রসূল ছাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া ছাল্লাম অবমাননাকারীর শরয়ী সাজা

গাজ্জালিয়ে যমান হযরত সৈয়্যদ আহমদ ছাঈদ কাজেমী (রহঃ)
---------------
 গাজ্জালিয়ে যমান হযরত শাহ সৈয়যদ আহমদ ছায়ীদ কাজেমী (রহঃ) পবিত্র হারামে রাসূল মদীনা মুনাওয়ারায় দরবারে রেছালতে আবেগ ভরা হৃদয়ে মনের আবেদন- নিবেদন-ফরিয়াদ পেশ করছিলেন। মুখমন্ডল কাবার কাবা সরদারে আম্বিয়া, মাহবুবে কিবরিয়া আহমদে মুজতবা মুহাম্মদ মুস্তফা ছাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের দিকে আর পৃষ্ঠদেশ খানায়ে কাবা বাইতুল্লাহ শরীফের দিকে ছিল। আর ইহাই বুজুর্গানে দ্বীনের অনুসৃত দরবারে রেছালতে উপস্থিতির চিরাচরিত আদব যে, যখনই রাসূলে আকরম নূরে মুজাসুসাম ছাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের দরবারে পাকে উপস্থিত হবেন মুখ মন্ডল রওজায়ে রাসূল (দঃ) এর দিকে এবং পৃষ্ঠদেশ খানায়ে কাবার দিকে হবে।
রাসূলে পাক (দঃ) এর রওজায় নিযােজিত নজদী প্রহরীরা নিষেধ করলাে এবং বললোে খানায়ে কাবার দিকে পৃষ্ঠদেশ প্রদর্শন করবেন না। বরং বাইতুল্লাহর দিকে মুখমন্ডল করে রাসূলে খােদার রওজার দিকে পিঠ ফিরিয়ে নিন। আল্লামা কাজেমী (রহঃ) তাঁদের কথায় আমল দিলেন না। তই দ্বিতীয় দিন তাঁকে সাউদী বিচারকের সামনে উপস্থিত করা হলাে। বিচারক মহােদয় আল্লামা কাজেমী (রহঃ) কে লক্ষ্য করে জিজ্ঞাসা করলেন-আপনি কি রওজায়ে রাসূল (দঃ) কে পবিত্র খানায়ে কাবা থেকে অধিকতর উত্তম মনে করেন? জবাবে তিনি বললেন- আপনি খানায়ে কাবার কথা বলছেন? আমিতাে শুধু খানায়ে কা'বা নয় বরং রওজায়ে রসূল (দঃ) এর মহিমাম্বিত স্থানকে আরশে আজম থেকে ও উৎকৃষ্টতর বলে বিশ্বাস করি। বিচারক জিজ্ঞাসা করলেন, এ কথার স্বপক্ষে দলীল প্রমান কি? আল্লামা কাজেমী (রহঃ) প্রতি উত্তরে বললেন- বিচারক মহােদয় লক্ষ্য করুন , পবিত্র কুরআনের আলােকে প্রমানিত হয় -সাইয়্যেদুনা হযরত ঈছা আলায়হিস সালাম আল্লাহ পাকের শুকরগুজার মহিমান্বিত বান্দা। আল্লাহ্ পাক বলেন- আমি তাঁকে শুকরগুজার কৃতজ্ঞচিত্ত হওয়ার বদৌলতে চতুর্থ আসমানে উত্তোলন করে মহিমান্বিত আসনে অধিষ্ঠিত করেছি। আর সেখানেও তিনি আল্লাহর শােকর আদায় করছেন। পবিত্র কুরআনের ঘােষনা হলাে -  لئن شكرتم لازيدنكم অর্থাৎ নেয়ামতের শুকর আদায় করলে নেয়ামতের পরিমাণ বৃদ্ধি করে দেবে বহুগুনে।
খােদায়ী ঘােষণার প্রেক্ষিতে প্রত্যাশিত ছিল আল্লাহপাক হযরত ঈছা আলায়হিস সালাম এর মহিমান্বিত অবস্থান চতুর্থ আসমান থেকে উন্নীত করে আরশে মুয়াল্লায় উপনীত করবেন তাঁর শুকরগুজারীর বদৌলতে । কিন্তু আল্লাহপাক তাঁকে সবশেষে রাসূলে আকরম ছাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের পার্শ্বদেশে রওজা শরীফের অভ্যন্তরে চির শয্যায় শায়িত করবেন। এর দ্বারা প্রতীয়মান হয়, যেই মর্যাদা-মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব রাসূলে খােদা (দঃ) এর পার্শ্বদেশে অবস্থানের মধ্যে রয়েছে তা আরশে আজমে নেই। আল্লামা কাজেমী (রহঃ) এর এহেন অকাট্য দলীল শ্রবণে নজদী বিচারক নির্বাক নিরুত্তর হয়ে রইলেন।

আল্লামা শাহ সৈয়্যদ আহমদ ছায়ীদ কাজেমী রহমতুল্লাহি আলায়হি মুসলিম মিল্লাতের গৌরব, অদ্বিতীয় মুহাদ্দিছ, যুগশ্রেষ্ঠ ফকীহ, মহান গবেষক এবং মনীষী ছিলেন। জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি হাদীসে নববীর খেদমত এবং প্রচার-প্রসারে অতিবাহিত করেন।
বিভিন্ন বিষয়ের উপর জ্ঞানগর্ভ ও গবেষণালক অনেক গ্রন্থ রচনা করেন। মুসলিম জাতির প্রতি অন্তরে গভীর দরদ লালন করতেন। দেশ এবং জাতির প্রয়ােজনে যে কোন ত্যাগ স্বীকারে তিনি কুন্ঠিত হতেন না। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মতাদর্শ পদদলিত হওয়ার আশংকায় তিনি সর্বদা বিচলিত থাকতেন। জাতীয় জীবনের প্রতিটি স্তরে আহলে সুন্নাতের আদর্শ প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় আজীবন সচেষ্ট ছিলেন।

গজ্জালিয়ে যমান, রাজীয়ে ওয়াক্ত সৈয়াদ আবুন নজুম আহমদ ছায়ীদ কাজেমী (রহঃ) এর বংশ পরম্পরা আহলে বাইতে রাসূল এর অন্যতম ইমাম সাইয়্যেদুনা মুছা কাজেম (রহঃ) এর সঙ্গে মিলিত হয়। ১৯১৩ সালে মুরাদাবাদ এর আঞ্চলিক শহর আমরূহায় তিনি ভূমিষ্ট হন। বাল্যকালেই তিনি বুজুর্গ পিতা সৈয়্যদ মুহাম্মদ মুখতার কাজেমীর স্নেহ ছায়া থেকে বঞ্চিত হন। জীবনের সূচনা পর্ব থেকে সাফল্যের চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষা-দীক্ষা, তালীম-তরবিয়ত সবই তাঁর সম্মানিত বড় ভাই হযরত আল্লামা উস্তাজুল উলামা সৈয়্যদ খলীল ছাহেব কাজেমী, খাকী, মুহাদ্দীসে আমরুহী রহমতুল্লাহি আলায়হির সযত্ন তত্তাবধানে সুসম্পন্ন হয়। এবং তাঁরই বরকতময় হাতে "সিলসিলায়ে চিশতীয়া চাবেরীয়া" এর বায়আত গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে সম্মানিত বড় ভাই সৈয়্যদ খলীল ছাহেব কাজেমী (রহঃ) তাকে খেলাফত দানে ধন্য করলেন।

আল্লামা কাজেমী (রহঃ) এর খেদমতঃ
----------------
ষোল বছর বয়সে আল্লামা শাহ সৈয়দ আহমদ ছায়ীদ কাজেমী(রহঃ) শিক্ষা জীবনের সমাপনী সনদ অর্জন করলেন। অতঃপর দস্তারবন্দী উপলক্ষে আয়ােজিত আজিমুশশান জলসায় জগদ্বিখ্যাত মুহাদ্দিস এবং আরেফে কামেল হযরত ছুদরুল আফাযিল সৈয়্যদ মুহাম্মদ নঈমুদ্দীন মুরাদাবাদী (রহঃ) , হযরত মাওলানা মে'ওয়া ছাহেব রামপুরী (রহঃ), হযরত মাওলানা নেছার আহমদ ছাহেব কানপুরী এবং অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় ওলামা- মাশায়েখে আহলে সুন্নাত এর উপস্থিতিতে মহান অলীয়ে কামেল হযরত শাহ সূর্ফী আলী হুছাইন ছাহেব আশরফী কছুছভী রহমতুল্লাহি আলায়হি বরকতময় হাতে আল্লামা কাজেমী (রঃ) এর মাথায় দস্তারে ফজিলত বেঁধে দিলেন।

শিক্ষা সমাপনীর পর আল্লামা কাজেমী (রহঃ) লাহুর আগমন করে জামেয়া নূমানিয়ায় অধ্যাপনার দায়িত্বে নিয়ােজিত হলেন। এক পর্যায়ে একই সময়ে গুরুত্বপূর্ণ আটাশটি পাঠের অধ্যাপনার দায়িত্ব তাঁর জিম্মায় সােফর্দ হলাে। ১৯৩১ সালে তিনি লাহুর থেকে নিজের জন্মস্থান আমরুহায় আগমন করে চার বছর পর্যন্ত মাদ্রাসায়ে মুহাম্মদীয়া হানফীয়ায় সম্মানিত বড় ভাই ও পীর মুহাদ্দীস খলীল ছাহেব কাজেমীর পৃষ্ঠপােষকতায় শিক্ষকতায় আত্মনিয়ােগ করলেন। ১৯৩৫ সালের প্রারম্ভে তিনি মূলতানে শুভাগমন করলেন। প্রাথমিক অবস্থায় নিজের বাসস্থানেই অধ্যয়ন-অধ্যাপনার কার্যক্রম শুরু করে দিলেন। কিছু দিন পর মূলতান শরীফের মধ্যভাগে ভূমি ক্রয় করে মাদ্রাসা আনওয়ারুর উলুম' প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করে দিলেন।

আল্লামা কাজেমী (রহঃ) ভারত উপমহাদেশ বিভক্তি এবং মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও শুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে জোরদার করার লক্ষ্যে বেনারস কনফারেন্সে যােগদান করেছিলেন। যে যুগে কংগ্রেসী এবং আজাদী আন্দোলনের উলামারা জানবাজি করে পাকিস্তানের বিরােধিতা করছিল সে সময়ে খাজা ক্বমরুদ্দীন সিয়ালভী, পীর সৈয়্যদ জামাত আলী শাহ (রহঃ), মাওলানা আবুল হাছানাত, মাওলানা আবদুল হামেদ বদায়ূনী, মাওলানা আবদুল গফুর হাজারভী(রহঃ) প্রমুখের সঙ্গে আল্লামা কাজেমী (রহঃ) পৃথক
জাতীয়তা এবং স্বাধীন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য ধারাবাহিক সংগ্রামে ও লাগাতার কর্মসূচী পালনে নিয়ােজিত ছিলেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি নুতন অবস্থার পর্যবেক্ষনে দেখলেন- যারা এতােদিন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ঘাের বিরােধিতা করেছিলেন পাকিস্তান সৃষ্টির পর তারা মুসলিম লীগে যােগদান করে শাসক গােষ্ঠীর নজরে চোখের সুরমার ন্যায় গ্রহণযােগ্য হয়ে গেলেন। সে সময়ে আল্লামা কাজেমী (রহঃ) আহলে সুন্নাতের ঐক্য এবং সাংগঠনিক শক্তির প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করলেন যাতে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের রাজনৈতিক অবস্থান ও শক্তি বৃদ্ধি পায়। এ বিষয়ে তাঁর প্রচেষ্টা সফল হয়। মূলতানে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের এক বিশাল সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে হযরত আল্লামা
মাওলানা আবুল হাছানাত (রহঃ)কে সভাপতি, আল্লামা শাহ সৈয়দ আহমদ ছাঈদ কাজেমী (রহঃ) কে জেনারেল সেক্রেটারী করে "জমিয়তে উলামায়ে পকিস্তান নামে আহলে সুন্নাতের একটি সাংগঠনিক প্লাটফরম তৈরী করা হয়।আল্লামা কাজেমী (রহঃ) এর সুযােগ্য নেতৃত্বে "জমিয়তে উলামায়ে পাকিস্তানের প্রভূত অগ্রগতি সাধিত হয়।

দেশ ও মাজহাব-মিল্লাতের খেদমতে ব্যাপক অবদান রাখতে সক্ষম হয়। যার মধ্যে "কাশ্মীর সংগ্রাম, সংবিধান রচনা, খতমে নবুওয়ত আন্দোলন, প্রচার-প্রসার, বন্যার্তদের সাহায্য ইত্যাদী উল্লেখ্যযােগ্য। এক কথায় প্রতিটি প্রয়ােজনীয় মূহুর্তে কার্যকরী ভূমিকা
রাখতে সক্ষম হয় এই জমিয়ত।

২৫শে রমজান শরীফ ১৪০৬ হিঃ মুতাবেক ১৯৮৬ইং গাজ্জালিয়ে যমান আল্লামা শাহ সৈয়্যদ আহমদ কাজেমী (রহঃ) এই নশ্বর জগত ত্যাগ করে মাওলায়ে হাকীকীর একান্ত সান্নিধ্যে গমন করেন। (ইন্না লিল্লাহি, ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজেউন) তার ইন্তেকালে সর্বস্তরের ছু্নী মুসলমান এবং মাজহাব-মিল্লাত অসহায়ত্বের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হন।

আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ ছায়ীদ কাজেমী (আল্লহ পাক তাঁর মর্যাদাকে বুলন্দ করুন) এর মহান সত্তা প্রকৃত পরিচয় প্রদানের মুখাপেক্ষী নন। যখনই তাঁর মহিমান্বিত নাম উল্লেখ করা হয় বড় বড় উপাধী-অভিধাগুলাে তাঁর আজীমুশশান ব্যক্তিত্বের মূল্যায়নে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বলে মনে হয়। নিঃসেন্দেহে তিনি যুগের "নাবেগা" ছিলেন- যারা শতাব্দীর পর পৃথিবী পৃষ্ঠে আবির্ভূত হন। তাঁর মহা মূল্যবান জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থগুলাে অধ্যয়ন করলে তাঁর সুউচ্চ মর্যাদা ও মহান ব্যক্তিসত্তা দিবালােকের ন্যায় সকলের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে। নিম্নে কতিপয় গ্রন্থের নাম উল্লেখ করা হলাে- (১) তাছবীহর রহমান (২) মুযিলাতুন নিযা আন মাসআলাতিস সেমা (৩) তাছকীনুল খাওয়াতির (৪) হায়াতুন্নবী (দঃ) (৫) মি'রাজুন্নবী (দঃ) (৬) মীলাদুন্নবী (দঃ) (৭) তাকরীরে মুনীর (৮) ইসলাম এবং খৃষ্টবাদ (৯) তাহকীকে কুরবানী (১০) ইসলাম এবং সমাজতন্ত্র (১১) আল-হাক্কুল মুবীন (১২) মওদুদী দৰ্পন (১৩) কিতাবুত তারাবীহ (১৪) নাফযুজ জিল্লেওয়াল ফাইয়ে (১৫) আত্-তাবশীর বিরদ্দিত্ তাহজীর (১৬)

পবিত্র কুরআনে করীমের উর্দু অনুবাদ ইত্যাদী।

- মুহাম্মদ আলতাফ কাদেরী রজভী

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন