নামায জান্নাতের চাবি: এ হাদিস অস্বীকার

 

নামায জান্নাতের চাবি: এ হাদিস অস্বীকার


‘নামায বেহেস্তের চাবি’ ইহা একটি সহিহ হাদিস। কিন্তু বর্তমানে মুজাফফর বিন মুহসিন নামক জনৈক সালাফি শায়খ এই হাদিসটিকে কখনো জাল আবার কখনো মিথ্যা ও কাল্পনিক বলে অভিহিত করেছেন। তাই আমি এই হাদিসটির ব্যাপারে উলামায়ে কেরামদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণসহ প্রমাণ করব যে ইহা একটি সহিহ হাদিস। তাহলে আসুন প্রথমে আমরা মুযাফফর সাহেবের বক্তব্যটি তার লিখিত ‘জাল হাদিসের কবলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সালাত’ বই থেকে দেখি তিনি লিখেছেন:


‘এক কথায় সালাতের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য পবিত্র কুরআন ও সহিহ সুন্নাহর অমীয় বাণীই যথেষ্ট। কিন্তু বর্তমানে সেই অভ্রান্তবাণী ছেড়ে যয়ীফ ও জাল হাদিস মিথ্যা ও উদ্ভট ও কাল্পনিক কাহিনী শুনিয়ে উৎসাহিত করা হচ্ছে। আমরা এই অধ্যায়ে সেগুলো উল্লেখ করার পাশাপাশি সহিহ দলিলগুলোও উল্লেখ করার চেষ্টা করব ইনশা আল্লাহ।



অতঃপর তিনি লিখেন:  ‘সালাত জান্নাতের চাবি’ কথাটি সমাজে বহুল প্রচলিত। অনেকে বুখারিতে আছে বলেও চালিয়ে দেয়। অথচ এর সনদ ত্রুটিটিপূর্ণ।


عن جابر بن عبد الله قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم مفتاح الجنة الصلاة ومفتاح الصلاة الطهور-


অর্থ: জাবের ইবনু আব্দিল্লাহ (رضي الله عنه) বলেন: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: জান্নাতের চাবি হল সালাত। আর সালাতের চাবি হল পবিত্রতা।


(মুসনাদে আহমদ: ১৪৭০৩, তিরমিজি: ৪)



তাহকিকঃ হাদিসটির প্রথম অংশ যইফ। আর দ্বিতীয় অংশ পৃথক সনদে সহিহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে।


প্রথম অংশ যঈফ হওয়ার কারণ হল: উক্ত সনদে দুজন রাবী দুর্বল রাবী আছেন। ক. সুলায়মান বিন করম, খ. আবু ইয়াহইয়া আল ক্বাত্তাত। (সূত্র আলবানী)



পর্যালোচনা



সম্মানিত পাঠক!  এতক্ষণ আপনারা মুজাফফর সাহেবের মনগড়া ফতোয়াটি দেখলেন। বড়ই পরিতাপের বিষয় যে, তিনি শুধুমাত্র আলবানী সাহেবের যুক্তি পেশ করেই হাদিসটিকে কখনো জাল, কখনো সনদে ত্রুটিটি আছে আবার কখনো যয়ীফ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ হিসেবে বলেছেন উক্ত সনদে দুজন দুর্বল রাবী রয়েছেন।


আমি বলব কোন হাদিসের রাবী দুর্বল হলেই হাদিসটিকে জাল বা মিথ্যা বলা ষড়যন্ত্রের শামিল।



এখানে একটা মজার বিষয় হল, মুজাফফর সাহেবের গুরু আলবানী সাহেব এই হাদিসটিকে সহিহ তিরমিজি থেকে উল্লেখ করেছেন। আরেকটু খোলাসা করে বলি, আলবানী সাহেব তিরমিজি শরীফকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। এক ভাগ হল সহিহ তিরমিজি আর একভাগ হল যয়ীফ তিরমিজি। আলহামদু লিল্লাহ এই হাদিসকে তিনি সহিহ তিরমিজিতে উল্লেখ করেছেন। (হাদিস নং: ৪)



মুজাফফর সাহেব লিখেছেন: হাদিসটির প্রথম অংশ যয়ীফ আর দ্বিতীয় অংশ সহিহ। ইহা কেমন কথা ? একই হাদিসের অর্ধেক সহিহ আর অর্ধেক যয়ীফ ইহা তার মনগড়া কথা।


যদি রাবী দুর্বলের কারণে হাদিসটি দুর্বল হয় তাহলে পুরো সনদটিই দুর্বল হবে। এখানে আরো একটি বিষয় স্পষ্ট হল যে, কোন হাদিসের একটি সূত্র দুর্বল হলেই হাদিসটি জাল নয় বরং অন্যান্য সূত্র দেখতে হবে।


সম্মানিত পাঠক!  এবার আসুন আমরা দেখি হাদিসটি কোন কোন ইমামগণ বর্ণনা করেছেন এবং মুহাদ্দিসীনে কেরামদের কী মতামত।



ইমাম তিরমিজি



عن جابر بن عبد الله رضى الله تعالى عنه قال قال رسول لله صلى الله عليه وسلم مفتاح الجنة الصلاة ومفتاح الصلاة والوضوء


অর্থ: হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: জান্নাতের চাবি হল নামায আর নামাযের চাবি হল অজু।


১.তিরমিজি হাদিস নং ৪


২.ইমাম আহমদ বিন হাম্বল, মুসনাদ গ্রন্থ হাদিস নং ১৪৬৬২


৩.ইমাম বায়হাকি শুয়াবুল ঈমান। হাদিস নং ২৪৭৯


৪.ইমাম তাবরানি, আল মু’জামুল আওসাত। হাদিস নং ৪৩৬৪


এছাড়া আরো ইমামগণ তাদের স্ব-স্ব কিতাবে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন।



এবার আসুন যে দুজন রাবী সম্বন্ধে তিনি আপত্তি তুলেছেন তাদের সম্বন্ধে মুহাদ্দিসীনে কেরামদের বক্তব্য দেখি।



ক. সুলাইমান ইবনে করম


ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) تهذيب التهذيب গ্রন্থে বলেছেন:


سليمن بن قرم بن معاذ التميمى الضبى ابوداود النحوى- روى عن ابى اسحاق السبيعى وابى يحى القتات وعطاء بن السائب وابن المنكدر والاعمش وسماك بن حرب وعاصم بن بهدلة وغيرهم-


وعنه سفيان الثورى وهو من اقرانه وابو الجواب وحسين بن محمد المروذى- ويعقوب بن اسحاق الحضرمى ويونس بن محمد المؤدب وابو الاحوص وابو بكر بن عياش وابوداود الطيالس وغيرهم-


অর্থ: সুলায়মান বিন করম বিন মায়ায আত তামিমী, আদ দ্বাবি আবু দাউদ আন নাহুবী। তিনি হাদিস বর্ণনা করেছেন আবু ইসহাক আস সাবিয়ী, আবু ইয়াহইয়া আলকাত্তাত আতা বিন সাইব, ইবনুল মুনকাদির আ’মাশ, সিমাক বিন হারব এবং আসিম বিন বুহদালাহ সহ অন্যান্যাদের কাছ থেকে। তার কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন সুফিয়ান সাওরি, আবুল জওয়াব, হুসাইন বিন মুহাম্মাদ আল মারুযি, ইয়াকুব বিন ইসহাক আল হাদরামী ইউনুস বিন মুহাম্মদ আল মুয়াদ্দাব, আবুল আহওয়াস, আবু বকর বিন আইয়াশ এবং আবু দাউদ আত তায়ালিসি প্রমূখ।


অতঃপর ইমাম আসকালানী বলেন:


قال عبد الله بن احمد بن حنبل- كان ابى يتتبع حديث قطبة بن عبد العزيز وسليمان بن قرم ويزيد بن عبد العزيز بن سياه وقال هؤلاء قوم ثقات- وهم اتم حديثا من سفيان وشعبة وهم اصحاب كتب وان كان سفيان وشعبة احفظ منهم-


অর্থ:আব্দুল্লাহ বিন আহমদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন: আমার পিতা (ইমাম আহমদ) কুত্ববাহ বিন আব্দুল আজিজ, সুলাইমান বিন করম, এবং ইয়াযিদ বিন আব্দুল আজিজ এর হাদিস খোঁজ করতেন। তিনি বলেছেন: এরা হলেন বিশ্বস্ত বর্ণনাকারী। তারা সুফিয়ান ও শুয়বাহর চেয়ে পরিপূর্ণ। তারা কিতাবের অধিকারী। যদিও সুফিয়ান ও শুয়বাহ তাদের চেয়ে অধিক স্মৃতিসম্পন্ন। (সংক্ষেপিত)


অতঃপর ইবনে হাজার আরো কিছু উক্তি বর্ণনা করেছেন:


وقال محمد بن عوف عن احمد لاارى به بأسا لكنه كان يفرط فى التشيع وقال ابن معين ضعيف وقال مرة ليس بشئ


অর্থ: মুহাম্মদ বিন আওফ আহমাদ থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন: আমি এতে কোন সমস্যা দেখিনি। তবে তিনি শিয়াতের ব্যাপারে অতিরিক্ত করতেন। ইবনে মুয়িন বলেছেন: দুর্বল মুররাহ বলেছেন: কোন সমস্যা নাই।

(সংক্ষেপিত) (তাহযিব আত তাহযিব, ৪র্থ খন্ড ২১৩ পৃষ্ঠা)


নবীজির মর্যাদসমূহ জানতে ক্লিক করুন


সম্মানিত পাঠক!  একজন রাবী সম্পর্কে বিভিন্ন ইমামের ভিন্ন ভিন্ন মতামত থাকতে পারে। তাই বলে একজন রাবীকে মিথ্যাবাদী বা জাল হাদিস বর্ণনাকারী বলা যাবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত কোন হাদিসের ইমাম তাকে মিথ্যাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত না করবেন। এখানে আমরা কি দেখলাম? ইমাম আহমাদসহ অনেকেই সুলাইমান বিন করমকে বিশ্বস্ত রাবী বলেছেন। যদিও কেউ দুর্বল বলেছেন কিন্তু কেউ মিথ্যাবাদী বলেননি।



খ. আবু ইয়াহইয়া আল কাত্তাত


জামাল উদ্দিন আবুল হাজ্জাজ ইউসুফ আল মাযী الكمال تهذيب গ্রন্থে দীর্ঘ বর্ণনা করেছেন। সেখান থেকে নিম্নে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরা হল:


ابو يحى القتات الكوفى الكناسى


روى عن حبيب بن ابى ثابت وعطاء ابن ابى رباح وجاهد بن جبر المكى


روى عنه اسرائيل بن يونس وخديج بن معاوية وزياد بن خيثمة وسفيان الثورى وسليمان بن قرم وسليمان الاعمش


قال عبد الله بن احمد بن حنبل عن ابيه كان شريك يضعف ابا يحى القتات


قال عثمان بن سعيد الدارمى عن يحى من معين ثقة قال احمد بن سنان القطات سمعت يحى بن معين يقول  ابو يحى القتات فى الكوفين مثل ثابت فى البصرين


وقال السنانى ليس بالقوى:


روى له البخارى فى الادب وابو داود والترمذى وابن ماجه


অর্থ: আবু ইয়াহইয়া আল কাত্তাত আল কুফি, আল কানাসী, তিনি হাদিস বর্ণনা করেছেন হাবিব বিন আবি সাবিত আত্বা ইবনে আবি রিবাহ এবং মুজাহিদ বিন জবর আল মাক্কী থেকে। তাঁর কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন ইসরাইল বিন ইউনুস। খাদিজ বিন মুয়াবিয়াহ, যিয়াদ বিন খায়সামাহ, সুফিয়ান সাওরি, সুলাইমান বিন করম এবং সুলাইমান আল আ’মাশ। আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন হাম্বল তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন। শারীক নামক রাবী আবু ইয়াহইয়াকে দুর্বল বলেছেন। উসমান বিন সাঈদ আদ দারামী ইয়াহইয়া বিন মুয়িন থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আবু ইয়াহইয়া ছিলেন নির্ভরযোগ্য। আহমাদ বিন সিনান আল কাত্তান বলেন: আমি ইয়াহইয়া বিন মুয়িন থেকে শুনেছি। কুফাবাসীদের জন্য আবু ইয়াহইয়া তেমন বসরা বাসিদের জন্য সাবিত যেমন।


নাসাঈ বলেছেন: তিনি শক্তিশালী ছিলেন না। আবু ইয়াহইয়া থেকে ইমাম বুখারি আদাব গ্রন্থে এবং আবু দাউদ, তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ হাদিস বর্ণনা করেছেন।


(তাহযিবুল কামাল, পৃষ্ঠা ৪০১-৪০৩) রাবী নং ৭৬৯৯)।


উপরোক্ত দলিলভিত্তিক আলোচনা থেকে প্রমাণিত হল যে, ‘নামায বেহেস্তের চাবি’ ইহা মিথ্যা বা জাল হাদিস নয়। বরং ইহা একটি সহিহ হাদিস।

_________________

কিতাবঃ হাদিস নিয়ে সালাফিদের জালিয়াত

লেখকঃ হাফিজ মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ ইকরাম উদ্দিন

 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন