শবে বরাতের সহিহ হাদিসকে অস্বীকার

শবে বরাতের সহিহ হাদিসকে অস্বীকার


শাবান মাসের মধ্যবর্তী রাত যা শবে বরাত নামে পরিচিত। হাদিসের ভাষায় যাকে বলা হয়েছে ليلة النصف من شعبان বা শাবানের মধ্যবর্তী রাত। এ রাতের ফজিলত সম্বন্ধে অনেকগুলো হাদিস বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। যার মধ্যে সহিহ ও হাসান হাদিসও রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে কিছু আলিম এতদ সংক্রান্ত সবগুলো হাদিসকে জয়িফ কিংবা মাওজু আখ্যায়িত করে সাধারণ জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন। তাদের মধ্যে শায়খ আব্দুল কাইয়ুম অন্যতম। তিনি ‘ইস্ট লন্ডন মসজিদের জুমুআর খুতবাহ’ গ্রন্থে বলেছেন এ সব হাদিসের কোনটিই সহিহ নয় বরং সবগুলোই জয়িফ। তাই আমি বিষয়টি নিয়ে কিছু লিখতে চাই। প্রথমে আসুন উনার বক্তব্যটি দেখি, তিনি লিখেছেন:


‘আর দ্বিতীয় প্রকার হাদিস হল এ রাতের ফজিলত, ইবাদতের গুরুত্ব ইত্যাদি বিষয়ে। এসব হাদিসগুলোর কোনটাই সহীহ হিসেবে প্রমাণিত নয়। বরং সবগুলোই দ্বায়ীফ (দুর্বল)। তবে সবগুলোই মাওদু (জাল বা বানোয়াট নয়)।


কয়েক লাইন পরে লিখেছেন:


‘শবে বরাত সংক্রান্ত কোন একটি হাদিস ও বুখারী ও মুসলিম গ্রন্থদ্বয়ে আসেনি। আর বাকী ৪টি গ্রন্থে বা অন্যান্য আরো কিছু গ্রন্থে এ সংক্রান্ত যে হাদিসগুলো এসেছে তার একটিও সহিহ হাদিসের মানদন্ডে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। (ইস্ট লন্ডন মসজিদের খুতবাহ ১৩৮-১৩৯)


সম্মানিত পাঠক!  এতক্ষণ আব্দুল কাইয়ুম সাহেবের বক্তব্যের কিছু অংশ দেখলেন। তার বক্তব্যের সারাংশ হল শবে বরাত সম্বন্ধে কোন সহিহ হাদিস নাই। এ ব্যাপারে যতগুলো হাদিস বর্ণিত হয়েছে এর সবগুলোই দ্বায়ীফ।


আমি বলব ইহা তার মনগড়া বক্তব্য। শবে বরাত সংক্রান্ত অনেকগুলো হাদিস বর্ণিত হয়েছে। যার কোনটা হাসান আবার কোনটি সহিহ পর্যায়ের হাদিস। দেখুন নিম্নের হাদিসটি:


عن ابى موسى الاشعرى عن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال ان الله ليطلع فى ليلة النصف من شعبان فيغفر لجميع خلقه الا لمشرك او مشاحن


( ابن ماجه)


অর্থ: হযরত আবু মুসা আশয়ারি (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: শাবানের মধ্যবর্তী রাতে আল্লাহ তা’য়ালা আত্মপ্রকাশ করেন। অতঃপর আল্লাহ তা’য়ালা মুশরিক ও মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিকারী ব্যতীত সবাইকে মাফ করে দেন। (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ১৩৯০)



এ হাদিসটিকে স্বয়ং সালাফিদের মান্যবর নাসিরউদ্দিন আলবানী সাহেবও সহিহ বলেছেন। দেখুন তার মন্তব্য:


حديث صحيح روى عن جماعة من الصحابة من طرق مختلفة يشد بعضها بعضا وهو معاذ ابن جبل وابو ثعلبة الخشنى وعبد الله بن عمرو وابى موسى الاشعرى وابى هريرة- وابى بكر الصديق وعوف ابن مالك وعائشة-


অর্থ: হাদিসটি সহিহ। ইহা ভিন্ন ভিন্ন সনদে একদল সাহাবা থেকে বর্ণিত হয়েছে। যার একটি সূত্র অন্যটিকে শক্তিশালী করে। তারা হলেন মুয়াজ ইবনে জাবাল, আবু সা’লাবা আল খাশানী, আব্দুল্লাহ বিন আমর, আবু মুসা আশয়ারি, আবু হুরায়রা, আবু বকর সিদ্দিক, আওফ বিন মালিক এবং আয়েশা সিদ্দিকা প্রমূখ ((رضي الله عنه)ম)


(সিলসিলাতুল আহাদীস আস সাহীহা, হাদিস নং ১১৪৪)



অতঃপর আলবানী সাহেব এই হাদিসটি বর্ণনাকারী মুহাদ্দিসগণের দীর্ঘ তালিকা পেশ করেছেন। যেমন: মুয়াজ বিন জাবাল (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত হাদিসটি বর্ণনা করেছেন যথাক্রমে।



১. আবি আসীম: ‘আস সুন্নাহ’ গ্রন্থে, হাদিস নং ৫১২।


২. ইবনে হিব্বান, হাদিস নং ১৯৮০।


৩. আবুল হাসান আল কাযুনী: ‘আল আমালী গ্রন্থে’ ২/৪,


৪. আবু মুহাম্মদ আল জাওহারী’: আল মাজলি আস-সাবিয় গ্রন্থে ২/৩।


৫. মুহাম্মদ ইবনে সুলাইমান আর রাবযী: ‘জুয উম মিন  হাদিস’ গ্রন্থে। ১/২১৭ এবং ১/২১৮।


৬. আবুল কাসিম আল হুসায়নী: ‘আল আমালী’ গ্রন্থে।


৭. বায়হাকী: শুয়াবুল ঈমান, ২/২৮৮।


৮.  ইবনে আসাকির: তারিখ গ্রন্থে, ২/৩০২।


৯. হাফিজ আব্দুল গণি মুকাদ্দাসী: ‘আস সালিস ওয়াত তিসঈন’ গ্রন্থে।


১০.  ইবনুল মুহিব صفات رب العالمين গ্রন্থে ২/৭।


১১. হায়সামী مجمع الزوائد গ্রন্থে ৮/৬৫।


১২. তাবরানী الاوسط এবং الكبير গ্রন্থে ‘বর্ণনাকারীগণ বিশ্বস্ত’।



দেখুন আরেকখানা হাদিস:


عن عائشة رضى الله تعالى عنها قالت قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ان الله ينزل ليلة النصف من شعبان الى السماء الدنيا فيغفر لاكثر من عدد شعر غنم كلب-


অর্থ: আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: নিশ্চয় আল্লাহ তা’য়ালা শাবানের মধ্যবর্তী রাতে দুনিয়ার নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করেন। (অর্থাৎ আল্লাহর রহমত অবতীর্ণ হয়) অতঃপর আল্লাহ বনি ক্বলব গোত্রের ছাগলের পশমের চেয়ে অধিক লোকদেরকে ক্ষমা করেন। (তিরমিজি হাদিস নং ৭৩৯)



নাসির উদ্দিন আলবানীর বিশ্লেষণ


واما حديث عائشة فيروية حجاج عن يحى بن ابى كثير عن عروة عنه مرفوعا- اخرجه الترمذى وابن ماجه واللالكائ واحمد وعبد بن حميد فى المنتخب من المسند- وقال الترمذى وسمعت محمد (يعنى البخارى) يضعف هذا الحديث-


অর্থ: আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা কর্তৃক বর্ণিত হাদিসটি বর্ণনা করেছেন হাজ্জাজ, তিনি ইয়াহইয়া বিন আবি কাসির থেকে তিনি উরওয়াহ থেকে, তার থেকে মারফু সূত্রে বর্ণিত।


এই হাদিসটি সংকলন করেছেন তিরমিজি, ১/১৪৩, ইবনে মাজাহ ১৩৮৯, লা’লাকাঈ ১/১০১, আহমদ ৬/২৩৮, আব্দ ইবনে হুমাইদ المنتخب من المسند গ্রন্থে ১/১৯৪, ইমাম তিরমিজি বলেছেন, আমি শুনেছি ইমাম বুখারি এই হাদিসকে দ্বায়ীফ বলেছেন। (সিলসিলাতুল আহাদীস আস সাহীহাহ, হাদিস নং ১১৪৪)



অতঃপর শায়খ আলবানী বলেন:


وجملة القول ان الحديث بمجموع هذه الطرق صحيح-


অর্থ: সারকথা হল, এই হাদিসটি উল্লেখিত বিভিন্ন সূত্রের সমন্বয়ে নিঃসন্দেহে সহিহ ও বিশুদ্ধ।



আলহামদুলিল্লাহ: সালাফিদের মান্যবর আলবানী সাহেবের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমেই প্রমাণিত হল যে, শবে বরাতের ফজিলত সংক্রান্ত হাদিসটি সহিহ। অতএব যারা বলেন: শবে বরাত সম্বন্ধে কোন সহিহ হাদিস নাই তারা প্রকৃতপক্ষে সাধারণ জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন।

_________________

কিতাবঃ হাদিস নিয়ে সালাফিদের জালিয়াত

লেখকঃ হাফিজ মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ ইকরাম উদ্দিন

 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন