রাসূল


কালেমা-ই-তাইয়্যেবা' এর দুটি অংশ, (যথা) لا اله الا الله আর محمد رسول الله “ইলাহ” এর অর্থ এবং যে জিনিসের উপর উলুহিয়াতের স্থিতি, তা আপনারা বুঝতে পেরেছেন। এখণ গবেষণার বিষয় হচ্ছে রাসুল'কে হয়ে থাকেন আর রেসালতের অর্থ কি? রেসালত এর স্থিতি কোন জিনিসের উপর?


স্মরণ রাখা দরকার যে, রেসালত এর অর্থ প্রেরণ করা, “বেয়েছত” এর অর্থও প্রেরণ করা। কিন্তু এতে পার্থক্য হচ্ছে “বায়াছ” সাধারণ প্রেরণকে বলা হয় কিন্তু রেসালত বলা হয় কিছু প্রদান পূর্বক প্রেরণ করাকে। যেমন কারাে নিকট প্রেরণ করা আর কিছু প্রদান করার জন্য প্রেরণ করা। কাজেই, রেসালত বেয়েছত অপেক্ষা খাস এবং এ জন্যেই আমরা সাধারণ জনগণ রসূল না। “রসুল” এর সংক্ষিপ্ত অর্থ হচ্ছে সংবাদ বাহক ও ফয়েজ বাহক। আবার রসুল দুই প্রকারের যথাঃ “বে- ইখতিয়ার রসুল” (ক্ষমতাহীন রসুল) এবং “বা-ইখতিয়ার রসুল” (ক্ষমাতাবান রসুল) বেইখতিয়ার রসুল’ অনেক ফেরেস্তাই আছে, যাদের সরদার হচ্ছে হযরত জিব্রাইল আমিন আলাইহিস সালাম যেমন মহান প্রভূর এরশাদ হচ্ছে  جاعل الملائكة رسلا أولى أجنحة



 (অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা ফেরেস্তাদেরকে পালর্ক বিশিষ্ট রসুল (বার্তাবাহক) বানায়েছেন।



আর “বা -ইখতিয়ার রসুল” হচ্ছেন হযরত আম্বিয়া -ই কিরাম। উদাহরণ নয় কেবল বুঝার জন্য বলছি যে, বাদশাহ এর প্রশাসনিক নির্দেশ ডাক যােগে গভর্ণর অথবা প্রধান মন্ত্রীর প্রতি প্রেরিত হয়ে থাকে, যাতে করে সেই নির্দেশ মাফিক জনসাধারণের উপর শাসন জারী করা হয়। পােষ্ট অফিসের কর্মচারী সেই সংবাদ রেজিষ্টারী আকারে গভর্ণর কিংবা প্রধান মন্ত্রীর বরাবরে পৌছিয়ে দেয়। অতঃপর এ সকল সম্মানিত ব্যক্তিরা জনসাধারণকে একত্রিত করে এ নির্দেশ ওদেরকে শুনায় এবং তাদের উপর জারী করেন, আইন লংগন কারীদের কঠোর শাস্তি প্রদান করেন, আবার অনেককে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের কারণে পুরস্কারও প্রদান করেন। | দেখুন! ডাকঘরের কর্মচারীই ঐ সব কর্মকর্তাদের নিকট বাদশাহ্র সংবাদ নিয়ে যায় এবং সব কর্মকর্তারা জনসাধারণের কাছে বাদশাহের সংবাদ পৌছায়। কিন্তু উভয়ের সংবাদ পৌছানাের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে প্রথমােক্ত ব্যক্তি হচ্ছে ক্ষমতাহীন সংবাদবাহক,আর এ সব কর্মকর্তারা হচ্ছে ক্ষমতাবান অথচ কাজ উভয়ই একই করেছেন। কিন্তু বিভিন্ন পদমর্যাদায় করেছেন। এ পার্থক্যের কারণে ফলাফল এটাই প্রকাশ হলাে যে, প্রথমােক্ত কর্মচারীকে খাদেম বলা হয়, আর শেষােক্ত কর্মকর্তাকে প্রশাসক বলা হয়। ঐসব কর্মকর্তাদের আনুগত্য বাদশাহের আনুগত্যের নামান্তর। তাদের নির্দেশাবলীর অমান্যতা বাদশাহের প্রতি বিদ্রোহ ধরে নেয়া হয়। ঐ সব কর্মকতাদেরকে প্রয়ােজন বােধে জেল, ফাঁসী প্রদান করারও ক্ষমতা দেয়া হয়। কিন্তু পত্র বাহক পর্যায়ভূক্ত কর্মচারীর এ ধরণের কোন ক্ষমতা নেই।



এভাবে সংবাদ (ওহী) বাহক ফিরিশতাদেরকে সম্মানিত নবীগণের খাদিম হিসেবে ধরে নেয়া হয়। কোন ব্যক্তি ঐ সব ফেরেস্তাদের উম্মত হয় না এবং কোন ব্যক্তির উপর ঐ সব ফেরেস্তাদের কোন বিধি বিধান প্রয়ােগ হয় না। ঐ সব ফেরেস্তাদের নাম কলেমায়ে সংযােযন হয় না বরঞ্চ ঐ সব ফেরেস্তারা সম্মানিত নবীগণের বিশিষ্ট খাদিম হিসেবে বিবেচিত হয়।



সম্মানিত আম্বিয়ায়ে কিরাম সৃষ্টির শাসক, মহান প্রতিপালকের পক্ষ থেকে নিয়ােগপ্রাপ্ত ক্ষমতাবান হাকিম স্বরূপ। এ জন্যেই কওম বা জাতিকে তাদের উম্মত বলা হয়। তাদের নামের কালেমা পাঠ করতে হয়। তাদের বিধি-বিধান-সবার উপর প্রয়ােগ করা হয়। এ ক্ষমতাবান আর ক্ষমতাহীন এর মধ্যকার পার্থক্যের কথা নিশ্চয় যেন স্মরণ থাকে। এই পর্যায়ের সম্মানিত আম্বিয়া-ই- কেরামও যদি ক্ষমতাহীন রসুল হয়, তাহলে রেসালত-ই-জিব্রাইলী এবং রেসালত-ই-মােহাম্মদী এর মধ্যে কি পার্থক্যটা হতাে?



আর আমরা কলেমা-ই-তায়্যৈবায় মােহাম্মদুর রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) কেন পড়ি? জিব্রাইল রসুলুল্লাহ কেন পড়ি না?



মুসলিম ও বােখারী শরীফের এক হাদিছে আছে যে, “হযরত ওমর (রা) বলেন একদা আমরা বারগাহে রেসালতে উপস্থিত ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি আসলাে, যার পােষাক সাদা আর চুল কালাে ছিল, আমাদের মধ্যে কেউ তাকে ইতিপুর্বে দেখিনি। অর্থাৎ সেই ব্যক্তিটি মদিনার বাসিন্দা ছিল না। সে হুজুরের (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) সামনে দুজানু হয়ে হাঁটুর উপর হাত রেখে আদবের সাথে তশরিফ রাখলাে যেমন নামাজী আত্তাহিয়াতে প্রভূর সামনে বসে। অতপর হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর খেদমতে পাঁচটি প্রশ্ন রাখে (১) ঈমান কি? (২) ইসলাম কি? (৩) ইহসান কি? (৪) কেয়ামত কখন হবে? (৫) কেয়ামতের আলামত কি? হুজুর ছৈয়্যদুল মুরছালীন (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) আগন্তুকের প্রক্যেকটি প্রশ্নের উত্তর দিলেন এবং আগন্তুক প্রত্যেক উত্তরান্তে স্বীকৃতি স্বরূপ বললেন সত্যিই বলেছেন, সত্যিই বলেছেন। অতপর চলে গেলেন। তৎপর হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বললেন, ইনি জিব্রাইল যিনি দ্বীনি শিক্ষা দেয়ার জন্য তােমাদের নিকট এসেছেন।



দেখুন! জিব্রাইল আমিন আলাইহিস সালাম সাহাবা-ই-কিরামকে সম্বােধন করে বলেননি যে, ভাই সব, আমি জিব্রাইল। আমার নিকট হতে এ.সব মাসআলা শিখে নাও। বরঞ্চ হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) সামনে সাগরীদ সূলভ আত্তাহিয়াতের অনুরূপ বসলেন এবং সওয়াল পেশ করতঃ প্রিয় নবীর পাক জবানে ঐ সব মসআলা বয়ান করালেন, কিন্তু কেন?



এ জন্যেই যে, মানুষের উপর তার অনুসরণ এবং তার কথা মানা ওয়াজিব ছিল না বরঞ্চ দুজানু হয়ে বসে মুসলমানদেরকে বারগাহে নবুয়াতের আদব শিক্ষা দিলেন এবং বলেছিলেন যে, আমি তােমাদের ন্যায় তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামই) খাদিম ও উম্মত। এটাই হচ্ছে বা- ইখতিয়ার রসুল এবং বে-ইখতিয়ার রসূলের মধ্যকার পার্থক্য। যারা আজ আম্বিয়া-ই-কেরামকে সম্পূর্ণ দুর্বল বান্দা, ক্ষমতাহীন পােষ্টম্যান এর ন্যায় শুধু সংবাদ বাহক স্বীকার করে এবং এভাবে কবিতা পড়ে থাকে ।



جن اداری



. مصطفی ہرگز نه گفتے تانه گفتے جبرائيل



 جبرائیل ہرگز نه گفتے تانه گفتمے کردگان



অর্থাৎ নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) কক্ষনাে বলতেন না যদি জিবরাইল না বলতেন, এবং জিবরাইল কখনাে বলতেন না যদি রব তায়ালা না বলতেন।



তারা জিব্রাইলের রেসালত এবং মােহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর রেসালতের মধ্যে কি পার্থক্যটা করবে? এবং এমতাবস্থায় তাদেরই অনুসরণই বা কি করে হবে? এবং মানব জাতি তাদের উম্মত কেন হবে? রেসালতের ক্ষমতা সম্পর্কে কুরআন করীমের এরশাদ সমূহ পড়ে দেখুন- মহান রাব্বল আলামিন এরশাদ ফরমান



ويزكيهم ويعلمهم الكتاب والحكمة (1)



অর্থাৎ আমাদের নবী ঐ সব লােকদিগকে জাহেরী (বাহ্যিক) বাতেনী (আধ্যত্মিকভাবে) পাক-পবিত্র করেন এবং তাদেরকে কিতাব (কোরআন) ও হিকমত (পবিত্র হাদিস) শিক্ষা দেন।



প্রতীয়মান হলাে যে, কেবল ক্ষমতাহীন বার্তা রাহক তাযকিয়া (পবিত্রকরণ) ও শিক্ষা দান করতে পারে না। .



 (2)   خذ من اموالهم صدقة تطهرهم و تزكيهم بها



মাহবুব (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) আপনি তাদের মালামালের ছদকাহ (যাকাত) আদায় করে নিন। এবং তাদেরকে ঐসব ছদকার দ্বারা জাহেরী (বাহ্যিক পবিত্র) ও তাযকিয়া (আধ্যাত্মিক পবিত্রতা) দান করুন।




ترجى من تشاء منه وتؤوي إليك من تشاء (3)



* আপনি আপনার বিবিদের মধ্য থেকে যাঁকে চান আপনার কাছে রাখুন, যাকে চান আপনার থেকে পৃথক রাখুন।



ما كان لمؤمن ولا مؤمنة إذا قضى الله ورسوله أمرا أن يكون لهم الخيرة من أمرهم (8)



انا



যখন আল্লাহ ও রসুল কোন বিষয়ে ফয়সালা দেন, তখন কোন মুসলিম নর-নারী " দ্বিমত পােষণ করার অবকাশ থাকে না। আরও বলা হয়েছে



فلا وربك لا يؤمن حتى يحكموك فيما شجر بينهم ثم لا ( يجدوا في أنفسهم حرجا مما قضيت ويسلموا تشليما (5)



- হে মাহবুব (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) আপনারই প্রতিপালকের শপথ, এ লােক ততক্ষন মুমিন হতে পারে না, যতক্ষন আপনাকে নিজের তামাম ইখতিয়ারের একচ্ছত্র বিচারক স্বীকার করবে না এবং আপনার ফয়সালায় স্বীয় হৃদয়ে কোন রকমের সংসকীর্ণতার স্থান থাকে বরঞ্চ অবনত মস্তকে স্বীকার করবে।



ক্ষমতাহীন বার্তা বাহক বিচারক হতে পারে, না তার স্বীয় কউমের (গােত্রের) উপর এত বেশী ক্ষমতা রাখতে পারে।



রসুলের প্রয়ােজনীয়তা



যদিও আল্লাহ তায়ালা গ্রীবাস্তিত ধমনী অপেক্ষা ও আমাদের নিকটতম (যেমন) এরশাদ ফরমান



 نحن أقرب إليه من حبل الوريد



অর্থাৎ আমি তার কাছে শায়রগ আঁপেক্ষা অতি নিকটবর্তী। কিন্তু আমরা মহান প্রভূর অতি দূরে। এ প্রসঙ্গে শেখ সাদী (রাঃ) কত সুন্দর বলেছেন



يار نزديك تر از من بمن است



ویں عجب ہیں که من ازودے دورام



বন্ধু আমার অতি নিকটে কিন্তু এটা আশ্চর্য যে আমি তার থেকে অনেক দূরে।



 মাধ্যম ছাড়া আমরা তারই নিকট হতে দয়ার ভাগী হতে পারি না। কারণ আমরাতাে অন্ধকার, সে তাে নূর, তিনি শক্তিশালী, আমরাতাে দুর্বল। সে প্রভাবশালী, আমরাতাে প্রভাবান্বিত। কাজেই প্রয়ােজন ছিলাে যে, রব ও পূজারী,আবেদ ও মাবুদ, খালেক ও মাখলুক, বান্দা ও প্রতিপালক, মােহতাজ (মুখাপেক্ষী) ও বে-নিয়াজ এর মধ্যে এমন বৃহত্তর মাধ্যম হওয়া চায়, তিনি প্রভূর থেকে ফয়েজ নিতে পারেন, এবং আমাদের দিতে পারেন। যেমন কলব (আত্মা) এবং দেহের সংযােগের জন্য মধ্যবর্তী রগ, শিরা ইত্যাদির প্রয়ােজন হয়। কেননা এসব রগ কলবের ফয়েজ হাড় এবং মাংস পর্যন্ত পৌছায়ে থাকে। “রূহ” শরীরকে কলব ও আত্মা দ্বারা প্রতিপালিত করে থাকে। তাহলে আমাদের ন্যায় দূর্বল বান্দাদের পক্ষে বিনা মাধ্যমে প্রভূ থেকে ফয়েজ হাছিল করা ও ঐ পর্যন্ত পৌছা কি করে সম্ভবপর হবে? কারণ আমাদের এবং প্রভূর মধ্যবর্তী একটা মাধ্যম অতিশয় প্রয়ােজন। ঐ মাধ্যমের নাম হচ্ছে রসুল আর ঐ উপায়ের নাম হচ্ছে রেসালত।



প্রত্যেক ব্যক্তি যারা রব পর্যন্ত পৌছতে চায়, অথবা, তাঁর কাছ থেকে কিছু নিতে চায়, তাদের রসুলের প্রয়ােজন। বরঞ্চ যারা দুনিয়ার সংকট থেকে বাঁচতে চায়; তাদের জন্য নবীর দামন (আঁচল) ধরা একান্ত কর্তব্য। যেমন মহান প্রভূ এরশাদ করেছেন



 واعتصموا بحبل الله جميعا و لا تفرقوا



অর্থাৎ সবাই আল্লাহ তায়ালার রশিকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধর, এবং বিচ্ছিন্ন হইও না। এ আয়াতের ব্যাখ্যা এটাই বুঝে নিন যে, একটা গভীর কুপে স্বচ্ছ পানি রয়েছে এবং তলায় রয়েছে কাদা ও ময়লা। আমরা চাচ্ছি যে, যেন কৃপে বালতি গিয়ে পানি নিয়ে নিরাপদে ফিরে আসে। এবং বালতি কাদা-আবর্জনার পতিত না হয়। সে জন্য রশির মধ্যস্ততা গ্রহণ করা হয়। এর এক প্রান্ত নিজ হাতে থাকে অপর প্রান্ত বালতিতে বাধা থাকে। আর যদি রশি মােটা হয়, গিরা দেয়া যায় না; তখন এটাকে লােহার তার কিংবা চিকন রশি দ্বারা বালতির সাথে বাঁধা হয়। এমতাবস্থায় বালতি কৃপে গিয়ে পানিসহ নিরাপদে উপরে উঠে, না কাঁদায় আটকে পড়ে, না তলায় রয়ে যায়।



দুনিয়াও একটা গভীর কূপ স্বরূপ যেখানে সঠিক আকিদা ও নেক আমলের স্বচ্ছ পরিস্কার পানির রয়েছে, যদ্বারা আখিরাতের চাষাবাদ সফল হয় এবং খারাপ আকিদা ও খারাপ আমলের আবর্জনাও আছে। আমরা বালতির ন্যায় এখানে নেক আমলের পানি গ্রহণের উদ্দেশ্যে এসেছি। তাই প্রভূ ঘােষণা করেছেন



 وما خلقت الجن و الإنس الا ليعبدون



অর্থাৎ আমি জ্বীন ও ইনসান (মানুষ)কে সৃজন করেনি কিন্তু ইবাদতের জন্যে।



বিধাতার ইচ্ছে ছিল যে, তার আত্মভােলা বান্দারা দুনিয়ার চাকছিক্যের মােহে যাতে আবদ্ধ না হয়ে ওখান থেকে নিরাপদে আমল ও আকিদার পানি নিয়ে আসে। তাই ঐ মেহেরবান, দয়াময় আল্লাহ এ বুযর্গ স্বত্ত্বাকে পাঠালেন; যার এক হস্ত প্রভূর কুদরতের হাতে; আর অপরটি সৃষ্টির সাহায্য করার জন্য এদিকে ওদিকে রয়েছে। এরই নাম হাব লুল্লাহিল মতিন বা আল্লাহর মজবুত রশি।



যিনি আল্লাহ তায়ালার এ মজবুত রশিকে আঁকড়ে ধরেছে, উনি আল্লাহর সম্মানিত হস্তকে আঁকড়ে ধরেছে।



যেমন আল্লাহ নিজেই বলেছেন



إن الذين يبايعونك إنما يبايعون الله يد الله فوق أيديهم



অর্থাৎ যে ব্যক্তি আপনার কাছে বাইয়াত গ্রহণ করে, সে (যেন) আল্লাহর তায়ালার বাইয়াত করে। তাদের হাতের উপর আল্লাহর হাত রয়েছে।



অতপর স্বরণ থাকা চাই যে, যেমনিভাবে বালতিকে মােটা ও মজবুত রশি দ্বারা মধ্যস্থতাবিহীন আবদ্ধ করা সম্ভবপর নয় বরং একে তার ও ছােট রশি দ্বারা আবদ্ধ করা হয়; তেমনিভাবে আমরাও সােজাসুজি হুযুরের (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) দামানের সাথে আবদ্ধ হতে পরি না, কাজেই ঐ আবদ্ধতার জন্য বেলায়তের মজবুত তারের প্রয়ােজন। আমাদের মশায়েখ (পীর) গণ আমাদেরকে হুযূর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) পর্যন্ত পৌছান, আর হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) মহান আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছান।



بھیکا وه سرکوڑ میں جوجانیں گر کو اور



ارب روٹھے گرمیل گررو ٹھے نہیں ٹھور



এ অধমের এ তকরীর (বক্তব্য) থেকে রেচালতের প্রয়ােজনীয়তা প্রমাণিত হলাে। অনুরূপভাবে, বেলায়তের প্রয়ােজনীয়তাও। ওলী হুযূর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) পর্যন্ত পৌঁছাবেন এবং হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) পৌছাবেন খােদা পর্যন্ত। পৌছানাের দায়িত্ব হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) শুধুমাত্র হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এরই কাজ। গুজরাটবাসীদেরকে এক্কা গাড়ী, যত মূল্যবান হােক না কেন, করাচী পৌছাতে পারবেনা; কেবল ষ্টেশন পর্যন্ত পৌছাতে পারবে। রেল করাচী পৌছাবে। . যখন এ ব্যাপারটা বুঝে নিলেন, তবে এটাও বুঝে নিন যে, আকিদায়ে রেসালতের জন্য তিনটি কথা স্বীকার করা অত্যাবশক। প্রথম এ যে, আমরা সােজাসুজিভাবে মহান প্রভূ থেকে কোন নেয়ামত নিতে পারিনা। যা কিছু মিলবে রসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর উসীলায় মিলবে। অন্যথায় রেসালতের প্রয়ােজনও থাকতাে না এবং পৃথিবীতে রসুলের আগমন সম্পূর্ণ অনর্থক হতাে যদি আমরা ডাইরেক্ট গ্রহীতা আর রব ডাইরেক্ট দাতা হতেন। রসুলের তাহলে প্রয়ােজনীয়তা কেন??



দ্বিতীয়তঃ রসুল আমাদের মত কর্তৃত্বহীন নয়, তিনি রব’ থেকে নিতে পারেনএবং আমাদেরকে দিতেও পারেন। যদি তিনি সােজাসুজিভাবে রব’ থেকে নিতে সক্ষম না হন, তাহলে পুনরায় তাঁর জন্য আর একজন রসুল প্রেরণ করার প্রয়ােজন হবে যার উম্মত তিনিই হতেন। আর যদি আমাদের দিতে সক্ষম না হন; তাহলে আমাদের জন্য অপর একজন রসুলের প্রয়ােজন হয়ে পড়তাে।



তৃতীয়তঃ রসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) দাতা রব’কেও জানেন এবং গ্রহীতা উম্মতদেরকেও চিনেন। এ দু’জ্ঞান ব্যতিত নেয়া আর দেয়া প্রমাণিত হয় না। যে সমস্ত লােক নবুয়াতের ওসীলা গ্রহণ করাকে অস্বীকার করে এবং বলে যে, প্রত্যেক নেয়ামত মাধ্যম ছাড়া আল্লাহ থেকে প্রাপ্ত এটা মূলতঃ হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর রেসালতকে অস্বীকার করার নামান্তর এবং কালেমা-ই-তায়্যৈবার দ্বিতীয়াংশের অস্বীকারকারী। কেননা যখন প্রত্যেক কিছু রব' থেকে আমরা নিজেই নিতে পারি; তখন তার আবার কি প্রয়ােজন ছিল? নায়াজুবিল্লাহ মিনহু।



এ বক্তব্য থেকে আপনারা এটা বুঝে গেছেন যে, আল্লাহর সাথে রসূলের সম্পর্ক হচ্ছে আদায় করার আর আমাদের সাথে সম্পর্ক হচ্ছে প্রদান করার। এজন্যই তাকে رسول الله রসুলুল্লাহও বলা হয় অর্থাৎ আল্লাহর নিকট হতে গ্রহণকারী এবং আমরা তাঁকে رسولنا (আমাদের রসুল)ও বলি অর্থাৎ প্রদানকারী। উক্ত দুই সম্পর্কের মাধ্যমে তাঁর দু'টি কামালিয়াতের বহিঃ প্রকাশ ঘটেছে। এ জন্যে কোরআন করীমে হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) কে رسول الله “রসুলুল্লাহ” এবং رسولكم “রসুলুকুম” বলা হয়েছে।



রসুলের মর্যাদা




 পৃথিবীতে আমরা প্রভূ কর্তৃক প্রেরিত হয়েছি, অনুরূপ রসুলও। কিন্তু আমাদের আগমনকে কোরআন করীম খলক বা জন্ম বলেছেন যেমন এরশাদ হচ্ছে خلقكم و ما تعملون আল্লাহ তােমাদেরকে এবং তােমাদের কার্যাদিকে সৃজন করেছেন। আরও বলা হয়েছে



 و ما خلقت الجن و الإنس الا ليعبدون



আমি জ্বীন ও ইনসান (মানব)কে এবাদতের উদ্দেশ্যে সৃজন করেছি।



আরও এরশাদ হয়েছে,



 خلقكم والذين من قبلكم আল্লাহ তােমাদেরকে এবং তােমাদের পূর্ববর্তীগণকে সৃজন করেছেন।



কিন্তু পৃথিবীতে রসুলের তশরীফ আনয়নকে বেছত (প্রেরণ) এবং রেছালত দ্বারা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।



যেমন এরশাদ হচ্ছে



 هو الذي بعث في الأميين رسولا



আল্লাহ তিনিই; যিনি মুর্খদের মাঝে রসুল প্রেরণ করেছেন।আরও এরশাদ হচ্ছে



 هو الذي ارسل رسوله بالهدى و دين الحق



আল্লাহ হচ্ছে তিনিই, যিনি আপন রসুলকে হেদায়াত এবং সত্য ধর্ম দিয়ে প্রেরণ করেছেন। মােট কথা বেছত’ এবং রেছালত' শব্দদ্বয়ে শুধুমাত্র নবীদের বেলায় ব্যবহৃত হয়েছে, আমাদের বেলায় নয়। অর্থাৎ আমরা হলাম আল্লাহর কেবলমাত্র মখলুক, আর রসুল তার মখলুকও, “রসুল”ও এবং তাঁর প্রেরিতও বটে।



এ পার্থক্যের কয়েকটি কারণ রয়েছে।



প্রথমতঃ আমরা পৃথিবীতে আপন আপন কাজ-কর্মের জন্যে নিজ জিম্মায় আগমন করি আর রসুল পৃথিবীতে তশরীফ আনেন প্রভূর কাজ-কর্মের উদ্দেশ্যে স্বয়ং প্রভূর জিম্মায়। উদাহরণ স্বরূপ, কোন দেশে কেউ নিজ কাজ-কর্মের জন্যে যায়, আর কেউ সরকারের প্রতিনিধি হয়ে রাষ্ট্রীয় কাজ কর্মের জন্যে রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে যায়। নিশ্চয় উভয়ের যাওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধির বেলায় যাতায়াতের সমস্ত খরচাদি তার রাষ্ট্রেরই জিম্মায় থাকে, এবং তার প্রতিটি ক্রিয়াকলাপ রাষ্ট্রীয় ক্রিয়াকলাপ বলে গণ্য হয়। পক্ষান্তরে নিজ জিম্মায় ভ্রমণকারীর বেলায় তা নয়।



দ্বিতীয়তঃ আমরা এসেছি পৃথিবীতে নিজেকে গঠন করার জন্যে। যেমন, বিশুদ্ধ আকিদা অবলম্বন করতঃ মুমিন হই, নেক আমল করে মুত্তাকী পরহেজগার হই, কিন্তু রসুল তশরীফ এনেছেন অন্যদের গঠন করার জন্যে যেমন মানব সমাজ তাদের মাধ্যমে মুত্ত্বাকী-পরহেজগর হয়। ইসলামের জাহাজে আমরা যেমন যাত্রী, রসুলও তাই। কিন্তু, আমরা বন্দরে পৌছার জন্যে আর রসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বন্দরে পৌছানাের জন্যে। উদাহরণ স্বরূপ জাহাজে যাত্রীও উঠে কাপ্তানও উঠে এবং যদিওবা জাহাজে সমুদ্র যাত্রার শুরু আর শেষ উভয়ের একই হয়, কিন্তু যাত্রী জাহাজে সওয়ার হয়েছে বন্দরে পৌছার জন্যে, আর কাপ্তান হয়েছে বন্দরে পৌছিয়ে দেয়ার জন্যে। এ পার্থক্যের কারণে যাত্রী বাড়া দিয়ে সওয়ার হয় আর কাপ্তান মাসিক বেতন নিয়ে।



তৃতীয়তঃ আমরা সাধারণ লোক পৃথিবীতে নিবোধ অবস্থায় জন্ম লাভ করি। এখানে এসে শিক্ষা গ্রহণ করি। আর ঐসব হযরত সব কিছু প্রভূ কর্তৃক শিক্ষা গ্রহন করে অন্যদের শিক্ষা দানের জন্যে তশরীফ আনেন। এ কারণে আমরা এখানের সামাজিক পরিবেশ গঠিত হই। কিন্তু রসুলগণ কালিমাপূর্ণ সমাজে আর্বিভূত হয়ে পবিত্র থাকেন অথাৎ পরিবেশ আমাদেরকে পরিবর্তন করে আর তাঁরা পরিবেশকে পরিবর্তন করেন।



হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম ভূমিষ্ট হওয়া মাত্রই এরশাদ করলেন



أتاني الكتاب وجعلنی نبيا وجعلنی مباركا أينما كنت وأوصاني بالصلوة والركوة مادمت حيا وبرا بوالدتي



আমি আল্লাহর বান্দা আমাকে তিনি কিতাব (ইঞ্জিন) দান করেছেন, আমাকে নবী বানিয়েছেন এবং আমাকে বরকতময়ী করেছেন, যেখানেই আমি থাকি না কেন, আমাকে নামাজ ও পবিত্রতার নির্দেশ দিয়েছেন যতদিন পর্যন্ত জীবিত থাকি এবং আমাকে আপন মায়ের সাথে সৎ ব্যবহারকারী করেছেন।



উক্ত আয়াতে করীমার সব স্থানে অতীতকালের ক্রিয়া ব্যবহৃত হয়েছে।



অর্থাৎ সব কিছু শিখে, জেনে এখানে এসেছি। এটাই হচ্ছে রসুলের শান বা মর্যাদা। আমাদের হাবীব (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) জন্মগত আরিফ বা আধ্যাত্মিক দৃষ্টি সম্পন্ন কামেল রসূল ছিলেন। বাল্য জীবনে ধাত্রী মাতা বিবি হালিমার তত্ত্বাবধানে থাকাকালে যখন সমবয়সী ছােট ছােট ছেলেরা তাঁকে খেলার জন্যে আহবান করে, তখনই তিনি এতাে স্বল্প বয়সেও পবিত্র জবান দ্বারা ফরমালেন “আমাকে এ কাজের জন্যে প্রেরণ করা হয়নি"- এটাই হচ্ছে রসূলের প্রকৃতি, এটাই হচ্ছে পৃথিবীতে রসূলের আগমনের শান ও মর্যাদা।


⭕⬅⬅⬅⬅⬅⬅⬅⬅⬅



যে সব লােক রসূলগণকে নিজেদের মত সংজ্ঞাহীন, জ্ঞানহীন কিংবা নবুয়াত প্রকাশের পূর্বে পথ ভ্রষ্ট ও ধর্মহীন মনে করে, ঐ সব লােক মূলতঃ রসুলের মর্যাদার অস্বীকারকারী। রসুল যদি আমাদের মতাে সংশােধনের মুখাপেক্ষী হতেন; তাহলে তাঁর জন্য অন্য একজন রসুলের প্রয়ােজন হতাে, যিনি তাঁকে সংশােধন করতেন আর যার উম্মত হতেন খােদ তিনি।



উল্লেখ্য যে, সর্বাপেক্ষা সেই ব্যক্তিই সফলকাম যিনি পুতঃ পবিত্র অবস্থায় জীবন অতিবাহিত করে এবং আল্লাহর জিকির করে এবং নামাজের নিয়মানুবর্তীতা রক্ষা করে।



কোরআন শরীফে এরশাদ হচ্ছেঃ



 قد افلح من تزكى و ذكر اسم ربه فصلى



“নিঃসন্দেহে, কামিয়াব হয়েছে সেই, যিনি পাক-পবিত্র হয়েছে এবং যিনি স্বীয় প্রভূর বরকতময় নাম জিকির করেন এবং নামাজ পড়েন।"বুঝা গেল যে, পুত-পবিত্রতা হচ্ছে কামেয়াবীর প্রথম সােপান। প্রশ্ন হচ্ছে, পবিত্রতা দানকারী কে?



এ প্রসঙ্গে কোরআন শরীফে এরশাদ হচ্ছে



 ويزكيهم و يعلهم الكتب و الحكم



আমার নবী ঐ সমস্ত লােকদেরকে পাক-পবিত্র করেন এবং তাদের কিতাব ও হেকমত শিখান।” আরও এরশাদ হচ্ছে-



 جذ من اموالهم صدقة تطهرهم و تزكيهم بها



আপনি তাদের ছদকাহ সমূহ’ গ্রহণ করুন। এর বিনিময়ে আপনি তাদেরকে পাক-পবিত্র করুন।



বুঝা গেল যে, পবিত্রতা অর্জনকারী হলাম আমরা আর পবিত্রতাদানকারী হলেন হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) । আমাদের মধ্যে চারটি বস্তু রয়েছে, শরীর, মস্তিষ্ক, চিন্তা ও রূহ (আত্মা)। হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)ও আমাদের চারটি জিনিস দান করেছেন “শরীয়ত, তরীকত, হাকীকত, মারেফত”। শরীয়ত দ্বারা আমাদেরকে শরীরকে পাক করেছেন, তরীকত দ্বারা আমাদের মস্তিষ্ক ও চিন্তা-ভাবনাকে পবিত্রতা দান করেছেন, হাকিকত দ্বারা অন্তরকে আর মারেফত দ্বারা রূহ বা আত্মাকে পাক পবিত্র করেছেন।



এটাও জানা থাকা চাই যে, শরীয়তের কেন্দ্র হলাে প্রিয় নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর শরীর মােবারক, তরীকতের কেন্দ্র হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর অন্তর মুবারক। হাকিকতের প্রস্রবনের অগ্রভাগ হলাে রূহে মােস্তাফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এবং মারেফতের কেন্দ্রও নবুয়াতের রহস্য। হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে চার ধরনের কালিমা দূরীভূত করার জন্যে চার প্রকারের পানি দান করেছেন। বাকী রইলাে, আমাদের নাফসে আম্মার। এটাকে পাক ও পবিত্র করার জন্যে ‘ইশকে মােস্তাফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বা মুহাব্বতের আগুণ দান করেছেন, যদ্বারা নাফসকে ভষ্ম করতঃ তার হাকীকত বদলায়ে দেয় এবং পরিবর্তিত হাকীকত নাপাককে পাক করে দেয়।



যা হােক সৃষ্টির কাছে রসুলের এতবেশী প্রয়ােজন, যেমন জমির জন্য পানি, বাগানের জন্যে বৃষ্টি। জমির কোন অংশই কখনাে বৃষ্টি থেকে মুক্ত হতে পারে না। এমনিভাবে কোন ব্যক্তি সে যেই স্তর বা পজিশনের হােক না কেন হায়াত-মাউত, কবর নশরের বেলায় কখনাে হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) থেকে উদাসীন হতে পারে না। যেমন বাগানের প্রতিটি পাপড়ি, ফুল কুড়ি গুল্ম বৃষ্টির কাছে ঋণী তেমনি মখলুকের চরম উৎসর্কতা বারগাহে নবুয়াতের মেহেরবাণী। তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) প্রভূর কসম,যার যা মিলেছে, সবই হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর দয়ার কারণে মিলেছে। খােদার দরবারে প্রার্থনা, আমাদের সবাইকে হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর অনুগ্রহের বৃষ্টি দ্বারা প্লাবিত করুন, আমিন।




একটি সংশয়



আমার এ বক্তব্যের উপর কোন কোন হযরতের মনে একটি শংসয় জন্ম নিতে পারে যে, যখন রসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) মাধ্যমবিহীন মহান আল্লাহর কাছ থেকে সব কিছু লাভ করতে পারেন, তারপরও তাঁর এবং প্রভূর মধ্যখানে হযরত জিব্রাইল (আলাইহিস সালাম) এর মধ্যস্থতা কেন রাখা হলাে? এবং ওহী প্রেরণের সিলসিলা কেন প্রতিষ্ঠা করা হলাে? মহান প্রভূ এরশাদ করেন



 جاعل الملائكة رسلا أولى أجنحة



আল্লাহতায়ালা ফেরেস্তাদেরকে পাখা বিশিষ্ট বাহক বানিয়েছেন।



আর এরশাদ হচ্ছে- نزله روح القدس على قلبك  



হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম এ কোরআন আপনার অন্তরে অবতীর্ণ করেন।



উপরােক্ত আয়াতে করীমা দ্বারা বুঝা যায় যে, যেমনি ভাবে আমরা মাধ্যমবিহীন প্রভুর কাছ থেকে কিছু লাভ করতে অক্ষম; তেমনিভাবে, রসুলও মাধ্যম বিহীন তার (প্রভূ) কাছ থেকে কিছু লাভ করতে অক্ষম। ঐ সব রসুল অপর একজন রসূলের প্রয়ােজনীয়তা মনে করে, যাকে শরীয়তের ভাষায় “রুহুল কুদুস বা জিব্রাইল বলা হয়। এ সব কারণে কোরআন করীম হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম তথা তার সাহায্য কারীদের রসুল আখ্যা দিয়েছেন।




সংশয়ের অবসান



উক্ত আপত্তির উত্তর হচ্ছে, ওহীর আগমন এবং জিব্রাইল আলাইহিস সালাম হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর দরবারে আসা একটা কানুনের অনুসরণ মাত্র, হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর ইলমের জন্য নয়। মহান আল্লাহ হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) কে প্রথমেই সব কিছু শিক্ষা দিক্ষা দান করেই প্রেরণ করেছেন। কিন্তু প্রভূর নিয়মাবলী বান্দাদের মধ্যে প্রচলন ঐ সময় হবে; যখন ওহীর মাধ্যমে ঐ সব কানুন অবতীর্ণ করা হবে। এর পিছনে কয়েকটি দলিল রয়েছে।



প্রথমতঃ রাব্বল আলামীন কোরআন করীমের প্রশংশী এভাবে করেছেন  هدى للمتقين



 এ কোরআন মুক্তাকীদের জন্য পথ প্রদর্শক স্বরূপ। অর্থাৎ হে মাহবুব! তােমার পথ প্রদর্শক নয় তুমি তাে প্রথম থেকে হেদায়াত প্রাপ্ত। এজন্য هدى لك (আপনার হেদায়ত) বলা হয়নি।



দ্বিতীয়তঃ কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার সিলসিলা হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর চল্লিশ বৎসর বয়সের পর আরম্ভ হয়। কিন্তু হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর চল্লিশ বৎসরের জিন্দেগীটা ছিল সততা, বিশ্বস্ততা, সত্যবাদিতা ও সরলতার অতি উত্তম দৃষ্টান্ত। ফলে কাফিররাও তাঁকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) আল-আমীন (সত্যবাদী), সাদেকুল ওয়াদ (অঙ্গীকার রক্ষাকারী) খেতাব দিয়েছিল।



তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হেদায়াত প্রাপ্তি কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার উপর যদি নির্ভরশীল, তা হলে তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) চল্লিশ বৎসরের জিন্দেগীটা আসে পাশের অন্যান্য সাধারণ আরবদের ন্যায় অতিবাহিত হতাে। অথচ হাদিছ দ্বারা প্রমাণিত, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) উক্ত দীর্ঘ সময়ে শিরক ও কুফর তাে দূরের কথা বরং কখনাে খেলাধুলা, আমাদে-প্রমােদ, গায়রুল্লাহর (আল্লাহ ভিন্ন) নামের উপর জবেহ কৃত পশুর মাংস খাননি। বলুন এ হেদায়াত হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) কোন্ ফেরেস্তা কিংবা ওহীর মাধ্যমে অর্জন করেছিলেন?



তৃতীয়তঃ যখন প্রথম ওহী নাযিল হয়, তখন ছরকারে দোজাহান (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হেরা পর্বতের গুহায় ছয় মাস পর্যন্ত ইতেকাফ, নামাজ, সিজদা, রুকু ইত্যাদি ইবাদাত সমূহে মশগুল ছিলেন। চিন্তা করুণ, ঐ সময় হুযুর এ সব ইবাদাত সমূহ কোথা থেকে শিক্ষা লাভ করেছিলেন?



চতুর্থঃ স্মর্তব্য যে, হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) নামাজের তােহফা মিরাজরজনীতে লামাকানে পৌছে লাভ করেন। মিরাজের ভােরবেলায় ফজরের নামাজ পড়ানাে হয়নি। জোহর থেকে আরম্ভ করে পরস্পর দুই দিন পর্যন্ত জিব্রাইল আমিন আলাইহিস সালাম নিয়মিত উপস্থিত ছিলেন আর এ দিকে হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) প্রত্যেক ওয়াক্তের নামাজ পড়াইতেছেন। তখন থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের প্রচলন হয়। কিন্তু চিন্তার বিষয় যে, মিরাজরজনী ফরশ (পৃথিবী) থেকে আরশের অভিমুখে সফরকালে হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বাইতুল মােকাদ্দাসে সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরামকে সাথে নিয়ে নামাজ আদায় করেন। তিনি ইমাম হলেন আর সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরাম হলেন মুকতাদী। এদের মধ্যে আবার কেউ মুয়াজ্জিন কেউ মােকাব্বের। চিন্তা করুন, এটা এমন মুবারক সময় এদিকে নামাজ গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। অথচ দেখুন, এরই পূর্বে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) নামাজ পড়ায়ে গমন করেছেন। সুবহানাল্লাহ। যাদের নিয়ে নামাজ পড়লেন, তাঁরা হলেন সম্মানিত নবীগণ যাঁরা স্বীয় উম্মতদেরকে নামাজ পড়াতেন, এবং শিখাতেন। এ থেকে এ মসআলাটা হৃদয়ঙ্গম হওয়া চাই যে, নামাজের ইমাম শরীয়তের দৃষ্টিতে নামাজ সংক্রান্ত মসআলা-মসায়েল সম্পর্কে মুক্তাদীদের থেকে অধিকতর পরিপক্ষ হওয়া বাঞ্চনীয়।



পঞ্চমতঃ হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর প্রতি জিব্রাইল  আলাইহিস সালাম এর মাধ্যমে সবসময় অহী নাজিল হতাে না। প্রায় সময় বিনা মাধ্যমে হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর প্রতি ওহী হতাে। মহান প্রভূ বলেন



وما ينطق عن الهوى إن هو الا وحي يوحى



আমার মাহবুব “স্বীয় অভিলাষ মতে কথা বলেন না, যা বলেন, তা সব প্রভূর ওহী মাত্র, যা কিছু তার প্রতি অবতীর্ণ করা হয়।”



উল্লেখ্য যে, প্রত্যেক বিষয়ে জিব্রাইল আমীন ওহী নিয়ে আসতেন না। আরও এরশাদ হচ্ছে-



  ثم دنا فتدلى. فكان قاب قوسين أو أدنى فاوحى إلى عبده ما اوحى



তারপর, আমার মাহবুব, নিকট থেকে আরও নিকটতর হন,' যেমন দু’টি কামানের মুখামুখি। প্রভূ স্বীয় বান্দাকে যা ওহী দিতে চেয়েছেন, তা দিয়েছেন।



উল্লেখ্য যে, এ নৈকট্যের বিশেষ সময় বিশেষ ওহীই করা হয়েছে। জিব্রাইলের কল্পনা সেখানে পৌছার কোন অবকাশ নেই।



غنچه ما اوحی کے وہ چٹکے دنی کے باغ میں



بلبل سدره تك ان کی بو سے بھی محرم نہین



যাই হােক এটা মানতে হবে যে, রাব্বল আলামীন ও তার মাহবুবের মাঝে জিব্রাইলের আনাগােনা এবং ওহীর পরস্পরা নিয়মতান্ত্রিতার প্রতিফলন মাত্র। এ নিয়ম নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) কে জ্ঞানদান করার জন্য নয়। নতুবা আমরা যেমন হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর উম্মত হই, অনুরূপ, হুযুর (সাল্লাল্লাহ আলাইহে ওয়া সাল্লাম) জিব্রাইল আমিনের উম্মত হতেন। এবং আমরা যেরূপ হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর কালেমা পাঠ করি, হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে। ওয়া সাল্লাম) ও জিব্রাইলের কলেমা পাঠ করতেন।



নবীঃ এ বিষয়ে দু'টি অংশ আছে, একেতঃ সুমহান ইসলামের নবুয়তের মর্যাদা। দ্বিতীয়তঃ ইসলামের মহান নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) অবস্থান। তাই মুক্তির পূর্বশর্ত তৌহিদ নয়, বরং ঈমান। আর ঈমানের ভিত্তি হচ্ছে প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর মুহাব্বত। ফলাফল দাঁড়ায় যে রসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর প্রেমই মুক্তির পূর্বশর্ত। এর পিছনে অনেক দলিলাদি রয়েছে।



প্রথমতঃ শয়তান খােদার জাত-সিপাত বেহেস্ত দোযখ, হাশর-নশর, অদৃষ্ট ও ফিরিস্তা ইত্যাদি সবকিছুর বিশ্বাসী ছিল কিন্তু মুক্তি পায়নি। স্বয়ং নিজেই বলছেঃ



 ولعزتك لأغوينهم أجمعين الا عبادك منهم المخلصين



আপনার ইজ্জতের কসম, আমি সমস্ত আদম সন্তানকে পথভ্রষ্ট করবো, আপনার একান্ত বান্দাদের ব্যতিত। বুঝা গেল যে, প্রভূর জাত ও সিফাত সম্পর্কে সে বিশ্বাসী ছিল। ওটাও জানতাে যে, প্রভূর একান্ত বান্দারা এসব বিষয় সমূহে খুবই দক্ষ অর্থাৎ তকদীরের (অদৃষ্ট) বিশ্বাসী।



সে আরও বলছে-



 انظرنى إلى يوم يبعثون



মাওলা! আমাকে পুনরুত্তান দিবস পর্যন্ত সময় দিন। বুঝা গেল যে, (সে) কিয়ামত তথা কিয়ামতের অবস্থাদি জানতে ও মানতাে।



তখন প্রভূ এরশাদ করলেন



 لاملئن جهنم ممن تبعك  



আমি তােমার অনুসারীদেরকে দোযখে নিক্ষেপ করবাে। এতে জানা যায়, সে বেহেস্ত দোযখ সম্পর্কেও জ্ঞাত ছিল। বস্তুতঃ ঈমানের সকল দিক সমূহ মানতাে, অস্বীকারকারী ছিল কেবল নবুয়াতের। এ জন্য অভিশপ্ত হলাে। নবুয়াত হচ্ছে, যেমন শত বা হাজার টাকার নােট, এ নােট যখন সরকারী অনুমােদিত হয় তখন একটা কাগজের মূল্য একশত বা একহাজার টাকা হয় কিন্তু সরকারী সম্পর্কহীন এসব কাগজের কোন মূল্য নেই। অনুরূপ কিয়ামতের মাঠে তৌহিদের মূল্য তখনই হবে, যখন তা নবুয়াতের সাথে সম্পৃক্ত হবে।



দ্বিতীয়তঃ কালেমা-ই-তায়্যৈবার নাম হচ্ছে কালেমা-ই- তৌহিদ (একত্ববাদের স্বীকারােক্তি)। কিন্তু এর দু’টি অংশ রয়েছে, প্রথমাংশের রয়েছে তৌহিদের উল্লেখ এবং দ্বিতীয়াংশে নবুয়তের। সুতরাং চিন্তা করুন, নামে কলেমা-ই-তৌহিদ, আর এতে উল্লেখিত হয়েছে দুটি বিষয়ের। যেমন প্রথমাংশে রয়েছ তৌহিদের কাগজের উল্লেখ, আর দ্বিতীয়াংশে এর সরকারী মােহরের, ফলশ্রুতিতে তৌহিদে ঈমানী তৌহিদে নববীতে রূপান্তরিত হলাে।



কেবল তৌহিদই যদি মুক্তির জন্য যথেষ্ট হতাে, তাহলে উক্ত কলেমাই তায়্যৈবায় এ দ্বিতীয় অংশটা নিঃসন্দেহে অর্থহীন হতাে।



তৃতীয়তঃ মহান আল্লাহ কোরআন করীমে আমাদেরকে তৌহিদী জনতা বলেননি বরং আমাদের পুরুষদের মােমেনিন আর মহিলাদের মােমেনাত খেতাব দিয়েছেন। তৌহিদবাদী বলে কোথাও সম্বােধন করেনি। কেবল তৌহিদ যদি মুক্তির জন্য যথেষ্ট হতাে, তাহলে কোথাও না কোথাও এই খেতাবটা অবশ্যই দেখা যেতাে।



চতুর্থঃ মুসলিম ভিন্ন আরও অনেক জাতি রয়েছে, যারাও তৌহিদের দাবীদার যেমন, শিখ, আ’রীয়া, এবং কতেক খৃষ্টানও। কিন্তু এদের মুসলিম বলা যাবে না এবং তাদের জন্য মুক্তির কোন সম্ভাবনাও নেই। কেননা নবুয়তকে ইন্কার করেছে। তৌহিদকে নবুয়তের দর্পনে দেখুন, কা’বা মােয়াজ্জমার প্রতিকৃতিও সবুজ গুস্বদের চারদিকের ঝালির জানালা দিয়ে দেখুন, তখনই মুমিন হতে পারবে।



পঞ্চমতঃ হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) পর্যন্ত পৃথিবীতে অনেক আসমানী ধর্ম এসেছে, এবং ঐ সবকে পৃথক পৃথক ধর্ম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। তবে এজন্য নয় যে, ঐ সব ধর্মে তৌহিদ প্রশ্নে ভিন্ন ভিন্ন অভিমত ছিল। আবার এটাও নয় যে, ঐ সব ধর্ম সমূহে হাশর-নশর, বেহেস্ত দোযখ ইত্যাদির বিশ্বাস নিয়ে মতভেদ ছিল, এটাও নয় যে, সেসব ধর্ম সমূহে বেহেস্ত দোযখের ফিরিস্তা কিংবা তাকদীর সম্পর্কীয় মাসআলা স্বীকার করার মধ্যে মতান্তর ছিল। প্রত্যেক ধর্মই ঐ সব বিষয় সম্পর্কে একই বিশ্বাস পােষণ করতাে, তথাপি মতান্তর ছিল। কারণ, তাদের নবুয়ত ভিন্ন এবং নবী আলাইহিস সালাম পৃথক ছিলেন। মূছায়ী ধর্ম এক ধরণের ছিল এবং ইসায়ী ধর্ম ছিল অন্য ধরণের। এ জন্য যে, মূছায়ী ধর্মের নবী ছিলেন হযরত মূছা আলাইহিস সালাম। আর ইসায়ী ধর্মে ঈসা আলাইহিস সালাম। এতে বুঝা গেল যে, ধর্ম প্রবর্তিত হয় নবুয়ত দ্বারা। কেবল তৌহিদ ও দীনকে প্রভূ কখনাে পৃথিবীতে পাঠাননি।



ষষ্ঠতঃ যেহেতু কবরের মধ্যে মৃত ব্যক্তির কাছে তৌহিদ ও ধর্ম সম্পর্কে প্রশ্ন করার পর নবুয়ত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়



 ما كنت تقول في حق هذا الرجل



 (তুমি এই ব্যক্তিটি সম্পর্কে কি ধারণা পোষণ করতে?)।



যদি কেবল তৌহিদের বিশ্বাসই যথেষ্ট হতাে; তাহলে প্রথম উত্তরের ভিত্তিতে মৃত ব্যক্তিকে ক্ষমা করা হতাে।



উপরােক্ত দলিলাদি থেকে প্রমাণিত হলাে যে, মুক্তির নির্ভরতা কেবল তৌহিদের বিশ্বাসের উপর নয়, বরং ঈমানের উপর। আর ঈমানের ভিত্তি হচ্ছে নবুয়তের উপর। যে সব মৃত দেহ দাফন করা হয়নি, যেমন, বাঘে খেয়ে ফেলেছে কিংবা পানিতে ডুবে বা আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়েছে অথবা দীর্ঘ কাল ধরে লাশ পড়ে আছে, ঐ সব থেকেও ঐ সব প্রশ্ন এবং প্রশ্নের পর প্রতিকার প্রদান করা হবে।



কিন্তু এটা কেবল রূহ এর উপর, যা কেউ অনুভব করতে পারেন না। মাতৃগর্ভে ফিরিস্তা গমন করতঃ সবকিছু লিখে নেয়, কিন্তু মা’র খবর হয়না। উপরােক্ত দলিলাদি দ্বারা প্রমাণিত হলাে যে, মুক্তির নির্ভরতা কেবল তৌহিদের বিশ্বাসের উপর নয়, বরং ঈমানের উপর। আর ঈমানের ভিত্তি হচ্ছে নবুয়তের উপর।



সূক্ষ্ম তত্ত্বঃ এ আলােচনা প্রসঙ্গে যখন কবরে প্রশ্নোত্তরের কথা এসেছে, তাহলে একটি ঈমান উদ্দীপক ও তাৎপর্যপূর্ণ কথাও শুনে নিন, মুনকির-নকির ফেরেস্তা কবরে মৃতদেরকে তিনটি প্রশ্ন করেনঃ



১। তােমার প্রভূ কে? বান্দা বলেন, আল্লাহ।



২। তােমার ধর্ম কি? মুমিন বান্দা বলেন, ইসলাম।



৩। তুমি এই ব্যক্তিটি সম্পর্কে কি বল? মুমিন বান্দা বলেন, আল্লাহর প্রেরিত সত্য রসুল।



 কিন্তু প্রশ্নের নিয়মে পার্থক্য রয়েছে। তৌহিদ ও ধর্ম সম্পর্কে প্রশ্ন করার বেলায় এই শব্দটা নেই কিন্তু নবুয়ত সম্পর্কে প্রশ্ন করার বেলায় “এই” শব্দটা রয়েছে। অর্থাৎ যেমন প্রশ্ন করা হয়েছিল, তােমার প্রভূ কে? তােমার ধর্ম কি? কিন্তু তােমার নবী কে, বলা হয়নি। অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ যে, প্রশ্ন হচ্ছে তিনটি, আর নিয়ম দুইটি। পার্থক্যের কারণ হচ্ছে এই যে, মহান আল্লাহ আর ধর্ম মৃতকে দেখানাে হয়নি।তাই “এই” শব্দ দ্বারা ইংগিত করা হয়নি। আর হুযুর মুহাম্মদ মােস্তাফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর জামাল কে দেখায়ে বলা হয়-দেখ, ঐ মনােরম চেহেরাদারী, কালাে জুলফি বিশিষ্ট লােকটি কে? এবং জীবিত কালে কি বলতে তাঁকে তুমি? ভাই বলতে, না আকা, নিজের মতাে বলতে, না বে-মেছাল নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) বলতে? ..



দু’টি আপত্তি



আপত্তি নং ১ একই সময়, বিভিন্ন স্থানে সহস্রাধিক মৃত ব্যক্তি দাফন হয়। এবং একই সময় একই মুহূর্তে ঐ সহস্রাধিক স্থানে কবরে প্রশ্নোত্তর হয়ে থাকে। একটি জামাল (সৌন্দর্য) এতসব স্থানে একই সময় কিভাবে দেখানাে সম্ভবপর হয়?



উত্তরঃ একটি সূর্য একই সময় সহস্রাধিক স্থানে দেখা যেতে পারে। এবং সব জায়গায় ইংগিত করে বলা হয় যে, এটা সূর্য। এমনকি সহস্রাধিক স্থানে যদি লক্ষ আয়েনাকে একই সময় সূর্যের প্রতি ধরা যায়, তাহলে ঐ একটি সূর্য উক্ত সব আয়েনাতে স্বীয় তাপ, তীক্ষ্ণতা, ও উজ্জল্যতা প্রদান করে। এটা তাে আসমানী উদাহরণ । আজকের বিজ্ঞানী অবদান টেলিভিশন উক্ত মসআলাটা আরও সহজ কে দিয়েছে যে, একজন ব্যক্তি একই সময় প্রত্যেক জায়গায় দেখা যেতে পারে এবং এর আওয়াজ লক্ষ স্থানে শুনা যায়। আগুনের যখন এ শক্তি, তখন নূরের শক্তি সম্পর্কে কি আর আপত্তি করার আছে।



আপত্তি নং ২ আমরা মুসলমান, জীবনে কখনাে জামালে মােস্তাফা (সাল্লাল্লাহ আলাইহে ওয়া সাল্লাম) (নবীর মুবারক চেহারা) দর্শন ভালে সমর্থ হয়নি, কবরে হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)কে কিভাবে চিনতে পারব? পক্ষান্তরে, আবু জাহেল প্রমুখ মক্কার কাফিরেরা যারা সারাটা জীবন হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) কে দেখে ছিল, তারা কেন চিতে সক্ষম হবে না।



উত্তরঃ দুনিয়াবী সম্পর্কের বেলায় পরিচয়টা দেখাশুণায় হয়ে থাকে। কিন্তু আত্মিক ও ঈমানী সম্পর্কের বেলায় পরিচয় লাভ বাহ্যিক দর্শনের উপর নির্ভর নয়। জীবনে যাদের হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর সাথে ঈমানী সম্পর্ক বর্তমান রয়েছে; তাঁরা অবশ্যই চিনতে পারবেন, যদিওবা কখনাে দেখেননি, পক্ষান্তরে হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর সাথে যাদের সম্পর্ক বর্তমান নেই, তারা কখনাে তাকে চিনতে পারবে না, যদিওবা তারা মৃত্যু অবধি হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) কে দেখতে পেয়েছিল । কোন কোন ভাগ্যমান লােকেরা স্বপ্নে আর কোন কোন কামেল ব্যক্তি কাশফের মাধ্যমে হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর দর্শন লাভ করেন এবং দেখা মাত্রই চিনতে পেয়ে উৎসর্গীত হয়ে যান।



যাহােক এ মাসআলাটা একবারেই সুস্পষ্ট। তথাপি কতেক লােকের ধারণা হচ্ছে। যে,هذا(এই) শব্দটা স্মৃতিপটের প্রতি ইংগিত করাই উদ্দেশ্য, বাস্তব ইংগিত নয়। অর্থাৎ মৃতদেরকে জামালে মােস্তাফা দেখানাে হয় না বরং এদের জিজ্ঞাসা করা হয়; ঐ ব্যক্তিটা কে, যিনি তােমার স্মৃতি পটে আছে? কিন্তু এটা নিঃসন্দেহে ভুল ধারণা।



কারণঃ



প্রথমতঃ অন্তরেতাে ধর্মও বর্তমান ছিল, আল্লাহর তা'আলা সম্পর্কে মৃতব্যক্তি অবহিতও ছিল, তথাপি ঐ দুইয়ের বেলায় । শব্দটি দ্বারা কোন প্রতিস্মরণ মূলক ইংগিত করা হয়নি।



দ্বিতীয়তঃ কাফির হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে অজ্ঞ হয়ে থাকে। যদি কোন জামাল (সুন্দর আকৃতি) তার দৃষ্টির সামনে না হতাে, তাহলে সে প্রশ্ন করা মাত্রই বলতাে-কার সম্পর্কে জিজ্ঞাস করছেন? কিন্তু তারা এরূপ বলে না, বরং বলে, আমি তাকে চিনি না। বুঝা গেল যে, কোন সুন্দর আকৃতি তার সামনে রয়েছে, যা সে দেখছে কিন্তু চিনতে পারছে না।কতেক লােকদের ধারণা যে, ফেরেস্তারা মৃতদেরকে হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে। ওয়া সাল্লাম) এর ছবি দেখান কিন্তু এটা বাতিল। কারণ, ছবিটা না ব্যক্তি হয়, না নবী। ঐ ছবিকে ব্যক্তি বলা ভুল হবে আর নবী বলা কুফরী হবে। তদুপুরি সর্বত্র দেখানাে ছবিটা যদি একটিই হয় তাহলে আবার ঐ প্রশ্নটাই সৃষ্টি হবে যে, একটি ছবি, একই সময় লক্ষ স্থানে কিভাবে দেখা যায়। উপরন্তু যদি ছবি একাধিক হয়, তাও হবে ভুল। কেননা প্রশ্ন কর্তা ফেরেস্তা হলেন ওনারাই।যা হােক, এ কথা নিশ্চিত যে, মুক্তির নির্ভরতা তৌহিদের উপর নয় বরং ঈমানের উপর আর ঈমানের ভিত্তি হচ্ছে নবুয়তের উপর।


আল্লাহ সবাই কে বুঝতে সাহায্য কর। আমীন।

_________________

কিতাবঃ ইসলামের মৌলিক চারটি বিষয়।

মূলঃ হাকিমুল উম্মাহ মুফতি ইয়ার খান নঈমী (রহঃ)

 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন