হুযূর পূর নূর (ﷺ) এর তাঁর ধৈর্য, দীর্ঘ দুঃখকষ্ট ও ক্ষমা প্রদর্শন


ধৈর্য, দীর্ঘকাল দুঃখকষ্ট ভোগ, শাস্তি বিধানের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ক্ষমা প্রদর্শন, এসব বৈশিষ্ট্য আর ক্লেশ সহ্য করার ক্ষমতা একে অপর হতে পৃথক। ধৈর্য (হিলম্) হচ্ছে উস্কানির মুখেও সম্মান ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। দীর্ঘ কষ্টভোগ (এহতেমাল) হচ্ছে আঘাত ও জখম হওয়ার মুখেও আত্মসংযমী ও আত্মসমর্পিত থাকা। ধৈর্য (সবর ) সেটার অনুরূপ হলেও অর্থের দিক থেকে এটা কিছুটা ভিন্ন। আর ক্ষমা প্রদর্শন (’আফওয়া) মানে হলো অন্য কারো প্রতি কোনো রকম হিংসা-বিদ্বেষ (অন্তরে) লালন করতে অস্বীকৃতি।


এসব গুণ-ই সেই আদবের (শিষ্টাচারের) অংশ যা দ্বারা আল্লাহ (ﷻ) তাঁর রাসূল (ﷺ)-কে বিভূষিত করেন। 


❏ আল্লাহ পাক ইরশাদ ফরমান: “হে মাহবূব! ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বন করুন, সৎকর্মের নির্দেশ দিন এবং মূর্খদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন” [আল-কুরআন, ৭:১৯৯; মুফতী আহমদ ইয়ার খাঁন সাহেব (رحمة الله) কৃত ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’]। 


❏ এ কথা বর্ণিত আছে (তাফসীরে ইবনে জারির তাবারী, ইবনে আবি হাকীম ও অন্যান্য কিতাবে) যে, এই আয়াতটি যখন মহানবী (ﷺ)-এর প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল, তখন তিনি হযরত জিবরীল আমিন (عليه السلام)-কে এটা ব্যাখ্যা করতে বলেছিলেন। হযরত জিবরীল (عليه السلام) তাঁকে উত্তর দিয়েছিলেন, “যিনি জানেন (মানে খোদাতা’লা) তাঁকে জিজ্ঞেস করা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।” অতঃপর ফেরেশতা প্রস্থান করেন এবং ফিরে এসে হুযূর পাক (ﷺ)-কে বলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! আল্লাহ পাক আপনাকে আদেশ করেন যেন আপনি তাদের সাথে মিলেমিশে যান যারা আপনার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল; আর তাদেরকে দান করুন যারা আপনাকে দিতে অস্বীকার করেছিল; আর তাদেরকে ক্ষমা করে দিন যারা আপনার প্রতি অন্যায় করেছিল।”


❏ আল্লাহ তা’লা মহানবী (ﷺ)-এর কাছে (হযরত লোক্বমান-সম্পর্কিত ঘটনা) বর্ণনা করেন: “এবং যে বিপদাপদ তোমার প্রতি আপতিত হয় সেটার ব্যাপারে ধৈর্য ধারণ করো” [আল-ক্বুরআন, ৩১:১৭]।

❏ তিনি অন্যত্র ইরশাদ ফরমান: “সুতরাং আপনি ধৈর্য ধারণ করুন যেমনিভাবে সাহসী রাসূল (عليه السلام)-বৃন্দ ধৈর্য ধারণ করেছেন” [আল-ক্বুরআন, ৪৬:৩৫]। 

❏ তিনি আরো ফরমান: “এবং তাদের উচিত যেন ক্ষমা করে দেয় এবং দোষত্রুটি উপেক্ষা করে” [আল-ক্বুরআন, ২৪:২২]। 

❏ আল্লাহ পাক ইরশাদ ফরমান: “এবং নিশ্চয় যে ব্যক্তি ধৈর্যধারণ করেছে এবং ক্ষমা করেছে, তবে এটা অবশ্য সৎ সাহসের কাজ”[আল-ক্বুরআন, ৪২:৪৩; মুফতী আহমদ ইয়ার খাঁন (رحمة الله) প্রণীত ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’]।


রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ধৈর্যধারণ ও দীর্ঘকাল দুঃখকষ্ট ভোগের ফলাফল সুস্পষ্ট। প্রতিটি মানুষেরই সময়ে সময়ে ধৈর্যচ্যুতি ঘটা একটা জানা ব্যাপার। কিন্তু মহানবী (ﷺ)-এর ক্ষেত্রে আঘাতের মাত্রা যতো বড় হতো, ততোই তাঁর ধৈর্যধারণ আরো বৃদ্ধি পেতো; অতিষ্ঠকারী লোকদের বাড়াবাড়ির মুখেই শুধু তাঁর ধৈর্যধারণ আরো বেড়ে যেতো।


❏ হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দুটো বিষয়ের মাঝে পছন্দ করার ক্ষেত্রে সহজতর বিষয়টি বেছে নিতেন, যতোক্ষণ পর্যন্ত তা ভুল হিসেবে বিবেচিত না হতো; ভুল কর্ম হলে তা হতে তিনি সবার চেয়ে বেশি দূরত্ব বজায় রাখতেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজের খাতিরে প্রতিশোধ নিতেন না, যতোক্ষণ না কোনো কিছু আল্লাহ (ﷻ)'র সম্মান (’হুরমা’) লঙ্ঘন করতো। অতঃপর তিনি আল্লাহর ওয়াস্তে প্রতিবিধানসূচক ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন।” [মুসলিম ও আল-বুখারী এবং আবূ দাউদ]


❏ বর্ণিত আছে যে, উহুদের জ্বিহাদে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যখন দাঁত মোবারক শহীদ হয় এবং পবিত্র মুখে আঘাত লাগে, তখন সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-এর জন্যে এ ঘটনা বাস্তবিক-ই অসহনীয় হয়ে দাঁড়ায়। তাঁরা বলেন, “আপনি যদি তাদের প্রতি শুধু লা’নত (অভিসম্পাত) দিতেন (তাহলেই তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হতো)!” মহানবী (ﷺ) উত্তর দেন, “আমাকে অভিসম্পাত দেয়ার জন্যে প্রেরণ করা হয়নি, বরঞ্চ (দ্বীনের প্রতি) আহ্বানকারী ও (খোদার) রহমত (তথা করুণা) হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। হে আল্লাহ! আমার জাতিকে হেদায়াত দিন (মানে সঠিক পথপ্রদর্শন করুন)। কেননা, তারা জানে না (সঠিক রাস্তা সম্পর্কে)।”


❏ আরেকটি বর্ণনায় হযরত উমর ফারূক (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্যে কুরবান হোন। পয়গম্বর নূহ (عليه السلام) তাঁর কওমের প্রতি অভিসম্পাত দিয়ে বলেছিলেন, ‘হে আমার রব্ব! পৃথিবীপৃষ্ঠে কাফেরদের মধ্য হতে কোনো বসবাসকারীকে (অস্তিত্বশীল) রাখবেন না’ [আল-ক্বুরআন, ৭১:২৬]। 

আপনি যদি অনুরূপ কোনো লা’নত আমাদের প্রতি দিতেন, তাহলে আমাদের শেষ ব্যক্তিটিও নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো। আপনার মোবারক পিঠ পদদলন করা হয়েছে, আপনার পবিত্র মুখমণ্ডল রক্তাক্ত করা হয়েছে, এবং দাঁত মোবারক-ও ভেঙ্গেছে, তথাপিও আপনি ভালো ছাড়া কোনো কিছু উচ্চারণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। আপনি বলেছেন, ‘হে আল্লাহ! আমার জাতিকে হেদায়াত দিন (মানে সঠিক পথপ্রদর্শন করুন)। কেননা, তারা জানে না (সঠিক রাস্তা সম্পর্কে)‘।”


❏ কাজী আবূল ফযল (رحمة الله) বলেন: চোখ চেয়ে দেখুন, উদারতার কী পূর্ণতা, এহসান তথা সদগুণাবলীর কী মাত্রা, চমৎকার চারিত্রিক উৎকর্ষ, মহত্ত্ব ও সীমাহীন ধৈর্যের নিদর্শন মহানবী (ﷺ)-এর এই কথায় ফুটে ওঠেছে! তিনি তাদের ব্যাপারে কেবল নীরবতায় সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং তাদের ক্ষমাও করে দিয়েছেন, তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়েছেন, করুণাশীল-ও হয়েছেন, তাদের জন্যে দোয়া ও শাফায়াত তথা সুপারিশ-ও করেছেন। তিনি (দোয়ায়) বলেন, “ক্ষমা” বা “পথপ্রদর্শন করুন”, অতঃপর তাদের অজ্ঞতার জন্যে ক্ষমা চেয়ে বলেন, “তারা জানে না।”


❏ একবার এক ব্যক্তি [হুনাইনের যুদ্ধে প্রাপ্ত গনীমতের মালামাল রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কর্তৃক বণ্টনের সময় মোনাফেক ও পরে খারেজী হিসেবে নিহত যুল-খোয়াইসারা] হুযূর পূর নূর (ﷺ)-কে বলে, “ইনসাফ করুন। কেননা, এভাবে অংশের বণ্টন আল্লাহর পুরস্কারপ্রাপ্তির উদ্দেশ্যে কৃত নয়।” এমতাবস্থায় তিনি শুধু ওই লোকের অজ্ঞতা প্রকাশের জন্যে পরামর্শের আকারে বলেন, “ধিক তোমার প্রতি! আমি ইনসাফ না করলে কে ইনসাফকারী হবে? ইনসাফ না করলে আমি-ই তো ব্যর্থ ও পথভ্রষ্ট হবো” 

[হযরত জাবের (رضي الله عنه) হতে মুসলিম বর্ণিত; আল-বুখারী ও আল-বায়হাক্বীতেও উদ্ধৃত]। অধিকন্তু,  তিনি ওই লোককে হত্যা করতে উদ্যত তাঁর সাহাবী (رضي الله عنه)-দের বাধাও দেন।


❏ গাওরাস্ ইবনে হারিস্ ও কিছু লোক যাতু’র রিক্বা অভিযান সম্পর্কে আলোচনা করার সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি মহানবী (ﷺ)-কে খুঁজে একটি গাছের নিচে বসা অবস্থায় পান। উন্মুক্ত তরবারি হাতে সামনে এসে দাঁড়ানো পর্যন্ত হুযূর পূর নূর (ﷺ) তাকে বাধা দেননি। তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে জিজ্ঞেস করেন, “কে আপনাকে আমার কাছ থেকে রক্ষা করবেন এখন?” রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জবাব দেন, “আল্লাহ।” (এ কথা শুনে ভয়ে কম্পমান হয়ে) গাওরাসের হাত থেকে তরবারি পড়ে যায় এবং মহানবী (ﷺ) তা উঠিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করেন, “কে তোমাকে আমার কাছ থেকে রক্ষা করবে এখন?” তিনি বলেন, “আমাকে সেরা পদ্ধতিতে শাস্তি দিন।” অতঃপর হুযূর পাক (ﷺ) তাঁকে ছেড়ে দেন এবং ক্ষমাও করেন। গাওরাস্ ইবনে হারিস্ তাঁর লোকদের কাছে ফিরে গিয়ে বলেন, “আমি তোমাদের কাছে এসেছি মানবজাতির মাঝে সেরা জনের সান্নিধ্য হতে।” [মুসলিম ও আল-বুখারী]


❏ মহানবী (ﷺ)-এর ক্ষমা করার শ্রেষ্ঠ নজির হচ্ছে এক ইহুদী রমনীর বেলায়, যিনি ভেড়ার গোস্তে তাঁকে বিষ প্রয়োগ করার পর তা স্বীকার করে ক্ষমা চাইলে তিনি তাকে মাফ করে দেন। [প্রাগুক্ত মুসলিম ও আল-বুখারী]


❏ লাবিদ ইবনে আ’যম বাণ-টোনা করার পর নবী করীম (ﷺ) তাকে ক্ষমা করে দেন, যদিও তিনি ওই ঘটনার আগেই এতদবিষয়ে ব্যাখ্যাসম্বলিত ওহী প্রাপ্ত হয়ে অবহিত ছিলেন। তিনি এমন কি তাকে তিরস্কারও করেননি, শাস্তি দেয়া তো দূরে। তিনি আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ও অন্যান্য মোনাফেক্কদের দ্বারা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ ও কুৎসা রটনার গুরুতর ঘটনা সত্ত্বেও তাদেরকে মাফ করে দেন। অপরদিকে, যে ব্যক্তি ইঙ্গিত করেছিলেন তাদের (মোনাফেক্বদের) কয়েকজনকে হত্যা করতে হবে, তাকে উদ্দেশ্য করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, “এ কথা যেন বলা না হয় যে মুহাম্মদ (ﷺ) তাঁর সাহাবা (رضي الله عنه)-বৃন্দকে হত্যা করেন।” [প্রাগুক্ত মুসলিম ও আল-বুখারী]


❏ হযরত আনাস (رضي الله عنه) বলেন, “আমি একবার রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর সাথে ছিলাম। ওই সময় তিনি একটি কালো আলখাল্লা পরা অবস্থায় ছিলেন। এক বেদুঈন আরব লোক তাঁর আলখাল্লা ধরে এমন জোরে হেঁচকা টান দেন যে সেটার শক্ত গলার ধার তাঁর মোবারক গলায় দাগ বসিয়ে দেয়। অতঃপর ওই বেদুঈন বলেন, ‘ওহে মুহাম্মদ (ﷺ)! আপনার অধীনে থাকা আল্লাহর সম্পদ দ্বারা আমার এই দুটি উট বোঝাই করতে আমাকে সুযোগ দেয়া হোক। আপনি তো আর আপনার নিজস্ব সম্পদ বা আপনার পৈতৃক সম্পদ হতে আমাকে তা করতে দেবেন না।’ কিছুক্ষণ চুপ থেকে হুযূরে পূর নূর (ﷺ) তাকে বলেন, ‘এই সম্পদ তো আল্লাহ (ﷻ)'র আর আমি হলাম তাঁরই বান্দা।’ এরপর তিনি আরো বলেন, ‘ওহে বেদুঈন, তুমি আমার সাথে যা করেছো,  সেজন্যে আমি কি এর কোনো প্রতিবিধান করবো?’ বেদুঈন উত্তর দেন, ‘না।’ মহানবী (ﷺ) জিজ্ঞেস করেন, ‘কেন নয়?’ বেদুঈন জবাব দেন, ‘কেননা, আপনি কোনো মন্দ কাজের প্রতিদান কোনো মন্দ কাজের মাধ্যমে দেন না।’ এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হেসে ফেলেন এবং এ মর্মে নির্দেশ দেন যেন একটি উট যব দ্বারা এবং অপরটি খেজুর দ্বারা বোঝাই করা হয় ।”[প্রাগুক্ত মুসলিম ও আল-বুখারী]  


❏ হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, “আমি কখনো দেখিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর প্রতি কৃত কোনো অন্যায়ের প্রতিশোধ নিয়েছেন – যতোক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহর এমন কোনো হুকুম হয়েছে যাকে সম্মান করতেই হতো। তিনি কাউকেই তাঁর হাত দিয়ে কোনো আঘাত করেননি, ব্যতিক্রম শুধু আল্লাহর রাস্তায় জ্বেহাদ করার সময় (মানে যুদ্ধক্ষেত্রে)। তিনি কখনোই কোনো সেবক বা নারীকেও আঘাত করেননি।” [প্রাগুক্ত মুসলিম ও আল-বুখারী]


❏ এক ব্যক্তিকে মহানবী (ﷺ)-এর সামনে আনা হয় এবং তার সম্পর্কে তাঁকে বলা হয়, “এই লোক আপনাকে হত্যা করতে চেয়েছিল।” রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে বলেন, “ভয় করো না! ভয় করো না! তুমি যদি আমাকে হত্যা করতেও চাইতে, তবুও আমাকে হত্যা করার সেই ক্ষমতা তোমায় দেয়া হতো না।” [ইবনে তাবারানী ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, সহীহ এসনাদ-সহ]


❏ মুসলমান হবার আগে যায়দ ইবনে সা’না (رضي الله عنه) হুযূর পূর নূর (ﷺ)-এর কাছে এসে তাঁর কাছে দেয়া হাওলাতের পাওনা দাবি করেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাঁধের জামা ধরে টানাটানি ও রূঢ় আচরণ করেন, আর তাঁকে বলেন, “বনূ আবদুল মোত্তালেব, তুমি (ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে) গড়িমসি করছো।” হযরত উমর (رضي الله عنه) তাকে হটিয়ে দেন এবং কঠোর ভাষায় তিরস্কার করেন। মহানবী (ﷺ) এই সময় শুধু স্মিত হাসেন। অতঃপর তিনি বলেন, “ওহে উমর, তোমার কাছ থেকে তার এবং আমার অন্য জিনিসের প্রয়োজন ছিল; (তা হলো) আমাকে সুষ্ঠুভাবে ঋণ পরিশোধ করতে বলা, আর তাকে ভালোভাবে (অর্থাৎ, সুন্দর আচরণের মাধ্যমে) তা আদায় করতে বলা।” তিনি আরো বলেন, “আমার দেনা এখনো তিনটি।” অতঃপর তিনি হযরত উমর (رضي الله عنه)-কে ওই ঋণ পরিশোধ করতে বলেন এবং তিনি তাতে আরো ২০ ‘সা’ বেশি যোগ করেন, যেহেতু হযরত উমর (رضي الله عنه) ওই ইহুদীকে তিরস্কারের মাধ্যমে আতঙ্কগ্রস্ত করেছিলেন। যায়দ ইবনে সা’না (رضي الله عنه)-এর বক্তব্য অনুযায়ী এটাই ছিল তাঁর ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কারণ। তিনি বলেন, “হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) এর মধ্যে নবুওয়্যতের দুটি নিদর্শন আমার তখনো দেখা বাকি ছিল: অল্পতে রেগে যাওয়ার পরিবর্তে ধৈর্য ধারণ ও চরম মূর্খতার মুখোমুখি হয়ে ধৈর্য ধারণ মাত্রার আরো বৃদ্ধি প্রাপ্তি। আমি এ বিষয়গুলোতে তাঁকে পরীক্ষা করেছিলাম এবং তাঁর সম্পর্কে যা বলা হয়েছিল, সে মোতাবেক-ই পেয়েছিলাম।” [আল-বায়হাক্বী, ইবনে হিব্বান, তাবারানী ও আবূ নু’য়াইম, সহীহ সনদে]


রাসূলে পাক (ﷺ)-এর ধৈর্য ধারণ ও শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও মাফ করে দেয়ার মাহাত্ম্যসম্পর্কিত হাদীসের সংখ্যা এতো বেশি যে সবগুলো এখানে উল্লেখ করা সম্ভব নয়। আমরা যেগুলো উদ্ধৃত করেছি, সেগুলোই যথেষ্ট হওয়া উচিত। 


❏ এই হাদীসগুলো বিভিন্ন সহীহ হাদীসের সংকলনে এবং অনেক আলাদা আলাদা এসনাদ-সহ অন্যান্য নির্ভরযোগ্য বইপত্রে উদ্ধৃত হয়েছে। কুরাইশ গোত্র কর্তৃক মহানবী (ﷺ)-এর প্রতি যে রূঢ় আচরণ করা হয়েছিল এবং জাহেলীয়্যা যুগে তাদের হাতে তাঁকে যে আঘাত ও কঠিন দুঃখকষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল – যতোক্ষণ না আল্লাহ (ﷻ) তাঁকে তাদের ওপর বিজয়ী করেছিলেন – এসব বর্ণনায় তা ফুটে ওঠেছে। (ফতেহ মক্কার পরে) কুরাইশ গোত্র সন্দেহ করেনি এ ব্যাপারে যে তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করা হবে এবং তাদের ধনাঢ্য লোকদেরকে হত্যা করা হবে, কিন্তু মহানবী (ﷺ) সবাইকে মাফ করে দিতেই থাকেন এবং তিনি কারোরই শাস্তি বিধান করেননি। তিনি জিজ্ঞেস করেন, “আমি তোমাদের সাথে যে আচরণ করবো, সে সম্পর্কে তোমরা কী বলো?” তারা উত্তর দেয়, “উত্তম (আচরণ), একজন উদার ভ্রাতা ও উদার ভাতিজা (হিসেবে)।” তিনি বলেন, “আমি ঠিক সেভাবেই বলছি, যেভাবে আমার ভাই ইউসূফ (عليه السلام) বলেছিলেন, ‘আজ তোমাদেরকে কোনো রকম তিরস্কার করা হবে না’ [আল-ক্বুরআন, ১২:৯২]। অতএব, যাও, তোমরা মুক্ত।”


❏ হযরত আনাস (رضي الله عنه) বলেন, “ফজরের নামাযের ওয়াক্তে আটজন লোক তা’নিম এলাকা  [মক্কার উত্তরে অবস্থিত, যেখান থেকে মক্কাবাসী মানুষ উমরাহ হজ্জ্বের জন্যে এহরাম বাঁধেন] হতে আগমন করে; এদের উদ্দেশ্য ছিল মহানবী (ﷺ)-কে হত্যা করার। কিন্তু এরা ধরা পড়ে যায় এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এদের মুক্ত করে দেন। আল্লাহ পাক এ মর্মে আয়াতে করীমা নাযিল করেন, ‘এবং তিনি-ই, যিনি তাদের হাতকে তোমাদের থেকে প্রতিরুদ্ধ করেছেন’।” [আল-ক্বুরআন, ৪৮:২৪] {হাদীসটি বিদ্যমান মুসলিম, আবূ দাউদ ও নাসাঈ শরীফে}


অনুরূপভাবে, 

❏ আবূ সুফিয়ান হুযূর পাক (ﷺ)-এর বিরুদ্ধাচারীদেরকে জোটবদ্ধ করা, তাঁর চাচা (আমীরে হামযা রাদিয়াল্লাহু আনহূ)-কে [আবূ সুফিয়ান ও তাঁর স্ত্রীর উস্কানিতে আবিসিনীয় গোলাম দ্বারা] হত্যা, অধিকন্তু অনেক সাহাবা (رضي الله عنه)-কে হত্যা এবং অন্য সাহাবা (رضي الله عنه)-দেরকে দৃষ্টান্তস্বরূপ বিকলাঙ্গ করা সত্ত্বেও যখন মহানবী (ﷺ)-এর সামনে তাঁকে আনা হয়, তখন তিনি তাঁকে ক্ষমা করে দেন এবং তাঁর সাথে নম্র আচরণ করেন। তিনি বলেন, “ওহে আবূ সুফিয়ান, আল্লাহ (ﷻ) আপনার প্রতি সদয় হোন। এখনো কি সময় হয়নি আপনার এ কথা জানার যে আল্লাহ (ﷻ) ছাড়া কোনো মা’বূদ (উপাস্য) নেই?” আবূ সুফিয়ান উত্তর দেন, “আমার পিতা ও মাতা আপনার জন্যে কুরবান হোন! আপনি কতোই না ধৈর্যশীল ও উদার, আত্মিয়তার বন্ধন (এখনো) বজায় রেখেছেন!” [আত্ তাবারানী ও আল-বায়হাক্বী]


রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ছিলেন মানুষের মাঝে রাগ হতে সবচেয়ে দূরে এবং তাঁর রেযামন্দি তথা সন্তুষ্টি লাভের বেলায় সবচেয়ে সহজতর।

________________

কিতাবঃ আশ শিফা [অসম্পূর্ণ]

মূল: ইমাম কাজী আয়াজ (رحمة الله)

অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন


সূত্রঃ 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন