মৃতব্যক্তির মাগফিরাতের জন্য জিয়াফত ও চল্লিশার বিরুদ্ধে মনগড়া ফতোয়া

 

মৃতব্যক্তির মাগফিরাতের জন্য জিয়াফত ও চল্লিশার বিরুদ্ধে মনগড়া ফতোয়া


সালাফি শায়খ কাজী ইব্রাহিম সাহেবের নিকট জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করলেন: ‘কোন ব্যক্তি ইন্তেকালের পর গ্রামের লোকদেরকে দাওয়াত করে খাওয়ানো যাবে কি না? জবাবে কাজী সাহেব বললেন:


‘হ্যাঁ যাবে। কেউ মারা গেলে আপনি দশজন, বিশজন একশজন, চারশজন নিয়া খাওয়াইলেন, অনুষ্ঠান করলেন। হ্যাঁ করতে পারেন,যদি আপনার নিয়তে থাকে কবর ওয়ালা মানুষটার উপর একটু আযাব হোক। আপনি যদি কবর ওয়ালা মানুষটিকে আযাব দিতে চান, এই লোকটা এত সুখে থাকবে কেন কবরে ? একটু গযব হোক, একটু আগুন জলুক তার কবরে। তাহলে তার নামে একটি চল্লিশা করে দিবেন। আগুন জ্বলা শুরু হয়ে যাবে। নবীজি বলেছেন: الميت يعذب بما نيح عليه অর্থ: মুর্দাকে আযাব দেয়া হবে যদি মুর্দার জন্য নিয়াহত তথা যিয়াফত বা খাওয়ানোর অনুষ্ঠান বা শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান করা হয়।


ইহা কাজী ইব্রাহিমের কথা নয়। কোন মৌলভী মুনসির কথা নয়। ইহা সহিহ বুখারিশরীফ জানাযা পর্বের হাদিস।


সে যদি জীবদ্ধশায় নিষেধ করে না গিয়ে থাকে, আর ছেলে মেয়েরা যদি এটা করে তাহলে তার আযাব শুরু হয়ে যাবে। (ইউটিউব থেকে সংগৃহীত)




পর্যালোচনা



সম্মানিত পাঠক!  দেখলেন তো কাজী ইব্রাহিম সাহেবের মনগড়া ফতোয়া। এখানে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, তিনি মৃত ব্যক্তির রূহের মাগফিরাতের জন্য গরিবদেরকে খাওয়ানোর অনুষ্ঠানকে নাজায়েয এবং কবর আযাবের কারণ বলতে গিয়ে বুখারি শরীফের একটি হাদিসকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তিনি হাদিসটির অর্থকে সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন করে সাধারণ জনগণকে ধোকা দেবার চেষ্টা করেছেন। তিনি হাদিসে ব্যবহৃত নিয়াহত শব্দটিকে যিয়াফত অর্থ করে বিভ্রান্তি তৈরি করেছেন। তাই আসুন আমরা প্রথমে বুখারি শরীফের মূল হাদিসটি দেখি:


عن ابن عمر عن ابيه عن النبى صلى الله عليه وسلم قال الميت يعذب فى قبره بما نيح عليه


অর্থ: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর বর্ণনা করেছেন তার পিতার কাছ থেকে। তিনি বর্ণনা করেছেন নবী করিম (ﷺ) থেকে, তিনি (ﷺ) বলেন: মৃত ব্যক্তিকে কবরে আযাব দেয়া হবে যদি তার জন্য বিলাপ করে ক্রন্দন করা হয়। (কিতাবুল জানাইয, হাদিস নং ১২৯২)



উক্ত হাদিসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: ‘নিয়াহত’ তথা মর্সিয়া করে, বিলাপ করে রোদন করলে কবরে মৃত ব্যক্তির আযাব হয়। অথচ কাজী ইব্রাহিম সাহেব নিয়াহত শব্দের অর্থ করেছেন যিয়াফত বা খাওয়ানোর অনুষ্ঠান বা শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান। ইহা সম্পূর্ণ তার মনগড়া ব্যাখ্যা এবং অর্থ বিকৃতি।



এবার আসুন আমরা ‘নিয়াহত’ শব্দের প্রকৃত অর্থ একটু বিশ্লেষণ করি। ইমাম বুখারি উল্লেখিত হাদিসটির শেষাংশে ‘নিয়াহত’ শব্দের ব্যাখ্যা স্বরূপ আরেকটি হাদিস উল্লেখ করেছেন নিম্নরূপ:


وقال ادم عن شعبة الميت يعذب ببكاء الحى عليه


অর্থ: আদম শুবা থেকে বর্ণনা করেছেন, ‘জীবিত ব্যক্তির ক্রন্দনের জন্য মৃত ব্যক্তিকে আযাব দেয়া হবে। (হাদিস নং ১২৯২)।



উক্ত হাদিস দ্বারা সুষ্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল যে, নিয়াহত শব্দের অর্থ হলো ক্রন্দন করা।



ইমাম বুখারি রহমতুল্লাহি আলাইহি উক্ত হাদিসের শিরোনাম করেছেন এভাবে- باب ما يكره من النياحة على الميت অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির উপর ক্রন্দন করা মাকরূহ অধ্যায়। এর ব্যাখ্যায় হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানী আলাইহির রহমত লিখেছেন:


قال الزين بن المنير ما موصولة ومن لبيان الجنس فالتقدير الذى يكره من جنس البكاء هو النياحة-


অর্থ: যাইন ইবনুল মুনির বলেছেন: এখানে ما শব্দটি মাওসুলাহ এবং من শব্দটি জিনস বা শ্রেণি বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। অতএব ‘নিয়াহত’ হলো ক্রন্দন এর একটি প্রকার যা মাকরূহ। (ফাতহুল বারী: ৩/১৯২)



 


নিয়াহত শব্দের বিশ্লেষণ



শায়খ মুহাম্মদ সালিহ আল মুনজিদ অত্যন্ত চমৎকারভাবে নিয়াহত শব্দের ব্যাখ্যা করেছেন। নিম্নে তা প্রদত্ত হলো:


النياحة لغة اسم من النوح وهى البكاء بصوت عال


অর্থ: নিয়াহত শব্দটি একটি বিশেষ্য পদ। ইহা নাওহুন থেকে গঠিত। এর শাব্দিক অর্থ হল উচ্চস্বরে ক্রন্দন করা।


وفى الاصطلاح اختلفت عبارات الفقهاء فى تعريف النياحة فعرفها الحنفية- بانها البكاء مع ندب الميت وعند المالكية- ان النياحة هى البكاء اذا اجتمع معه احد امرين هى صراخ او كلام مكروه


وعند الشافعية بانها رفع الصوت بالندب ولو من غير بكاء- وعرفها الحنابلة بانها رفع الصوت بالندب برنة او بكلام مسجع-


অর্থ: নিয়াহত শব্দের পারিভাষিক অর্থ বর্ণনায় ফোকাহায়ে কিরামদের মধ্যে সামান্য তারতম্য রয়েছে। যেমন:


১. হানাফিদের মতে: নিয়াহত হল মৃত ব্যক্তির নামে ক্রন্দন করা।


২. মালেকীদের মতে: নিয়াহত অর্থ ক্রন্দন করা। হয়ত সেটা উচ্চস্বরে হবে অথবা মন্দ শব্দ সহকারে হবে।


৩. শাফেয়ীদের মতে: মৃত ব্যক্তির নামে উচ্চস্বরে বিলাপ করা। যদিও কান্না ব্যতীত বিলাপ করা হয়।


৪. হাম্বলীদের মতে: মৃত ব্যক্তির নামে উচ্চস্বরে রোদন করা। হোক গানের সুরে অথবা ছন্দাকারে। (সূত্র اسلام سوال وجواب সুয়াল নং ১৬৩২৭২, তাং ১৩/০৬/১১ইং)



উক্ত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হল যে, ‘নিয়াহত’ শব্দের অর্থ যিয়াফত বা খাওয়ানোর অনুষ্ঠান বলে মনগড়া ফতোয়া প্রদান করা ফিতনা বৈ কিছুই নয়।


তাছাড়া এক মুসলমান অপর মুসলমানকে খানা খাওয়ানো অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। এ ব্যাপারে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। দেখুন নিম্নের হাদিস:


عن عبد الله  بن عمرو رضى الله تعالى عنه ان رجلا سأل النبى صلى الله عليه وسلم اى الاسلام خير- قال تطعم الطعام وتقرأ السلام على من عرفت ومن لم تعرف-


অর্থ: হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, একব্যক্তি নবী করিম (ﷺ)কে জিজ্ঞাসা করলেন: কোন ব্যক্তির ইসলাম সর্বোত্তম? (ইমাম আসকালানী অর্থ করেছেন اى خصال الاسلام অর্থাৎ ইসলামের কোন আমল সর্বোত্তম ?)


জবাবে রাসূল (ﷺ) বললেন: পরিচিত অথবা অপরিচিত ব্যক্তিকে খানা খাওয়ানো এবং সালাম প্রদান করা সর্বোত্তম আমল। (বুখারি কিতাবুল ঈমান: হাদিস নং: ১২)।

_________________

কিতাবঃ হাদিস নিয়ে সালাফিদের জালিয়াত

লেখকঃ হাফিজ মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ ইকরাম উদ্দিন

 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন