প্রশ্ন: উচ্চরবে যিকির করা উত্তম, না নীরবে? দলীল সহকারে জবাব দিন।
উত্তর: প্রত্যেক প্রকার যিকিরে ফজীলত রয়েছে। কখনো সরবে উত্তম; আবার কখনো নীরবে উত্তম। কোরআন মজিদে সাধারণভাবে যিকিরের নির্দেশ দেয়াই তার উজ্জ্বল প্রমাণ।
যেমন- আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন- اذْكُرُوا اللهَ ذِكْرًا كَثِيرًا
অর্থাৎ- তোমরা অধিক পরিমাণে আল্লাহর যিকির কর। আর সাধারণার্থক শব্দ দ্বারা যে কাজ বা বস্তুকে বুঝানো হয় তা পালনীয়। উল্লেখ্য যে, আনুসঙ্গিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তার ‘ফজীলত’ বা মর্যাদা বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে। এতদ্ভিত্তিতে যিকিরের ছওয়াবও সময় এবং অবস্থা অনুসারেই পাওয়া যায়। (মৌলানা রশিদ আহমদ গঙ্গুহী)।
তিনি অন্যত্র উল্লেখ করেছেন- যিকির যে কোন অবস্থায়ই হউক না কেন জায়েজ। তিনি তার লিখিত ফতোয়ার ২১৫ পৃষ্ঠায় এক প্রশ্নের জবাবে উল্লেখ করেছেন- ফতোয়া দানকারীর জন্য তাঁর মতে সঠিক মছয়ালাই ব্যক্ত করা আমি ‘ফরজ’ মনে করি।
উপরোক্ত মৌলানা সাহেবের (গঙ্গুহী সাহেব) এসব বক্তব্যাদি দ্বারা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, তার মতেও সর্বাবস্থায় উচ্চরবে যিকির করা জায়েজ; শুধু তাই নয়, সময় ও অবস্থার প্রেক্ষিত কখনো কখনো তা উত্তমও বটে। তাই তিনি উল্লেখ করেছেন যে, আল্লাহ্ তায়ালা যিকিরের জন্য সাধারণভাবে নির্দেশ বা অনুমতি দিয়েছেন। কাজেই জানাজার সাথে পথচলার সময়টাও যে সে সাধারণ নির্দেশের আওতাভূক্ত তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই; যেহেতু এ সম্পর্কে শরীয়তে কোন নিষেধ নেই। সুতরাং উক্ত আলোচ্য সময়ে উচ্চরবে যিকির করা নিষিদ্ধ হবার কোন কারণ নেই; বরং তা উত্তমই।
উল্লেখ্য যে, জানাজার সাথে পথচলার সময় পদাতিকদের ‘যিকির’ সম্মিলিত কন্ঠেই হয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে ছহীহ্ বোখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফ ইত্যাদি বিশুদ্ধ হাদিস গ্রন্থাদিতে উল্লেখিত হযরত আবু হোরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত হাদিসে হুজুর (ﷺ) এরশাদ করেছেন, আল্লাহ্ তায়ালার এরশাদ হল-
أَنَا عِنْدَ ظَنِّ عَبْدِي بِي وَأَنَا مَعَهُ إِذَا ذَكَرَنِي فَإِنْ ذَكَرَنِي فِي نَفْسِهِ ذَكَرْتُهُ فِي نَفْسِي وَإِنْ ذَكَرَنِي فِي مَلَإٍ ذَكَرْتُهُ فِي مَلَإٍ خَيْرٍ مِنْهُمْ . (صحيح البخارى)
অর্থাৎ- “আমি আমার বান্দার সাথে তেমন আচরণ করি যেমনি বান্দা আমার প্রতি ধারণা পোষণ করে। যে আমাকে স্মরণ করে, আমি তার সাথেই থাকি। যদি সে আমাকে একাকী স্মরণ করে, আমিও তাকে একাকী স্মরণ করি। যদি সে সম্মিলিতভাবে আমাকে স্মরণ করে, তবে আমিও তাকে তদাপেক্ষা অধিক উত্তম জমায়েতে অর্থাৎ নিষ্পাপ ফেরেশতাদের জমায়েতে স্মরণ করি।”
এ হাদিস দ্বারাও সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হল যে, উচ্চরবে ‘যিকির’ করা উত্তম ও মোস্তাহাব। আর আল্লাহ্ তায়ালা যিকিরকারীদের সাথেই আছেন। উল্লেখ্য যে, উক্ত হাদিসেও কোন স্থান বা সময়ের বিশেষত্ব বর্ণিত হয়নি; বরং সর্বাবস্থায়ই উচ্চরবে সম্মিলিতভাবে যিকির করার বৈধতা ও উপকারিতা প্রমাণিত হচ্ছে। সুতরাং, জানাজার সাথে সম্মিলিত ভাবে উচ্চরবে যিকির সহকারে পথ চলাই মোস্তাহাব।
ইমাম খাইরুদ্দীন রমলী (رحمة الله) তাঁর প্রণীত ফতোয়া খাইরিয়্যাহ ২য় খণ্ডের ১৮১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন-
فاما الذكر والجهر به وانشاء القصائد فقد جاء فى الحديث ماقتضاء طلب الجهر نحو وان ذكرنى فى ملاء ذكرته فى ملاء خير منه رواه البخارى والمسلم والترميذى والنسائى وابن ماجة ورواه احمد بنحوه باسناد صحيح وزاد فى اخره قال قتادة والله- والذكر فى الملاء لا يكون الّا عن جهر .
অর্থাৎ- উচ্চরবে ‘যিকির’ ও ‘কছিদা’ পাঠ হাদিস শরীফ দ্বারাই প্রমাণিত। যেমন- হাদিসে কুদছীতে আল্লাহ্ তায়ালা বলেছেন- যদি বান্দা আমাকে জমায়েতে স্মরণ করে তবে আমিও তাকে তদপেক্ষা অধিক উত্তম জমায়েতে (ফেরেশতাদের জমায়েতে) স্মরণ করি।’ এ পবিত্র হাদিসের উক্ত অংশেই উচ্চরবে ‘যিকির’ এর নির্দেশ বা অনুমতি পাওয়া যায়। ইমাম বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাসায়ী এবং ইমাম আহমদ (رحمة الله) বিশুদ্ধ সনদ দ্বারা উক্ত হাদিসটি বর্ণনা করেছেন।
ইমাম কাতাদাহ (رحمة الله) একথাও উল্লেখ করেছেন- সম্মিলিত কন্ঠে যিকির উচ্চরব ব্যতিরেকে হয় না।
পক্ষান্তরে, কোন কোন হাদিসে নীরবে যিকির করাই উত্তম বলে ইঙ্গিত রয়েছে। যেমন- خير الذكر الخفى অর্থাৎ- উত্তম যিকির হল নীরবে যিকির।
এখন পরস্পর বিরোধী দুই বর্ণনার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানকল্পে উল্লেখ করা হয়-
والجمع منهما بانّ ذالك يختلف باختلاف الاشخاص والاحوال كما جمع بين الاحاديث الطالبة للجهر بالقرأة والطالبة للامر اربها ولايعارض ذالك خير الذكر الخفى لانه حيث خيف الرياء او تأذى المصلين والنيام .
অর্থাৎ- উভয় প্রকার পরস্পর বিপরীতমুখী দুই বর্ণনার মধ্যে এভাবে সামঞ্জস্য বিধান করা যায় যে, যিকির ব্যক্তি বিশেষ ও অবস্থার ভিন্নতার ভিত্তিতে বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। যেমনিভাবে উচ্চরবে ও নীরবে কোরআন পাঠ নির্দেশক পরস্পর বিপরীত হাদিস সমূহের মধ্যে সমন্বয় বিধান করা যায়। সুতরাং ‘নীরব যিকির’ নির্দেশক উক্ত হাদিস সরব নির্দেশক হাদিসের খন্ডনকারী হবে না। কারণ নীরব যিকির সেখানে উত্তম; যেখানে লোক দেখানোর মনোবৃত্তির সঞ্চার হওয়ার কিংবা পার্শ্ববর্তী মুসল্লী বা কোন নিদ্রারত ব্যক্তিকে যিকিরের শব্দ দ্বারা কষ্ট পৌঁছানোর সম্ভাবনা থাকে।
خير الذكر الخفى (সুতরাং অন্যান্য যিকিরের বেলায়ও অনুরূপভাবে যেখানে ঘুমন্ত ব্যক্তি বা মুসল্লীর ক্ষতি হবার কিংবা “লোক দেখানোর মনোবৃত্তি সঞ্চারের সম্ভাবনা না থাকে সেখানে উচ্চরবে যিকির করা এবং যেখানে এসব বাধা থাকে সেখানে নীরবে যিকির করাই উত্তম হবে।)
কাজেই যেহেতু জানাজার সাথে যিকিররত অবস্থায় পথ চললে উপরোক্ত কোন অসুবিধার সম্মুখীন হবার সম্ভাবনা নেই সেহেতু এ মুহূর্তে উচ্চরবে যিকির করাই শ্রেয় হবে। উপরোক্ত উদ্ধৃতিতে “অবস্থা বিশেষে”- এ শব্দদ্বয় দ্বারা এটাই প্রতীয়মান হয় যে, জানাজার সাথে পথ চলার সময় উচ্চরবে যিকির করা একটা যুগোপযোগী পদক্ষেপ বা আমল। কেননা, বর্তমান যুগের সাধারণ মুসলমানের অবস্থা অবর্ণনীয়ই বটে। কেননা, এমন মুহূর্তে পার্থিব কথাবার্তা, হাসি-ঠাট্টা এমন কি অন্যের কুৎসা রটনা করতেও তারা দ্বিধাবোধ করে না। এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করেই ইমাম শা’রানী (رحمة الله) বলেছেন-
فكيف بمنع منها وتأمل احوال غالب الخلق الان فى الجنازة تجدهم مشغولين بحكايات الدنيا لم يعتبروا بالميت وقلبهم غافل عن جميع ماوقع له بل رأيت منهم من يضحك واذا تعارض عندنا مثل ذالك وكون ذالك لم يكن فى عهد رسول الله صلّى الله عليه وسلّم قدمنا ذكرالله عزوجل بل كل حديث لغو اولى من حديث انباء الدنيا فى الجنازة فلو صاح كل من الجنازة لا اله الّا الله محمد رسول الله . فلا اعتراض .
অর্থাৎ- তাতে (উচ্চরবে যিকিরে) কিভাবে বাধা দেয়া যায়? বর্তমানকালীন জনসাধারণের অবস্থা তোমরা পর্যবেক্ষণ করা। তাদেরকে জানাজার সাথে পথচলার মুহূর্তেই অধিকন্তু দুনিয়াবী গল্প-গুজবে রত অবস্থায় দেখতে পাবে। মৃত ব্যক্তিকে দেখে তাদের অন্তরে কোন শিক্ষা স্থান পেয়েছে বলে মনে হয় না। প্রায়শঃ তাদেরকে অন্য মনষ্কই থাকতে দেখা যায়। এমন কি আমরা অনেককে হাসি-ঠাট্টা করতেও দেখেছি। এ যুগে সাধারণের এই অবস্থার প্রেক্ষিতেই পুরাকালে এ মুহূর্তে কলেমা সরবে পাঠ করার প্রচলন না থাকিলেও এখন তাতে বাধা দেয়া উচিত হবে না। বরং তা জায়েজ বলাই আবশ্যকীয়। কারণ দুনিয়াবী কথাবার্তা অপেক্ষা এ মুহূর্তে যিকির করা যে অধিকতর শ্রেয় হবে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। অতএব, জানাজায় উপস্থিত সবাই সম্মিলিত কন্ঠে উচ্চরবে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পাঠ করলে আপত্তি করার কোন কারণ নেই।
বিবেচ্য যে, আল্লামা শা’রানী (رحمة الله) এর যুগে যদি এ হুকুম হয়, তবে বহু পরিবর্তনোত্তর এ যুগে কি হুকুম হতে পারে? একটু ভেবে দেখুন।
যে সব ফকীহ ‘জানাজার সাথে পথ চলার সময়’ উচ্চরবে যিকির করা হারাম বা মাকরূহ বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ এমনও রয়েছেন যাঁদের মতে উচ্চরবে যিকির করা সর্বাবস্থায়ই মাকরূহ বা হারাম। যেমন খানীয়াহ ও অনুরূপ অন্যান্য কিতাবাদিতেও এরূপ মতামত উল্লেখ করা হয়েছে। কাজেই তাঁদের মতানুযায়ী শুধু জানাজার সাথে পথচলার সময়কে নির্দিষ্ট করার প্রয়োজনই বা কি? অথচ কোরআন মজিদের আয়াত এবং যথেষ্ট সংখ্যক হাদিসে সরব যিকিরের বৈধতা সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে; এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। সুতরাং অন্যান্য ফকীহগণ বিশেষ করে পরবর্তীকালীন ওলামা কেরাম তা জায়েজ বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন এবং যারা এ কাজটাকে হারামরূপে আখ্যায়িত করে তাতে বাধা প্রদান করেন তাদের যথাযথ জবাবও দিয়েছেন। এমনকি দেওবন্দী বিশেষ উল্লেখযোগ্য আলেমগণও এ কাজটির বৈধতা নিশ্চিতভাবে স্বীকার করেছেন। যেমন- বিশেষত, ফত্ওয়ায়ে রশিদিয়াই তার প্রমাণবহ।
_____________
আল্-ক্বাওলুল হক্ব
(জানাজায় উচ্চরবে যিকির জায়েয প্রসঙ্গে)
রচনায়ঃ মুহাম্মদ আজিজুল হক আল-কাদেরী (رحمة الله)
অনুবাদঃ মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মন্নান (এম.এম.এম.এফ)
🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন