আজান ইবাদত সমতুল্য, ইবাদতের পূর্বে সতর্ক
স্বরূপ দরূদ পাঠ করা জায়েয ও বৈধ
এখন আমি মূল বক্তব্যের দিকে ফিরে যাচ্ছি। জেনে রাখা ভাল যে, আজানের আগে দরূদ শরীফ পাঠ করা কোন প্রকার দোষনীয় নয় এবং তাতে আজানের বাক্যগুলোতে কোন প্রকার পরিবর্তন ঘটে না। হ্যাঁ, যদি আজানের বাক্যগুলো বর্জন করে শুধু দরূদ শরীফকে আজান বলে অভিহিত করা হয় তাহলে তা জায়েয হবে না। কারণ আজানের বাক্যগুলো শরীয়তে নির্ধারিত হয়েছে। আজানের সময় দরূদ শরীফ পাঠ করলে বেশ কয়েকটি উপকার হয়ে থাকে। লোকেরা যখন ঐ সময় দরূদ শরীফ শুনে তখন তাড়াতাড়ি আজান শোনার জন্য ওদিকে মনোনিবেশ করে এবং ভালভাবে আজান শুনার জন্য তৈরী হয়ে যায়, আর নামাজের দিকে ধাবিত হয়। অথবা এটাও বলা চলে যে, আজানটা নামাজের ঘোষণা বা আহ্বান অথবা ইবাদত সমতুল্য। সুতরাং ইবাদতের পূর্বে সতর্ক করে দেয়া জায়েয ও বৈধ।
❏ যেমন প্রসিদ্ধ একটি উক্তি আছেঃ
التنبيه للعبادة مشروع
অর্থাৎ- ইবাদতের জন্য হুঁশিয়ার করে দেয়া শরীয়ত সম্মত।
সুতরাং ঐ সময়ে দরূদ শরীফের মাধ্যমে আজান শুনার জন্য সতর্কতা জ্ঞাপন করা হল। এটাও বলা যায় যে, ঐ সময় দরূদ শরীফ মুয়াজ্জিনদের তছবীহতে পরিগণিত, কারণ এভাবে তছবীহ পাঠ করা মুয়াজ্জিনদের জন্য ইসলামী আইনশাস্ত্রবীদদের (ফোকাহা) নিকট বৈধ।
অতএব, আজানের পূর্বে দরূদ শরীফ পাঠ করা শরীয়তের কোন খেলাফ বা উল্টো হয়নি।
বর্তমান যুগে মানুষের মধ্যে অলসতা খুবই বেড়ে গেছে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে; যখন আজানের পূর্বে দরূদ শরীফ পড়া হয় তখন লোকেরা বলে উঠেন যে, এখন নামাজের আজান হবে। যেন ঐ সময়ে দরূদের শব্দ শুনে নামাজের প্রতি ভক্তি ও ভালবাসা বেড়ে গেল, মনের অলসতা দূর হয়ে গেল, অন্তরের কালিমা মুছে গেল, এমনভাবে পরিলক্ষিত হয়। একথা কখনো বলা চলে না যে, মনের অলসতা দূর করণার্থে দরূদ শরীফ ব্যবহার করা হয়। আর তা জায়েযও নয়। বরং অন্তরের ময়লা, কলুষ, অলসতাও বিদূরিত করা যায়। যাতে লোকেরা অপর কোন কাজে ব্যস্ত থাকলে তা ত্যাগ করতঃ তাদের ধ্যান-ধারণা আজানের প্রতি দিতে পারেন এবং মনোযোগ সহকারে আজান শুনে নামাজের দিকে মনোনিবেশ করতে পারেন।
এ কথাটি অবশ্যই জেনে রাখা প্রয়োজন যে, আমরা আজানের পূর্বে দরূদ শরীফ পড়াকে অপরিহার্য বলি না। অথচ আমাদের দাবী হল ঐ সময়ে কোন মুয়াজ্জিন যদি দরূদ শরীফ পড়েন তা হলে কোন অপরাধ হবে না। বরং শরীয়তের কোন নিষেধাজ্ঞা না থাকার কারণে সেটা হবে মুস্তাহাব, আর যদি কেউ তা না পড়েন তাতেও দোষ হবে না; পড়ার জন্য বাধ্য করা যাবে না; আবার পাঠকারীকে বাধাও দেয়া যাবে না। যার মনে চায় পড়বে, যার ইচ্ছা হয় পড়বে না। তবে হ্যাঁ, যিনি পড়বেন তাঁকে অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে, দরূদ শরীফ পাঠ করে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। যাতে আজানের বাক্যের সাথে সংযুক্ত হয়ে না যায়।
এখন সাব্যস্ত হলো যে, আজানের আগে দরূদ শরীফ পড়া দোষণীয় বেদা’ত হতে পারে না। কারণ বেদা’তে মজমুমা বা দোষণীয় বেদা’ত হতে পারে না। কেননা, বেদা’তে মজমুমা বা দোষণীয় বেদা’ত বলে ঐ সব নব আবিষ্কৃত কর্মকে যা সুন্নতে মুতাওয়ারেছা বা রাসূলে পাক (ﷺ) হতে প্রাপ্ত সুন্নাতকে বিকৃত করে ফেলে অথবা সুন্নাতের পরিপন্থী হয়। তবে আজানের বাক্যসমূহ বর্জন করে যদি দরূদ শরীফ কিংবা অপর কোন বাক্য ব্যবহার করে তাহলে তা অবশ্যই দোষণীয় বেদা’ত হবে। কেননা আজানের কলেমাগুলো হুজুর পাক (ﷺ) হতে প্রাপ্ত সুন্নাত দ্বারা প্রমাণিত আছে।
❏ হযরত ছৈয়দ আহমদ বিন জাইনী দাহলান (رحمة الله) আপন কিতাব ‘রিছালাতুন নছর’ এর ১৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন:
لايجوز ان يجعل بدل الاذان الصلواة والسلام على النبى صلّى الله عليه وسلّم المنائر لان الشارع جعل للاذان الفاظا مخصوصة لايجوز ابدالها بغيرها .
অর্থাৎ- মিনারায় চড়ে আজানের পরিবর্তে রাসূলে পাক (ﷺ)-এর উপর ছালাত-ছালাম (দরূদ শরীফ) পাঠ করা জায়েয নাই। কেননা শরীয়ত প্রণেতা ও শরীয়তের নির্দেশদাতা নবী মুহাম্মদ মুস্তফা (ﷺ) আজানের বিশেষ কতগুলো শব্দ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। সুতরাং ঐ নির্বাচিত শব্দগুলোর পরিবর্তন সাধন করা জায়েয নাই।
এখন বুঝা গেল আজানের বাক্যসমূহ পরিত্যাগ করা অথবা কোন বাক্যকে অন্য বাক্য দ্বারা বদলে দেয়া ঐগুলো সব নিকৃষ্ট বেদা’ত। কারণ এখানে সুন্নাতকে বিকৃত করা হল, যে কাজটা সুন্নাতকে উল্টিয়ে দেবে সেটা হবে বেদা’তে ছাইয়েআ বা মন্দ বেদা’ত। আর যে কাজটা সুন্নাতের সহায়ক হবে সেটাও সুন্নাতের অন্তর্ভূক্ত।
عمل فى السنة বা সুন্নাতের মধ্যে অনাধিকার চর্চা করা জায়েয নাই। আর عمل للسنة বা সুন্নাতকে উজ্জ্বল ও দৃঢ় করার নিমিত্ত কোন কর্ম করা জায়েয আছে।
আল্লামা ইবনে জাইনী দাহলানের উপরোক্ত উক্তিটি হতে এটাও প্রতীয়মান হল যে, আজানের কলেমাগুলো ঠিক রেখে তার আগে ও পরে রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর উপর দরূদ শরীফ পাঠ করা জায়েজ ও উত্তম।
কেউ যদি একথা বলে থাকে যে, শুধুমাত্র কুরআন ও হাদীস শরীফ দ্বারা যা কিছু প্রমাণিত হবে শুধুমাত্র তাই পালন করব, অন্য কিছু মানব না। আসলে এ সমস্ত কথা নিছক বোকামী, পথভ্রষ্টতা আর ইজমায়ে উম্মতের পরিপন্থী বৈ আর কিছু নয়। কেননা সাহাবায়ে কেরাম হতে আরম্ভ করে আজ পর্যন্ত সমস্ত উম্মতে মুহাম্মদীয়ার সম্মিলিত ঐক্যমত এই যে, যা কিছু আদিল্লায়ে আরবা (ইসলামের প্রামাণ্য চতুঃশাস্ত্র কুরআন, হাদীস, ইজমা, কিয়াছ) দ্বারা প্রমাণিত আছে ঐসবগুলোই শরীয়তের হুকুম। অনেক মাছআলা আছে কুরআন শরীফে তার হুবহু কোন প্রমাণ নাই। অথচ তা হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত আছে। এভাবে যা হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত হয় না তা আবার ইজমা দ্বারা প্রমাণিত আছে। অনুরূপ ইজমাতে প্রমাণ পাওয়া না গেলে কেয়াছেই তার সমাধান পাওয়া যায়।
দুঃখের বিষয় এ যুগে এমন এক দল সৃষ্টি হয়েছে যারা নিজের খাহেশাত বা কুমনোবৃত্তি আর বিজ্ঞানের পিছনে পড়ে ইজমা ও কেয়াছের বিরুদ্ধে চিৎকার শুরু করে দেয়। অপ্রত্যাশিতভাবে আলোচনা দীর্ঘায়িত হয়ে গেল। এখন আগের কথায় আসা যাক। আমাদের দাবী হল আজানের পূর্বে দরূদ শরীফ পাঠ করা বৈধ।
صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
কুরআনে পাকের আদেশসূচক উক্ত আয়াতটি গভীরভাবে বিশেষণ করলে একথা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, আয়াতে প্রদত্ত নির্দেশটি হল অনির্দিষ্ট (মুতলাক)। তবে একথা সত্যি যে, শরীয়তের কোন নিষেধাজ্ঞা বা বাধা থাকলে সেক্ষেত্রে দরূদ শরীফ পাঠ করা জায়েয নাই। সব কথার সারাংশ এই দাঁড়াল যে, যাদের অন্তরসমূহে ঐ মধুমাখা পবিত্র নামের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে, ঐ নামের প্রতি অগাধ ভক্তি অতীব আন্তরিকভাবে হয়ে গেছে; তাঁরা অবশ্যই সম্ভাব্য সবসময়ে দরূদ শরীফের জপনা করে থাকেন। আর যারা আজল বা আত্মক জগত হতেই ঐ অমূল্যরত্ন লাভ করা থেকে বঞ্চিত রয়েছে; তারা বেদা’ত বা শির্কের ফত্ওয়া না দিয়ে আর করবে কি?
_________________
কিতাবঃ আযানের আগে দরূদ পড়া জায়েয
রচনায়ঃ মুহাম্মদ আজিজুল হক আল-কাদেরী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি)
অনুবাদঃ গোলাম মোহাম্মদ খান সিরাজী
🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন