সৃষ্ট পদার্থ যেরকমই হোকনা কেনো- আশ্রয়নিরপেক্ষ অথবা আশ্রয়সাপেক্ষ, শরীর অথবা প্রাণ, আকাশ অথবা ভূত তুষ্টয় (আগুন, পানি, মাটি, বাতাস)— সকল কিছুই সর্বশক্তিমান এবং ইচ্ছাময় আল্লাহ্ তায়ালার সৃজনেচ্ছার প্রতি সম্পূর্ণতই নির্ভরশীল।
তিনিই সমগ্র সৃষ্টিকে অনস্তিত্বের অন্তরাল থেকে অস্তিত্বের দৃষ্টিগোচরতায় এনেছেন।
অস্তিত্বপ্রাপ্তি এবং স্থায়িত্ব লাভ, সকল ব্যাপারেই সৃষ্টি তাঁর মুখাপেক্ষী। সকল সামগ্রী-সরঞ্জাম (যেমন মাতাপিতার মধ্যস্থতায় সন্তান লাভ, ঔষধের মধ্যস্থতায় রোগ নিরাময়, পরিশ্রমের বিনিময়ে অর্থোপার্জন) তাঁর কাজের পর্দা এবং সকল বুদ্ধিকৌশল তাঁর কুদরতের আবরণ। তাও নয়। বরং উপকরণ-সামগ্রীকে তিনি তাঁর কাজের প্রমাণ এবং জ্ঞানবুদ্ধিকে তাঁর অসীম ক্ষমতার নিদর্শন করেছেন।
সৃষ্টির অস্তিত্ব ও স্থিতি সম্পূর্ণতই তাঁর মুখাপেক্ষী। তাঁর ইচ্ছা এবং অনুগ্রহেই জগতের সকল নিয়মশৃঙ্খলা, আবর্তন-বিবর্তন-অনুবর্তন-পরিবর্তন অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে। নতুবা জড় এবং অচেতন বস্তুপুঞ্জের সঞ্চালন, স্পন্দন আদৌ সম্ভব ছিলো না। জ্ঞানী ব্যক্তিগণ সহজেই বোঝেন যে, সৃষ্টির এই ভাঙাগড়া লীলারহস্যের পরিচালক, ব্যবস্থাপক এবং স্রষ্টা নিশ্চয়ই কেউ আছেন। আর যারা নির্বোধ, তারা সৃষ্টিকে স্বয়ং ক্ষমতাসম্পন্ন এবং আপনাআপনি সৃষ্ট মনে করে। এভাবেই তারা প্রকৃত স্রষ্টাকে অস্বীকার করে এবং নাস্তিকতার ভ্রান্তিকে সত্য বলে মনে করতে থাকে।
আল্লাহ্ তায়ালার এরশাদ,
‘ইউদ্বিল্লুবিহী কাছীরাঁও ওয়া ইয়াহ্দী বিহী কাছীরা’
অথ্যার্ৎ,
‘ইহা দ্বারা অনেকে পথচ্যুত হয়, আবার অনেকে হয় পথপ্রাপ্ত’। সুরা বাকারা, ২৬ আয়াত।
হজরত মোজাদ্দেদে আলফে সানি শায়েখ আহমদ ফারুকী সেরহিন্দি (রঃ) বলেন ‘আমার এই মারেফাত নবুয়তের তাক থেকে গৃহীত। সবাই এই তত্ত্বটি বুঝতে সক্ষম নয়। একদল সুফী মনে করেন, সরঞ্জাম বা মধ্যস্থতা উঠে যাওয়াই কামালাত বা পূর্ণতা। তারা সকলকিছুকে বিনা মাধ্যমে আল্লাহ্ তায়ালার প্রতি সম্পর্কিত করেন। তারা জানেন না যে, সরঞ্জাম-মধ্যস্থতা উঠে যাওয়া মানে আল্লাহ্ তায়ালার হেকমত বা কৌশল উঠে যাওয়া। অথচ হেকমতের ভিতরে বহু উপকার এবং কল্যাণ রয়েছে।
আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন—
‘রব্বানা মা খলাক্তা হাজা বাতিলা’
অথ্যার্ৎ,
হে আমাদের প্রতিপালক। এটা তুমি অনর্থক সৃষ্টি করোনি। আলে ইমরান, ১৯১ আয়াত।
নবী ও রসুলগণ সরঞ্জাম-মধ্যস্থতার প্রতি দৃষ্টি রেখে চলতেন এবং সকল কাজের ফলাফল আল্লাহ্ তায়ালার প্রতি ন্যস্ত করতেন।
মানুষের কুদৃষ্টির আশংকায় হজরত ইয়াকুব (আঃ) তাঁর পুত্রদেরকে বলেছিলেন ‘বৎসগণ, তোমরা এক দরোজা দিয়ে (বাদশাহর দরবারে) প্রবেশ করো না।ভিন্ন ভিন্ন দরোজা দিয়ে প্রবেশ করো'।
সূরা ইউসুফ, ৬৭ আয়াত।
এরকম উপদেশ দেওয়ার পর তিনি আল্লাহ্ তায়ালার প্রতি নির্ভরতা প্রকাশ করেছিলেন এভাবে— ‘আমি তোমাদেরকে আল্লাহ্ তায়ালার পক্ষের কোনোকিছু থেকে রক্ষা করতে পারবো না। আদেশ আল্লাহ্ তায়ালার অধিকারভূত। আমি তাঁর উপরেই নির্ভর করলাম এবং তাঁর উপরে নির্ভর করাই নির্ভরকারীগণের কর্তব্যকর্ম’।
আল্লাহ্ তায়ালা নবী ইয়াকুব (আঃ) এর এই মারেফাত এবং জ্ঞানকে পছন্দ করে বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই তিনি জ্ঞানবান, যেহেতু আমি তাঁকে জ্ঞান দান করেছি। কিন্তু অধিকাংশ লোক একথা জানে না’। সূরা ইউসুফ, ৬৮ আয়াত।
আমাদের নবী হজরত মোহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেও আল্লাহ্ তায়ালা সরঞ্জাম-মধ্যস্থতার পাঠ দিয়েছেন এভাবে— 'হে নবী! আপনার জন্য আল্লাহ্ তায়ালাই যথেষ্ট। তৎসহ আপনার আনুগত্যকারী মুমিনগণ’। সূরা আনফাল, ৬৪ আয়াত।
বস্তুসমূহ বা উপকরণ-সরঞ্জামাদির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার (তাছির) ব্যাপারটা আবার অন্যরকম। আল্লাহ্ তায়ালা যদি সরঞ্জাম-সামগ্রীতে তাছির সৃষ্টি করেন তবে উদ্দেশ্য সফল হয়। আর যদি না করেন তবে হয় না। সাধারণভাবে তাছির অস্বীকার করা গোয়ার্তুমির নামান্তর। তাছির স্বীকার করতে হবে। কিন্তু তাকেও বস্তুসামগ্রীর মতো আল্লাহ্ তায়ালার সৃষ্টবস্তু বলে জানতে হবে। এই ফকিরের অভিমত এরকমই। আল্লাহ্ পাক প্রকৃত বিষয়ের জ্ঞানদাতা’। উপরের আলো নায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, সামান-সরঞ্জামের মধ্যস্থতা গ্রহণ আল্লাহ্ পাকের উপর তাওয়াক্কোলবিরোধী নয়। বরং এরকম আচরণ পূর্ণনির্ভরতার পরিচায়ক। যেমন, রোগে ঔষধের মধ্যস্থতা, যুদ্ধে অস্ত্রসম্ভারের, ক্ষুধায় খাদ্যের। অর্থোপার্জনে চাকুরী বা ব্যবসার মধ্যস্থতা গ্রহণও তাওয়াক্কোলের অনুকূলেই থাকে। প্রতিকূলে নয়।
হজরত ইয়াকুব (আঃ) মধ্যস্থতা অবলম্বন করেই তাঁর তাওয়াক্কোলকে প্রকাশ করেছিলেন এভাবে— ‘তাঁরই প্রতি আমার নির্ভর এবং তাঁরই প্রতি নির্ভর করা নির্ভরকারীদের কর্তব্যকর্ম’। সূরা ইউসুফ, ৬৭ আয়াত।
সকল কাজের স্রষ্টা
_____________
আল্লাহ্ তায়ালা ভালো-মন্দ — সকল কাজের স্রষ্টা। কিন্তু তাঁর সন্তুষ্টি ভালো কাজের সঙ্গে এবং অসন্তুষ্টি খারাপ কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত।
‘ইচ্ছা’ এবং ‘সন্তুষ্টি’র মধ্যে সুক্ষ্ম পার্থক্য বিদ্যমান। স্খলনমুক্ত দল আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত কেবল এই পার্থক্যের প্রতি জ্ঞান রাখে। অন্যান্য দল এই পার্থক্যের জ্ঞান না পাওয়ায় ভ্রষ্টতায় নিপতিত। যেমন মোতাজিলা সম্প্রদায়ের বিশ্বাস— প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজ কাজের স্রষ্টা। আর কুকাজ এবং গোনাহর সৃষ্টিকর্তা মানুষই।
শায়েখ মুহিউদ্দিন এবং তাঁর অনুগামীগণের বক্তব্য থেকেও বুঝা যায় যে, ঈমান এবং সৎকর্ম যেমন আল্লাহ্ তায়ালার ‘আল হাদী’ নামের পছন্দনীয় এবং কাম্য, তেমনি কুফর এবং গুনাহ্ও তাঁর ‘আল মুদিল্লু’ বা ‘ভ্রষ্টকারী’ নামের মনঃপুত এবং অভীপ্সিত। তাঁর এই বাক্যও সত্যবাদী আলেমগণের বিরুদ্ধে এবং আল্লাহ্ তায়ালার প্রতি বাধ্যতা আরোপকারী। সূর্য যেমন কিরণ দিতে বাধ্য তার ইচ্ছা ও সন্তুষ্টির এখানে কোনো মূল্যই নেই। কিন্তু সূর্যের সৃষ্টিকর্তা তো সেরকম নন। বাধ্যতায় নয়, বরং স্ব-ইচ্ছায় ও অনুগ্রহে সকল কাজ তিনিই সৃষ্টি করেন। তাঁর সন্তোষ উত্তম কাজের সঙ্গে। আর অসন্তোষ অনুত্তম কাজের সঙ্গে। একথা অবশ্যস্মরণীয়।
বান্দাদেরকে ইচ্ছা করবার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। যাতে তাদের অর্জন তাদের নিজেদের ইচ্ছার কারণে হয়। অতএব, ব্যাপারটা দাঁড়ালো এরকম যে— ‘সৃজন’ আল্লাহ্ তায়ালার দিক থেকে আর ‘অর্জন’ বান্দাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
আল্লাহ্ তায়ালার ফিতরত বা আত্মভাব এরকম যে, বান্দারা কাজের ইচ্ছা করলে আল্লাহ্ তায়ালার সৃজনশৈলী তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয় এবং ঘটনা বা কাজে রূপ নেয়। বান্দার ইচ্ছাই যেহেতু কাজ সৃষ্টির সূচনা বা কারণ, তাই প্রশংসা অথবা তিরস্কার (সওয়াব অথবা গোনাহ্) তার প্রতিই বর্তায়। অনেকে বলেন, বান্দার ‘এখতিয়ার’ বা ইচ্ছাশক্তি দুর্বল। আল্লাহ্ তায়ালার এখতিয়ার বা ইচ্ছাশক্তির তুলনায়
দুর্বল একথা অবশ্য ঠিক, কিন্তু ‘নির্দেশিত কাজ সম্পাদনে তার ইচ্ছাশক্তি যথেষ্ট নয়’ একথা ঠিক নয়। কারণ আল্লাহ্ তায়ালা আয়ত্তাতীত বিষয়ের দায়িত্ব প্রদান করেন না।
এরশাদ হয়েছে—
‘বরং তিনি বান্দার প্রতি সহজ করতে চান। কঠিন করতে চান না’। সূরা বাকারা, ১৮৫ আয়াত।
পৃথিবীর সাময়িক কাজের বদলে চিরস্থায়ী বিনিময় প্রদান— আল্লাহ্ তায়ালারই অনুগ্রহসিক্ত পরিমান নির্ধারণ। নির্ধারিত হয়েছে যে, সাময়িক কুফরের প্রতিফল চিরস্থায়ী আজাব এবং সাময়িক ঈমানের বিনিময় চিরস্থায়ী বেহেশত।
আল্লাহ্ তায়ালার এরশাদ এরকম—
‘এটা মহাপরাক্রমশালী ও সুকৌশলী আল্লাহ্ তায়ালার পরিমাণ নির্ধারণ’। সূরা ইয়াসিন, ৩৮ আয়াত।
হজরত মোজাদ্দেদে আলফে সানি (রহঃ) বলেন, আল্লাহ্ তায়ালার দয়ায় আমরাও বুঝতে পারি যে, যিনি সকল প্রকার বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ নেয়ামত দান করেছেন, যিনি আকাশ ও পৃথিবীর স্রষ্টা— সকল পূর্ণতা, পবিত্রতা ও শ্রেষ্ঠত্ব তাঁর অস্তিত্বেই বিদ্যমান। এরকম পবিত্রতম সত্তার প্রতি অস্বীকৃতির প্রতিফল কঠিনতম হওয়াই যুক্তিযুক্ত। তাই অস্বীকৃতির শাস্তি চিরকাল দোজখবাস। অপরপক্ষে শয়তান এবং প্রবৃত্তির প্রাধান্য সত্ত্বেও পবিত্রতম, মহোত্তম ও অদৃশ্য আল্লাহ্ তায়ালার প্রতি ঈমান আনা এবং তাঁর প্রত্যাদেশকে সত্য জানার প্রতিদান সর্বশ্রেষ্ঠ হওয়াই শোভনীয়। অনন্ত বেহেশতবাস তাই তার পারিতোষিক নির্ধারণ করা হয়েছে। কোনো কোনো মাশায়েখ বলেছেন, বেহেশতলাভ আল্লাহ্ তায়ালার অনুগ্রহের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু একে ঈমানের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার কারণ এই যে, কর্মের প্রতিফল হিসাবে পারিতোষিক প্রাপ্তির ধারণা অধিক আনন্দময়। এ ফকিরের ধারণা, বেহেশতলাভ প্রকৃতপক্ষে ঈমানের প্রতিই নির্ভরশীল। আর ঈমান আল্লাহ্ তায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ অনুগ্রহ। নিছক দয়া। পক্ষান্তরে দোজখভুক্তি কুফরের প্রতি ন্যস্ত এবং কুফর নফসে আম্মারা, অর্থাৎ অসৎ প্রবৃত্তিজাত অপবিত্রতা।
আল্লাহ্ পাক এরশাদ করেন—
‘উৎকৃষ্ট যা কিছু তুমি পাও তা আল্লাহর দিক থেকে। আর নিকৃষ্ট যা কিছু লাভ করো তা তোমারই প্রবৃত্তিজাত’।
সূরা নিসা, ৭৯ আয়াত।
বেহেশতপ্রাপ্তি ইমানের কারণে জানা, প্রকৃতপক্ষে ঈমানকে সম্মান করা, বরং যাঁর প্রতি ঈমান আনা হয়েছে, তাঁরই সম্মান করা। এজন্যই চরমতম এবং উচ্চতম পারিতোষিক ঈমানদার বান্দাকে দেওয়া হয়েছে। আবার দোজখভুক্তিকে কুফরের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা কুফরকে অপমান করা এবং একই সঙ্গে পবিত্রতম ও অতুলনীয় ওই সত্তার সম্মান করা, যাঁর প্রতি অবিশ্বাস করা হয়েছে। তাই রমতম এবং নিকৃষ্টতম বিনিময় তার প্রতিদান।
___________________
ইসলামী বিশ্বাস
কৃত: মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ
ইসলামী বিশ্বকোষ ও ইসলামিক বই সম্ভার
এপ্সে রয়েছে ২৩০ টি কিতাব
👉https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan
🌬যাজাকাল্লাহু খাইরান
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন