সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! আমি সর্বপ্রথম রাসূল (ﷺ) সৃষ্টি এ বিষয়ক কতিপয় হাদিসে পাক উল্লেখ করলাম, এছাড়াও হাদিসের জাবের (رضي الله عنه)সহ আরও কিছু হাদিস সামনে উল্লেখ করা হবে, ইন শা আল্লাহ
এখানে আমি এ বিষয়ের পক্ষে বিভিন্ন মুহাদ্দিস, ইমামদের অভিমত কি তা আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
১. বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) লিখেন-
وَأَمَّا نُورُهُ عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ فَهُوَ فِي غَايَةٍ مِنَ الظُّهُورِ شَرْقًا وغَرْبًا وَأَوَّلُ مَا خَلَقَ اللَّهُ نُورَهُ وَسَمَّاهُ فِي كِتَابِهِ نُورًا وَفِي دُعَائِهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اللَّهُمَّ اجْعَلْنِي نُورً ... لَكِنَّ هَذَا النُّورَ لَيْسَ لَهُ الظُّهُورُ إِلَّا فِي عَيْنِ أَهْلِ الْبَصِيرَةِ [فَإِنَّهَا لَا تَعْمَى الأَبْصَارُ وَلَكِنْ تَعْمَى الْقُلُوبُ الَّتِي فِي الصُّدُور
-‘‘সৃষ্টির সর্বত্র প্রিয় নবীর নূরানী সত্ত্বাই সর্বাধিক পরিচিত ও প্রকাশিত। আল্লাহ্ তা‘য়ালা তাঁরই নূরানী সত্ত্বাকে সর্বাগ্রে সৃষ্টি করেছেন। পবিত্র কোরআনে তাকে নূর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তিনি তার প্রার্থনায় বলেছেন, আল্লাহ্ আমাকে নূরানী সত্ত্বায় প্রতিষ্ঠিত রাখুন। ....এতদ্সত্তে¡ও তার নূরানী সত্ত্বা বস্তু জগতে একমাত্র অন্তর্দৃষ্টি সম্পূর্ণ মানুষের কাছেই প্রজ্জ্বলিত। (কেবল কপালের চোখে প্রিয় নবীর নূরানী সত্ত্বার যিয়ারত সম্ভব নয়) আল্লাহ পাক বলেন, কপালের চোখ তো অন্ধ নয়, বরং অন্ধ হচ্ছে বক্ষস্থিত হৃদয় বা অন্তর্দৃষ্টি।’’
(আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী, আসরারুল মারফূআ, ৪০৪ পৃ.)
২. আল্লামা নূর উদ্দিন মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) স্বীয় ‘শরহে শামায়েলে তিরমিযী’ গ্রন্থের (মুলতান থেকে মুদ্রিত) ১ম খণ্ডের, ১৪৬ পৃষ্ঠায় লিখেন,
أَنَّ أَوَّلَهَا النُّورُ الَّذِي خُلِقَ مِنْهُ - عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ-
-‘‘সর্বপ্রথম সৃষ্টি সেই মহান ‘নূর’ যার দ্বারা হুযূর (ﷺ) কে সৃষ্টি করা হয়েছে।’’ ৬২
➥{মোল্লা আলী ক্বারী : মেরকাত : ১/২৪১ পৃ., হা/৭৯ }
৩. আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘মিরকাতুল মাফাতীহ’ এর ১ম খণ্ডের ১৬৭ পৃষ্ঠায় ঈমান বিল-ক্বদর অধ্যায়ে সর্বপ্রথম কোন বস্তু সৃষ্টি তা সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে বলেন,
فَالْأَوَّلِيَّةُ إِضَافِيَّةٌ، وَالْأَوَّلُ الْحَقِيقِيُّ هُوَ النُّورُ الْمُحَمَّدِيُّ عَلَى مَا بَيَّنْتُهُ فِي الْمَوْرِدِ لِلْمَوْلِدِ............ وَرُوِيَ: أَنَّ أَوَّلَ مَا خَلَقَ اللَّهُ الْعَقْلُ، وَإِنَّ أَوَّلَ مَا خَلَقَ اللَّهُ نُورِي، وَإِنَّ أَوَّلَ مَا خَلَقَ اللَّهُ رُوحِي، وَإِنَّ أَوَّلَ مَا خَلَقَ اللَّهُ الْعَرْشُ ، وَالْأَوَّلِيَّةُ مِنَ الْأُمُورِ الْإِضَافِيَّةِ فَيُؤَوَّلُ أَنَّ كُلَّ وَاحِدٍ مِمَّا ذُكِرَ خُلِقَ قَبْلَ مَا هُوَ مِنْ جِنْسِهِ، فَالْقَلَمُ خُلِقَ قَبْلَ جِنْسِ الْأَقْلَامِ، وَنُورُهُ قَبْلَ الْأَنْوَارِ- (مرقاة:১/২৭০)
-‘‘বাস্তবিক পক্ষে প্রথম সৃষ্টি হচ্ছে- নূরে মুহাম্মদী (ﷺ) যেমন আমি আমার ‘‘আল মাওরিদ লিল মাওলিদ’’
(১ম খণ্ড : ১৬৮ পৃষ্ঠা, হাদিস, ৯৪)
এ উল্লেখ করেছি।....... আর যেসব বর্ণনায় এসেছে- আল্লাহ্ প্রথমে (আমার) আকল (বিবেক) সৃষ্টি করেছেন, অন্য বর্ণনায় আল্লাহ্ প্রথমে আমার নূরকে সৃষ্টি করেছেন, অন্য বর্ণনায় আল্লাহ্ প্রথমে আমার রুহকে সৃষ্টিকে করেছেন, অন্য বর্ণনায় আল্লাহ্ প্রথমে আরশ সৃষ্টি করেছেন।
এসব বর্ণনায় ‘‘প্রথমে’’ শব্দটি দ্বারা আনুপাতিক প্রথম বুঝানো হয়েছে। সুতরাং এর ব্যাখ্যা এভাবে দেয়া যাবে যে, উল্লেখিত প্রতিটি বস্তু সে জাতীয় সব বস্তুর মধ্যে প্রথমে সৃষ্টি করা হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে। যেমন, সব কলমের মধ্যে উলিখিত কলমটি তাক্বদীর লিখন কলমটি সর্বপ্রথম সৃষ্ট হয়েছে। সুতরাং সৃষ্টিকুলের সমস্ত নূরের মধ্যে সর্বপ্রথম হুযূর (ﷺ) এর নূরকেই সৃষ্টি করা হয়েছে।’’ ৬৩
➥{আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী : মিরকাতুল মাফাতীহ : ১/১৬৮পৃ.ঈমান বিল ক্বদর : হা/৯৪}
৪. আল্লামা সৈয়দ শরীফ আলী বিন মুহাম্মদ আল জুরজানী (رحمة الله) শরহে মাওয়াক্কের (ইরানের কোম থেকে প্রকাশিত) এর ৭ম খণ্ডের ২৫৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন,
قال بعضهم وجه الجمع بينه (اول ما خلق العقل) وبين الحديثين الاخرين اول ما خلق الله القلم واول ما خلق الله نورى – ان المعلوم الاول من حيث انه مجرد يعقل ذاته ومبدأه يسمى عقلا- ومن حيث انه واسطة فى صدور سائر الموجودات ونفوس العلم يسمى قلما ومن حيث توسطه فى افاضة انوار النبوة كان نورا لسيد الانبياء-
-‘‘হাদিসে পাকে সর্বপ্রথম সৃষ্টি হিসেবে ‘‘আকল’’, ‘‘কলম’’ এবং ‘‘আমার নূর’’ তিনটি বস্তুর উল্লেখ মূলত: নবীক‚ল সম্রাট এর নূর মোবারককেই বুঝানো হয়েছে। সর্বাগ্রে নিরেট ও নির্ভেজাল অস্তিত্বময় একমাত্র তাঁরই সত্ত্বা। তাই তাকে ‘‘আক্বল’’ এবং সমগ্র সৃষ্টির অস্তিত্ব প্রাপ্তির তিনিই মাধ্যম তাই তাকে ‘‘কলম’’ এবং আনওয়ারে নবুওয়্যাতের তিনিই ফয়েয বিতরণের একমাত্র সোপান তাই তিনি ‘নূর’ হিসেবে আখ্যায়িত।’’
৫. আরেফ বিল্লাহ ইমাম আল্লামা আবদুল ওয়াহাব শারানী (رحمة الله)اليواقيت والجواهر গ্রন্থের ২য় খণ্ডের, ২০ পৃষ্ঠায় হাদিসে উলিখিত اول ما خلق الله نورى এবং اول ما خلق الله العقل উভয় বর্ণনার সামঞ্জস্য বিধানে বলেন,
ان معناهما واحد لان حقيقة محمد صلى الله عليه وسلم تارة يعبر عنها بالعقل الاول وتارة بالنور-
-‘‘মানে নূর কিংবা আকল পরস্পর কোন বৈপরিত্য নেই। এগুলো হাক্বীক্বতে মুহাম্মদী (ﷺ) এর বহুমুখী পরিচিতি।’’ ৬৪
➥{আল্লামা শায়খ ইউসূফ বিন নাবহানী : জাওয়াহিরুল বিহার : ২/৪৭পৃঃ}
৬. আল্লামা হুসাইন বিন মুহাম্মদ বিন হাসান দিয়ার বকরী (رحمة الله) স্বীয় ‘তারীখুল খামীস’ কিতাবের ১ম খণ্ডের ২৫ পৃষ্ঠায় অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন-
وأهل الحقيقة على ان المراد من هذه الأحاديث شئ واحد لكن باعتبار نسبه وحيشياته تعدرت العبارات-
-‘‘আহলে তাহকীক ওলামাদের অভিমত এই যে, যেই সমস্ত হাদিস হতে বস্তু (সর্বপ্রথম সৃষ্টির ব্যাপারে উদ্দেশ্য হয়েছে) সেই সমস্ত হাদিস দ্বারা একটিকে অপরটিরদিকে অনুপাতিক নেসবত করা হয়েছে। (মূলত রাসূল (ﷺ) এর নূরই সর্বপ্রথম সৃষ্টি)’ ৬৫
➥{আল্লামা হুসাইন বিন মুহাম্মদ বিন হাসান দিয়ার বকরী : তারীখুল খামীস : ১/২৫ পৃ}
৭. আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকায়েদের ইমাম আবুল হাসান আশ‘আরী (رحمة الله) বলেন,
انه تعالى نور ليس كالانوار و روح النبوية القدسية لمعة من نوره والملائكة اشرار تلك الانوار وقال صلى الله عليه وسلم اول ما خلق الله نورى ومن نورى خلق الله كل شئ-
-‘‘আল্লাহ্ তা‘য়ালা নূর, তবে অন্যান্য নূরের মতো নন। আর নবী করীম (ﷺ) এর রুহ মোবারক হচ্ছে তার নূরের ঝলক। আর ফেরেশতাগণ হচ্ছেন তার নূরের শিখা। হুযূর (ﷺ) ইরশাদ ফরমান, আল্লাহ্ তা‘য়ালা সর্বপ্রথম আমার নূরকে সৃষ্টি করেছেন। আর আমার নূর থেকে আল্লাহ্ প্রত্যেক কিছু সৃষ্টি করেছেন।’’ ৬৬
➥{ক. আল্লামা ইমাম মাহদী আল ফার্সী : মাতালিউল মুর্সারাত : ২১ পৃ. মাতবায়ে মাকতুবায়ে নূরীয়া, লেবানন।
খ. আল্লামা শায়খ ইউসূফ বিন নাবহানী : জাওয়াহিরুল বিহার : ২/২২০ পৃ. দিলী থেকে প্রকাশিত।}
৮. বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা ইমাম জাওযী (رحمة الله) স্বীয় “মওলুদুন নববী শরীফ’ গ্রন্থে এ বিষয়ক হাদিস প্রসঙ্গে লিখেন-
اول ما خلق الله نورى ومن نورى خلق جميع الكائنات-
-‘‘রাসূল (ﷺ) এর বাণী : সর্বপ্রথম আল্লাহ্ তা‘য়ালা আমার নূর মোবারক সৃষ্টি করেছেন, আর আমার নূর হতে কুল কায়িনাত সব কিছু সৃষ্টি করেছেন।’’ ৬৭
➥{আল্লামা ইমাম ইবনে যাওজী: বায়ানুল মিলাদুন্নবী: ২২ পৃ. তুরস্ক হতে প্রকাশিত।}
৯. আল্লামা ইমাম আবদুল গণী নাবলুসী (رحمة الله) হযরত জাবের (رضي الله عنه) এর সনদ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে সর্বপ্রথম সৃষ্টি সম্পর্কে বলেন,
قد خلق كل شئ من نوره صلى الله عليه وسلم كما ورد به الحديث الصحيح-
-‘‘রাসূল (ﷺ) এর নূর মোবারক থেকে সব কিছু সৃষ্টি। উক্ত বর্ণিত হাদিসটির সনদ সহীহ।’’ ৬৮
➥{ইমাম আব্দুল গনী নাবলুসী: হাদীকাতুল নাদিয়া:২/৩৭৫ পৃ. মাতবাতে মাকতবায়ে নূরীয়াহ, ফয়সালাবাদ।}
১০. বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাকার ইমাম কাস্তাল্লানী (رحمة الله) স্বীয় উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘মাওয়াহিবুল্লাদুন্নীয়া’ গ্রন্থে ‘সর্বপ্রথম কী কলম সৃষ্টি’ তা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে লিখেন,
ان اولية القلم بالنسبة الى ما عدا النور النبوى المحمدى صلى الله عليه وسلم-
-‘‘সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি বলতে নূরে মুহাম্মদী (ﷺ) এর পরে অন্যান্য সকল বস্তুর আনুপাতিক হিসেবে প্রথমে ইঙ্গিত করা হয়েছে।’’ ৬৯
➥{আল্লামা ইমাম কাস্তাল্লানী: মাওয়াহেবে লাদুন্নীয়া : ১/৭৪ পৃ.}
━━━━━━━━━━━━━━━━
🌍 তথ্যসূত্রঃ [শহিদুল্লাহ বাহাদুর গ্রন্থসমগ্র এপ্স]
ডাউনলোড লিংকঃ bit.ly/Sohidullah
অথবা, এপ্সটি পেতে প্লে স্টোরে সার্চ করুন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন