সৎ নিয়্যতের উপরই কর্তার ফলাফল নির্ধারণ

 

সৎ নিয়্যতের উপরই কর্তার ফলাফল নির্ধারণ


ফতোয়া শামীতে উল্লেখ করা হয়-

فاِنّ النية تصير العادات عبادات والمباحات طاعات .

অর্থাৎ- সৎ নিয়ত দ্বারা স্বভাবজনিত প্রচলিত কার্যাদি ও ‘মোবাহ’ কাজকে এবাদতে পরিণত করে; (যতক্ষণ না শরীয়ত মতে তা নিষিদ্ধ বলে প্রমাণিত হয়।) এটা অনস্বীকার্য যে, এ যুগের লোকেরা ক্রমশঃ ‘যিকির’ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় তাদেরকে আল্লাহ্ তায়ালার ‘যিকির’ বা স্মরণ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা কি তাদের পরিশুদ্ধিমূলক পদক্ষেপ হবে? কখনো না। কারণ মুসলমানগণ উক্ত কাজটা ছওয়াবের নিয়তেই করে থাকে। নিয়ত অনুসারে কর্মফল পাওয়া যায়। ‘ফতোয়া খাইরিয়্যাহ’- ২য় খণ্ডের ১৮০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়-



ان الامور بمقاصدها والشئ الواحد ليتّصف بالحل والحرمة باعتبار ماقصد له وهى ماخوذة من الحديث الذى . (رواه الشيخان)



অর্থাৎ- সমস্ত কাজের ফলাফল কর্তার নিয়ত অনুসারেই পাওয়া যায়। কোন কাজে নিয়ত বা উদ্দেশ্য যদি ভাল হয়, তবে সে কর্মও পূণ্যময় হয়। আর তার পরিণামও ভাল হয়। পক্ষান্তরে, উদ্দেশ্য (নিয়ত) যদি খারাপ হয়, তবে তার পরিণামও খারাপ হওয়া যুক্তিযুক্ত। এতে বুঝা যায় যে, একই কাজ কর্তার উদ্দেশ্যের (নিয়ত) ভিত্তিতে ‘হালাল’ এবং ‘হারাম’ উভয় নামেই অভিহিত হতে পারে। এ বর্ণনাটি ইমাম বোখারী ও মুসলিম (رحمة الله) এরই বর্ণনা থেকে গৃহীত। তাছাড়া আলোচ্য ‘যিকির’ দ্বারা মৃত ব্যক্তির রূহে শান্তি এবং আনন্দের সঞ্চার হয়।



বিশেষত, সর্বোৎকৃষ্ট ‘যিকির’ ‘‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্” অনুরূপভাবে অন্যান্য ‘যিকির’; যদ্বারা মৃত ব্যক্তির ‘তালক্বীন’ বা শিক্ষা প্রদানের কাজ হাসিল হয়। আল্লাহর ‘যিকির’ হিসেবে তো তা আদায় হয়ই।



যেমন- الله ربى محمد نبى صلّى الله عليه وسلّم (আল্লাহু রাব্বী, মুহাম্মদ নবী (ﷺ)) যা আমাদের দেশে (ওরফরূপে) সাধারণভাবে প্রচলিত যিকিরেরই শামিল। সুতরাং এমন এক পূণ্যময় কর্ম থেকে মুসলমানদেরকে বিরত রাখা একগুঁয়েমী ও অন্যায়ের পক্ষপাতীত্ব ছাড়া আর কি হতে পারে? কাজেই আলেম সম্প্রদায়ের উচিৎ, যেন তাঁরা এ ধরণের ‘যিকিরে’ বাধা না দিয়ে যুগের মুসলমানদের অবস্থার প্রতি দৃষ্টি রেখেই এ যিকিরের প্রতি উৎসাহ প্রদান করেন। কারণ জনসাধারণকে আল্লাহ্ ও তাঁর রসূল (ﷺ) এর যিকির থেকে বিরত রাখা মুসলমানদের আত্মার পরিশুদ্ধি হবে না; বরং পথভ্রষ্ট করারই নামান্তর হবে।



‘ফতোয়া খাইরিয়্যাহ’তে বর্ণনা করা হয়-



من حرمّ الحلال فقد وقع فى الضلال .



অর্থাৎ- যে ব্যক্তি হালালকে হারাম জ্ঞান করে, সে নিশ্চয় পথভ্রষ্টতার দিকে ধাবিত হর।



উপরোলে­খিত কিতাবের ২য় খণ্ডের ১৮১ পৃষ্ঠায় বর্ণিত হয়-



قال بعض اهل العلم انه افضل حيث خلا ممّا ذكر لانه اكثر عملا ولتعدّى فائدته الى السامعين ويوقظ قلب الذّاكر فيجمع همّه الى الفكر ويصرف سمعه اليه ويزيد النشاط .



অর্থাৎ- কোন কোন ইমাম অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, নীরবে যিকির করা অপেক্ষা উচ্চরবে যিকির করা উত্তম। কেননা তাতে কর্মের আধিক্য রয়েছে। তাছাড়া এতে শ্রোতাগণও উপকৃত হয়; তা যিকিরকারীর অন্তরকে জাগ্রত করে; অতঃপর তার ধ্যান-ধারণা সুচিন্তার দিকে ধাবিত হয়; শ্রোতারা যিকিরকারীর দিকে কর্ণপাত করে এবং এতে তার আনন্দ ও উৎসাহ বাড়তে থাকে।



জেনে রাখা দরকার যে উক্ত সময়টা হল ‘যিকির’ ও ভাবনা-চিন্তার।



ইমাম নববী (رحمة الله) উল্লেখ করেছেন-



فان هذا وقت ذكر وفكر يقبح فيه الغفلة والهو والاشتغال بالحديث الفارغ ان الكلام بما لا فائدة فيه منهى عنه فى جميع الاحوال فكيف فى هذا الحال .



অর্থাৎ- নিশ্চয়ই এ সময়টা (জানাজার) হল ‘যিকির’ ও ভাবনা-চিন্তার। এ মুহূর্তে অন্য মনষ্ক হয়ে বা অনর্থক কর্মে কিংবা বাজে কথাবার্তায় রত থাকা মোটেই উচিৎ নয়। কেননা, যেহেতু অনর্থক কথা-বার্তা অন্য যে কোন সময়ে নিষিদ্ধ, সেহেতু এ সময়টুকুতে কি করে উচিৎ বা জায়েজ হতে পারে?



কাজেই ধ্যান ধারণাকে সুচিন্তার দিকে ধাবিত করা, অলসতা বর্জন করা, বাজে কথা-বার্তা থেকে বিরত রাখা এবং ‘যিকির’ এর প্রতি উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যেই বর্তমানে ওলামায়ে কেরাম ‘জানাজা’ নিয়ে পথচলার সময় উচ্চরবে যিকির করা জায়েজ তথা মোস্তাহাব বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন।



দুঃখের বিষয়, অনেক স্থানে বহু উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গকেও বাজে কথাবার্তায় মগ্ন হতে দেখা যায়। এখানে জেনে রাখা দরকার যে, কোন কাজ হুজুর (ﷺ) এর যুগে কৃত হয়নি বলে তা পরবর্তী যুগে মোস্তাহাব হতে পারে না- এমন নয়; যদি তা কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী না হয়।



যেমন- ‘বেক্বায়া’ নামক কিতাবে উল্লেখ করা হয়- والقصدمع اللفظة اولى অর্থাৎ অন্তরস্থ নিয়তের সাথে শাব্দিক সমন্বয় সাধন উত্তম।



‘মুনিয়াতুল মুছাল্লী’তে নিয়তের সাথে সাথে শাব্দিক উচ্চারণ মোস্তাহাব বলে অভিহিত করা হয়। (غررالاحكام) গুরারুল আহকাম নামক কিতাবে উল্লেখ করা হয়- التلفظ مستحب অর্থাৎ- মৌখিকভাবে নিয়তকে ব্যক্ত করা মোস্তাহাব। এ কথাও সুস্পষ্ট যে, ‘কুরুনে ছালাছাহ’ (হুজুর (ﷺ), ছাহাবা ও তাবেয়ী (رضي الله عنه) এর যুগসমূহ) তে যা ছিলনা, তা পরবর্তী কালে না জায়েজ বা অবৈধ হতে পারে না, যদি না তা হেদায়তসম্মত পন্থার পরিপন্থী হয়। কারণ মূলতঃ যুগ কখনো শরীয়তের বিধি-বিধানের উৎস নয়; শরীয়তের বিধি-নিষেধের উৎস হল কোরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াস। উল্লেখ্য যে, কোন কিছু তখনই মন্দ বা বর্জনীয় হয় যখন তা সর্বস্বীকৃত সুন্নাহর পরিপন্থী হয়। যেমন- ‘মিরকাত’ শরহে মিশকাত’ এ উল্লেখ করা হয়-



انّ احداث مالا ينازع الكتاب والسنّة ليس بمذموم .



অর্থাৎ- যে সব নব প্রচলিত কাজ কিতাব ও সুন্নাহর পরিপন্থী নয় তা অবশ্যই মন্দ বা বর্জনীয় নয়।



তবে ইসলামের প্রাথমিক ‘তিন যুগ’ এর প্রাধান্য সম্পর্কে হাদীস শরীফে যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে তা তৎকালীন মুসলমানদের ঈমান-আকিদা ও বরকতের ভিত্তিতেই; আইন প্রণয়নকারী হিসেবে নয়। কারণ মূলতঃ ‘যুগ’ শরীয়তের বিধান সমূহের উৎস নয়; দ্বীনি বিধি নিষেধের ভিত্তি হল কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াছ। অবশ্য কেউ কেউ ‘ওরফ’ ও শরিয়তের বিধানে মৌলিকত্বের দাবীদার বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন।



এসব উদ্ধৃতিসমূহে একথা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ‘জানাজার’ সাথে পথ চলার সময় উচ্চরবে যিকির করা নিঃসন্দেহে জায়েজ বা বৈধ বরং     মোস্তাহাব। সুতরাং তাতে কাকেও বাধা দেয়া কিংবা বারণ করা মোটেই উচিৎ হবে না। বরং তাতে উৎসাহিত করাই শ্রেয়।

_____________

আল্-ক্বাওলুল হক্ব

(জানাজায় উচ্চরবে যিকির জায়েয প্রসঙ্গে)

রচনায়ঃ মুহাম্মদ আজিজুল হক আল-কাদেরী (رحمة الله)

অনুবাদঃ মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মন্নান (এম.এম.এম.এফ)

 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন