মাতৃগর্ভে থাকাকালীন সময়ে পিতার ইন্তেক্বাল
ঐতিহাসিক আল্লামা ওয়াকেদীর মতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মাতৃগর্ভে থাকাবস্থায়ই স্বীয় পিতা হযরত খাজা আব্দুল্লাহ (رضي الله عنه ) ইন্তেকাল করেন। এ সম্র্পকে দুটি অভিমত পাওয়া যায়। যথাঃ
(১) দাদা খাজা আব্দুল মুত্তালিব (رضي الله عنه ) পিতা আবদুল্লাহ (رضي الله عنه ) কে কুরাইশ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়ায় প্রেরণ করেছিলেন। সিরিয়ার বানিজ্য হতে প্রত্যাবর্তনের সময় মধ্যপথে অসুস্থ হওয়ার দ্বরুন স্বীয় পিতার মাতুল দেশ বনী আদী ইবনে নাজ্জার গোত্রে প্রায় একমাস অবস্থান করেন। পরবর্তীতে সে অসুস্থতায়ই তথায় তাঁর ইন্তেক্বাল হয় এবং তথায়ই তাঁকে সমাহিত করা হয়।
(২) ঐতিহাসিক ইবনে ওয়াহাবের সুত্রে বর্ণিত: তিনি ইউনুসের সুত্রে এবং তিনি ইবনে শিহাবের সুত্রে বর্ণনা করে বলেন যে, মক্কায় খাদ্যের অভাব দেখা দেয়ায় আব্দুল মুত্তালিব (رضي الله عنه ) স্বীয় মাতুল দেশ খেজুরের এলাকা মদীনায় খাজা আব্দুল্লাহ (رضي الله عنه ) কে পাঠিয়ে ছিলেন খেজুরের জন্য। তথায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন এবং সে অসুস্থতাই তথায় তাঁর ইন্তেকাল হয়।
(তারীখে তাবারী, ২-৮)
এ অভিমতকে ইবনে ইসহাক প্রাধান্য দেন। ইমাম ইবনে সা’দ অনূরূপই বর্ণনা করেছেন।
ইমাম ইবনুল জাওযী (رضي الله عنه ) এর মতে উক্ত মতেরই উপর আহলে সিয়রদের এক বৃহৎদল সমর্থন করেন।
কোন কোন ঐতিহাসিকদের মতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর জন্মের পর স্বীয় পিতা ইন্তেকাল করেন। এ সংক্রান্ত হাদীস বর্ণনা করেন ইমাম ইয়াহইয়া বিন সায়ীদ আল উমায়ী (رضي الله عنه )। তিনি মাগাজী অধ্যায়ে উসমান বিন আব্দুর রহমান আল ওয়াক্কাসী সুত্রে, তিনি ঐতিহাসিক ইবনে শিহাব যুহরীর সুত্রে বর্ণনা করেন, তিনি সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব (رضي الله عنه ) সুত্রে। হযরত সাইয়্যিদ ইবনুল মুসাইয়্যিব (رضي الله عنه ) বলেন: সাইয়্যিদিনা হযরত আমেনা (رضي الله عنه ) স্বীয় পুত্রকে প্রসবের পর খাজা আব্দুল্লাহ (رضي الله عنه ) কে স্বীয় পিতা খাজা আব্দু মুত্তালিব (رضي الله عنه ) নির্দেশ দিলেন সন্তানকে তাঁর কাছে অর্পনের জন্য। তিনি স্বীয় আদরের দৌহিত্রকে নিয়ে আরবের সম্ভ্রান্ত লোকদের নিকট চলে গেলেন তাঁর লালন পালণের জন্য। পরিশেষে বাচ্ছাকে দুধপান করানোর জন্য হযরত হালিমাকে নিয়োগ করলেন।
বর্ণিত আছে যে, তিনি পূর্ণ ছয় বছর হালিমার তত্তাবধানে ছিলেন। এক পর্যায়ে মোহাম্মদ (ﷺ) এর বক্ষ বির্দীন হলে পরবর্তীতে শিশুকে তিনি তাঁর মায়ের কোলে হস্তান্তর করেন।
হালিমা (رضي الله عنه ) কর্তৃক শিশু মোহাম্মদ (ﷺ)কে স্বীয় মায়ের কোলে হস্তান্তরের প্রাক্ষালে মোহাম্মাদ (ﷺ) এর বয়স কতছিল? এ বিষয়ে কিছু মতভেদ পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক ইবনে সাদের মতে এ সময় তাঁর বয়স ছিল দু বছর চার মাস মাত্র। ঐতিহাসিক ইবনে সাদের বর্ণনা মতে তাঁর বয়স ছিল মাত্র সাত মাস।
কথিত আছে যে, ঐ বয়সে থাকাবস্থায় খাজা আব্দুল্লাহ (رضي الله عنه ) স্বীয় পিতার মাতুল দেশ মদীনায় যাওয়ার পর অসুস্থ্য হয়ে পড়লে পর পরবর্তীতে ঐ অবস্থায়ই তিনি তথায় ইন্তেকাল করেন।
উল্লেখ্য যে, ফেরেস্তাকুল আল্লাহর কাছে এ বলে নিবেদন করেন:
إلهنا وسيدنا بقي نبيك هذا يتيما فقال الله انا له ولي وحافظ ونصير .
অর্থাৎ- হে আমাদের মাওলা! আজ থেকে আপনার নবী মোহাম্মদ (ﷺ) চির এতীম হয়ে গেলেন। মহান আল্লাহ পাক বলেন (জেনে রাখ) আমি তাঁর (বিপদ সংকটের) বন্ধু, সংরক্ষনকারী এবং সাহায্যকারী। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)কে ইয়াতীম বানানোর কারণ সম্র্পকে ইমাম জাফর সাদিক (رضي الله عنه ) কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি বললেন لئلا يكون عليه حق لمخلوق যাতে করে কার উপর অন্যান্য মাখলুকাতের কোন অধিকার না থাকে। আবু হাইয়্যান এ হাদীসকে স্বীয় বাহার, গ্রন্থে বর্ণনা করেন।
ইমাম ছাখাভী (رضي الله عنه ) বলেন: মৃতুকালে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সম্মানীত পিতা খাজা আব্দুল্লাহ (رضي الله عنه ) দাসী উম্মে আয়মন পঁাচটি উট ও কিছু বকরীর পাল রেখে যান। পরবর্তীতে উত্তরাধিকার সুত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)ই এ গুলোর মালেক হন।
হযরত উম্মে আয়মন (رضي الله عنه ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)কে দুধপান করাতেন বিধায় তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর এক অন্যতম ধাত্রীমাতা হিসেবে বিশ্বে খ্যাতি লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেন। খাজা আব্দুল মুত্তালেবের সুযোগ্য পিতা হযরত খাজা আব্দুল হাশিম বিন আব্দুল মনাফ (رضي الله عنه ) বনু আদী বিন নাজ্জার গোত্রীয় এক মহান ব্যক্তি আমরের স্নেহশীল কণ্যা হযরত সালমাকে বিবাহ করেন ফলে তাঁরই ঔরসে খাজা আব্দুল মুত্তালিব (رضي الله عنه ) এর জন্ম হয়। আর এ জন্যইতো মহানবী (ﷺ) গর্ব সহকারে বলেন: انى انزل على احوال عبد المطلب الى مهم بذالك- অর্থাৎ- আমি অবশ্যই খাজা আব্দুল মুত্তালিব (رضي الله عنه ) এর গোত্রে অবতীর্ন হয়েছি বিধায় সম্মানীত। এ হাদীসটি বিশুদ্ধ গ্রন্থে হিজরত সংক্রান্ত হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।
ইমাম বায়হাক্বী, তাবারানী, আবু নাঈম প্রমুখগন মুহাম্মাদ বিন আবু সাঈদ-সাক্কাফীর সুত্রে তিনি উসমান বিন আবীল আস-সাক্কাফী (رضي الله عنه ) এর সুত্রে বর্ণনা করত: বলেন : হযরত উসমান বিন আবীল আস-সাক্কাফীর (رضي الله عنه ) বলেন: আমার মহীয়াসী মাতা ফাতেমা বিনতে আব্দুল্লাহ সাক্কাফী رضي الله عنه (যিনি একজন অন্যতমা মহিলা সাহাবী) আমার কাছে বর্ণনা করেন যে, সাইয়্যিদিনা হযরত মা আমেনা বিনতে ওয়াহাব যুহরী (رضي الله عنه ) যে রজনীতে স্নেহের দুলালী সাইয়্যিদুল কাওনাইন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জন্মদান করেছিলেন, সে রাত্রে তিনি মা আমেনার পাশের্ব উপস্থিত ছিলেন। তিনি নিজেই বলেন:
قالت فجعلت انظر الى النجوم قدلى وتدنو حتى قلت ليقعن على فلما ولدت خرج منها نور اضاء له البيت والدار-
অর্থাৎ- তিনি বলেন: আমি ঘরের ভেতরে যত কিছই দেখেছি সবই ছিল নূর এবং আমি আকাশের সমস্ত তারকারাজীকে দেখেছি, ওরা এতই নিকটে চলে এসেছিল যে, আমার মনে হচ্ছিল এক্ষণেই বুঝি আমার উপর পড়ে যাবে। অত:পর নূরে মোহাম্মাদী (ﷺ) জন্ম কালে তাঁর থেকে এমনই এক নূর বের হয়ে আসে যে, যদ্বরুন সমস্ত বাড়ী ঘর নূরে আলোকিত হয়ে যায়।
ইবনে সা’দ বলেন, আমাদের কাছে হায়ছাম বিন খারেজা বর্ণনা করেন তিনি ইয়াহইয়া ইবনে হামযা হতে, তিনি ইমাম আওযায়ী হতে তিনি হাসমান বিন আতিয়্যা হতে, তিনি বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জন্মকালীন সময়ে উভয় জানূর উপর ভর দিয়ে আকাশ পানে চোখ তুলে দৃষ্টি নিবদ্ধাবস্থায় মহান নবী ও রাসূল রূপে আগমন করেন।
ইমাম ইসহাক বিন আবু তালহা হতে মুরসাল সুত্রে প্রমাণিত যে, হযরত আমেনা (رضي الله عنه ) বলেন:
وضعته نظيفا ما ولدنه كما يولد السغل اى المولود الحب الى اهله مايه قذر
অর্থাৎ- আমি তাঁকে মোহাম্মাদ (ﷺ) পুত: পবিত্রাবস্থায় জন্মদান করেছি, অন্যান্য নবজাত শিশুর ন্যায় তাঁকে জন্মদান করিনি যে, তাঁর কোন দোষত্রুটি রয়েছে।
তিনি আরও বলেন : وهو جالس على الارض بيده অর্থাৎ- বাচ্ছা মোহাম্মাদ (ﷺ) জমীনে হস্ত ধারণ করে বসাবস্থায় আগমন করেন।
হযরত আবু হুসাইন ইবনে বুশরান হতে বর্ণিত: তিনি ইবনে সাম্মাক হতে, তিনি বলেন, আমাদের কাছে আবুল হুসাইন ইবনে বারা বণর্না করেন যে, সাইয়্যিদিনা হযরত মা আমেনা (رضي الله عنه ) বলেন:
ولدته جاثيا على ركبتيه ينظر الى الماء ثم قبض قبغة من الارض وأهوى مساجدا- وقالت وكبيت عليه اناء فوجدته قد انفلق الاناء عنه وهو يمص اجهامه يشحب لبنها
অর্থাৎ- প্রসব ব্যথার সঙ্গে সঙ্গে আমি মোহাম্মদ (ﷺ)কে ধরনীর বুকে দেখতে পাই: উভয় জানূর উপর হস্তধারণ অবস্থায় জন্ম দান করি। তিনি আকাশ পানে দৃষ্টি নিবদ্ধবস্থায় আগমন করেন। অত:পর ভূমি হতে এক মুষ্টি মাটি নিলেন এবং সেজদাবনত অবস্থায় প্রার্থনা জানান। তিনি আরও বলেন: আরবীয় প্রথানুযায়ী বাচ্ছা মোহাম্মাদ (ﷺ) এর উপর মা জননী হাড়ি রেখে দেন। সকাল বেলা দেখা গেল যে, হাড়িটি ভেঙ্গে খন্ডবিখন্ড হয়ে যায়।
ইমাম ছাখাভী (رضي الله عنه ) বলেন: হযরত আমেনা رضي الله عنه বাচ্ছা প্রসব দানের পর কোলের শিশুকে স্বীয় দাদা আব্দুল মুত্তালিব (رضي الله عنه ) এর কাছে পাঠিয়ে দেন এবং এ বলে সংবাদ জানান যে, আজ রাত্রে আপনার এক দৌহিত্র জন্ম নিয়েছেন। আপনি তাঁর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করুন। আমেনা ঘটনা প্রবাহে খাজা আব্দুল মুত্তালিব (رضي الله عنه ) শিশু মোহাম্মদ (ﷺ) কুলে নেয়ার পরই মহান আল্লাহ পাকের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে লাগলেন এবং এ প্রসঙ্গে নিন্মোক্ত কবিতাবৃত্তি করেন-
الحمد الله الذى العطانى هذا الغلام الطيب الأر دان قد ساد فى المهد على الغلمان اعيذه باالبيت ذى الأركان-
_______________
আল মাওরিদুর রাভী ফি মাওলিদিন নাবাবী (ﷺ)
মূলঃ ইমাম নূরুদ্দীন মুল্লা আলী কারী আল হারুবী (رحمة الله)
🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন