পরিস্থিতিভেদে প্রশংসাযোগ্যতা ও শ্রেষ্ঠতাসম্পন্ন তৃতীয় ধরনের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে অজস্র ধনসম্পদের মালিকানা।
সাধারণতঃ কারো প্রচুর ধনসম্পদ থাকলে মানুষেরা তাঁকে শ্রদ্ধা করেন। কেননা তাঁরা বিশ্বাস করেন ওই ব্যক্তি তা দিয়ে নিজ চাহিদানুযায়ী সব কিছুই পেতে সক্ষম এবং তাঁর পক্ষে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করাও সম্ভব। তবে এই সম্পদ নিজ হতে কোনো বৈশিষ্ট্য নয়। কেউ এর মালিক হলে তাঁর নিজের প্রয়োজন মেটানোর জন্যে এবং তাঁর কাছে আগমনকারী মানুষের চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে তিনি তা যথাযথভাবে খরচ করলে ওই ধনসম্পদ তাঁর জন্যে বয়ে আনে মহত্ত্ব, প্রশংসা, শ্রেষ্ঠতা এবং মানুষের অন্তরে উচ্চাসন। এমতাবস্থায় পৃথিবীবাসীর চোখে ওই ধনসম্পদ তাঁরই একটি গুণ হয়ে দাঁড়ায়।
সম্পদের মালিক যদি ধর্ম ও পুণ্যের উদ্দেশ্যে, আল্লাহ (ﷻ) ও আখেরাতের নিয়্যতে তা দান-সদকাহ’তে ব্যয় করেন, তাহলে প্রত্যেকের দৃষ্টিতে প্রতিটি ক্ষেত্রেই তা এক গুণ হিসেবে দেখা হয়।
আর যদি সম্পদের মালিক কৃপণ হয় এবং এর যথাযথ ব্যবহার না করে, আর যদি সে সম্পদের পাহাড় গড়তে তৎপর হয়, তাহলে ওই সম্পদ প্রচুর পরিমাণে হলেও মনে হবে যেন সেটার কোনো অস্তিত্ব-ই নেই। সেটা তখন তার মালিকের জন্যে একটি খুঁত হয়ে দেখা দেয়। এতে সম্পদের মালিক নিরাপদ স্থানে যেতে পারে না, বরঞ্চ কৃপণতা ও নীচতাপূর্ণ ত্রুটির গহ্বরে পতিত হয়।
ধনসম্পদ গুণ হিসেবে বিবেচিত হলে সে সম্পদ ও তার গুণের প্রশংসা খোদ সম্পদের কারণে হয় না। কারো সাথে এর সংশ্লিষ্টতা ও যথাযথ ব্যবহারের কারণেই এটার মর্যাদা উন্নীত হয়। সম্পদ মওজূদকারী যদি যথাযথভাবে তার সদ্ব্যবহার না করে, তাহলে সে প্রকৃতপ্রস্তাবে সম্পদশালী নয়, আর ধনাঢ্য শব্দটির খাঁটি অর্থেও সে তা নয়। জ্ঞানী-গুণীজনের কেউই তাকে প্রশংসা করেন না। সে সবসময়-ই গরিব থাকে এবং সে তার লক্ষ্য অর্জনেও ব্যর্থ হয়। কেননা, সে তার লক্ষ্য বাস্তবায়নে সক্ষম হওয়ার মতো সম্পদের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও ওই সম্পদের ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সে অনেকটা অন্য কারো সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির মতোই, যার নিজস্ব কোনো সম্পত্তি-ই নেই। সে যেন কোনো কিছুর মালিক-ই নয়।
যে সম্পদের মালিক (যথাযথ পন্থায়) তা ব্যয় করেন, তিনি প্রকৃত-ই ধনী ও সম্পদশালী। তিনি অর্থকড়ির বিভিন্ন সুফল অর্জন করতে পেরেছেন, যদিও ওই সম্পদের কোনো কিছু তাঁর মালিকানায় আর অবশিষ্ট না থাকে।
ধনসম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের মহানবী (ﷺ)-এর জীবনী ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পরীক্ষা করুন। আপনারা দেখতে পাবেন তাঁকে বিশ্বজগতের ধনভাণ্ডার ও রাজ্যসমূহের চাবি দেয়া হয়েছিল। গনীমতের মাল যা তাঁর পূর্ববর্তী কোনো নবী-রাসূল (عليه السلام)-এর জন্যে হালাল তথা বৈধ ছিল না, তা তাঁর জন্যে জায়েয তথা অনুমতিপ্রাপ্ত হয়েছিল। তাঁর যাহেরী তথা প্রকাশ্য জীবদ্দশায় তিনি হেজায (মক্কা মোয়াযযমা ও মদীনা মোনাওয়ারা), ইয়েমেন ও সমগ্র জাযিরাতুল আরব তথা আরব উপদ্বীপ এবং এর পাশাপাশি সিরিয়া ও ইরাকের সীমান্তসংলগ্ন বিভিন্ন অঞ্চল জয় করেন। গনীমতের মালামালের এক-পঞ্চমাংশ ছাড়াও তাঁর খেদমতে পেশ করা হয় জিযিয়া কর ও যাকাত, যার যৎসামান্য অংশ-ই কেবল তাঁর পূর্ববর্তী রাজা-বাদশাহবর্গ পেতে সক্ষম হয়েছিলেন। বেশ কয়েকজন বিদেশী শাসক তাঁর খেদমতে উপহার সামগ্রী পাঠিয়েছিলেন। তিনি এসবের কিছুই নিজের জন্যে রাখেন নি, কোনো দিরহাম-ও জমা করেননি। যথাযথ পন্থায় তিনি এগুলো ব্যয় করেছেন, অন্যান্যদেরকে এসব দ্বারা ধনাঢ্য করেছেন, আর মুসলমানদেরকে এগুলোর সাহায্যে শক্তিশালী করেছেন।
❏ মহানবী (ﷺ) ইরশাদ ফরমান, “রাতে আমার কাছে কোনো সোনার দিনার অবশিষ্ট থাকলে আমি স্বস্তি পাই না, ব্যতিক্রম শুধু ওই দিনারটা, যেটা আমি ঋণ পরিশোধের জন্যে আলাদা করে রেখেছি।” [মুসলিম ও আল-বুখারী]
কখনো তাঁকে দিনারসমূহ দেয়া হলে তিনি তা ভাগ করে দিতেন; হয়তো ছয়টি দিনার অবশিষ্ট থেকে যেতো। এমতাবস্থায় তিনি সেগুলো তাঁর কয়েকজন স্ত্রীর মাঝে বণ্টন করতেন। তিনি ঘুমোতে যেতেন না, যতোক্ষণ না এই বিলি-বণ্টন শেষ হতো। অতঃপর তিনি বলতেন, “এখন আমি বিশ্রাম নিতে পারবো।” তাঁর বেসালপ্রাপ্তির সময় আপন পরিবারের খোরাকির জন্যে নিজের বর্মটি পর্যন্ত তিনি বন্ধক রেখেছিলেন।
তাঁর জীবনধারণ, জামাকাপড় ও বসতঘর বাবদ তিনি প্রয়োজন মোতাবেক খরচ করতে রাজি ছিলেন এবং এর বাইরে ব্যয় করা হতে নিবৃত্ত ছিলেন। তিনি তা-ই পরতেন যা কিছু তাঁর কাছে লভ্য ছিল। সাধারণতঃ তিনি একটি চাদর, একটি মোটা কাপড় কিংবা একখানি মোটা বহিরাবরণ-বস্ত্র (জুব্বা) পরিধান করতেন। এসব বুটিদার ও সোনা দিয়ে কারুকাজ করা জুব্বা তিনি তাঁর সামনে উপস্থিত মানুষজনের মাঝে বণ্টন করতেন, অথবা অনুপস্থিতদের কাছে প্রেরণ করতেন। এটা এ কারণে যে আল্লাহ-ওয়ালাদের দৃষ্টিতে জামাকাপড় ও সাজসজ্জার অহঙ্কার মহত্ত্ব ও সম্মানজ্ঞাপক কোনো গুণ নয়। এটা মহিলাদের একটা বৈশিষ্ট্য।
যেসব জামাকাপড় সবচেয়ে প্রশংসিত, সেগুলো পরিষ্কার ও মধ্যম মানের হয়ে থাকে। এ ধরনের বস্ত্র পরিধান করলে পৌরুষ হতে চিত্তবিক্ষেপ হয় না, আর অন্যান্য মানুষের চোখেও (নিজেকে) বড় করে দেখানো হয় না। শরীয়ত এই বড় করে দেখানোকে নিষেধ করেছে। মানুষ প্রায়শঃ যা দ্বারা গর্ব করে থাকে, তা হচ্ছে অধিক কাপড়চোপড় ও ধনসম্পদ।
একই কথা প্রযোজ্য জাঁকালো বসতভিটা, প্রশস্ত বাড়ি কিংবা অনেক মালামাল, সেবক ও জন্তু-জানোয়ারের বেলায়ও। কারো জমি-জিরাত থাকলে এবং তা কর্ষণ করে কৃচ্ছ্বব্রত ও অনাসক্তির কারণে তার ফসল দান করলে তিনি ওই সম্পত্তির মালিকানাসম্পর্কিত গুণ অর্জন করেন এবং এই গুণ সম্পর্কে গর্ব করার অধিকারও সংরক্ষণ করেন – যদি এই গর্ব করাকে কখনো কোনো সময় গুণ বলে সম্বোধন করা যায়। ধনসম্পদ থেকে (এভাবে) মুখ ফিরিয়ে নেয়াটার উচ্চসিত প্রশংসা করা হয়েছে, আর এর অনুপস্থিতিতে অল্পে তুষ্ট থাকার এবং ধনসম্পদের যথাযথ ব্যবহারেরও (যেমন দান-সদকাহ করারও) ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে।
________________
কিতাবঃ আশ শিফা [অসম্পূর্ণ]
মূল: ইমাম কাজী আয়াজ (رحمة الله)
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
সূত্রঃ 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন