তৃতীয় প্রকার জিকির

 

তৃতীয় প্রকার জিকির


এ প্রসঙ্গে আল্লামা কাজী ছানাউল্লাহ পানিপথি(رحمة الله) তদীয় কিতাবে উল্লেখ করেন,

, وثالثها الذكر بالقلب والروح والنفس وغيرها

-"তৃতীয় প্রকার জিকির হচ্ছে: ক্বাল্ব, রুহ, নাফছ ও অন্যান্য লতিফা দ্বারা জিকির করা।"


(তাফছিরে মাজহারী, ৩ য় খন্ড, ৩৮৬ পৃ: সূরা আরাফের ৫৫ নং আয়াতের তাফছিরে)



তাছাউফ পন্থিদের একটি বিশেষ জিকির হচ্ছে জিকরে ক্বাল্বি বা খফি জিকির। অর্থাৎ, যে জিকির ক্বাল্বে ধ্যাণ করে ঠোট ও জিহ্বা নাড়ানাে ব্যতীত নিশ্বাসের সাথে করা হয়, ঐ জিকিরকে 'জিকিরে ক্বালি বা খফি জিকির ' বলা হয়। এই ধরণের জিকির প্রসঙ্গে আল্লামা কাজী ছানাউল্লাহ পানিপাথি(رحمة الله) তদীয় কিতাবে আরাে উল্লেখ করেন,



الذي لا مدخل فيه للسان وهو الذكر الخفي الذي لا يسمعه الحفظة



-"যে জিকিরে জিহ্বার কোন ভূমিকা নেই সেই জিকিরকে 'খফি জিকির বলে যা আমলনামার ফেরেস্তারাও শুনেনা।" (তাফছিরে মাজহারী, ৩ য় খন্ড, ৩৮৬ পৃ:)



সুতরাং ঠোট ও জিহ্বা নাড়ানাে ব্যতীত জিকিরে কালি বা খফি জিকির করা হয়। শরিয়তের ভাষায় পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহ'র কোন বিষয় নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ করা বা চিন্তা করা এই জিকিরের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে গভীর ধ্যান করাও খফি জিকিরের অন্তর্ভুক্ত। এ ধরণের জিকির সম্পর্কে বিশ্ব বিখ্যাত মুফাচ্ছির আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী(رحمة الله) তদীয় কিতাবে উল্লেখ করেন ;



ذكر الله واشارة الى ثلاث مراتب . أولاها الذكر باللسان وثانيتها التفكر بالقلب . وثالثتها المعرفة بالروح لان ذكر اللسان يوصل صاحبه الى ذكر القلب فهو التفكر في قدرة الله وذكر القلب يوصل الى مقام الروح



-"আল্লাহর জিকির ৩ ধরণে ইশারা করা হয়।


প্রথমত: শুধু জিহ্বা যােগে,


দ্বিতীয়ত: ক্বাল্বের প্রতি ধ্যাণ করে।


তৃতীয়ত: রুহের পরিচয়ের মাধ্যমে। কেননা জিহ্বা যােগে জিকির করলে ছালেককে ক্বালবী জিকিরের স্তরে পৌছে দেয়। ফলে সে আল্লাহর কুদরত নিয়ে চিন্তা করতে থাকে। ক্বাল্বি জিকির ছালেক কে রুহের মাকামের পৌছে দেয়।" (তাফছিরে রুহুল বয়ান, ২ য় খন্ড, ১৭১ পৃ:)



এখানেও ক্বাল্বের প্রতি ধ্যাণ করে জিকির করার কথা উল্লেখ রয়েছে। এমনকি বলা হয়েছে, ক্বালবের প্রতি ধ্যাণ করে জিকির করলে ছালেক আল্লাহর সকল বস্তুর হাকিকত সম্পর্কে জানতে পারবে। যেমন উল্লেখ আছে-



وذكر القلب يوصل الى مقام الروح فيعرف في ذلك حقائق الأشياء



"জিকিরে ক্বাল্বি ছালিককে মাকামে রুহে পৌছে দেয়, ফলে সে আল্লাহর যাবতীয় বস্তুর হাকিকত জানতে পারে।" (তাফছিরে রুহুল বয়ান, ২ য় খন্ড, ১৭১)



সুতরাং ক্বাল্বের প্রতি ধ্যাণ করে যে জিকির করা হয়, ঐ জিকিরকে জিকরে কালী বা 'খফি জিকির ' বলা হয়। খফি জিকির সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা'লা বলেন,



اذغوا ربكم تضرعا وخفية إنه لا يحب المعتدين



-"তােমরা তােমাদের রবকে বিনীতভাবে ও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ডাক, নিশ্চয় তিনি সীমালঙ্গনকারীকে পছন্দ করেন না।" (সূরা আরাফ: ৫৫ নং আয়াত)



আর পবিত্র হাদিস শরীফে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) খফি জিকির ' প্রসঙ্গে বলছেন ;



حدثنا عيسى بن أحمد ، نا ابن وهب ، أخبرني أسامة ، عن محمد بن عبد الرحمن بن لبيبة ، أين سعد بن أبي وقاص قال: سمعت رسول الله صلى الله عليه وعلى آله وسلم يقول: إن خير النمر الخفي ،



-"হযরত সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাছ (رضي الله عنه) বলেন, আমি রাসূলে পাক (ﷺ) কে বলতে শুনেছি তিনি বলেছেন: সর্বোত্তম জিকির হচ্ছে 'খফি জিকির।"


(মুসনাদে শাশী: হাদিস নং ১৮৩ ; ছহীহ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং ৮০৯ ; ইমাম হিন্দী: কানজুল উম্মাল, ১ ম খন্ড, ২১৩ পৃ: ; তাফছিরে রুহুল মাআনী, ১৬ তম খন্ড, ৬৬৯ পৃ ; ফতােয়ায়ে শামী, ২ য় খন্ড, ৪৩৪ পৃ: ; তাফছিরে মাজহারী, ৯ খন্ড, ২৯৯ পৃ:)



হাদিসটি আরেকজন সাহাবী থেকে ভিন্ন আরেকটি সূত্রে বর্ণিত আছে,



, حدثنا يخيى بن سعيد ، عن أسامة بن زيد ، حدثني محمد بن عبد الرحمن ابن لبيبة ، عن سعد بن مالك ، عن النبي صلى الله عليه وسلم قال: خير النمر الخفي ،



-"হযরত সাদ ইবনে মালেক (رضي الله عنه) নবী করিম (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন, প্রিয় নবীজি (ﷺ) বলেছেন: সর্বোত্তম জিকির হল খফি জিকির।"


(মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ১৫৫৯ ; ইমাম বায়হাকী: শুয়াইবুল ঈমান, হাদিস নং ৫৪৮ ; মুছান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ, হাদিস নং ২৯৬৬৩)



এই হাদিস সম্পূর্ণ ছহীহ এবং স্পষ্ট প্রমাণিত হয় আল্লাহর নবী (ﷺ) বলেছেন: 'খফি জিকির হচ্ছে সর্বোত্তম জিকির। আর তাফছিরে মাজহারী থেকে আমরা পূর্বেই জেনেছি, যে জিকির ঠোট ও জিহ্বা নাড়ানাে ব্যতীত করা হয় ঐ জিকিরকে 'খফি জিকির ' বলা হয়। মুহাক্কিক উলামাদের কোরআন- সুন্নাহ'র গভীর গবেষনা- তাহকিক ও সৃষ্টি নিয়ে তাফাকুর করা জিকরে খফির অন্তর্ভূক্ত। এ ধরণের জিকির প্রসঙ্গে হাদিস শরীফে আরাে উল্লেখ আছে,



حدثنا أبو هشام الرفاعي ، حدثنا إسحاق ، حدثنا معاويه ، عن الزهري ، عن غزوة ، عن عائشة قالت: ... وكان رسول الله صلى الله عليه وسلم يفضل التمر الخفي الذي لا يسمعة الحفظ سبعين ضغقا .,



-"হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, নিশ্চয় আল্লাহর নবী 'খফি জিকির প্রসঙ্গে বলেছেন: এই জিকির আমলনামার ফেরেশতারাও শুনেনা। ইহার সওয়ার অন্য জিকিরের চেয়ে ৭০ গুণ বেশীর।"


(মুসনাদে আবী ইয়ালা, হাদিস নং ৪৭৩৮ ; ইমাম বায়হাকী: শুয়াবুল ঈমান, ১ ম খন্ড, ৩৫১ পৃ: হাদিস নং ৫৫১ ; ইমাম হিন্দী: কানজুল উম্মাল, ১ ম খন্ড, ২২৭ পৃ: ; ইমাম হায়হামী মজমুয়ায়ে জাওয়াইল, ১০ ম খন্ড, ৮১ পৃ: ; ইমাম ছিয়তী: জামেউছ ছাগীর, ২ য় জি: ২৬৫ পূর্ণ। ইমাম মােল্লা আলী: মেরকাত শরহে মেসকাত, ৪৫৬ নং হাদিসের ব্যাখ্যায় ; ইমাম ইবনে শাহিন। আত্তারগীব ওয়াত্তারহীব, হাদিস ১৩৬৫ ;)



হাদিসটিকে হাফিজ ইরাকী, আল্লামা তাহের পাটনী(رحمة الله) হাদিসটিকে জয়ীফ বলেছেন, তবে হাদিসটি মওজু নয়। আর সকলেই অবগত আছেন ফাজায়েলের ক্ষেত্রে এরুপ হাদিসই যথেষ্ঠ। যেমন ইমাম মােল্লা আলী ক্বারী(رحمة الله) বলেছেন,



والضعيف يعمل به في فضائل الأعمال الفاقا



-"সকল ওলামাগণ এই বিষয়ে একমত পােষণ করেছেন যে, যঈফ সনদের হাদিসের উপরে আমল করা মুস্তাহাব।" (মােল্লা আলী ক্বারী ; আজারুল মারআহ ফি আখবারিল মাওদুআত, ৩১৫ পৃ, হাদিস নং)



এ বিষয়ে হাদিসটি ভিন্নভাবে উল্লেখ আছে,



حدثنا أبو هشام الرفاعي ، حدثنا إسحاق ، حدثنا معاوية ، عن الزهري ، عن غزوة ، عن عائشة قالت: أن النبي صلى الله عليه وسلم قال:. وجاءت الحفظة بما حفظوا وكتبوا . قال الله لهم: انظروا . هل بقي له من شيء ؟ فيقولون: ربنا ما تركنا شيئا مما علمناه وحفظناه إلا وقد أخصاة وكتبناه . فيقول الله تبارك وتعالى له: إن لك عندي ځښنا لا تعلمه وأنا أجزي به ، وهو الذكر الخفي



-"হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলে পাক (ﷺ) বলেছেন: ... হাশরের ময়দানে ফেরেস্তারা যা যা আমল সংরক্ষণ করেছেন এগুলাে নিয়ে আসবে। আমলনামা দেওয়ার পরে আল্লাহ তা'লা বলবেন: আরােও কোন নেকী বাকী আছে কি? ফেরেস্তারা আশ্চর্য্য হয়ে বলবে: ওহে রব! আমরা যা যা শুনেছি সবই সংরক্ষণ করেছি। তখন আল্লাহ তা'লা বিশাল বড় সওয়াবের পাহাড় দেখিয়ে বলবেন, এগুলােও আমার বান্দার নেকী যা তােমরা জাননা। তােমরা যেন রাখ! ইহা হচ্ছে 'খফি জিকির '।"


(মুসনাদে আবী ইয়ালা, হাদিস নং ৪৭৩৮ ; মুসনাদে আবু আওয়ানা ; তাফছিরে মাজহারী, ৩ য় খন্ড, ৩৮৭ পৃ: ; ইমাম মােল্লা আলী: মেরকাত শরহে মেসকাত, ২২৬১ নং হাদিসের ব্যাখ্যায়)



ক্বালবী জিকির তথা খফি জিকির সম্পর্কে দেওবন্দের রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী সাহেব বলেন:"ছালেক যখন ক্বাল্কী জিকিরের ক্ষেত্রে নিমগ্নতার স্তরে পৌঁছে যায়, তখন শায়েখ জবানী জিকির ছাড়িয়ে তাকে কী জিকিরের তথা আল্লাহর ধ্যানে মশগুল করে দেন।" (ইমদাদুছ ছুলুক, ৬৬ পৃ:)



দলিল: তাফছিরে মারেফুল কোরআনের লেখক আল্লামা মুফতি শফি সাহেব বলেন: অধম হযরত থানভীর কাছ থেকে অপর এক মজলিসে শুনেছি যে, জিকিরে ক্বালবীর এটিও একটি প্রকার যে, আল্লাহ পাকের কোন নাম তার শব্দ সহকারে মনে মনে খেয়াল করে আদায় করতে থাকবে, তবে মুখ নাড়া- চাড়া করবে না।" (মাজালিছে হাকিমুল উম্মত, ৩৭১ পৃ:)



সুতরাং বিষয়টি স্পষ্ট যে, জিহ্বা ও ঠোট নাড়ানাে ছাড়াই দমে দমে ক্বালবে ধ্যাণ করে আল্লাহ তা'লার জিকির করার নাম 'খফি জিকির। আর এ ধরণের জিকিরের অর্থ বা আওয়াজ আমল নামার ফেরেস্থাদের আওতায়ও থাকেনা এবং ইহার সওয়াব স্বয়ং আল্লাহ তা'লা নিজের কুদরতী হতে দান করবেন (সুবহানাল্লাহ) আর এ ধরণের জিকিরকে আল্লাহর নবী (ﷺ) সর্বোত্তম জিকির বলেছেন।

______________________

শরীয়তের দৃষ্টিতে ক্বালবী জিকির ও ছামার বৈধ্যতা

রচনা ও সংকলনেঃ মুফতি মাওলানা আলাউদ্দিন জেহাদী

 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন