রূহে ইলাহী ও রূহে মুহাম্মদীর বর্ণনা

 

রূহে ইলাহী ও রূহে মুহাম্মদীর বর্ণনা


ফতোয়ায়ে নঈমিয়ার ১৯৫ পৃষ্ঠায় তাফসীরে রুহুল বয়ান এর সূত্রে উল্লে­খ রয়েছে যে, মুহাক্কেকীন সূফীয়ায়ে কেরাম বলেন, যেমনিভাবে হযরত ঈসা (عليه السلام) রূহে ইলাহী প্রাপ্ত হয়েছেন তেমনিভাবে গাউছে পাক (رحمة الله) রূহে মুহাম্মদী (ﷺ) প্রাপ্ত হয়েছেন। যখন হযরত ঈসা (عليه السلام) এর উপর রূহে ইলাহী এর প্রভাব অধিক হতো তখন তাঁর পবিত্র যবান দিয়ে انـى اخلق لكم অর্থাৎ নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করতে সক্ষম এর শ্লোগান নিঃসৃত হতো। তা বাস্তবে প্রকাশও হয়ে যেত। তেমনিভাবে শায়খ আব্দুল কাদের জিলানী (رحمة الله) এর উপর যখন রূহে মুহাম্মদী (ﷺ) এর প্রভাব অধিক হতো, তখন পবিত্র যবান থেকে এমন বাণী বের হতো যে, আমি হযরত নূহ (عليه السلام)কে সাহায্য করেছি এবং আমি হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام)কে নমরূদের আগুন থেকে রক্ষা করেছি। যে বাণীগুলোকে জনৈক বুজুর্গ ‘কছীদায়ে রূহী’ اشعار এর মধ্যে একত্রিত করেছেন।

 যেমন তিনি বলেন:

اَنَا كُنْتُ مَعَ نُوْحٍ بِفُلْكٍ اِذَا جَرَتْ                وَطُوْفَانٍ حَفَظْتُـه عَلٰى كَفِّ رَاحَتِىْ

اَنَا كُنْتُ مَعَ اِبْرَاهِيْمَ فِى النَّارِ مُلْقِيًا                وَمَا اُطْفِئَتِ النَّارُ اِلَّا بَفَتْلَتِىْ

اَنَا كُنْتُ مَعَ رُؤْيَا الذَّبِيْحِ مُشَاهِدًا                وَمَا اُنْزِلَ الْكَبْشُ اِلَّا بَفَتَواتِى

অর্থ: ১) মহা প্লাবনের সময় আমি হযরত নূহ আলাইহিস্ সালাম এর সাথে তাঁর নৌকায় ছিলাম। আর আমি তাঁকে আমার শান্তির হাতে এ মহা প্লাবন থেকে রক্ষা করেছি।



২) হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام)কে (নমরূদের) আগুনে নিক্ষেপ করার সময় আমি তাঁর সাথে ছিলাম। আমার হস্তক্ষেপের মাধ্যমেই ঐ প্রজ্বলিত আগুন নিভে গিয়েছিল এবং ঐ অগ্নিকুণ্ডলী শান্তি নিকেতনে পরিণত হয়েছিল।



৩) আমি সাইয়্যেদেনা ইসমাঈল যবীহুল্লাহ্ (عليه السلام)কে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে কুরবান দানের জন্য হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) স্বপ্নযোগে যখন আদিষ্ট হয়েছিলেন তখন আমি তাঁর সাথে উপস্থিত ছিলাম। বেহেশতের দুম্বাটি আমিই তথা হতে নামিয়ে এনেছি।



اِنِّـىْ اَخْلُقُ لَكُمْ হযরত ঈসা (عليه السلام) তাঁর কওমকে লক্ষ্য করে ঘোষণা করেছিলেন অর্থ: নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করতে পারি এ ঘোষণার ধ্বনি হযরত ঈসা (عليه السلام) এর ছিল না এবং হযরত গাউছে পাকেরও নয়। বরং এ ধ্বনিটি ছিল রূহে এলাহীর, আর হযরত গাউছে পাকের ধ্বনি ছিল রূহে মুহাম্মদীর। হযরত ঈসা (عليه السلام) اِنِّـىْ اَخْلُقُ لَكُمْ বলা সত্ত্বেও তাঁকে خالق বা স্রষ্টা বলা যাবে না এবং সকল নবীগণ থেকে তিনি শ্রেষ্ঠ এটাও বলা যাবে না। তেমনিভাবে গাউছে পাককে যেমন নবী বলা যাবে না। সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীন থেকে তাঁর মর্যাদা বেশীও বলা যাবে না।



সুতরাং হযরত ঈসা (عليه السلام) এর মর্যাদা দু’টি। একটি হলো রুহুল্লাহ্ অর্থাৎ আল্লাহর রূহ। দ্বিতীয় মর্যাদা হলো نبى الله অর্থাৎ আল্লাহর নবী। তেমনিভাবে হযরত গাউছে পাকের মর্যাদাও দু’প্রকার। একটি হলো কুতবিয়াতের মর্যাদা যা আদিকাল থেকে রসূলে পাকের মাধ্যমে তিনি অর্জন করেছিলেন। যা মুহাম্মদী দরবার হতে ইলমে লাদুন্নিয়া অর্জন করার পর হাসিল হয়েছিল। যে দিকে স্বয়ং কছীদায়ে গাউছিয়ায় ইঙ্গিত করা হয়েছে।



دَرَسْتُ الْعِلْمَ حَتَّـى صِرْتُ قْطْبًا



                       وَنِلْتَ السَّعْدَ مِنْ مَـوْلٰى الْمَـوَالِـىْ



অর্থাৎ: “আমি সঠিক ইলম শিখে কুতুব মর্যাদায় উন্নীত হয়েছি। আর এ সৌভাগ্য আমি আল্লাহ্ তায়ালার সাহায্যেই অর্জন করেছি। অর্থাৎ গাউছে পাকের বাণী হচ্ছে- প্রকৃত معرفت অর্জন করার জন্য কুরআনী সকল জ্ঞানে পূর্ণ দক্ষতা অর্জন করা আবশ্যক। ফিক্বহ, হাদীস এবং তাফসীর বিষয়ে পূর্ণ দক্ষতা যখন অর্জিত হবে তখন صالح বান্দা হওয়ার জন্য علم অর্জন করার সাথে আমল করাও জরুরী। এর সাথে আল্লাহ্ তায়ালার অনুগ্রহও সম্পৃক্ত থাকা আবশ্যক। আল্লাহ্ তায়ালার অনুগ্রহে দ্বীন সম্পর্কীয় যাবতীয় ইলম, জাহেরী ইলম ও বাতেনী যাবতীয় জ্ঞান আমি অর্জন করেছি। অতঃপর সৌভাগ্যের সকল স্তর অতিক্রম করে কুতুবে এরফান এবং হাক্বীক্বত এর আসনে আসীন হয়েছি। দ্বিতীয় মাকাম হচ্ছে, গাউছিয়াতের মাকাম। কছিদায়ে রূহীর মধ্যে شعر গুলোতে মাকামে কুতবিয়াত এর ধ্বনি ছিল। সে হিসেবে তিনি পূর্বাপর সকল আউলিয়াগণের সর্দার। যে ওলী তাঁর পূর্বে ছিল অথবা তার পরে হয়েছে এবং হতে থাকবে সবাই তাঁকে আদব করে থাকেন।



পূর্বেকার আউলিয়া বলতে বনী ইসরাঈল এর আউলিয়াগণকে বুঝানো হয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীনগণ নন। হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী (رحمة الله) বলেছেন, হযরত আবদুল কাদের জিলানী (رحمة الله) এর মর্যাদা শুধু তাঁর পরের আউলিয়াগণের উপর রয়েছে এটাই তার (مقام غوثيت) গাউছিয়াতের মাকাম। (মিরআত ইত্যাদি)



হুজুর গাউছে পাকের মাকাম, মাকামে কুতবিয়াতই হচ্ছে রূহে মুহাম্মদী। কেননা মুহাম্মদী কুতবিয়াতই হচ্ছে সবার সেরা। তাইতো হযরত মুহীউদ্দীন ইবনে আরবী (رحمة الله) ফতুহাতে মক্কীয়ার ২৪ ও ৬৬ পৃষ্ঠায় বলেছেন, জগতের প্রথম কুতুব সকল সৃষ্টিজীব হতে চার কোটি বছর আগে সৃষ্টি হয়েছেন। আর এ কুতুবই সকল আম্বিয়া (عليه السلام)কে সহায়তা করতে থাকেন। এ قطب اوّل দ্বারাই সকল সৃষ্টিজীবকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর ঐ قطب اوّل এর নামই হলো রূহে মুহাম্মদী (ﷺ)। হযরত ইবনে আরবী (رحمة الله) এর বাণী দ্বারা ঐ সকল রেওয়ায়েতের সত্যায়ন হয়েছে যা হুজুর (ﷺ) তার নিজ সৃষ্টি সম্পর্কে বিভিন্ন শব্দ দ্বারা বর্ণনা করেছেন। সুতরাং ইহা ঐ রূহে মুহাম্মদী হুজুরে গাউছে পাকের মধ্যে কোন মাধ্যম ছাড়াই আমানত রাখা হয়েছে। যেভাবে হযরত ঈসা (عليه السلام) এর মধ্যে রুহুল্লাহ্ কে আমানত রাখা হয়েছিল।



হুজুর (ﷺ) ইরশাদ করেছেন,



اَوَّلُ مَا خَلَقَ اللهُ نُوْرِىْ . اَوَّلُ مَا خَلَقَ اللهُ رُوْحِىْ وَغَيْره .



অর্থাৎ: আল্লাহ্ তায়ালা আমার নূর সর্বপ্রথম সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ্ তায়ালা সর্বপ্রথম আমার রূহকে সৃষ্টি করেছেন ইত্যাদি। মোদ্দাকথা হচ্ছে রূহ এবং নূর বিশেষ বীর্যের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয় না। বরং কখনো কখনো মাধ্যমসহ পিতার ললাট হতে স্থানাস্তরিত হয়ে থাকে। যেমন সকল নবীগণ (আলাইহিমুস্ সালাম) বিশেস করে হুজুর (ﷺ) এর নূর হযরত আব্দুল্লাহ (رضي الله عنه) এর ললাট হতে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন।



আল্লামা ইউসুফ নাব্হানী (رحمة الله) বলেছেন:



يَنْتَقِلُ نُـوْرُ النَّـبِـىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم مِنَ الْجَبِيْنَةِ اِلٰى الْجَبِيْنَةِ .



অর্থাৎ নবী করীম (ﷺ) এর নূর এক ললাট হতে অন্য ললাটে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন। সর্বপ্রথম এ পবিত্র নূর হযরত আদম (عليه السلام) এর ললাট মুবারকে স্থানান্তরিত হয়। আবার কখনো এ নূর কোন মাধ্যম ছাড়াই স্থানান্তরিত হয়। যেমন আল্লাহর রূহ হযরত ঈসা (عليه السلام) এর মধ্যে স্থানান্তরিত হয়েছিল।



এমনিভাবে গাউছে পাক আবদুল কাদের জিলানীর মধ্যে রূহে মুহাম্মদীও স্থানান্তরিত হয়েছে। উল্লে­খিত কছীদায়ে গাউছিয়ার شعر টি সে দিকেই ইঙ্গিত করেছে। সুতরাং এখানে قطب বলতে রূহে মুহাম্মাদীকেই বুঝানো হয়েছে। (ফতোয়ায়ে নঈমিয়া: ২৯৭)



সরকারে গাউছে পাক বলেছেন:



اَلْاَنْبِيَاءُ وَالْاَوْلِيَاءُ يُصَلُّوْنَ فِىْ قُبُوْرِهِمْ كَمَا يُصَلُّوْنَ فِىْ بُيُوْتِهِمْ .



অর্থ: আম্বিয়ায়ে কেরাম এবং আউলিয়াগণ তাঁদের কবরের মধ্যে এমনভাবে নামায পড়ে থাকেন যেমন তারা নিজ ঘরে নামাজ পড়তেন।



হযরত আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে ইয়াহ্ইয়া আন্নাযেফী আল হালবী (رحمة الله) (ওফাত ৯৬৩ হিজরী) বলেন:



اَقُوْلُ وَقَدْ اِنْعَقَدَ الْاِجْمَاعُ مِنْ جَمَاهِيْرِ الْاَشْيَاخِ مِنَ الْفُقَهَاءِ وَالْفُقْرَاءِ وَتَضَمَّنَتِ الْكُتُبُ الْمُدَوَّنَـةُ انّ اَصْحَاب التَّصرِيْف التَّام مِنَ السَّادَةَ القَادَة الْاَوْلِيَاءِ فِىْ حَيَاتِهِمْ وَفِى قُبُوْرِهِمْ بَعْدَ وَفَاتِهِمْ كَتَصْرِيف الْاَحْيَاءِ اِلٰى يَوْمِ القِيمٰةِ بِتَخْيصٍ مِنَ اللهِ تَعَالٰى لَهُمْ . (قلائد صـ৩৭ )



وَهُمُ الشَّيْخ عَبْدُ الْقَادِرِ الْجِيْلِى وَالشَّيْخُ مَعْرُوْف الكرْخِىْ وَالشَّيْخِ عقِيْلُ مَنْبَجِىْ وَالشَّيْخ حَيَاةُ بْنُ قَيْس الحَرَّانِى رَضِىَ اللهُ عَنْهُمْ وَ اِنَّ السَّادة الْبَرَرَة اَرْبَعَةٌ .



অনুবাদ: আমি বলছি, আউলিয়ায়ে কেরাম জীবদ্বশায় ও ওয়াফাতের পর তাঁদের কর্মতৎপরতার বিষয়ে জমহুর উলামা ও মাশায়েখগণ এ কথার উপর ঐক্যমত পোষণ করেছেন।



মুসলিম মিল্লাতের প্রসিদ্ধ কিতাবগুলোতে এ প্রসঙ্গে অনেক প্রমাণ রয়েছে যে, আল্লাহর অলীগণ পরিপূর্ণ প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা রাখেন- যাদেরকে আল্লাহ্ তায়ালা বাছাই করে এ ধরনের খাছ বান্দাগণের   অন্তর্ভূক্ত করে থাকেন। পার্থিব জীবনে যেমনি করে তাঁদের থেকে বিভিন্ন কর্মতৎপরতা ও অসাধারণ কারামত প্রকাশ হয়ে থাকে তেমনিভাবে তাঁদের ইন্তেকালের পরেও কবরের জিন্দেগীতেও প্রকাশ হয়ে থাকে। তাঁদের অন্যতম হলেন, হুজুর সাইয়্যেদেনা গাউছুল আজম আবদুল কাদের জিলানী, শায়খ মা’রুফ কারখী, শায়খ আকীল আল মনজবী ও শায়খ ইবনে কায়েস আল হাররানী যারা সমস্ত আউলিয়া কেরামগণের সর্দার হয়ে থাকেন। আর চারজন হলেন سادات صلحاء গণের অন্যতম।



اَيْضًا اَلَّذِيْنَ يُبْرِئُوْنَ الْاَكْمَهَ وَالْاَبْرَصَ وَيُحْيُوْنَ الْمَوْتٰى بِاِذْنِ اللهِ تَعَالٰى وَهُمْ اَلْقُطْبُ الْغَوْثُ الشَّيْخُ مُحِىُّ الدِّيْنِ عَبْدُ الْقَادِرْ جِيْلَانِى .



অর্থ: যাঁরা জন্মান্ধ, শ্বেতরোগীদের আরোগ্য করতে পারেন। আল্লাহর অনুমতি নিয়ে তাঁরা মৃতকে জীবিত করতে সক্ষম। আর তাঁদের মধ্যে অন্যতম কুতুবুল আকতাব হযরত গাউছ পাক শায়খ সাইয়্যেদ মুহীউদ্দীন আবদুল কাদের জিলানী (رحمة الله)। (কালায়েদ: ৩৭)।

_____________

কালামুল আউলিয়া ফি শানে ইমামিল আউলিয়া

রহমাতুল্লাহে তায়ালা আলাইহিম আজমাঈন

রচনায়:মুহাম্মদ আজিজুল হক আল্-কাদেরী

অনুবাদ: অধ্যক্ষ আল্লামা মুহাম্মদ নুরুল আলম খাঁন

 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন