একজনের আমল অন্যের উপকারে আসে কিনা?

প্রশ্নঃ কোন কোন আলেম বলেন- একজনের আমল অন্যের উপকারে আসেনা। কোরআন ও হাদীসে নাকি এর প্রমান আছে। তারা কোরআন মজিদের আয়াত "লাইছা লিল ইনছানে ইল্লা মা ছাআ (সুরা নাজম) এবং হাদীস শরীফ ইযা মাতাল ইনছানু ইনকাতাআ আনহু আমালুহ' এ প্রসঙ্গে পেশ করে থাকে। তারা আয়াতের অর্থ করে এভাবে- মানুষ তাই পায়- যা সে নিজে করে (সউদি কুরআনুল করিম)।

তারা হাদীস শরীফের অনুবাদ করে এভাবে- মৃত্যুর সাথে সাথে মানুষের আমল বন্ধ হয়ে যায় সুতরাং অন্যের কোন আমলে কাজ হবেনা। এখন জিজ্ঞাস্য এই- তাদের এই অর্থ বা ব্যাখ্যা সঠিক কিনা? যদি না হয় -  তাহলে সঠিক ব্যাখ্যা কি?


উত্তরঃ ইছালে সাওয়াব বিরােধী আলেমগন কুরআন ও হাদীসের যে ব্যাখ্যা দিয়েছে- তা সঠিক নয়। তারা কোরআন ও হাদীসের অপব্যাখ্যা করেছে। তাদেরই পূর্বতন নেতা ইবনে কাইয়েম যে ব্যাখ্যা দিয়েছে- তাতেই তাদের মুখােশ খুলে যাবে। ইবনে কাইয়েম

তার কিতাবুর রূহ গ্রন্থে সঠিক ব্যাখ্যাই দিয়েছে তিন প্রকারে।


প্রথম ব্যাখ্যা : (আরবির অনুবাদ,কিতাবে আরবি উল্লেখ আছে) অর্থ : "ইবনে কাইয়েম লাইছা লিল ইনছানে ইল্লা মা ছাআ - এর ব্যাখ্যা কিতাবুর রূহ

নামক গ্রন্থে এভাবে করেছে "কোরআনের উক্ত আয়াতে অন্যের আমলের দ্বারা উপকৃত হওয়া যাবেনা" -  এমন কথা কুরআনে বলা হয়নি। বরং বলা হয়েছে যে, মানুষ নিজের প্রচেষ্টার দ্বারা অর্জিত সাওয়াবের মালিক সে নিজেই হবে- অন্য লােক নয়। অন্যের অর্জিত আমলের মালিকও ঐ ব্যক্তি নিজেই। কিন্তু যদি অন্য মালিক ইচ্ছা করে এই ব্যক্তির জন্য কিছু দান করে, তবে করতে পারে। আর ইচ্ছা করলে দান না করে নিজের জন্যই রেখে দিতে পারে। আল্লাহ্ তায়ালা উক্ত আয়াতে তাে একথা বলেন নি যে, মানুষ।নিজের কর্মফল ছাড়া অন্যের দানকৃত আমল দ্বারা উপকৃত হতে পারবে না"। (কিতাবুর রূহ)।


নােটঃ উক্ত ব্যাখ্যায় ইবনে কাইয়েম একটি হরফের দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষন করেছেন। ঐ হরফটি হলাে  لِلۡاِنۡسَانِ  শব্দটির প্রথম হরফ لَامۡ লাম।

উক্ত  لَامۡ আরবী ব্যাকরনে দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়। যথা (১) اِنۡتِفَاعٌ বা উপকারার্থে,

(২) تَمۡلِيۡكُ  বা মালিক হওয়া অর্থে। বিরােধীরা হরফটির প্রথম অর্থ গ্রহন করে ভুল  ব্যাখ্যা করেছে। আয়াতের মধ্যে লাম (لَامۡ) হরফটি ইবনে কাইয়েমের মতে উপরােক্ত মালিকানা অর্থে ব্যবহৃত হবে। তাহলে আর কোন সমস্যাই থাকবেনা। এখন আয়াতের প্রকৃত অর্থ হবে এই- "মানুষ নিজে যা আমল করে, তার মালিক সে নিজেই। অন্য কোন লােক তা কেড়ে নিতে পারবেনা। যে পর্য্যন্ত সে অন্যকে দান না করবে, সে পর্যন্ত অন্য লােক এর দ্বারা উপকৃত হতে পারবেনা। এমনকি উহার মালিকও হতে পারবে না"।


কিন্তু ইছালে ছাওয়াবের মাধ্যমে নিজেদের কৃত আমলের ছাওয়াব অন্যের রূহে পৌছিয়ে দেয়া হয়। সুতরাং সে তখন সাওয়াবের মালিক হয়ে যায়। বিরােধীদের ব্যাখ্যা গ্রহন করলে- অন্যের দান করা আমলে উপকৃত হওয়া যাবেনা- বলে সাব্যস্থ হয়। অথচ কোরআন ও হাদীসে অসংখ্য প্রমান রয়েছে যে, নিজে আমল করে সে আমলের সাওয়াব অন্যকে দান করা যায়। যেমন- পূর্ববর্তী প্রশ্নোত্তরেই পিতা মাতার প্রতি সন্তানের নামাজ রােজা ইত্যাদি বখশিষ করার কথা হাদীসে এসেছে। আর বিরােধীদের উপস্থাপিত (ইযা মাতা) হাদীস খানাও তাদের মতের স্বপক্ষে নয়।

কেননা, উক্ত হাদীসে নবী করিম (দঃ) শুধু এতটুকুই বলেছেন যে- মৃত্যুর সাথে সাথে তার নিজের আমল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্ত তার ফলাফলও বন্ধ হয়ে যাবে- এমন কথার ইঙ্গিত উক্ত হাদীসে নেই। তদুপরি- অন্যের আমলের দ্বারা উপকৃত হওয়ার নিষেধাজ্ঞাও উক্ত হাদীসে নেই। বিরােধী দলেরা কোথায় পেল যে, অন্যের আমলের দ্বারা উপকৃত হওয়া যাবেনা? অন্যের আমলের মালিক হবে সে লােক নিজে। কিন্তু যদি সে নিজের আমল অন্যকে দান করে - তাহলে অবশ্যই তা দ্বিতীয় ব্যক্তি পাবে। আমল বন্ধ হয়ে যাওয়া এক জিনিস- আর অপরকে দান করা অন্য জিনিস। ইবনে কাইয়েমের প্রথম।ব্যাখ্যা সমাপ্ত। খুব ভাল করে বুঝে নিন।-অনুবাদক


দ্বিতীয় ব্যাখ্যা : 

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন- لَیۡسَ আয়াতটির হুকুম অন্য একটি আয়াত দ্বারা মানসুখ বা রহিত হয়ে গেছে। সে আয়াতটি হলাে। (আরবির অনুবাদ,কিতাবে আরবি উল্লেখ আছে)অর্থঃ "যারা ঈমানদার- তাদের সন্তানগনও তাদেরই অনুগামী হবে জন্মগত ঈমানের কারনে। আমি (আল্লাহ) তাদের সন্তানগনকে তাদের সাথে (জান্নাতে) একসাথ করবাে" (সুরা তুর)।


উক্ত আয়াতে পিতৃপুরুষের নেক আমলের (ঈমান) কারনে সন্তানগনও বেহেস্তী হবে বলে ঘােষনা করা হয়েছে। কাজেই এই আয়াত খানা  لَیۡسَ -আয়াতকে মানসুখ করে দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে- একজনের আমল অন্যের উপকারে আসবেনা। আর অত্র

শেষােক্ত আয়াতে বলা হয়েছে-পিতৃ পুরুষের ঈমান সন্তানের উপকারে আসবে।

ইবনে আব্বাসের তাফসীর অনুযায়ী لَیۡسَ لِلۡاِنۡسَانِ اِلَّا مَا سَعٰی আয়াতের মধ্যে لَامۡ হরফটি اِنۡتِفَاعٌ  অর্থে ব্যবহৃত হলেও ত  মানসুখ হয়ে গেছে। বর্তমানে উক্ত

আয়াতের কার্যকারিতা বা হুকুম রদ হয়ে গেছে এবং সুরা তুরের আয়াতটি তার রদকারী বা ناسِخۡ হয়ে অন্যের আমলের দ্বারা উপকার পাওয়ার প্রমান বহন করছে।


তৃতীয় ব্যাখ্যা :

তাবেয়ী ইকরামা (রহঃ) সুরা নাজমের উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন এভাবেঃ (আরবির অনুবাদ,কিতাবে আরবি উল্লেখ আছে)অর্থ : "হযরত ইবরাহীম (আঃ) ও হযরত মুছা (আঃ)-এর উম্মতের ক্ষেত্রেই উক্ত আয়াত খানার হুকুম ছিল। এই উম্মতের বেলায় নিজের আমল এবং অন্যের দান করা আমল- উভয়ই ফলদায়ক হবে বলে সুরা তুরে বর্ননা করা হয়েছে। সুতরাং এক উম্মতের হুকুম অন্য উম্মতের উপর চাপিয়ে দেয়া যাবেনা। এই উম্মতের বেলায় নিজের আমল ও অন্যের দানকৃত আমলের সাওয়াব উপকারী হবে। সুরা নাজমের আয়াত খানা (لَیۡسَ) হযরত ইব্রাহীম ও হযরত মুছা (আঃ)-এর উম্মতের ক্ষেত্রে নাযিল হয়েছে। উম্মতে মােহাম্মদীর জন্য নয়।


বিঃ দ্রঃ একজনের কৃত আমল যে অন্যের উপকারে আসে, সে সম্পর্কে দুখানা হাদীস খুবই তাৎপর্যপূর্ন।


প্রথম হাদীস খানা নিন্মরূপ: (আরবির অনুবাদ,কিতাবে আরবি উল্লেখ আছে)অথাৎ "এক মহিলা সাহাবীয়ার ছেলে মারা গেলে উক্ত মহিলা আরজ করলেন- ইয়া রাছুলাল্লাহ! আমি কি তার পক্ষে বদলা হজ্ব করতে পারবাে? নবী করিম (দঃ) বললেন- পারবে। তােমাকেও সাওয়াব দেয়া হবে"। এখানে ছেলের হজ্বের সাওয়াব সে পেয়ে গেল।


দ্বিতীয় হাদীসে বলা হয়েছে:  (আরবির অনুবাদ,কিতাবে আরবি উল্লেখ আছে) অর্থঃ "দ্বিতীয় এক সাহাবী আরজ করলেন- ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার মা ইনতিকাল করেছেন । আমি তাঁর জন্য সদকা করলে তিনি কি তার সাওয়াব পাবেন? হুজুর (দঃ)। এরশাদ করলেন- হাঁ, পাবে। উক্ত সাহাবী ছিলেন হযরত সাদ (রাঃ)"।

এতেই প্রমানিত হলাে- একজনের আমলের সাওয়াব অন্যজন পায়। 

(প্রশ্নোত্তরে আকায়েদ ও মাসায়েল শিক্ষা, মূল : আল্লামা শেখ জাঈন ছামীত আলভী হোসাইনী।  অনুবাদ: অধ্যক্ষ হাফেজ আবদুল জলীল রহমাতুল্লাহি আলাইহি। পৃষ্ঠা -  ৪৭,৪৮,৪৯,৫০,৫১)।



Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন