কোন মু’মিন জাহান্নামে গেলেও একদিন মুক্তি পাবে: এ হাদিস অস্বীকার
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আক্বিদা হল: কাফির মুশরিকগণ চিরস্থায়ী জাহান্নামী। তাদেরকে কখনো জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়া হবে না। কিন্তু যারা কালেমা পড়ে মুসলমান হয়েছে তারা চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে না। জীবনে একবারও যে কালেমা পড়েছে সে যদি জাহান্নামে যায়, তাকেও আল্লাহ তা’য়ালা এক সময় জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। ইহা বুখারি, মুসলিমসহ সমস্ত হাদিসের কিতাবদ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের আমির হামযা নামক জনৈক বক্তা এই সহিহ হাদিসকে ভ্রান্ত ও মিথ্যাকথা বলে সাধারণ জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। তার দাবি যে ব্যক্তি জাহান্নামে যাবে সে চিরকাল জাহান্নামে থাকবে। কখনও বের হবে না।
যেহেতেু ইহা একটি মৌলিক ঈমানী বিষয় তাই আমি এ ব্যাপারে কলম ধরতে বাধ্য হয়েছি। তাহলে আসুন প্রথমে আমরা তার বক্তব্যটি শুনি, সে বলেছে:
‘অনেক মানুষ একটি ভ্রান্ত কথা চালু করে দিয়েছে যা কর তা কর কালিমা একবার পড়লে যদি জাহান্নামে আল্লাহ দেয়ও শেষে তোমাকে একদিন জান্নাতে দেবে। এই কথা কিন্তু বাংলাদেশে প্রচলন আছে। এটা হাদিসের নামে জালিয়াতি। কালিমা একবার যদি কেউ পড়ে একদিন না একদিন জান্নাতে যাবে এই কতাটা ভুল। আমি আবার বলছি: আল্লাহপাক কুরআনে যেখানেই জান্নাত আর জাহান্নামের কথা বলেছেন সেখানেই বলেছেন خلدين فيها ابدا খালিদীনা ফিহা আবাদা মানে কি ? সেখানে যে প্রবেশ করবে সেখানে চিরকাল স্থায়ীভাবে থাকবে। স্থায়ী, চিরকাল বললেন আর কোন কথা থাকে ? সুতরাং এই ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে যারা বসে আছেন কালেমা একবার যখন পড়েছি জাহান্নামে যদি দেয়ও একদিন না একদিন জান্নাতে যাব। না যাকে আল্লাহ জান্নাতে দেবে এটাই ফাইনাল। কোন দিন আল্লাহ তাকে আর বের করবে না। আর যাকে জাহান্নামে দেবে, কোন দিন আল্লাহ তাকে আর বের করবে না। এটাই ফাইনাল। এখন আপনি কি করবেন ভেবে চিন্তে পা দেন।’
পর্যালোচনা:
সম্মানিত পাঠক! আমির হামযা সাহেবের বক্তব্যের জবাবটিকে আমি দুইটি ভাগে আলোচনা করব।
প্রথমত:خلدين فيها ابدا আয়াতের ব্যাখ্যা ও জবাব।
দ্বিতীয়ত: উক্ত বিষয়ে সহিহ হাদিস থেকে প্রামাণিক জবাব।
প্রথমত: আল্লাহ তা’য়ালা কুরআনুল কারীমের বিভিন্ন সূরায় বলেছেন: فى نار جهنم خلدين فيها ابدا
অর্থাৎ ‘জাহান্নামের আগুনে তারা স্থায়ীভাবে থাকবে’।
এই আয়াতটি যেখানে আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেছেন, সেখানেই কাফির মুশরিকদের আলোচনা করে এ কথা বলেছেন। কোথাও বলেননি যে কালেমা পাঠকারী কোন মুসলমান চিরস্থায়ী জাহান্নামে থাকবে। তাহলে আসুন আমরা এ ব্যাপারে কয়েকটি আয়াত দেখি।
আয়াত: ১ ان الذين كفروا من اهل الكتاب والمشركين فى نار جهنم خلدين فيها اولئك هم شر البرية
অর্থ: নিশ্চয় আহলে কিতাব ও মুশরিকদের মধ্যে যারা কুফুরি করেছে তারা জাহান্নামের আগুনে স্থায়ীভাবে থাকবে। তারাই সৃষ্টির অধম। (সূরা বাইয়্যিনাহ আয়াত: ৬)
আয়াত: ২
والذين كفروا وكذبوا بايتنا اولئك اصحاب النار هم فيها خلدين
অর্থ: আর যারা কুফুরি করবে এবং আমার নিদর্শনগুলোকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার প্রয়াস পাবে তারাই হবে জাহান্নামী। অনন্তকাল তারা সেখানে থাকবে। (সূরা বাকারা, আয়াত: ৩৯)
আয়াত: ৩.والذين كفروا وكذبوا بايتنا اولئك اصحاب النار خلدين
فيها وبئس المصير
অর্থ: এবং যারা কুফুরি করবে এবং আমার নিদর্শনগুলোকে মিথ্যা বলবে তারাই জাহান্নামের অধিবাসী। তারা তথায় অনন্তকাল থাকবে। আর ইহা কতই না মন্দ প্রত্যাবর্তন স্থল। (সূরা তাগাবুন, আয়াত: ১০)
আয়াত: ৪.ان الذين كفروا وظلموا لم يكن الله ليغفرلهم ولا ليهدهم طريقا- الا طريق جهنم خلدين فيها ابدا
অর্থ: নিশ্চয় যারা কুফুরি করেছে এবং যুলুম করেছে আল্লাহ কখনো তাদের ক্ষমা করবেন না। এবং সরল পথ দেখাবেন না। তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের পথ সেখানে তারা বাস করবে অনন্তকাল। (সূরা নিসা, আয়াত: ১৬৮-১৬৯)
আয়াত: ৫. ان الله لعن الكافرين واعدلهم سعيرا خلدين فيها ابدا
অর্থ:নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদেরকে অভিসম্পাত করেছেন এবং তাদের জন্য জলন্ত অগ্নি প্রস্তুত রেখেছেন। তথায় তারা অনন্তকাল থাকবে। (সূরা আহযাব, আয়াত: ৬৪-৬৫)
সুপ্রিয় পাঠক! উল্লেখিত আয়াতগুলো দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, যেখানেই আল্লাহ চিরস্থায়ী আযাবের কথা বলেছেন শুধুমাত্র কাফির মুশরিকদের জন্য বলেছেন। কোন মুসলমানের জন্য চিরস্থায়ী আযাবের কথা বলা হয়নি।
দ্বিতীয়ত: হাদিস শরীফ থেকে প্রমাণ
আমির হামযা বলেছেন: ‘বাংলাদেশে একটি ভ্রান্ত ধারণা চালু আছে: কালেমা একবার পাঠ করলে যদি আল্লাহ জাহান্নামে দেয়ও শেষে একদিন আল্লাহ জান্নাতে দেবে’ ইহা ভুল এবং হাদিসের নামে জালিয়াতি।’ নাউজুবিল্লাহ
তাহলে আসুন আমরা এ ব্যাপারে কয়েকটি হাদিস দেখি।
হাদিস: ১.
عن ابى سعيد الخدرى رضى الله تعالى عنه عن النبى صلى الله عليه وسلم قال يدخل اهل الجنة الجنة واهل النار النار- ثم يقول الله تعالى اخرجوا من كان فى قلبه مثقال حبة من خردل من ايمان فيخرجون منها قد اسودا- فيلقون فى نهر الحيا اوالحياة فينبتون كما تنبت الحبة فى جانب السيل- الم ترى انها تخرج صفراء ملتوية-
অর্থ: হযরত আবু সাঈদ খুদরি (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী করিম (ﷺ) বলেছেন, জান্নাতিগণ জান্নাতে এবং জাহান্নামীগণ জাহান্নামে প্রবেশ করার পর আল্লাহ তা’য়ালা (ফেরেশতাদেরকে) বলবেন: ‘যাদের অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণ ঈমান ছিল তাদেরকেও বের করে নিয়ে আস। অতঃপর ফেরেশতারা তাদেরকে বের করে আনবেন। এমতাবস্থায় তারা পুড়ে কালো হয়ে যাবে। অতঃপর তাদেরকে হায়াত নামক ঝর্ণার মধ্যে নিক্ষেপ করা হবে। তখন তারা এমনভাবে সতেজ হয়ে উঠবে যেমনিভাবে নদীর কিনারায় পানি পেয়ে কোন শষ্য দানা গজিয়ে উঠে। তুমি কি দেখনা সে বীজ কেমন হলুদ বর্ণ ধারন করে ফোটে উঠে। (বুখারি হাদিস নং ২২, মুসলিম হাদিস নং ...)
হাদিস: ২ ইমাম বুখারি ‘কিতাবুত তাওহিদ’ অধ্যায়ে শাফায়াত সংক্রান্ত লম্বা একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। নিম্নে হাদিসটির শেষাংশটুকু উল্লেখ করা হল:
من رواية ابى هريرة وزاد هنا فى اخره فيأتون عيسى فيقول لست لها ولكن عليكم بمحمد صلى الله عليه وسلم فيأتونى فاقول انالها فاستأذن على ربى فيؤذن لى ويلهمنى محامد احمده بها لاتحضرنى الان فاحمده بتلك المحامد واخرله ساجدا فيقال يا محمد ارفع رأسك وقل يسمع لك وسل تعط واشفع تشفع فاقول يا رب امتى امتى فيقال انطلق فاخرج منها من كان فى قلبه مثقال شعيرة من ايمان فانطلق فافعل-
(উল্লেখিত হাদিস অনেক লম্বা তাই ইবারত সংক্ষেপ করা হল। তবে সম্পূর্ণ অনুবাদ প্রদত্ত হল)
অনুবাদ: পূর্বে উল্লেখিত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) কর্তৃক বর্ণিত হাদিসের শেষে অতিরিক্ত বর্ণনা হয়েছে এভাবে ‘কিয়ামতের দিন লোকজন অবশেষে ঈসা আলাইহিস সালাম এর কাছে এসে শাফায়াতের জন্য অনুরোধ করবে। তখন তিনি বলবেন আমি এর জন্য নয় বরং তোমরা মুহাম্মদ (ﷺ) এর কাছে গমন কর। অতঃপর লোকজন আমার কাছে আসবে। তখন আমি বলব, আমিই শাফায়াত করব। অতঃপর আমি আমার প্রভূর অনুমতি প্রার্থনা করব। এবং আমাকে অনুমতি প্রদান করা হবে। তখন আমাকে এমন কিছু প্রশংসার বাক্য ইলহাম করা হবে, যার মাধ্যমে আমি আল্লাহর প্রশংসা করব। কিন্তু এখন তা আমার স্মরণে আসছে না। অতঃপর আমি আল্লাহর জন্য সিজদায় অবনত হব। তখন বলা হবে হে মুহাম্মদ! আপনার মাথা উত্তোলন করুন। আপনি বলুন আপনার কথা শুনা হবে। আপনি প্রার্থনা করুন আপনাকে প্রদান করা হবে। আপনি শাফায়াত করুন গ্রহণ করা হবে। তখন আমি বলব, হে প্রভূ আমার উম্মত, আমার উম্মত। তখন বলা হবে যার অন্তরে গমের দানা পরিমাণ ঈমান ছিল তাকেও জাহান্নাম থেকে বের করে নিয়ে আসুন। তখন আমি তাই করব।
অতঃপর আমি পুনরায় সিজদাবনত হব এবং আল্লাহর প্রশংসা করব। তখন আল্লাহ তা’য়ালা পূর্বের ন্যায় বলবেন। আমি বলব হে প্রভূ আমার উম্মত, আমার উম্মত। তখন বলা হবে যার অন্তরে সরিষা পরিমাণ ঈমান ছিল তাকেও জাহান্নাম থেকে বের করে নিয়ে আসুন। আমি যাব এবং তাই করব। অতঃপর আমি পুনরায় সিজদাবনত হব এবং পূর্বের ন্যায় প্রশংসা করব। তখন আল্লাহ পূর্বের ন্যায় অনুমতি দিবেন। তখন আমি বলব হে প্রভূ আমার উম্মত, আমার উম্মত। তখন বলা হবে যার অন্তরে ছোট থেকে ছোট পরিমাণ ঈমান ছিল তাকেও জাহান্নাম থেকে বের করে নিয়ে আসুন। নবীজি বলেন: তখন আমি তাদেরকেও জাহান্নাম থেকে বের করে নিয়ে আসব। (বুখারি হাদিস নং ৭৫১০)
হাদিস: ৩.
وفى رواية عنه قال ثم اعود الرابعة فاحمد بتلك المحامد ثم اخر له ساجدا فيقال يا محمد ارفع رأسك وقل يسمع وسل تعط واشفع تشفع فاقول يا رب ائذن لى فيمن قال لا اله الا الله فيقول وعزتى وجلالى وكبريائ وعظمتى لاخرجن منها من قال لا اله الا الله-
অর্থ: অন্য বর্ণনায় রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: অতঃপর আমি চতুর্থবার পুনরায় সিজাদাবনত হব। পূর্বের ন্যায় আল্লাহর প্রশংসা করব। তখন বলা হবে হে মুহাম্মদ! আপনার মাথা মোবারক উত্তোলন করুন। আপিন বলুন, শ্রবণ করা হবে। প্রার্থনা করুন প্রদান করা হবে। শাফায়াত করুন কবুল করা হবে। তখন আমি বলব, হে প্রভূ আমাকে অনুমতি দিন, আমি ঐ ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে বের করে আনব যে পড়েছিল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। তখন আল্লাহ বলবেন: আমার ইজ্জত, বড়ত্ব, জালালিয়ত ও মহত্বের কসম, আমি অবশ্যই তাকে জাহান্নাম থেকে বের করব যে পড়েছিল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’। (বুখারি হাদিস নং ৭৫১০)।
সম্মানিত পাঠক! এ ব্যাপারে বুখারি মুসলিমসহ অন্যান্য কিতাবে আরো অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। আমার লিখিত ‘শাফিউল মুযনিবীন’ গ্রন্থে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।
এবার আপনারাই বলুন, আমির হামযা সাহেবের বক্তব্য মনগড়া নয় কি ? ইহা সরাসরি কুরআন ও সহিহ হাদিসের খেলাফ। এর মাধ্যমে সরলপ্রাণ মুসলমানদের ঈমান নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে। আল্লাহ সবাইকে বুঝার তৌফিক দান করুন।
_________________
কিতাবঃ হাদিস নিয়ে সালাফিদের জালিয়াত
লেখকঃ হাফিজ মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ ইকরাম উদ্দিন
🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন