পবিত্র কোরআনে সীমালঙ্ঘনকারী বলতে কি বুঝায়েছে এর বর্ণনা
আল্লামা শামী এ প্রসঙ্গে যে দলিল পেশ করেছেন-
انه لا يحب المعتدين اى الجاهرين بالدعاء .
অর্থাৎ- আল্লাহ্ সীমালঙ্ঘনকারী অর্থাৎ উচ্চরবে প্রার্থনাকারীকে পছন্দ করেন না। তা উপরোক্ত দলিলাদির তুলনায় গ্রহণীয় নয়। (কারণ) আল্লামা শামীর ওস্তাদ আল্লামা খাইরুদ্দীন রমলী (رحمة الله) (আল্লামা শামী কর্তৃক উল্লেখিত আয়াতের) উক্ত তফসীরের জবাবে উল্লেখ করেছেন-
لا يحب المعتدين بالجهر بالدعاء مردود بانّ الراجح فى تفسيره التجاوز عن المامور به .
অর্থাৎ- উক্ত আয়াতের সর্বাধিক গৃহীত তফসীর হল কোন কাজে ‘শরীয়তের নির্দেশিত সীমালঙ্ঘন করা, উচ্চরবে প্রার্থনা করা নয়’। কাজেই শেষোক্ত তফসীর (উচ্চরবে প্রার্থনা করা) ত্রুটিপূর্ণ ও বর্জনীয়।
ফতোয়া খাইরিয়্যাহ’ ২য় খণ্ডের ১৮১ পৃষ্ঠায় আল্লামা শামীর উক্ত অভিমতের অন্য এক জবাবে উল্লেখ করা হয়- উক্ত আয়াতে দোয়া বা প্রার্থনার কথাই উল্লেখ করা হয়েছে; সাধারণভাবে আল্লাহর যিকিরের নয়। আমাদেরও একথা জানা আছে যে, নীরবে দোয়া বা প্রার্থনা করা উত্তম; যেহেতু তাতে একাগ্রতার প্রকাশ পায়।
তফসীরে ‘মুজহেরী’-সূরা আ’রাফ, ৪০৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়-
فان الاخفاء دليل الاخلاص وابعد من الرياء .
অর্থাৎ- নীরবতা ‘ইখলাছ’ বা একাগ্রতার চিহ্ন এবং লোক দেখানো থেকে মুক্ত। উক্ত তফসীর গ্রন্থের ৪১০ পৃষ্ঠায় উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করা হয়-
قيل المعتدين فى الدعاء كمن سأل منازل الانبياء او الصعود الى السماء او دخول الجنّة قبل ان يموت ونحو ذالك ممّا يستحيل عقلا او عادة او يسئل امورا لافائدة فيها معتدا بها .
অর্থাৎ- দোয়া প্রার্থনায় সীমালঙ্ঘন করা, যেমন- কেউ যদি নবী (আ.)-এর মর্যাদা প্রার্থনা করে, কিংবা আসমানে আরোহণের আকাঙ্খা ব্যক্ত করে, অথবা মৃত্যুর পূর্বেই বেহেশতে প্রবেশের সুযোগ চেয়ে বসে- এ ধরণের ‘দোয়া’ অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিক; অসম্ভবও বটে অথবা এমন কিছুর প্রার্থনা করা যাতে কোন লাভ বা ক্ষতি নেই। দোয়ায় এ ধরণের সীমালঙ্ঘনই আল্লাহ্ তায়ালার অপছন্দনীয়।
উক্ত তফসীরের ৪১১ পৃষ্ঠায় আল্লামা কাজী ছানাউল্লাহ পানিপথি (رحمة الله) উক্ত আয়াতের অধিকতর গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিয়ে উল্লেখ করেছেন-
الاعتداء التجاوز عن حــد ود الشـرع .
অর্থাৎ- اعتداء শব্দের অর্থ হল শরীয়তের বিধিতে সীমালঙ্ঘন করা।
‘তাফ্সীরে জালালাঈন’ শরীফে উল্লেখ করা হয়-
لايحب المعتدين فى الدعاء بالتسدق ورفع الصوت .
অর্থাৎ-একাগ্রতা ব্যতিরেকেই দোয়াকে অহেতুক দীর্ঘায়িত করা কিংবা অবাঞ্চিত ধরণের উচ্চরব সহকারে দোয়া করা আল্লাহর অপছন্দনীয়।
তফসীরে বায়দাবীর ১২৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়-
انه لايحب المعدين المجاوزين ما امروا فى الدعاء .
অর্থাৎ- দোয়ায় নির্ধারিত সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে আল্লাহ্ ভালবাসেন না।
তফসীরে ‘মাদারেক’ এ উল্লেখ করা হয়-
انه لا يحب المعتدين المجاوزين ما امروا به فى كل شئ من الدعاء .
অর্থাৎ- দোয়ায় যে সব বস্তুর প্রার্থনা করার সীমা নির্ধারিত হয় তা লঙ্ঘনকারীদেরকে আল্লাহ্ পছন্দ করেন না।
তফসীরে খাজেন ২য় খণ্ডের ২৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়-
لا يحب المعدين يعنى فى الدعاء .
অর্থাৎ- অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিক কিছু প্রার্থনা করে যারা দোয়ায় সীমালঙ্ঘন করে আল্লাহ্ তায়ালা তাদেরকে পছন্দ করেন না।
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মৌলানা আশরফ আলী থানভী তফসীরে বয়ানুল কোরআন ৪র্থ খন্ডের ১৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন- ‘‘তোমরা সর্বদা ও সর্বাবস্থায় স্বীয় প্রতিপালকের দরবারে প্রার্থনা কর প্রকাশ্যে কিংবা নিরবে। তবে, বাস্তবিক পক্ষে, আল্লাহ্ তায়ালা সে সব ব্যক্তিদের ভালবাসেন না, যারা দোয়ায় ‘আদব’ বা শালীনতার সীমালঙ্ঘন করে। উদাহরণস্বরূপ- কেউ এমন কিছু প্রার্থনা করল যা অযৌক্তিক ও শরীয়তের দৃষ্টিতে অসম্ভব বা মানবীয় প্রকৃতির পরিপন্থী। অথবা এমন কিছু প্রার্থনা করল; যা শরীয়ত মতে নিষিদ্ধ বা অস্বাভাবিক। যেমন- কেউ খোদায়ী, নবুয়ত, ফেরেশতাদের উপর স্বীয় প্রাধান্য বিস্তারের ক্ষমতা, কিংবা অবিবাহিত মহিলার সাথে মেলামেশার অনুমতি এবং ‘জান্নাতুল ফেরদাউসের’ ডান পার্শ্বে একটা মনোরম শুভ্রদালান ইত্যাদির প্রার্থনা করল। এ ধরণের প্রার্থনা আল্লাহর সঙ্গে বেয়াদবী করারই শামিল। অবশ্য ‘জান্নাতুল ফেরদৌস’ লাভের দোয়া কাম্য ও মার্জনীয়। তবে এতে অতিরিক্ত শর্তাবলী আরোপ করা নিষিদ্ধ।
তফসীরে ‘খাজায়েনুল এরফান’ এ উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত ছদরুল আফাজেল (رحمة الله) উল্লেখ করেছেন যে, আল্লাহ্ তায়ালার দরবারে মঙ্গল কামনাই হল ‘দোয়া’। তা অবশ্যই এবাদতের শামিল। কেননা প্রার্থনাকারী তখন নিজেকে নিতান্তই বিনয়ী ও শরণাপন্ন মনে করে; আর স্বীয় প্রতিপালককে সর্বশক্তিমান ও প্রকৃত ব্যবস্থাপক জ্ঞানে একাগ্রচিত্তে স্মরণ করে।
এ জন্যই হাদিস শরীফে এরশাদ করা হয়- الدعاء مخّ العبادات অর্থাৎ- ‘দোয়াই এবাদতের সারবস্তু। আর আল্লাহ্ তায়ালা ’تضرع‘ সহকারে দোয়া করার শিক্ষা দিয়েছেন। تضرع মানে স্বীয় লাজুকতা ও বিনয় প্রকাশ করা। এ প্রসঙ্গে হযরত হাছান বসরী (رضي الله عنه) এর অভিমত হল যে, নিম্নস্বরে (বিনয়ের সাথে) দোয়া করা উচ্চরবে দোয়া করার চাইতে সত্তর গুণ অধিক উত্তম। অতঃপর উল্লেখ করা হয় যে, দোয়ায় সীমালঙ্ঘন কয়েক প্রকারের হতে পারে। তন্মধ্যে অতীব উচ্চস্বরে দোয়া করা অন্যতম। আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের আলেম সম্প্রদায়ও দোয়ায় চিৎকাররূপী উচ্চস্বর পছন্দ করেন না।
এখন দেখুন; আল্লামা শামী (رحمة الله), উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় কি অভিমত ব্যক্ত করেছেন? তিনিও এ আয়াতের তফসীরে- المجاهرين بالدعاء (দোয়ায় স্বর-সীমালঙ্ঘনকারী) শব্দদ্বয় উল্লেখ করে উচ্চস্বরে দোয়া করা অনুচিত বলেই উল্লেখ করেছেন; উচ্চস্বরে যিকির করা সম্পর্কে কোন মন্তব্য করেননি। বস্তুত দোয়া ও ‘যিকির’ এর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। উভয়ের মধ্যেকার পার্থক্য হল, ‘বিশেষ’ ও ‘সাধারণ’ বা ‘কমব্যাপকার্থক’ ও ‘অধিক ব্যাপকার্থক’ এর মধ্যকার সম্পর্ক বা পার্থক্যের ন্যায়। যেমন হুজুর (ﷺ) এরশাদ করেছেন-
أَفْضَلُ الذِّكْرِ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَأَفْضَلُ الدُّعَاءِ الاسْتَغْفار .
অনুরূপভাবে-
أَفْضَلُ الذِّكْرِ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَأَفْضَلُ الدُّعَاءِ قَوْلُ الْحَمْدُ لِلهِ .
অর্থাৎ- ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ সর্বোৎকৃষ্ট ‘যিকির’ আর সর্বোৎকৃষ্ট দোয়া হল ‘ইস্তেগফার’ বা স্বীয় গুনাহর ক্ষমা প্রার্থনা করা। অন্য হাদিসে বলা হয়, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ পাঠ করা উৎকৃষ্টতম ‘যিকির’ এবং উৎকৃষ্টতম দোয়া হল ‘আলহামদুলিল্লাহ্’ বলা।
সুতরাং উভয় শব্দের মধ্যে পার্থক্য কি- তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কাজেই উল্লেখিত আয়াত আলোচ্য বিষয়ে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে না এবং তা আমাদের প্রতি অপবাদেরও সুযোগ দেবে না। কেননা আমরা তার পরিপন্থী নই; বরং তদানুযায়ী যথাযথভাবে আমরা আমল করি।
উল্লেখিত উদ্ধৃতি ও বর্ণনা থেকে সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হচ্ছে যে, উক্ত আয়াতের অর্থ (তফসীর) হল- দোয়ায় সীমালঙ্ঘনকারী আল্লাহর ভালবাসা অর্জনে অক্ষম; যদি সে নিম্নস্বরে এমন সব বস্তুর জন্য প্রার্থনা করে যা অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিক; কিংবা দোয়ায় মার্জনীয় কন্ঠসীমা অতিক্রম করে, তবেই সে ব্যক্তি দোয়ায় সীমালঙ্ঘনকারীদের পর্যায়ভূক্ত হিসেবে চিহ্নিত হবে।
হযরত ইবনে জুরাইজ (رضي الله عنه) বলেছেন-
الرافعين اصواتهم بالدعاء وعنه الصياح فى الدعاء مكروه وبدعة .
অর্থাৎ- দোয়ায় চিৎকার করা মকরূহ ও বিদয়াত।
তফসীরে মাদারেক ও অন্যান্য তফসীর গ্রন্থসমূহেও এ ধরণের অভিমত রয়েছে।
বিশেষেতঃ এখানে একটা মাছআলা স্মরণ রাখা দরকার যে, দোয়া যদি কেউ একাকী করে তবে তার জন্য নীরবে করাই উত্তম। আর সম্মিলিতভাবে দোয়া করলে সরবে করাই শ্রেয়। কেননা এতে অন্যান্য লোকেরা ‘আমীন’ বলার সুযোগ পাবে। এ প্রসঙ্গে হুজুর (ﷺ) এরশাদ করেছেন-
لا يجمع ملأ فيدعوا بعضهم ويؤمن بعضهم الّا اجابهم الله .
মুসলমানদের কোন জমায়েতে যদি কেহ দোয়া করে আর অন্যান্যরা ‘আমীন’ বলে, তবে সে দোয়া আল্লাহ্ নিশ্চয় কবুল করেন।
_____________
আল্-ক্বাওলুল হক্ব
(জানাজায় উচ্চরবে যিকির জায়েয প্রসঙ্গে)
রচনায়ঃ মুহাম্মদ আজিজুল হক আল-কাদেরী (رحمة الله)
অনুবাদঃ মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মন্নান (এম.এম.এম.এফ)
🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন