আল্লাহ্ তায়ালা আদি-অন্তশূন্য। নিরারম্ভ এবং নিঃসমাপ্ত। তিনি ছাড়া অনাদি, অনন্ত বলে আর কিছু নেই।
আল্লাহ্ তায়ালা ছাড়া অন্য কোনোকিছুকে যদি কেউ অনাদি অনন্ত বলে, তবে সে কাফের।
এই কারণেই ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) ইবনে সিনা, ফারাবী এবং তাঁদের মতো অন্যান্য দার্শনিকদেরকে কাফের বলেছেন।
কেননা তাঁরা ‘দশ আকল’ অর্থাৎ জ্ঞান নীতি এবং নফস বা প্রাণকে অনাদি বলেছেন এবং হাইউল বা প্রত্যেক বস্তুর মূল আকার-আকৃতিকে (সুরত) অনাদি বলে ধারণা করেছেন।
আবার আকাশ এবং তাতে যা কিছু আছে, তার সবকিছুকেও অনাদি বলেছেন। হজরত খাজা বাকী বিল্লাহ্ (রহঃ) বলেছেন, ‘শায়েখ মুহিউদ্দিন ইবনে আরাবীর অভিমত এরকম যে, কামেল ব্যক্তিগণের রূহ অনাদি এরকম বাক্যের বাহ্যিক অর্থ গ্রহণীয় নয়। বরং এর ভাবার্থ গ্রহণ করাই সমীচীন, যাতে সকল সুষ্ঠু মতামতের মধ্যে ঐক্যের সূত্র অটুট থাকে’।
সর্বশক্তিমানতা
__________
আল্লাহ্ তায়ালা সর্বশক্তিমান এবং ইচ্ছাময়। ঔচিত্য ও বাধ্যতা তাঁর প্রতি আরোপিত হয় না। হতে পারে না। অজ্ঞ দার্শনিকেরা অবশ্য বলেন অন্যকথা। তাঁদের মতে সক্ষম ব্যক্তি যেমন কাজ করতে বাধ্য, আল্লাহ্ তায়ালাও তেমনি। কিন্তু, প্রকৃত ব্যাপার তা নয়। আল্লাহ্ পাক সর্বশক্তিমান, সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু, তিনি শক্তি প্রদর্শন করতে এবং সৃষ্টি করতে বাধ্য নন।
আল্লাহ্ পাকের এরশাদ এরকম-
‘ফাআ’লুললিমা ইউরিদ’ (নিশ্চয় তিনি যা ইচ্ছা তা-ই করেন)।
ওই দার্শনিকেরা যতই খ্যাতিমান হোন না কেনো, আদতে তারা মূর্খই। তারা তো মনে করেছে, বাধ্যতামূলকভাবে সৃষ্টিজগতকে সৃজনের পর অবশ্যম্ভাবী জাতপাকের আর কাজ নেই। আর প্রাত্যহিক কাজ ও ঘটনা সৃষ্টি করে ‘আকলে ফায়াল’ (কার্যকরী জ্ঞান যা প্রথম স্তরে অবস্থিত)। এই আকলে ফায়ালের অস্তিত্ব রয়েছে কেবল তাদের কষ্টকল্পনায়। বাস্তবে নয়। তাদের বিকৃত ধারণা অনুযায়ী যেনো আল্লাহ্ তায়ালার সঙ্গে তাদের কোনো সম্বন্ধই নেই। তাই তারা বিপদ ও কষ্টের সময় বাধ্য হয়ে আকলে ফায়ালের আশ্রয়প্রার্থী হয়। আল্লাহ্ পাকের প্রতি মোটেই লক্ষ্য করে না। কারণ, তাদের অসৎ বিশ্বাসে প্রাত্যহিক কার্যকলাপে আল্লাহ্ তায়ালা অধিকারহীন। প্রকৃতপক্ষে তারা আকলে ফায়ালের প্রতিও মনোযোগী নয়। কারণ বিপদ দূর করতে আকলে ফায়ালেরও নাকি কোনো অধিকার নেই। এরকমই ধারণা তাদের। এরা মূর্খতা ও বোকামিতে সকল পথভ্রষ্ট দলের নেতৃস্থানীয়। যারা কাফের, তারাও বিপদে আপদে আল্লাহ্ তায়ালার নিকট সাহায্যপ্রার্থী হয় এবং তাঁর নিকটই বিপদমুক্তি কামনা করে।
যতরকম পথভ্রষ্ট দল আছে, তাদের মধ্যে এ সকল বোকা দার্শনিকদের ভিতর দু’টি অতিরিক্ত ভ্রষ্টতা আছে।
১. তারা আল্লাহ্ তায়ালার অবতারিত হুকুম এবং সংবাদ (ওহী) অস্বীকার করে। শুধু তাই নয়, ওহীর সঙ্গে শত্রুতা ও হিংসা রাখে।
২. তাদের অর্থহীন উদ্দেশ্যের সমর্থনে কতকগুলি ব্যর্থ মুখবন্ধ উপস্থাপনের প্রয়াস পায়। মিথ্যার পক্ষে যুক্তি প্রমাণ দিতে গিয়ে তারা হয়েছে প্রায় পাগল এবং বিকৃতমস্তিষ্ক। তারা মনে করে, আকাশ এবং নক্ষত্রমণ্ডলী সকল কাজের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে। আকাশ এবং নক্ষত্র-নীহারিকার স্রষ্টা, ব্যবস্থাপক, পরিচালক ও বিধানদাতা যিনি, সেই পবিত্র এক আল্লাহর প্রতি তাদের কোনো খেয়ালই নেই। এরা সত্যিই বিস্ময়কর হতভাগ্যের দল। এদের চেয়েও অজ্ঞ ওই ব্যক্তিরা, যারা এদেরকে জ্ঞানী মনে করে।
এ সকল দার্শনিকদের চর্চিত বিদ্যার মধ্যে একটি হলো জ্যামিতি। মানুষের বিশাল বিস্তৃত জীবনপরিসরে (আলমে আরওয়াহ্ থেকে আখেরাত) এই বিষয়টির তেমন কোনো গুরুত্বই নেই। ত্রিভুজের তিনটি কোণের সমষ্টি দুই সমকোণের সমান এরকম জ্ঞান কোন কাজে লাগে? তাদের মর্মস্পর্শী প্রতিজ্ঞা হচ্ছে শাকলে আরছি (৪৭ প্রতিজ্ঞা) এবং শাকলে মামুনী (৫ম প্রতিজ্ঞা)।
এসকল প্রতিজ্ঞা করেই বা কোন উদ্দেশ্য সাধিত হয়? তাদের বিদ্যার মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিদ্যাবলী হচ্ছে এলমে তিব বা শরীরতত্ত! শাস্ত্র, এলমে নজুম বা নক্ষত্রবিদ্যা এবং চরিত্র সংশোধনবিদ্যা। এ সমস্ত এলেম পূর্ববর্তী রসুলগণের কিতাব থেকে তারা অপহরণ করে নিজেদের নামে চালিয়ে দিয়েছে। এই বিষয়টি ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) তাঁর ‘আল মুনকিজ আনিদ্ব্দ্বালাল’ গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে লিখেছেন।
দ্বীনদার ব্যক্তিরা নবী-রসুলগণের পথপ্রদর্শনের উপরেই প্রতিষ্ঠিত থাকেন। তাঁরা দলিল-প্রমাণে ভুল করলেও ক্ষতি নেই। কারণ তাঁদের নির্ভরতা পয়গম্বরগণের অনুসরণের উপর। দলিল প্রমাণ তাঁরা উপস্থাপন করেন প্রযোজনবশত বিরুদ্ধবাদীদের ধারণা পরিষ্কৃতির জন্য, অথবা আত্মকৌতুহল নিবারণের জন্য। কিন্তু মূর্খ দার্শনিকেরা এর বিপরীত। তারা পয়গম্বর (আঃ)-গণের অনুসরণ স্বীকার করে না। তাদের পূর্ণ নির্ভরশীলতা যুক্তি-প্রমাণের উপরেই যা খণ্ডিত, সীমাবদ্ধ, সন্দিগ্ধ, অসম্পূর্ণ বেং সিদ্ধান্তবিবর্জিত। এরা নিজেরা তো ভ্রষ্টই। একই সাথে অপরকেও ভ্রষ্টতার প্রতি আহবানকারী। এদের কোনো একজন শ্রেষ্ঠ দার্শনিকের নিকট হযরত ঈসা (আঃ)-এর নবুয়তের দাওয়াত উপস্থাপন করা হলে সে বলেছিলো ‘আমরা পথপ্রাপ্ত দল পথপ্রদর্শনকারীর প্রয়োজন আমাদের নেই’। কতো বড়ো মূর্খতা! কতো বড়ো দুর্ভাগ্য! যিনি মৃতকে জিন্দা করেন, জন্মান্ধ এবং কুষ্ঠরোগীকে নিরাময় দান করেন, তাঁর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করাই ছিলো জ্ঞানীর কাজ। কারণ, ওই সকল মোজেজা তো অপ্রকৃত জ্ঞানকে মুহূর্তেই নিভিয়ে দিয়ে মূল জ্ঞানশিখার সংস্পর্শ এনে দেয়। না দেখে, না বুঝে, না চিন্তা করে নবুয়তের আহবানের অস্বীকৃতি পূর্ণ হিংসা এবং নিখাদ মূর্খতা। তাদের বিদ্যাবত্তার মূল শিরোনাম ‘ফাল্সাফাহ্’ (দর্শনশাস্ত্র)। ফাল্সাফার অধিকাংশ অক্ষর সাফাহ্ বা মূর্খতা।
আল্লহ্ পাক এদের অপবিত্র বিশ্বাসের অন্ধকার থেকে আমাদেরকে রক্ষা করুন। আমিন।
শায়েখ মুহিউদ্দিন ইবনে আরাবীর বর্ণনাসমূহের মধ্যেও ঔচিত্য এবং বাধ্যবাধকতার ইঙ্গিত আছে। তিনি আল্লাহ্ তায়ালার ‘কুদরত’ বা ক্ষমতাগুণের অর্থ ও প্রয়োগের ব্যাপারে দার্শনিকদের মতের অনুকূল ধারণা রাখেন। দার্শনিকদের মতো তাঁরও মত এই যে, সক্ষম ব্যক্তির জন্য কাজ না করা বৈধ নয়। বরং কাজ করা তার জন্য অত্যাবশ্যক (আর আল্লাহ্ যেহেতু ক্ষমতাবান তাই কাজ করতে বা সৃষ্টি করতে তিনি বাধ্য) এরকম মত সত্যের প্রতিকূল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এরকম ভ্রান্ত মতামত ব্যক্ত করা সত্তেও শায়েখ মহিউদ্দিন আল্লাহ্ তায়ালার নিকট গ্রহণীয় ব্যক্তিগণের অন্তর্ভূত পরিলক্ষিত হচ্ছেন। কিন্তু তাঁর অধিকাংশ মতামত সত্যবাদী আলেমগণের বিরুদ্ধে। ইজতেহাদ বা মাসআলা উদ্ধারে ভুল হলেও যেমন মুজতাহিদ ব্যক্তি নিন্দিত বা তিরস্কৃত হন না, শায়েখ মুহিউদ্দিনের বিষয়টিও সেরকমই। তাঁর ভুল প্রকৃতপক্ষে কাশফের ভুল, যা ইজতেহাদী ভুলের মতো। হজরত মোজাদ্দেদে আলফে সানি (রহঃ) বলেন ‘শায়েখ মুহিউদ্দিনের প্রতি আমার খাস আকিদা এই যে, তিনি আল্লাহ্ তায়ালার দরবারে মকবুল। কিন্তু তাঁর অধিকাংশ কাশফ ভুল এবং সাধারণের জন্য ক্ষতিকর।সুফীগণের কোনো কোনো দল শায়েখকে নিন্দা-অপবাদ দেয় এবং তাঁর এলেমসমূহকে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা করে। আবার কোনো কোনো দল শায়েখের আনুগত্য করে এবং তাঁর সমস্ত এলেমকে শুদ্ধ ও সত্য বলে বিশ্বাস রাখে এবং বিভিন্ন দলিল-প্রমাণ দ্বারা শায়েখের মতামতকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করে। এই উভয় দল সরল সত্য মধ্যবর্তী পথ থেকে সরে গিয়েছে।শায়েখ আল্লাহ্ তায়ালার মকবুল ব্যক্তি। সুতরাং কীভাবে তাঁকে অস্বীকার করা যেতে পারে? আবার তাঁর এলেমসমূহের অধিকাংশই সত্যবাদী আলেমগণের মতের বিপরীত। সুতরাং কীভাবে সে সমস্তকে শুদ্ধ বলে স্বীকার করা সম্ভব? অতএব বর্ণিত অভিমতদ্বয়ের মধ্যাবস্থাই সত্য। আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর অপার অনুগ্রহে একথা আমাকে অবগত হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন।অবশ্য ‘ওয়াহ্দাতুল অজুদ’ (তওহিদের একটি অপরিণত ও বিখ্যাত ধারণা) এর মাসআলার মধ্যে সূফীগণের এক বিরাট দল একমত। এই মাসআলাটি বাহ্যত সত্যবাদী আলেমগণের বিপরীত মনে হলেও চিন্তা ও গবেষণাসাপেক্ষে, সমন্বয় অথবা সমাধানযোগ্য। এ অধম ফকির (হজরত মোজাদ্দেদে আলফে সানি) আমাদের হজরত খাজা বাকী বিল্লাহ (রহঃ) এর রুবাইয়াতের ব্যাখ্যায় এই মাসআলাটিকে সত্যবাদী আলেমগণের মতের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন। বিষয়টির জটিলতা শব্দ বিভ্রাটের উপর স্থাপন করে উভয় দলের দ্বিধা-সন্দেহ এমনভাবে উৎপাটিত করেছেন যে, প্রতর্কপ্রশ্রয়তার অবকাশ আর নেই’।
__________________
ইসলামী বিশ্বাস
কৃত: মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ
ইসলামী বিশ্বকোষ ও ইসলামিক বই সম্ভার
এপ্সে রয়েছে ২৩০ টি কিতাব
👉https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan
🌬যাজাকাল্লাহু খাইরান
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন