর স্থাপন করে, যাতে বিলীন বা উচ্ছেদ হয়ে না যায় এবং কবরকে যেন পলেস্তারা করতে না পারে আর যেন কবরের উপর ইমারত তৈরী করতে না পারে। কেউ কেউ এগুলোকে জায়িয বলেন এবং এটাই গ্রহণযোগ্য।” ২৪


২৪ - তাহতাভী ‘আলাল মরাকিল ফালাহ, পৃষ্ঠা- ৩৩৫



৬. ইমাম আব্দুল ওয়াহহাব শা‘রানী বলেন:



ومن ذلك قول الائمة ان القبر لايبني ولايجصص مع قول ابي حنيفة يجوز ذلك قال الاول مشدد والثاني مخفف



-“অন্যান্য ইমামগণের মতামত হচ্ছে, কবরের উপর ইমারত তৈরী করা এবং একে চুন দিয়ে আলপনা করা যাবে না। তা সত্বেও ইমাম আবু হানিফার বক্তব্য হচ্ছে- এসব জায়িয। সুতরাং প্রথম উক্তিতে কঠোরতা এবং দ্বিতীয় উক্তিতে নমনীয়তা প্রকাশ পায়।” ২৫


২৫ - ইমাম শা‘রানী, মিযানুল কুবরা, কিতাবুল জানায়িয, ১/১৫৩



এখন তো আর কিছু বলার নেই। স্বয়ং মযহাবের ইমাম হযরত আবু হানিফা (رحمة الله)'র অভিমত পাওয়া গেল যে, কবরের উপর গম্বুজবিশিষ্ট ইমারত ইত্যাদি তৈরী করা জায়িয।



হাকিমুল্ উম্মত মুফতি আহমাদ ইয়ার খান নঈমি (رحمة الله)' বলেন:



“আল্লাহর শুকর, কুরআন হাদিস ও ফিকহের বিভিন্ন ইবারত এমনকি স্বয়ং ইমাম আবু হানিফার উক্তি থেকে প্রমাণিত হলো যে, আউলিয়া ও উলামায়ে কিরামের কবরের উপর গম্বুজ ইত্যাদি তৈরী করা জায়িয। বিবেকও বলে যে এটা জায়িয। কারণ-



প্রথমত, এটা লক্ষ্য করা গেছে যে, সাধারণ কাঁচা কবরের প্রতি জনগণের মনে তেমন কোন আদব বা সম্মানবোধ থাকে না। তাতে না ফাতিহা পাঠ করা হয়, না শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয় বরং জনগণ একে পদদলিত করে। কিন্তু যদি পাকা কবর সামনে পড়ে এবং এর উপর গিলাফ ইত্যাদি চড়ানো দেখে, মনে করে যে এটা কোন বুযুর্গের মাযার হবে। তখন সসম্মানে একে অতিক্রম করে এবং নিজে থেকে মুখে ফাতিহা পাঠ এসে যায়। মিশকাত শরিফের الدفن অধ্যায়ে এবং মিরকাতে উল্লেখ রয়েছে, ‘বুযর্গদেরকে জীবিতকালে এবং ইনতিকালের পর একই রকম সম্মান করা উচিত।’ অনুরূপ ফাতাওয়ায়ে আলমগীরীর কিতাবুল কারাহিয়াত এবং আশ‘আতুল লুম‘আত গ্রন্থে الدفن অধ্যায়ে বর্ণিত আছে যে, ‘মা-বাবার কবরকে চুমো দেয়া জায়িয।’ ফকিহগণ আরও বলেন যে, ‘কবর থেকে এতটুকু দুরত্বে বসবেন, যে পরিমাণ দুরত্বে কবরস্থ ব্যক্তির সামনে জীবিত অবস্থায় বসতেন।’ এর থেকে বোঝা গেল, ইনতিকাল হওয়া ব্যক্তি তার জীবিত থাকাকালিন সম্মানের সমঅধিকার। ইহজগতে আল্লাহর ওলিগণ বাধ্যতামূলক সম্মানের অধিকারী ছিলেন। সুতরাং ইনতিকালের পরও তাঁরা সম্মানের অধিকারী। কবরের উপর ইমারত তৈরী করা হচ্ছে সেই সম্মান প্রকাশের মাধ্যম বিশেষ। তাই তাকে কমপক্ষে মুস্তাহাব ধরে নেয়া যায়।



দ্বিতীয়ত, সমস্ত ইমারতসমূহের মধ্যে সরকারী ভবন বা মসজিদসমূহ হচ্ছে বিশেষ খ্যাত। যাতে লোকেরা অনায়াসে সেগুলোকে খুঁজে বের করে উপকৃত হতে পারে। উলামায়ে কিরামের বেশভুষা ও পোষাক-পরিচ্ছদ জ্ঞানী সুলভ হওয়া চাই। যেন লোকেরা তাদেরকে সনাক্ত করে মাসআলা জিজ্ঞাসা করতে পারে। অনুরূপ মাশায়িখ ও উলামায়ে কিরামের কবরসমূহ অন্যান্যদের কবর থেকে উন্নততর হওয়া চাই, যেন লোকেরা সনাক্ত করে ফায়য হাসিল করতে পারেন।



তৃতীয়ত, আল্লাহর ওলিগণের মাযার আল্লাহর নিদর্শন স্বরূপ, যেমন আমি ইতোপূর্বে তাফসিরে রূহুল বায়ানের বরাত দিয়ে বর্ণনা করেছি যে, আল্লাহর নিদর্শনসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন প্রয়োজন, যা কুরআন দ্বারা প্রমাণিত। সুতরাং কবরসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন উচিৎ। সম্মান প্রদর্শন স্থান ও কাল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে হয়ে থাকে। যে কোন প্রকারের সম্মান প্রদর্শন, যদি তা ইসলাম বিরোধী না হয়, জায়িয। হুযুর আলাইহিস্ সালামের পবিত্র যুগে হাড় ও চামড়ার উপর কুরআন লিখা হতো, মসজিদে নববী ছিল কাঁচা এবং এর ছাউনি ছিল খেজুর পাতার, যেখানে বৃষ্টির সময় পানি টপকিয়ে পড়তো। কিন্তু পরবর্তী যুগে মসজিদে নববীকে খুবই শানদার করে এবং রওযা পাককে একান্ত যতœ সহকারে তৈরী করা হয়েছে, কুরআন শরিফকে উন্নতমানের কাগজ দ্বারা ছাপানো হয়েছে।” ২৬


২৬ - জা-আল হক, ১ম খন্ড



হানাফি মুহাদ্দিস ইমাম মুহাম্মদ ইবনু হাসান শাইবানি (رحمة الله)' এতদসংক্রান্ত বিষয়ে গোটা একটি অধ্যায় রচনা করে তার শিরোনাম দেন ‘কবরের ওপর উঁচু স্তূপাকৃতির ফলক ও আস্তর’। এই অধ্যায়ে তিনি নিম্নের হাদিসটি লিপিবদ্ধ করেন: “ইমাম আবু হানিফা আমাদের কাছে হযরত হাম্মাদ-এর কথা বর্ণনা করেন, তিনি হযরত ইবরাহিম-এর কথা উদ্ধৃত করেন। যিনি বলেন, কেউ একজন আমাকে জানান যে তাঁরা মহানবী (ﷺ), হযরত আবু বকর ও হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা-এর মাযার বা রওযার ওপরে ‘উঁচু স্তূপাকৃতির ফলক যা (চোখে পড়ার মতো) বাইরে প্রসারিত ছিল- তা দেখতে পেয়েছিলেন এবং তাতে আরও ছিল সাদা এঁটেলমাটির টুকরো।” ইমাম মুহাম্মদ আরও বলেন, “আমরা (আহনাফ) এই মতকেই সমর্থন করি; মাযার শরিফ বড় স্তূপাকৃতির ফলক দ্বারা চিহ্নিত করতে হবে। কিন্তু তা বর্গাকৃতির হতে পারবে না। এটি-ই হচ্ছে ‘ইমাম আবু হানিফা-এর সিদ্ধান্ত’।” ( কিতাবুল আছার, পৃষ্ঠা- ১৪৫)।

________________

কিতাবঃ মাযারে ইমারত ও গম্বুজ নির্মাণের ফায়সালা

গ্রন্থনা ও সংকলন: মুফতি মুহাম্মদ আলমগীর হোসাইন আন-নাজিরী

 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন