হুজুর (ﷺ) উচ্চস্বরে দোয়া করার বর্ণনা
মিশকাত শরীফে বোখারী শরীফের উদ্ধৃতি দিয়ে এক বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়- একদা হুজুর (ﷺ) আল্লাহ্ তায়ালার দরবারে স্বীয় হস্ত মোবারক উত্তোলন করে নিম্নলিখিত দোয়া করেছিলেন-
اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي شَأْمِنَا اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي يَمَنِنَا .
অর্থাৎ- হে আল্লাহ্! আমাদের শাম (সিরিয়া) কে ধন্য কর; হে আল্লাহ্! আমাদের ইয়ামনকে তোমার কৃপা দ্বারা ধন্য কর।
তখন জনৈক সাহাবী আরজ করলেন- ‘আমাদের নজদকেও’। দ্বিতীয় বারও হুজুর (ﷺ) দোয়ায় শাম এবং ইয়ামনের কথাই উল্লেখ করেছেন। কিন্তু নজদের নাম উল্লেখ করেননি।
মোটকথা, হুজুর (ﷺ) ইয়ামন এবং শামের জন্য তিন বার দোয়া করেছেন এবং পরিশেষে নজদ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বানী করেছেন-
هُنَاكَ الزَّلَازِلُ وَالْفِتَنُ وَبِهَا يَطْلُعُ قَرْنُ الشَّيْطَانِ .
অর্থাৎ- সেখানে (নজদে) নানা প্রকার ভূমিকম্প ফিৎনা-ফ্যাসাদ এবং শয়তানের অনুসারী একটা দলের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে।
দেখুন, এ হাদিস দ্বারা উচ্চরবে দোয়া করা বৈধতা প্রমাণিত হল। কেননা, যদি হুজুর (ﷺ) উচ্চস্বরে দোয়া না করতেন তবে নজদবাসী নজদের জন্য দোয়া করার অনুরোধ কিভাবে করত? নীরব প্রার্থনা তো শুনা যায় না। সুতরাং উচ্চরবে দোয়া করার বৈধতা হুজুর (ﷺ)-এর পবিত্র ‘আমল’ দ্বারাই সুস্পষ্ট হয়ে উঠে; বরং তা উত্তমও বটে। আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেছেন-
ادْعُوا رَبَّكُمْ تَضَرُّعًا وَخُفْيَةً (سورة الأعراف)
আর এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) উল্লেখ করেছেন-
اى عـلانـيـة اوسـريـة
অর্থাৎ- সরবে ও নীরবে উভয় প্রকার দোয়া করার নির্দেশ দেয়া হয়। (তফসীরে ইবনে আব্বাস)
তফসীরে ছাবী ২য় খণ্ডে ৭০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়-
واعلم ان الانسان اذا كان وحده فالسر افضل له ان كان ينشط فى ذالك والا فالجهر افضل له كلجماعة .
অর্থাৎ- জেনে রাখ, একাকী প্রার্থনা নীরবে করা উত্তম; আর সম্মিলিত প্রার্থনা উচ্চরবে করাই শ্রেয়; যেমন লোক জামায়েতে। বাকী রইল- উচ্চরবে যিকির করার প্রসঙ্গ- কোরআন মজিদে উচ্চস্বরে যিকির করার প্রকাশ্য কিংবা অস্পষ্ট কোন নিষেধ নেই।
হযরত শাহ আবদুল আজিজ মোহাদ্দেছ দেহলভী (رحمة الله) এ প্রসঙ্গে বলেছেন- কোরআন করিমে ‘সরব-যিকির’-নির্দেশক প্রমাণই বিদ্যমান। যেমন- পূর্বোলেখিত আয়াত দ্রষ্টব্য।
‘জাআল্ হক’ এ হযরত হাকীমুল উম্মত (رحمة الله) উল্লেখ করেছেন- যে সব ফকীহ্ উচ্চরবে যিকির করা নিষিদ্ধ বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন; তারা স্বীয় দাবী প্রমাণে কোরআনের কোন আয়াত কিংবা কোন হাদিস উল্লেখ করেননি। তবে শুধু আল্লামা শামী (رحمة الله) প্রমাণস্বরূপ انه لايحب المعتدين (অর্থাৎ তিনি (আল্লাহ) সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না)- এ আয়াত উল্লেখ করেছেন। অতঃপর তার ব্যাখ্যায়- المجاهرين بالدعاء অর্থাৎ- চিৎকার সহকারে প্রার্থনাকারীদেরকে সীমালঙ্ঘনকারী হিসেবে অভিহিত করেছেন।
অতএব, বুঝা গেল যে, যিকিরে নিষেদ বা অবৈধতা সম্পর্কে কোন মন্তব্য এতে নেই। তাছাড়া হাদিস শরীফেও তার অবৈধতার প্রমাণ মিলে না। সুতরাং তা নিষিদ্ধ বলতে ‘মকরূহ তানজীহীর’ বেশী কিছু বলা যায় না। ‘মাকরূহ তান্জিহী’ জায়েজেরই পর্যায়ভূক্ত।
অনুরূপভাবে, মোশাররেহ তরীকায়ে মোহাম্মদীয়ায় বর্ণনা করেছেন-
هو يكره علٰى معنى انـه تارك الاولى .
অর্থাৎ- জানাজার সাথে পথচলার সময় উচ্চরবে যিকির করা মাকরূহ এ অর্থে যে তা অধিকতর উত্তম বর্জিত মাত্র। সুতরাং সর্বদা এটাই অনস্বীকার্য যে, যে সব ফকীহ্ উক্ত কাজটি মাকরূহ বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন; তাঁরাও তা ‘মাকরূহে তানজিহী’ বলেই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। (জা’আল্ হক- ৯ম খণ্ড, ৩৯১পৃ.)
মজার কথা হল আল্লামা শামী উক্ত কাজ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন-
قيل تحريما وقيل تنزيهًا
অর্থাৎ- তা কারো মতে ‘মাকরূহ তাহরীমি’ ও কারো মতে ‘মাকরূহ-তানজিহী’। তিনি এ বাক্যদ্বয়ে قيل (কর্তাবিহীন ক্রিয়া) দ্বারা মন্তব্যটা দুর্বল বলে ইঙ্গিত করেছেন। তিনি এ প্রসঙ্গে সঠিক মতামত কি তার সুস্পষ্ট বর্ণনা দেননি।
তদুপরি এ কাজটি সম্পর্কে ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله), ইমাম আবু ইউছুপ (رحمة الله) ও ইমাম মোহাম্মদ (رحمة الله) এর মত কোন স্বতন্ত্র কিংবা বিশেষ কোন মাজহাবের অনুসারী ‘মুজতাদিদের’ কোন সুস্পষ্ট মতামত নেই। অর্থাৎ তাঁরা তাকে মাকরূহ ‘তাহরীমী’ কিংবা ‘তান্জীহী’ বলে অভিহিত করেননি। তবে ফকীহদের মধ্যে আছহাবে আখ্রীজ এর মধ্যে কেউ কেউ তা মাকরূহ তাহরীমী, আর কেউ কেউ মাকরূহ তানজিহী, আবার কেউ কেউ তা উত্তম-বর্জিত বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। ফকীহ্গণের বিভিন্ন মন্তব্যাদি সম্বলিত কিতাবাদি পর্যালোচনা করলে তাই অনুমিত হয়।
‘জাআল হক’ এর ৩৯৪ পৃষ্ঠায় হযরত হাকীমুল উম্মত (رحمة الله) উল্লেখ করেছেন- ‘মুজতাহিদ’ (মুজতাহিদ হচ্ছে ইজতিহাদের শর্তাবলী সম্পন্ন ব্যক্তি, যিনি কোরআন ও হাদিসে গবেষণা করার যোগ্যতা রাখেন) ব্যতীত অন্য কারো (যাঁরা ‘মুজতাহিদ’ এর পর্যায়ে পড়ে না) মতামতের ভিত্তিতে ‘মাকরূহ তাহরীমী’ প্রমাণিত হয় না। কারণ ‘মাকরূহ তাহরীমী’ প্রমাণে শরীয়তের তদ্সংশ্লিষ্ট বিশিষ্ট ‘দলীলের’ই প্রয়োজন। তবে নগণ্য সংখ্যক ‘ফকীহ্র’ মতামতের ভিত্তিতে কোন কিছু ‘মোস্তাহাব’ বা জায়েজ বলে স্বীকৃত হতে পারে না। তাই ‘মোস্তাহাব’ এর সংজ্ঞায় একথাই বলা যায় যে, আলেমগণ যা মোস্তাহাব মনে করেন তাই ‘মোস্তাহাব’। কিন্তু মাকরূহ বা হারাম বলে কোন কিছু তখনই প্রমাণিত হয় যখন তা বিশেষ দলীল দ্বারা হারাম বা নিষিদ্ধ বলে প্রমাণিত হয়।
কাজেই, পরবর্তী যুগের আলেম সম্প্রদায় সাধারণ মুসলমানদের অবস্থা অবলোকন করে জানাজার সাথে পথচলার সময় উচ্চরবে যিকির করায় কোন ক্ষতি তো নেই; বরং মোস্তাহাব বলে ফতোয়া দিয়েছেন। তা আমাদের আহলে সুন্নাত ওয়াল জমাতের সমস্ত ওলামা-কেরামের নিকট গ্রহণীয়। তাই, মুসলিম সমাজে তা প্রচলিত হয়ে আসছে।
সর্বজনমান্য ইমাম হযরত আল্লামা শা’রানী (رحمة الله) বলেছেন-
كقول الناس اما الجنازة لا اله الّا الله محمد رسول اللهِ وقرأة احدن القرآن اما مهلو نحو ذالك ممن حرم ذالك فهو قاصر عن فهم الشريعة .
অর্থাৎ- যেমন জানাজার সম্মুখে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের কলেমা তৈয়্যবাহ পাঠ করা অথবা কোরআন করীম তেলাওয়াত করা যে ব্যক্তি হারাম বলে শরীয়তের জ্ঞান যোগ্যতা তার নেই বললেও চলে। (জাআল হক-১ম খণ্ড, ৩৮৯পৃ.)
আবার ইমাম শা’রানী (رحمة الله) অন্যত্র বলেছেন-
لا يجب انكاره فى هذا الزمان لانهم لم يشتغلوا الحديث الدنيا وذالك لان قلبهم فادغ من ذكر الموت .
অর্থাৎ- এ যুগে এ ধরণের যিকির থেকে নিষেধ করার কোন যৌক্তিকতা নেই এবং তা উচিৎও হবে না। কেননা, তারা যিকিরে মগ্ন না হলে পার্থিব বাজে কথাবার্তা আরম্ভ করবে। কারণ, তাদের অন্তর মৃত্যুর স্মরণ থেকে শূণ্য।
‘লাওয়াকেহুল আন্ওয়ায়িল কুদ্ছিয়াহ’ নামক কিতাবে উল্লেখ করা হয়, লেখক উল্লেখ করেছেন-
كان سيدى على الخواص رضى الله عنه يقول اذا علم من الماشيين مع الجنازة انهم لايتركون اللغو فى الجنازة يشتغلون باحوال الدنيا فينبغى ان نأمرهم بقول لا اله الّا الله محمد رسول الله، فان ذالك افضل من تركه ولا ينبغى الفقيه ان ينكر ذالك الّا بنص او اجماع . الخ
অর্থাৎ- আমার মাননীয় ওস্তাদ হযরত ‘আলী উল খাওয়াছ’ (رحمة الله) বলতেন- যখন একথা প্রতিভাত হয় যে, জানাজার সাথে যারা চলে, তারা যদি বাজে কথাবার্তা থেকে বিরত না থাকে, বরং পার্থিব আলাপ-আলোচনায় মগ্ন হতে থাকে, তখন তাদেরকে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ্ পাঠ করতে নির্দেশ দেয়া আমাদের উচিত। কারণ এমতাবস্থায় তা বাদ দেয়া অপেক্ষা পাঠ করাই শ্রেয় হবে। এতে বাধা সৃষ্টি করা কোন ফকীহর জন্য মোটেই উচিৎ হবে না। হ্যাঁ যদি কোরআন-হাদীস বা ইজমা লব্ধ দলীল দ্বারা তা নিষিদ্ধ বলে প্রমাণিত হয়, তবে তা বারণীয়।
তাতে বাধা এ জন্যই দেয়া হবে না যে, কলেমা তৈয়্যবাহ পাঠ করা হুজুর (ﷺ) এর সাধারণভাবে অনুমতি রয়েছে; যখনই চায়, তা পাঠ করতে পারে। এখানে সে সব অন্তরান্ধ ব্যক্তিদের ব্যাপারে আশ্চার্যান্বিত হতে হয়; যারা তা অস্বীকার করে এবং তাতে বাধা প্রদান করতে অপচেষ্টা চালায়। (জাআল হক, ১ম খণ্ড, ৩৮৮পৃ.)
উচ্চরবে ‘যিকির’ করা প্রসঙ্গে মৌলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী সাহেবের ফত্ওয়া দেখুন।
_____________
আল্-ক্বাওলুল হক্ব
(জানাজায় উচ্চরবে যিকির জায়েয প্রসঙ্গে)
রচনায়ঃ মুহাম্মদ আজিজুল হক আল-কাদেরী (رحمة الله)
অনুবাদঃ মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মন্নান (এম.এম.এম.এফ)
🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন