কালিমার অর্থ নিয়ে ষড়যন্ত্র
ইতোপূর্বে আমি আলোচনা করেছি যে, সালাফিগণ ঈমানের কালিমার বাক্যকে কাটসাট করে সেখান থেকে ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’কে বাদ দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে।
এবার আমি দেখাতে চাই কালিমার যে অংশটুকু তারা অবশিষ্ট রেখেছে সে অংশটুকুর অর্থও তারা পরিবর্তন করার চক্রান্ত করছে। তাদের মতে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর অর্থ ‘আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নাই।’ ইহা সম্পূর্ণ ভুল। এখানে আমি প্রথমে তাদের কিছু বক্তব্য তুলে ধরব। অতঃপর এর জবাব প্রদান করব ইনশা আল্লাহ।
ইমাম হোসাইন সালাফির বক্তব্য
ইমাম হোসাইন একজন সালাফি শায়খ। তিনি একটা মাহফিলে শ্রোতাগণকে প্রশ্ন করলেন ‘আপনারা বলেন তো লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ অর্থ কি? তখন লোকজন বললেন: আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নাই।‘ তখন তিনি বললেন: আপনারা সবাই জিরো পেয়েছেন। অর্থাৎ উত্তরটি শুদ্ধ হয়নি। এর অর্থ হবে لا معبود بحق الا الله অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোন হক্ব মাবুদ নাই। (ইউটিউব থেকে সংগৃহীত)
আক্রামুজ্জামান সালাফির বক্তব্য
আক্রামুজ্জামান আরেকজন সালাফি শায়খ। তিনি বলেছেন: ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর সঠিক অর্থ হল ‘আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত বা সত্যিকার অর্থে কোন মাবুদ নাই। এটা হল সঠিক অর্থ। আর বেঠিক অর্থ হল ‘আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ নাই’ পার্থক্য বুঝা গেছে? পার্থক্য কয়টি শব্দ দিয়ে হয়েছে? একটা শব্দ মাত্র। এর কারণ কি? কারণ হল কুরআন মাজীদে বিভিন্ন সূরাতে আল্লাহ তা’য়ালা বাতিল কতগুলো মাবুদের পরিচয় করাইছেন। যেমন সূরা তওবার ৩১ নং আয়াতে বলা হয়েছে:
اتخذوا احبارهم ورهبانهم اربابا من دون الله
অর্থ: আহলে কিতাবরা ইহুদি ও খ্রিস্টানরা তাদের ধর্মীয় আলেমদেরকে আল্লাহ বাদ দিয়ে রব হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এই রবগুলো কি সত্যিকার রব না বাতিল রব?
(ইউটিউব থেকে সংগৃহীত)
পর্যালোচনা
সম্মানিত পাঠক! এতক্ষণ আপনারা দুইজন সালাফি শায়খদের বক্তব্য শুনলেন। কি বুঝলেন? তারা এবার কালিমার শব্দ ও অর্থ উভয়টাকেই পরিবর্তন করে ফেলেছেন। আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নাই ইহা নাকি ভুল। বলতে হবে ‘লা মা’বুদা বিহাক্বিন ইল্লাল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোন হক্ব মাবুদ নাই। তাদের যুক্তি হল আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ নাই কেমনে? কুরআনেই তো বর্ণিত হয়েছে যে, ইহুদি নাসারাগণ তাদের আলিমদেরকে রব হিসেবে গ্রহণ করেছিল।
তাহলে আসুন আমরা এবার দেখি কুরআনুল কারীম ও হাদিসশরীফে কালিমার বাক্যটি কিভাবে বর্ণিত হয়েছে।
১. সূরা সাফফাত
انهم كانوا اذا قيل لهم لا اله الا الله يستكبرون
অর্থ: তাদেরকে যখন বলা হত ‘আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই, তখন তারা ঔদ্বত্য প্রদর্শন করত। (আয়াত: ৩৫)
২. সূরা মুহাম্মদ
فاعلم انه لا اله الا الله
অর্থ: জেনে রাখুন আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। (আয়াত ১৯)
৩. বুখারি শরীফ
عن ابن عمر رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم- بنى الاسلام على خمس- شهادة ان لا اله الا الله وان محمدا رسول الله واقام الصلوة وايتاء الزكوة والحج وصوم رمضان
অর্থ: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: ইসলামের মূলভিত্তি হল ৫টি। ১. এই স্বাক্ষ্য প্রদান করা যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ নাই এবং মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল। ২. নামায প্রতিষ্ঠা করা। ৩. যাকাত প্রদান করা। ৪. হজ্জ্ব করা ও ৫. রামাদ্বান মাসে রোযা রাখা। (হাদিস নং: ৮)
৪. মুসলিম শরীফ
ইমাম মুসলিম (رحمة الله) সহিহ মুসলিম শরীফের কিতাবুল ঈমান অধ্যায়ে ৮ নং বাবের মধ্যে উল্লেখ করেছেন:
باب الامر بقتال الناس حتى يقولوا لا اله الا الله محمد رسول الله
অর্থ: অধ্যায়: লোকদের সাথে ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ করার নির্দেশ যতক্ষণ না তারা বলে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।
এ ব্যাপারে আরো অনেক হাদিস আমার ‘কালেমায়ে তাইয়্যিবাহ’ গ্রন্থে বর্ণনা করা হয়েছে।
সম্মানিত পাঠক! আপনারা দেখলেন পবিত্র কুরআনুল কারীম ও হাদিসশরীফে কোথাও لامعبود بحق الا الله বলা হয় নাই। সব জাগাতেই বলা হয়েছে: لا اله الا الله
তাফসির গ্রন্থ থেকে ব্যাখ্যা
এখন আমি কয়েকটি তাফসির গ্রন্থ থেকে উক্ত কালেমার ব্যাকরণগত ব্যাখ্যা ও অর্থ বিশ্লেষণ করে প্রমাণ করব যে, আমরা যেভাবে কালেমার বাক্য ও অর্থ শিখেছি তাই সঠিক।
তাফসিরে কাশশাফ
আল্লামা যামাখশারী ‘তাফসিরে কাশশাফ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন:
الله اصله الاله- فحذفت الهمزة وعوض منها حرف التعريف والاله من اسماء الاجناس يقع على كل معبود بحق او باطل واما الله- بحذف الهمزة فمختص بالمعبود بالحق لم يطلق على غيره-
অর্থ:الله শব্দটি মূলত الاله ছিল। অতঃপর হামযাকে বিলোপ করে নির্দিষ্টবাচক শব্দ হরফে তারিফকে যুক্ত করে الله শব্দটি গঠন করা হয়েছে। আল ইলাহ শব্দটি হল ইসমে জিনস বা জাতী বাচক বিশেষ্য। ইহা হাক্ব অথবা বাতিল প্রত্যেক মাবুদের জন্যই ব্যবহৃত হয়। অতঃপর যখন হামযাকে বিলোপ্ত করে الله শব্দ গঠন করা হল তখন ইহা শুধুমাত্র হাক্ব মাবুদ বা সত্য প্রভূর জন্য নির্দিষ্ট হয়ে গেল। অতএব আল্লাহ শব্দটি মিথ্যা ইলাহ বা বাতিল মাবুদের জন্য প্রয়োগ হয় না। (সূরা ফাতিহা)
তাফসিরে বায়দ্বাভী
ইমাম নাসির উদ্দিন বায়দ্বাভী তাফসিরে বায়দ্বাভীতে বর্ণনা করেছেন:
والله اصله اله- فحذفت الهمزة وعوض منها الالف والام والله مختص بالمعبود بالحق- والاله فى الاصل لكل معبود ثم غلب على المعبود بالحق-
অর্থ:আল্লাহ মূলে ইলাহ ছিল। অতঃপর ইলাহ শব্দের হামযাহ অক্ষরকে বিলোপ করে আলিফ ও লামযুক্ত করে الله শব্দ গঠন করা হয়েছে। অতঃপর আল্লাহ শব্দটি শুধুমাত্র হক মাবুদ বা সত্য ইলাহের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। ইলাহ শব্দটি মূলত সকল প্রকার মাবুদের জন্যই ব্যবহৃত হত। অতঃপর যখন আল্লাহ গঠন করা হল তখন শুধুমাত্র হক্ব মাবুদের জন্য খাস হয়ে গেল। (সূরা ফাতিহা)
ব্যাকরণগত বিশ্লেষণ
আরবি ব্যাকরণ তথা ইলমে নাহুর মতে لا শব্দটি হল একটি হরফ বা অব্যয়। যাকে বলা হয় لا التى لنفى الجنس বা লায়ে নাফি জিন্স। لا শব্দটি যখন কোন ইসমের পুর্বে ব্যবহৃত হয় তখন তার খবরকে ইসমের সমস্ত শ্রেণি থেকে নিষেধ করে। যেমন: শায়খ মুহাম্মদ বিন সালিহ আল উসাইমীন বলেছেন:
لا التى لنفى الجنس- اى لنفى جنس مدخولها- وتكون فى ذالك نصافى العموم- لانك اذا قلت لا رجل فى البيت فالمعنى لايوجد هذا الجنس فى البيت لا واحد ولا اثنان ولا اكثر فنتضى الجنس
অর্থ: লায়ে নাফি জিন্স এমন হরফ যা তার অন্তর্গত সমস্ত জিনস বা প্রকারকে নিষেধ করে। আর ইহা আমভাবে এভাবেই প্রয়োগ হয়। আপনি যদি বলেন: ‘লা রাজুলা ফিল বাইত’ অর্থ ‘বাড়িতে কোন পুরুষ নেই’। তখন অর্থ দাড়ায়: বাড়িতে পুরুষ জাতীয় কোন লোকের অস্তিত্ব নাই। একজন হোক, দুইজন হোক কিংবা ততোধিক সকল প্রকারকেই নিষেধ করে। (শরহে আল ফিয়াতু ইবনু মালিক)
সম্মানিত পাঠক! কালিমার মধ্যে যে ‘লা’ ইহা লায়ে নাফি জিনস। অতএব ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলার সাথে সাথে আল্লাহ ছাড়া আর যত দেব-দেবি, গড, ঈশ্বর, বাতিল ইলাহ সবকিছু বাদ পড়ে যায়। এখানে لا معبود بحق الا الله বা আল্লাহ ছাড়া কোন হক মাবুদ নাই। বলার প্রয়োজন নাই। বরং আল্লাহ ছাড়া কোন হক মাবুদ বলার মধ্যেই শিরকের সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ এতে বুঝা যায় আল্লাহ ছাড়া আরো বেহক বা বাতিল মাবুদ রয়েছে। (নাউজুবিল্লাহ) অথচ কাফির মুশরিকগণ যাদেরকে তাদের প্রভূ বলে ডাকে ইসলাম তো তাদেরকে মাবুদ বলে না। মাবুদ শুধু একজনই, তিনি আল্লাহ।
অতএব কালিমার প্রকৃত অর্থ ভুল দাবি করে নতুন অর্থ সংযোজন করা ফিতনা ছাড়া কিছুই নয়।
_________________
কিতাবঃ হাদিস নিয়ে সালাফিদের জালিয়াত
লেখকঃ হাফিজ মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ ইকরাম উদ্দিন
🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন