আবু তালেবের মৃত্যুর পর হুজুর (ﷺ) হযরত আলীকে তাকে গোসল ও দাফন করার নির্দেশ


❏ আবু দাউদ ও নাছায়ী ইত্যাদি হাদীসের কিতাবে উল্লেখ আছে:

عن على رضى الله عنه انه قال لما مات ابو طالب اخبرت النبى صلى الله عليه وسلّم بموته فبكى وقال اذهب فغسله وكفنه .... غفرالله له ورحمه .

অর্থাৎ- হযরত আলী (رضي الله عنه) হইতে বর্ণিত হাদীসে তিনি বলিয়াছেন, আবু তালেব যখন মৃত্যুবরণ করিয়াছেন তখন আমি নবীর (ﷺ) খেদমতে তাঁহার মৃত্যুর সংবাদ দিলাম। অতঃপর তিনি (নবী) ক্রন্দন করিলেন এবং বলিলেন (আলী!) তুমি যাইয়া তাঁহাকে গোসল দিয়া দাফন করিয়া আস। আল্লাহ্ তাঁহাকে ক্ষমা এবং দয়া করুক।

হুজুর করীম (ﷺ) আবু তালেবের মৃত্যুর উপর মাতম করিয়াছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ইহাও ফরমাইয়াছেন, আল্লাহপাক তাঁহাকে ক্ষমা এবং রহম করুক।

যদি কেহ বলে, হুজুর (ﷺ) তাঁহার চাচার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা ইহা সদ্ব্যবহার ও পারিতোষিক হিসেবে ছিল। অতঃপর ইহার উত্তর এই হইবে যে, ক্ষমা করা বা না করা পারিতোষিকতার সহিত ইহার কোন সম্পর্ক নাই। কেননা, ক্ষমার পরিধি শুধু ঈমানের উপরই রহিয়াছে। যদি কোন ছেলে তাহার বেঈমান বাপের উপর যতই মাতম, শোকপ্রকাশ, দুঃখপ্রকাশ ও সদ্ব্যবহার এবং দোয়া করে উহা দ্বারা কি হইবে? অর্থাৎ তাহার ক্ষমা হইতে পারে?

সূরা মোমতাহিনার আয়াত হইতে স্পষ্ট প্রমাণ হিসেবে প্রকাশ হইতেছে যে, মুশরিকের জন্য ক্ষমা চাওয়া উচিত নয় এবং সূরা তাওবার আয়াতে এই নস (প্রকাশমান) স্পষ্ট বর্ণনা হইয়াছে যে, মুশরিকদের জন্য ক্ষমার দোয়া করা উচিত নয়, সেই মুশরিক যতই আত্মীয় ও ব্লাড সম্পর্কীয় হোক না কেন। মুশরিকদের ক্ষমা না হওয়া যখন নিশ্চিতরূপে ছাবেত হইয়া গেল, তখন নবীগণ (আলাইহিমুস সালাম) ও সমস্ত মুসলমানদের পক্ষে উচিত নয় যে, জীবিত হোক অথবা মৃত হোক সেই মুশরিকের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কেননা, এই রকম করার মধ্যে খোদা যে মুশরিকদের মুক্তি না দেওয়ার উপর ওয়াদা করিয়াছেন এবং যাহা সম্পূর্ণ নিশ্চিত, উহার উপর সন্দেহ আসিয়া যায়। হ্যাঁ, তবে মুশরিকদের জন্য ভাল দোয়া করা যাহাতে ঈমান নিয়া আসে, যাহা তাহাদের সহিত আসল মুহাব্বত এবং দয়া তাহা করার মধ্যে কোন বাধা নাই।

❏ মিশকাত শরীফের শরাহ মিরকাত ৭ম খণ্ডের ৫৩৪ পৃষ্ঠায় হাকীমুল উম্মত হযরত মুফতি আহমদ এয়ার খান নঈমী (رحمة الله) বলিয়াছেন যে, আবু তালেবের ঈমান সম্পর্কে ওলামায়ে আহলে সুন্নাতের মধ্যে মতভেদ রহিয়াছে। আল্লামা সৈয়দ আহমদ জিনী দহলান (رحمة الله) ‘আছনাল মাতালেব ফী ঈমানে আবী তালেব’ নামক একটি কিতাব লিখিয়াছেন এবং উক্ত কিতাবে তাঁহার (আবু তালেবের) ঈমান ছাবেত করিয়াছেন।

❏ তাফসীরে রূহুল বয়ানের তাফসীরকার আল্লামা ইসমাঈল হক্কী হানাফী (رحمة الله) বলিয়াছেন যে, তিনি (আবু তালেব) আইনানুযায়ী মুমিন ছিলেন না। যেহেতু তিনি প্রকাশ্যভাবে কলমা পড়েন নাই। কিন্তু খোদার সান্নিধ্যে মুমিন ছিলেন। সেই মহামনীষীদের মতে আবু তালেবের এই শাস্তি কোন কোন পাপী মুসলমানদের শাস্তির ন্যায় বৈপত্তিক শাস্তি হইবে এবং তাহাদেরকে আল্লাহ্ তায়ালার রহমতের সেই মুষ্ঠ দ্বারা দোযখ হইতে বাহির করা হইবে, সুপারিশ শেষ হইয়া যাওয়ার পরে জাহান্নামীদের হইতে সেই পরিপুর্ণ মুষ্ঠ জান্নাতে ঢালিবেন।

সর্বসাধারণ ওলামা বলিতেছেন, তাঁহার ঈমানের প্রমাণ নাই। কিন্তু খেয়াল রাখিতে হইবে যে, কেহ তাহার উপর বিদ্রূপ ও প্রগলভতা না করিবে। তিনি হুজুর (ﷺ) এর বড় খাদেম ছিলেন, হুজুর (ﷺ)কে তাঁহার সঙ্গে নিয়া শুইতেন এবং হুজুরের হেতু মক্কার কাফেরদের হাতে অনেক দুঃখ কষ্ট সহ্য করিয়াছেন। সম্ভবত তাঁহার উপর বিদ্রূপ করার কারণে হুজুরের কষ্ট হইবে। যদিও আইনানুযায়ী মুসলমান হন নাই, কিন্তু তিনি হুজুরের অনেক খেদমত করিয়াছেন। এমনকি হুজুর (ﷺ) তাঁহার পিতৃহীনতার কাল আব্দুল মোত্তালিবের পরে আবু তালেবের নিকট অতিক্রম করিয়াছেন।

❏ আল্লাহ্ তায়ালা বলিয়াছেন,

الم يجدك يتيما فاوى .

(আল্লাহ্ কি তোমাকে পিতৃহীন অবস্থায় পান নাই? অতঃপর তোমাকে আশ্রয় দান করিয়াছেন) সেই আয়াতের পরিণামে তাঁহার আজাব হইবে।

❏ উক্ত কিতাবের ৪২০ পৃষ্ঠায় হযরত হাকীমুল উম্মত (رحمة الله) একটি মনোরম রসিকতা বর্ণনা করিয়াছেন যে, হুজুর (ﷺ) এর চতুর্থ সুপারিশ সেই সমস্ত লোকদের জন্য হইবে, যাহারা দুনিয়ার মধ্যে শরীয়তানুযায়ী মুমিন ছিলেন না, কিন্তু খোদার সান্নিধ্যে মুমিন ছিলেন। অন্যথায় আইনানুযায়ী মুমিন একেবারে নগণ্য হইতে নগণ্য ও প্রথম তিন সুপারিশ দ্বারা জাহান্নাম হইতে মুক্তিপ্রাপ্ত হইয়াছে। সুতরাং এখন সেই লোকদের জন্য সুপারিশ হইবে যাহারা আইনানুযায়ী মুমিন ছিলেন না, কিন্তু আল্লাহর সান্নিধ্যে মুমিন ছিলেন। তিনি (হাকীমুল উম্মত) বলিয়াছেন, যাহাদের অন্তরে ঈমান ছিল কিন্তু মুখে উহা স্বীকার করে নাই সেই সমস্ত মানুষ খোদার সান্নিধ্যে মুমিন এবং আইনানুযায়ী মুমিন নয়। যেমন আবু তালেব ইত্যাদি, তাঁহাদেরকে শরীয়তে ছাতের (গোপনকারী) বলে এবং যাহার মুখে ঈমান ও অন্তরে কুফর তাহাকে মোনাফেক বলে। আর যাহারা অন্তর ও মুখ উভয় দিক দিয়া মুমিন হয় তাঁহাদেরকে অকৃত্রিম ও খাঁটি মুমিন এবং যাহারা অন্তর ও মুখ উভয় দিক দিয়া কাফের হয় তাহাদিগকে মোজাহের (যাহারা প্রকাশ্যভাবে ঈমানকে অস্বীকার করে) বলা হয়।

অতঃপর হুজুর (ﷺ) এর সুপারিশের মধ্যে মোনাফিকগণ অথবা অন্যান্য একত্বতার আকীদা পোষণকারী কাফেরগণ অন্তর্ভূক্ত হইবেনা। শুধু ছাতেরীন অর্থাৎ যাহারা ঈমানকে অন্তরে গোপন করিয়া রাখে তাহারাই হুজুর (ﷺ) এর সুপারিশের অন্তর্ভূক্ত হইবে। হ্যাঁ, অকপট মুমিন এবং অন্তরে যাহারা ঈমানকে গোপন করিয়া রাখে তাহাদের এই পার্থক্য যে, অকপট মুমিনগণ হুজুর (ﷺ) এর সুপারিশ এবং হুজুর (ﷺ) এর পবিত্র হস্তদ্বয় দ্বারা বাহির হইবে আর ছাতেরীনগণ হুজুর (ﷺ) এর সুপারিশ দ্বারা বাহির হইবে, কিন্তু হুজুর (ﷺ) এর হাত মোবারক দ্বারা বাহির হইবেনা। যেহেতু ইহা তাহারা দুনিয়ার মধ্যে হুজুর (ﷺ) এর শরীয়তানুযায়ী মুমিন না হওয়ার পরিণাম।

দেখুন! তাফসীরে নাঈমীর ৭ম পারার ২২৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, আবু তালেবের ঈমানের ব্যাপারে অনেক মতভেদ রহিয়াছে। কিন্তু খেয়াল রাখিতে হইবে, যাহাতে সম্মানের সহিত তাঁহার স্মরণ করা যায়। কেননা, তাঁহার সহিত বেয়াদবী করিলে হুজুর করীম (ﷺ) এর অসন্তুষ্টির সম্ভাবনা রহিয়াছে। যেহেতু আবু তালেব হুজুর করিম (ﷺ) এর আব্বাজানের ন্যায়, চাচা ও হুজুর (ﷺ) এর প্রতিপালনকারী ও তাঁহার (আবু তালেব) পবিত্রীকৃত স্ত্রী হযরত ফাতিমা বিনতে আছদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা অর্থাৎ শেরে খোদা হযরত আলীর (رضي الله عنه) মাতা হুজুর করীম (ﷺ) এর আম্মাজানের মত যে, হুজুর (ﷺ) তাঁহার বক্ষে প্রতিপালিত হইয়াছেন। অতঃপর আবু তালেবের ব্যাপারকে খোদার দিকে সমর্পণ কর।

❏ তাফরীহুল আজকিয়া ২য় খণ্ডের ৫৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, কোন বিস্ময়কর নয় যে, হুজুর (ﷺ) তাঁহার মাতা-পিতাকে যেই রকম জীবিত করাইয়া ঈমানদার করিয়াছেন, সেই রকম তাঁহার চাচাকেও মৃত্যুর পরে মুসলমান করিয়াছেন। যেমন মখদুম শেখ সা’দ (رحمة الله) ‘মজমা’ নামক কিতাবের মধ্যে উম্মুল মায়ানী হইতে এবং সবয়ে ছনাবেল শরীফ কিতাবের মধ্যে মজমা হইতে বর্ণনা করিয়াছেন যে, মে’রাজ শরীফের পরে হুজুর করীম (ﷺ) তাঁহার আম্মাজান, আব্বাজান এবং চাচাজান আবু তালেবকে ক্ষমা করাইয়াছেন। আল্লাহ্ তায়ালা তাঁহাদেরকে জীবিত করিয়াছেন। অতঃপর তাঁহারা তিন জনই মুসলমান হইয়া আপন স্থানে চলিয়া গিয়াছেন এবং হুজুর (ﷺ) এর আম্মা-আব্বার ঈমানের মধ্যে মোতাআখ্খেরীন অর্থাৎ পরবর্তী মোহাদ্দেসীনগণের কোন সন্দেহ নাই। উহা ব্যতীত সম্ভব যে, আবু তালেবের অন্তর হুজুর (ﷺ) এর আশীর্বাদে ঈমানের আলো দ্বারা আলোকিত হইয়াছে এবং কাফেরদের ভয়ে প্রকাশ্যভাবে ঈমান আনেন নাই। রূহের মৃত্যুর সময় আবু তালেব হুজুর (ﷺ) এর সত্যবাদীতার উপর কয়েকটি শে’র পড়িয়াছেন উহা কিতাবসমূহে উল্লেখ আছে। যেমন: একটি শে’র:

لقد علمته بان دين محمد

من خير اد يان البرية دينا .

অর্থাৎ, উহা আমি অবশ্যই জানিয়া নিয়াছি যে, ধর্ম হিসেবে মুহাম্মদ (ﷺ) এর ধর্ম; প্রত্যেক সৃষ্টিজীবের ধর্ম হইতে শ্রেষ্ঠ এবং উত্তম।

اللهم انا نعوذبك من غضبه وايذ ائه صلّى الله عليه وسلّم .

والله اعلم بالصواب .

وصلّى اللهُ علَى محمد واله واصحابه اجمعين .

সমাপ্ত

________________

নবী করীম (ﷺ) এর চাচা আবু তালেবের নাজাত সম্পর্কে বর্ণনা

রচনায়ঃ মুহাম্মদ আজিজুল হক আল-কাদেরী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি)

 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন