দিদারে এলাহি

 

দিদারে এলাহি


যখন সায়্যিদে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহতা’য়ালার বড় বড় নিদর্শন প্রত্যক্ষ করা শেষ করলেন, তখন বিশেষ নৈকট্যতার সাথে করুণা ও সান্বিধ্য লাভের মূহূর্ত ঘনিয়ে আসে এবং সর্বশেষ সীমায় উপনীত হন এবং সকল বস্তু হতে পূর্ণ বিচ্ছেদ ঘটে, তখন তিনি একা রয়ে গেছেন। কোন ফেরেশতাও নেই মানুষও নেই। এখনও এমন সত্তরটি নূরানী পর্দা রয়ে গেল যে, এক পর্দা দ্বিতীয় পর্দার সমতুল্য নয়। রেওয়ায়েত দ্বারা জানা যায় প্রত্যেক নূরানী পর্দার ঘনত্ব পাঁচশত বৎসরের পথ ছিল। এখনও তা অতিক্রম করা বাকি রয়েছে। নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহতা’য়ালার সাহায্য সহানুভূতির দ্বারা উক্ত পথ অতিক্রম করেন। ঐ সময় এক বিশেষ ধরনের বিচলিত ও ভয় এবং আল্লাহতা’য়ালার মহিমা ও শ্রেষ্ঠত্বের সম্মূখীন হন। আহব্বানকারী আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু এর ন্যায় আওয়াজ দ্বারা আহব্বান করা হয় যে-


قف يا محمد فان ربك يصلى 


হে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনি দাঁড়ান, নিশ্চয় আপনার প্রভূ সালাত প্রেরণ করছেন। অর্থাৎ এ সালাতের অর্থ দরূদ বা আল্লাহতা’য়ালা তাঁর হাবিবের উপর রহমত বর্ষণ করছেন, তাঁর প্রশংসা করছেন। হাবিবে খোদা স্তম্বিত হলেন যে, আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু এর আওয়াজ কোথা হতে আসল। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উক্ত আওয়াজ হতে কিছুটা স্বস্তিবোধ করলেন এবং যে ভয়ভীতির সঞ্চার হয়ে ছিল তা দূরীভূত হয়ে গেল। এরপর মহিমান্বিত আল্লাহতা’য়ালার দরবার হতে আহব্বান আসে যে-


ادن يا خير البرية ادن يا احمد ادن يامحمد 


হে সৃষ্টিজীবের সর্বশ্রেষ্ঠ, নিকটে আসুন, হে আহমদ নিকটে আসুন, হে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকটবর্তী হোন। অতঃপর আল্লাহতা’য়ালা আমাকে তার নিকটবর্তী করলেন এবং আমি অতি নিকটবর্তী হয়ে গেলাম যে স্বয়ং আল্লাহতা’য়ালা এরশাদ করেন-


ثم دنى فتدلى فكان قاب قوسين او ادنى 


অতঃপর আল্লাহতা’য়ালার নূরের তজল্লী নিকটবর্তী হয়, তারপর আরো সন্নিকটে নেমে আসে। তখন সেই তজল্লী এবং হাবিবে খোদার মাঝখানে মাত্র দুই ধনুক ব্যবধান থেকে যায় বরং এর চেয়েও কম। গাউসেপাক তাফসিরে আল জিলানীতে উল্লেখ করেন- দুই ধনুকের দূরুত্ব পরিমাণ তথা অজুব ও ইমকানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অক্ষুন্ন রেখে উলুহিয়ত ও উবুদিয়তের মর্যাদার দিকে লক্ষ্য রেখে উবুদিয়তের অধিক মর্যাদায় অধিষ্টিত হলেন। এখানে কুরব বা নিকটতম হওয়া ‘কুরবে মাকান’ নয় বরংقرب مدح ‘কুরবে মদহে’ অর্থাৎ আল্লাহতা’য়ালা হাবিবে খোদাকে কামালে মহব্বত করেছেন, তারই নিদর্শন। মোদ্দাকথা হলো মি’রাজ রজনীতে আল্লাহর হাবিব আল্লাহর দরবারে অধিক নৈকট্যলাভ করেছেন এবং কপালের চোখ মোবারক দ্বারা নিরাকার আল্লাহর দিদারে ধন্য হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ‘নাছিমুর রিয়াজ’ এর এবারত নিম্নে প্রদত্ত হলো-


(والقرب والدنو) لقوله تعالى (ثم دنى فتدلى فكان قاب قوسين او ادنى) على القول بان الضمير للنبى صلى الله عليه وسلم وليس هذا قربا مكانيا ان كان المرادبه من القرب من الله تعالى لاستحالة المكان والجهة على الله وقد ذكر فى الاية على سبيل المدح- 


অর্থাৎ যদি ধরে নেয়া হয় আল্লাহর হাবিব আল্লাহর নিকটবর্তী হয়েছেন, এমতাবস্থায় ‘কুবব’ বা নিকটবর্তী হওয়া ‘কুরবে মাকান’ অর্থ নেয়া যাবে না, কেননা আল্লাহর জন্য মাকান ও দিক সবকিছুই অসম্ভব। আয়াতে কারিমার মধ্যে যা বর্ণনা করা হয়েছে, তা শুধুমাত্র হাবিবে খোদা যে, আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় এর ইঙ্গিত বহন করে। এখানে ‘কুরব’ বা নিকটতম হওয়া কুরবে মাকান নয় বরং قرب مدح ‘কুরবে মদহে’ অর্থাৎ হাবিবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লার দরবারে অধিক নৈকট্য লাভ করেছেন, যে নৈকট্য কুল সৃষ্টির মধ্যে অন্য কারো ভাগ্যে জুটেনি। ‘মাদারিজুন নবুয়ত’ প্রথম জিলদের ২০৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-


وپر سید ازمن پروردگار من چیزی پس نتوا نسیم الخ 


ভাবার্থ: আমার প্রভূ আমার নিকট কিছু জিজ্ঞাসা করেন, তখন আমার মধ্যে এতটুকু ইলিম বা জ্ঞান ছিল না যে, আমি উহার উত্তর দিতে সক্ষম হই। ঐ সময় আল্লাহতা’য়ালা তাঁর কুদরতের দ্বারা তাঁর রহমত আমার স্কন্দ মোবারকের মধ্য দিয়ে আমার বক্ষ মোবারকে পৌঁছিয়ে দেন, ফলে আমি উহার শীতলতাকে আমার বক্ষ পটে অনুধাবন করি। ঐ সময় আমাকে اولين واخرين পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল প্রকারের ইলিম বা জ্ঞান দান করা হয় এবং বিভিন্ন প্রকারের ইলিম শিক্ষাও দিয়ে থাকেন। মি’রাজ রজনীতে তিন প্রকারের ইলিম আল্লাহ তাঁর হাবিবকে দান করেছেন। তন্মধ্যে একপ্রকারের জ্ঞান বা ইলিম এমন ছিল, যা কারো নিকট প্রকাশ না করার জন্য হুজুরপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট হতে অঙ্গীকার লওয়া হয়, যেহেতু ঐ ইলিম হুজুরপাক ছাড়া অন্য কারো সহ্য করার ক্ষমতা নেই। অর্থাৎ হুজুরপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরমান- এক প্রকার ইলিম এমন ছিল, যা কারো নিকট প্রকাশ না করার জন্য আমার নিকট হতে অঙ্গীকার নেয়া হয়, যেহেতু আমি ছাড়া অন্য কারো পক্ষে সহ্য করার ক্ষমতা নেই।


علمی بودکہ عھد گرفت ازمن کتمان آنراکہ باھیچکس نگویم وھیچکس طاقت برداشت ندارد جز من- 


এক প্রকার ইলিম এমন যা প্রকাশ করা ও গোপন রাখার অধিকার আমাকে দেয়া হয়েছে।


وعلمی دیگر بود کہ مخیر گردا نید در اظھار وکتمان آن 


এবং আরো এক প্রকারের ইলিম হলো যা আমার উম্মতের আম-খাস সকলের মধ্যে প্রচার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।


وعلمی بود کہ امر کرد مرابہ تبلیغ آن بخاص وعام از امت من – مدارج النبوۃ 


১/২০৩


এ প্রসঙ্গে নবম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ুতি আলাইহির রহমত তদীয় تفسير الدر المنثور ‘তাফসিরে দুররে মনসুর’ নামক কিতাবের সপ্তম খ- ৬৪৭ পৃষ্ঠায় ‘তাফসিরে ইবনে জারির তাবারি’ থেকে উল্লেখ করেন-


واخرج ابن جرير عن ابن عباس قال: قال صلى الله عليه وسلم: رأيت ربى فى احسن صورة فقال لى: يا محمد هل تدرى فيم يختصم الملاء العلى؟ فقلت: لا يا رب- فوضع يده بين كتفى فوجدت بردها بين ثديى فعلمت ما فى السماء والارض- فقلت: يا رب فى الدرجات والكفارات ونقل الاقدام الى الجماعات وانتظار الصلوة بعد الصلوة فقلت: يا رب انك اتخذت ابراهيم خليلا وكلمت موسى تكليما وفعلت وفعلت- فقال: الم اشرح لك صدرك؟ الم اضع عنك وزرك؟ الم افعل بك؟ الم افعل؟ فأقضى الى باشياء لم يؤذن لى ان احد ثكموها- فذلك قوله (ثم دنى فتدلى فكان قاب قوسين او ادنى فاوحى الى عبده ما اوحى ما كذب الفؤاد ما رأى) فجعل نور بصرى فى فؤادى فنظرت اليه بفؤادى- 


ভাবার্থ: ইবনে জরির তাবারি আলাইহির রহমত হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিনা করেন, তিনি বলেন- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নূরানী ফরমান, হাবিবে খোদা বলেন- আমি আমার রবকে আহসান সুরত, তথা- উত্তম গুণে গুণান্বিত অবস্থায় দেখেছি। অতঃপর আমার রব আমাকে বললেন- يا محمد হে (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম!) অর্থাৎ চরম প্রশংসিত সত্ত্বা। তুমি কি জান মালায়ে আ’লা তথা ঊর্ধ্বজগতে শীর্ষস্থানীয় ফেরেশতাগণ, কি কি বিষয় নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত? তখন আমি উত্তরে বললাম- হে আমার রব! না (আমি এ বিষয়ে অবগত নই) অতঃপর মহান আল্লাহ তাঁর রহমতের হাত তথা বিশেষ শক্তি ও ক্ষমতা আমার দু’কাঁধের মধ্যখানে স্থাপন করলেন, যার শীতলতা আমার বক্ষে অনুভব করলাম-


فعلمت ما فى السموات والارض 


অতঃপর আমি আসমানসমূহ ও জমিনসমূহে যা কিছু আছে, সব বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবগত হলাম এবং আমি বলতে লাগলাম, হে রব! উচ্চ পর্যায়ের ফেরেশতাগণ দারাজাত, কাফফারাত, পায়ে হেঁটে জুমুয়ার নামাযে গমন, এক নামাযের পর অন্য নামাযের ফজিলত সম্পর্কে বিতর্ক করছেন। এরপর আমি আরো বললাম- হে আমার রব, নিশ্চয় আপনি হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামকে খলিল হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং হযরত মুসা আলাইহিস সালামের সাথে কালাম করেছেন এবং আপনি তা করেছেন, তা করেছেন।’ উত্তরে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’য়ালা বললেন- (হে হাবিব) আমি কি আপনার বক্ষ মোবারক উন্মোচন করিনি? আমি কি আপনার থেকে আপনার বোঝা অপসারণ করিনি? (আমি কি আপনার জন্য তা করিনি?) আল্লাহর হাবিব এরশাদ করেন- অতঃপর আল্লাহপাক আমাকে এমন কতগুলি গোপন বস্তুর তত্ত্ব জ্ঞান দান করলেন যা কারো কাছে প্রকাশ করতে আমাকে অনুমতি প্রদান করেননি। (এভাবে আরো কতগুলি জ্ঞান দান করলেন যা প্রকাশ করার অনুমতি দিলেন) নিম্নে ইবনে জরির তাবারি এর এবারত প্রদত্ত হলো-


فأقضى الى باشياء لم يؤذن لى ان احد ثكموها- فذلك قوله ثم دنى فتدلى فكان قاب قوسين او ادنى فاوحى الى عبده ما اوحى

__________

কিতাব : মি’রাজুন নাবী ﷺ

লেখকঃ  হযরতুল আল্লামা অধ্যক্ষ শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী (মা.জি.আ.)

 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন