ইসলামি সংস্কৃতির প্রকৃতি, তাৎপর্য ও এর পরিধি (১ম পর্ব)


ইসলামি সংস্কৃতির প্রকৃতি, তাৎপর্য ও এর পরিধি

------------
অ্যাডভোকেট মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার
+++++++++

‘সংস্কৃতি’ বিমূর্ত বিষয়। এর কোনো বস্তুগত স্বরূপ নেই। দেখা যায় না, ছোঁয়া যায়না- এমন কিছু বিধায় একে শুধু অনুভব করা যায়। বুদ্ধি দিয়ে বুঝবার বিষয় এটি। সংস্কৃতি সম্পর্কে একেকজন একেকভাবে ধারনা দিয়ে থাকেন। বিভিন্ন জনের ধারনার আলোকে ও বিশ্লেষণে এর একটি সাধারণ জ্ঞান বা ধারণা আমাদের দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে। এরই মাপকাঠিতে সংস্কৃতি বিষয়টি আলোচিত হয়ে আসছে এ পর্যন্ত।
বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টিতে সংস্কৃতি
ইংরেজি Culture শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে বাঙলায় ‘সংস্কৃতি’ শব্দটি পরিচিত। এর আভিধানিক অর্থ-শিক্ষা বা অভ্যাস দ্বারা লব্ধ উৎকর্ষ বা কৃষ্টি। সম্-কৃ (করা)+ ক্তি-এ ব্যুৎপত্তির মধ্যেই নিহিত থাকে পরিশীলিত, পরিমার্জিত পরিশ্রুত, নির্মলীকৃত শোধিত ধরনের অনুভবসমূহ। ফলে উৎকর্ষময় বা পরিশ্রুত জীবন চেতনাই সংস্কৃতির সার কথা-এ উক্তি মূলানুগ।
[নরেন বিশ্বাস, ইতিহাসের আলোকে বাংলাদেশর সংস্কৃতি, সুকান্ত একাডেমী, ঢাকা, পৃ. ৯]
ড. আহমদ শরীফ বলেন, সত্য, সুন্দর এবং মঙ্গলের প্রতি মানুষের যে প্রবণতা, মানুষ সচেতনভাবে চেষ্টা দ্বারা যে সুন্দর চেতনা, কল্যাণকর বুদ্ধি ও সুশোভিত জগৎময় দৃষ্টি অর্জন করতে চায়- তাকেই হয়তো তার সংস্কৃতি বলে অভিহিত করা যায়। সংস্কৃতি হল মানুষের অর্জিত আচরণ, পরিশুদ্ধ জীবন-চেতনা। জীবিকা-সম্পৃক্ত পরিবেষ্টনী প্রসূত হলেও প্রজ্ঞা ও বোধিসম্পন্ন ব্যক্তি চিত্তেই এর উদ্ভব এবং বিকাশ। ব্যক্তি থেকে ক্রমে সমাজে এবং সমাজ থেকে বিশ্বে তা হয় ব্যাপ্ত। চিন্তায়, কর্মে ও আচরণে জীবনের সুন্দর, শোভন, পরিশীলিত ও পরিমার্জিত অভিব্যক্তিই সংস্কৃতি।
[তাজুল ইসলাম হাশেমী, ইতিহাসের আলোকে বাংলাদেশের সংস্কৃতি, সুকান্ত একাডেমী, পৃ. ৫৫]
মোতাহার হোসেন চৌধুরী’র মতে, সমাজ সাধারণভাবে মানুষকে সৃষ্টি করে, মানুষ আবার নিজেকে গড়ে তোলে শিক্ষাদীক্ষা ও সৌন্দর্য সাধনার সহায়তায়। এই নিজেকে বিশেষভাবে গড়ে তোলার নাম কালচার। তাই কালচার্ড মানুষ স্বতন্ত্র সত্তা, আলাদা মানুষ। নিজের চিন্তা, নিজের সাধনা, নিজের কল্পনার বিকাশ না ঘটলে কালচার্ড হওয়া যায়না। তিনি বলেন, সত্যকে ভালোবাসো, সৌন্দর্যকে ভালোবাসো, ভালোবাসাকে ভালোবাসো, বিনা লাভের আশায় ভালোবাসো, নিজের ক্ষতি স্বীকার করে ভালোবাসো-এরি নাম সংস্কৃতি। তাঁর মতে সংস্কৃতির অনিবার্য শর্ত হচ্ছে মূল্যবোধ।
তিনি মনে করেন, অমৃতকে কামনা, তথা প্রেমকে কামনা, সৌন্দর্যকে কামনা, উচ্চতর জীবনকে কামনা এ তো সংস্কৃতি। সংস্কৃতি মানে জীবনের ঠধষঁবং সম্বন্ধে ধারনা। তিনি বলেন, সংস্কৃতি মানেই আত্মনিয়ন্ত্রণ-নিজের আইনে নিজেকে বাঁধা। বন্দুকের নলেই যারা জীবনের একমাত্র সার্থকতা খুঁজে পান তারা কালচার্ড নন। তাঁর মতে, কালচার্ড লোকেরা সবচেয়ে বেশী ঘৃণা করেন অন্যায় আর নিষ্ঠুরতাকে। [সূত্র.মোতাহার হোসেন চৌধুরী, সংস্কৃতির কথা]
কীভাবে সংস্কৃতিবান হওয়া যায় এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আবুল ফজল তাঁর ‘সাহিত্য-সংস্কৃতি জীবন’ গ্রন্থে বলেন, ‘কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক ও ধার্মিকের সৃষ্টিকে হজম করেই সংস্কৃতিকে করা যায় আয়ত্ব ও একমাত্র এভাবেই হওয়া যায় সংস্কৃতিবান। কতিপয় সৃষ্ট বিষয় যখন অনেকের উপভোগের ব্যাপার হয়, অতীত ও বর্তমানের উৎকৃষ্ট বস্তুগুলো যখন মানুষ সাগ্রহে গ্রহণ করে ও তার উপযুক্ত মূল্য দেয়, তখনই সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। [সূত্র. আসাদ বিন হাফিজ, ইসলামী সংস্কৃতি, পৃ.২৩]
বদরুদ্দিন ওমরের মতে, ‘জীবন চর্চারই অন্য নাম সংস্কৃতি। মানুষের জীবিকা, তার আহার-বিহার, চলাফেরা, তাঁর শোকতাপ, আনন্দ বেদনার অভিব্যক্তি, তার শিক্ষা-সাহিত্য, ভাষা, তার দিন-রাত্রির হাজারো কাজকর্ম, সব কিছুরই মধ্যেই তার সংস্কৃতির পরিচয়।
আবুল মনসুর আহমদ তাঁর ‘বাংলাদেশের কালচার’ গ্রন্থে বলেন, ‘‘কোনও সমাজ বা জাতির মনে কোন এক ব্যাপারে একটি স্ট্যান্ডার্ড ব্যবহার বিধি মোটামুটি সার্বজনীন চরিত্র, ক্যারেক্টর, আচরণ বা আখলাকের রূপ ধারণ করিলেই সেটাকে এ ব্যাপারে ওই মানব গোষ্ঠীর কালচার বলা হইয়া থাকে।’’
গোপাল হালদার ‘সংস্কৃতির রূপান্তর’ গ্রন্থে বলেন, সংস্কৃতি বলতে আমরা বুঝি মানুষের প্রায় সমুদয় বাস্তব ও মানসিক কীর্তি ও কর্ম, তার জীবন যাত্রার আর্থিক ও সামাজিকরূপ অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠান, তার মানসিক ও আধ্যাত্মিক চিন্তা-ভাবনা, নানা বৈজ্ঞানিক আবিস্ক্রিয়া আর নানা শিল্প সৃষ্টি, সমস্ত চারু ও কারু কলা-এই হল সংস্কৃতির স্বরূপ।’
পাশ্চাত্য মনীষীদের দৃষ্টিতে সংস্কৃতি
ডিউই বলেন, CULTURE MEANS AT LEAST SOMETHING CULTIVATED, SOMETHING REPENED. IT IS OPPOSED TO THE RAW AND CRUDE. অর্থাৎ সংস্কৃতি বলতে বুঝায় এমন কিছু যার অনুশীলন করা হয়েছে, যা পূর্ণতা লাভ করেছে। এ হচ্ছে অমার্জিত ও অপরিণতের পরিপন্থী।
টেইলর বলেন, CULTURE IS THE COMPLEX-WHOLE WHICH INCLUDES KNOWLEDGE, BELIEF, ART, MORAL LAW, CUSTOM AND ANY OTHER CAPABILITES AND HABITS ACQUIRED BY MEN AS A MEMBER OF SOCIETY. অর্থাৎ সংস্কৃতি হলো সমাজের মানুষের
অর্জিত জ্ঞান, বিশ্বাস শিল্পকলা, নেতিক আইন, প্রথা, সংস্কার ও অন্যান্য বিষয়ে জটিল সমাবেশ। [আসাদ বিন হাফিয, ইসলামী সংস্কৃতি, পৃ.২৪]
রাশিয়ান চিন্তাবিদ ট.ভি.ডি রবার্টির মতে, সংস্কৃতি হলো অনুমানগত ও ফলিত সব চিন্তাধারা ও জ্ঞানের সমষ্টি। গ্রাহাম ওয়ালেসের মতে, সংস্কৃতি হলো, চিন্তাধারা, মূল্যবোধ ও বস্তুর সমষ্টি, এক কথায় সামাজিক ঐক্য। আর, বি. মালিনওস্কির মতে, সংস্কৃতি হলো, মানুষের ক্রমবর্ধমান সৃষ্টির সমষ্টি। রবার্ট রেডফিল্ড বলেছেন, সংস্কৃতি হলো সমগ্রভাবে ‘সমঝোতাসমূহের অংশ।’ র‌্যাডক্লিফ ব্রাউনের মতে, সংস্কৃতি মূলতই একটি ‘নিয়ম কানুনের ধারা’।
উপরোক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বুলবুল ওসমান তাঁর ‘সংস্কৃতি ও সংস্কৃতিতত্ত্ব’ বইয়ে বলেন, ‘মানুষের সমগ্র সৃষ্টির বিভিন্ন নাম, যেমন- ভাষা, কলা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, আইন, দর্শন, রাষ্ট্র, নৈতিকতা, ধর্ম-তাছাড়া সমগ্র যন্ত্রপাতি ও ব্যবহারিক দ্রব্যাদি এবং এই সমস্ত দ্রব্য নির্মাণের সমস্ত বিদ্যা, ঐতিহ্য, রীতি-প্রথা, মূল্যবোধ, প্রতিষ্ঠান, অনুষ্ঠান-এর সবই পড়ে সংস্কৃতির আওতায়। সংস্কৃতি ধারণাকে উপরোক্ত অভিমতসমূহের আলোকে বিশ্লেষণ করলে সহজেই বুঝা যায় যে, সংস্কৃতি একটি ব্যাপক-বিস্তৃত ব্যাপার। মানুষের সামগ্রিক অর্থবহ ও গ্রহণযোগ্য জীবনাচারের অপর নাম সংস্কৃতি। মূল্যবোধ এর অপরিহার্য পূর্বশর্ত বিধায় বিশ্বাসই এর মূলভিত্তি। মানুষ দলবদ্ধভাবে বসবাস করতে গিয়ে তার বিশ্বাস ও মূল্যবোধের আওতায় যা যা করে তাই সংস্কৃতি। মানুষের কাজ-আচরণ শুধু নয় তার ব্যবহারের জিনিষ-পত্রকেও সংস্কৃতির আওতায় আনা হয়েছে। মানুষের যাবতীয় সৃষ্টি যেমন সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, আইন-কানুন ইত্যাদি সবকিছু। সুতরাং সংস্কৃতি এতো ব্যাপক একটি ব্যাপার যে, একে মানুষের সামগ্রিক পরিশীলিত কর্মকান্ড হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে সমগ্র বিশ্বে, সমগ্র পর্যায়ে।
অথচ আজ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সংস্কৃতি শব্দটি উচ্চারিত হলেই আমাদের মানসপটে এক সংকীর্ণ কর্মকান্ডের কথা বার বার ভেসে আসে। সংস্কৃতিকর্মী বলতে আমরা আজকাল বুঝি বিনোদন কর্মীদের। যারা নাটক-থিয়েটার করে। গান গায়-নাচে। ভাষাতত্ত্বের ভাষায়, এটা সংস্কৃতি (Culture) অভিধাটির অর্থ সংকোচনের এক সাম্প্রতিক উদাহরণ বটে। বাংলাদেশে এ শব্দটির ব্যাপকতা ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে এবং সংকীর্ণ একটি পরিমন্ডলের সাথে যুক্ত থাকছে মাত্র। নাটক-গান-নাচ ইত্যাদি বিনোদনধর্মী কাজগুলো এক শ্রেণির মানুষের সামগ্রিক সংস্কৃতির একটি ক্ষুদ্র অঙ্গ মাত্র। এ কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা সংস্কৃতি কর্মী নিঃসন্দেহে। তবে, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের একটি সীমিত মন্ডলের কর্মী এরা। রাজনৈতিক কর্মীরাও সাংস্কৃতিক কর্মী; বরং এদের সীমানা তুলনামূলকভাবে বড়। কারণ, রাজনৈদিক দর্শন বিনোদন সংস্কৃতির রূপরেখাতেও পরিবর্তন আনতে সক্ষম। ধর্ম ও সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বিধায় মসজিদ, মাদরাসা খানক্বাহ্, মাজার ইত্যাদিতে নিয়োজিত কর্মীরাও সংস্কৃতি কর্মী। এভাবে মানব সমাজে ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার আওতায় নিয়োজিত হয়ে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে জড়িত রয়েছে এ সমাজের অসংখ্য মানুষ এসব শাখা-প্রশাখার প্রায় সব মানুষও সংস্কৃতিকর্মী। হ্যাঁ, যেহেতু পরিশ্রুত উৎকর্ষিত জীবন চেতনাকেই সংস্কৃতির বিবেচনাতে ধরা হচ্ছে, সেহেতু এসব কর্মকান্ড অবশ্যই ওই মূল্যবোধের আওতায় হওয়া অপরিহার্য।
সুতরাং বাংলাদেশের মানুষের ধর্ম-কর্ম, ভাষা, সাহিত্য, শিল্পকলা, আইন-বিচার, অর্থনীতি, রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যের ধরণ, নাটক, সিনেমা, খাবার-দাবার, পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার ব্যবহার, কথার ধরণ, ব্যবহৃত জিনিষপত্র, লোক গাঁথা, ঐতিহ্য-প্রথা থেকে শুরু করে রাষ্ট্র থেকে পরিবার পর্যন্ত আচরিত যাবতীয় বৈশিষ্ট্য যা পৃথিবীর অন্য যে কোন দেশের সাথে কোনো না কোনো ক্ষেত্রে মিল-অমিল রক্ষা করে বহমান আছে, তাই বাংলাদেশের সংস্কৃতি, বাঙালি সংস্কৃতি। দেশগত এবং ধর্মীয় পার্থক্যের কারণেই আজ বাংলাদেশের বাঙালি সংস্কৃতির সাথে কোলকাতার বাঙালি সংস্কৃতির রয়েছে ব্যাপক পার্থক্য।
ইসলামী সংস্কৃতি কী
উপরোক্ত মনীষীদের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বলা যায় যে, ইসলাম কর্তৃক অনুমোদিত মানবজাতির জীবনঘনিষ্ট যাবতীয় কর্মকান্ডই ইসলামী সংস্কৃতি। যেহেতু মূল্যবোধ সংস্কৃতির প্রাণ, তাই ইসলামী মূল্যবোধ পরিপন্থী জীবনাচারকে অপসংস্কৃতি হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। মদপান, ঘুষ খাওয়া, জুয়া খেলা, ব্যভিচার, অশ্লীলতা সবই অপসংস্কৃতি, যদিও তা মুসলিম সমাজে আচরিত হোক না কেন। অপরপক্ষে, অমুসলিম সমাজে প্রচলিত থাকলেও সত্যবাদিতা, শালীনতা, মেহমানদারী, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা, পরোপকারে ঝাঁপিয়ে পড়া ইত্যাদিকে ইসলামি সংস্কৃতি বলা যেতে পারে। ঈমান না থাকার কারণে এসব ইসলাম সম্মত কাজ করার পরও তারা মুসলিম নয় বটে। তবুও তাদের আচরিত অভ্যাসকে ইসলামি সংস্কৃতি বলা যেতে পারে। যেহেতু, ব্যক্তি থেকে সমাজে সংস্কৃতির বিকাশ শুরু হয়, সুতরাং এর বিকাশ ঠিকানা হযরত আদম-হাওয়া আলায়হিমাস্ সালাম-এর মাধ্যমে শুরু হয়েছে এবং পরিপূর্ণতা এসেছে শেষ নবী সরকারে দো-আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের হাতে, সাহাবা, তাবে‘ঈন, আহলে বায়ত, সূফী, দরবেশ, আউলিয়া ও সচেতন আলেম-ওলামা এবং তাক্বওয়াবান মুসলমানদের হাতে। এর সৌন্দর্য ও পরিধি বৃদ্ধি প্রাপ্ত হতে চলছে এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
ব্যক্তি যখন ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেন, তখন তাঁর পরিশীলিত আচরণ-অভ্যাস ধীরে ধীরে সমাজের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে গৃহীত হতে থাকে। এভাবেই সংস্কৃতির এক একটি সোপান গড়ে উঠে। নবীগণ আলায়হিমুস্ সালাম-এর অনুসরণে তাঁদের উম্মতের সমাজ ও উত্তম ইসলামি সংস্কৃতির উত্তরাধিকার লাভ করেছে এভাবেই।
আবার, সমাজ থেকেও ব্যক্তিতে, সমাজ থেকে অপর সমাজেও সংস্কৃতি স্থানান্তরিত হতে পারে। যেমন, শিশু মুসলিম সমাজে জন্ম নেওয়ার সুবাদে সংশ্লিষ্ট সমাজ থেকে ইসলামি রীতিনীতি শিখে নেয়। দীর্ঘদিন মুসলিম সমাজে বসবাসের কারণে অমুসলিমরাও অনেক সময় মুসলিম সমাজের রীতিনীতিতে অভ্যস্থ হয়ে ওঠতে পারে। বিশেষত অন্য সম্প্রদায়ের ভালো রীতি-নীতিকে গ্রহণে ইসলাম আপত্তি করেনা, যদি তা ক্বোরআন-সুন্নাহর পরিপন্থি না হয়। আর এ কারণেই ইসলাম জাহেলী যুগের অনেক পরিশ্রুত আচার-আচরণকে স্বীকৃতি দিয়েছে। যখন যে দেশ আয়ত্ব করেছে তখন সে দেশের স্থানীয় সংস্কৃতির ভালো উপাদানগুলোকেও অনুমোদন দিয়েছে এবং পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। আর এই উদারতাই ইসলামকে দিয়েছে মহাবিজয়, ইসলামি সংস্কৃতির ভান্ডারকে করেছে মহাসাগরের মতো গভীর ও বিশাল।
ইসলামী সংস্কৃতির বিবর্তন ও রূপরেখা
ইসলামী সংস্কৃতি বিবর্তিত হয়ে বর্তমানের ব্যাপক পরিধি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে মূলত: ইসলামের চার দলীলের ভিত্তিতে- কিতাবুল্লাহ্, সুন্নাহ্, এজমা’ ও ক্বিয়াস। ক্বোরআনুল করীম হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালাম মারফত হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে প্রেরিত আল্লাহর বাণী বা ‘ওহী’। ‘সুন্নাহ্’ বলতে বুঝাচ্ছি রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর কর্ম, বাণী ও অনুমোদন, যেগুলো খোদ্ রসূলের পাকের জন্য খাস নয়; উম্মতের আমল করার জন্য প্রযোজ্য।
এগুলো ছাড়াও খোলাফা-ই রাশেদীন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত ওমর ফারূক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত ওসমান গণী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এবং হযরত শেরে খোদা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর সুন্নাতসমূহও ‘সুন্নাহ’র অন্তর্ভুক্ত। ক্বোরআন- সুন্নাহ্ মূলত আল্লাহরই পক্ষ হতে এসেছে। এ দু’টি ইসলামি সংস্কৃতির মৌলিক ভিত্তি। এ দুই ভিত্তি’র আলোকেই ইজতিহাদ বা গবেষণার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ঐক্যমত হলো এজমা’। ক্বোরআন, সুন্নাহ্ ও ইজমা’র অনুসরণে ক্বিয়ামত পর্যন্ত উদ্ভূত পরিবেশ, সমস্যা ও পরিস্থিতির আলোকে গবেষণা করে ক্বিয়াস বা অনুমান ভিত্তিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠবে। এভাবে ইসলামী সংস্কৃতি বির্নিমাণের অবারিত ধারা চলতে থাকবে, যা কখনো শেষ হবে না। উল্লেখ্য, বর্ণিত উৎসগুলো শেষ নবী হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সময় থেকে ধরা হয়। তাছাড়া, সংস্কৃতির ধারা, প্রথম নবী হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম থেকে শুরু হয়েছে। প্রথম পুরুষ হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম এবং প্রথম নারী হযরত হাওয়া আলায়হিস্ সালাম’র জীবনাচার’র বিবর্তন’ ও আজকের সংস্কৃতির আদিতম উৎস, যা তাঁদের পরবর্তী বংশধরগণ কর্তৃক অনুসৃত হয়ে এবং তাদের মধ্যে সংশোধিত ও সম্প্রসারিত হয়ে, শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর হাতে পূর্ণতা লাভ করে। পূর্ণতাপ্রাপ্ত সেই রূপরেখা অনুসরণ করেই সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ মানব সমাজের ¯্রােতে ভেসে কালের শেষ সীমানা পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছবে। যদিও এ সাংস্কৃতিক ধারা আদম-হাওয়া আলায়হিমাস্ সালাম’র মাধ্যমেই সর্বপ্রথম এ দুনিয়ায় প্রবেশ করে, পক্ষান্তরে একটি প্রশ্ন থেকে যায় ‘অপসংস্কৃতি’ সম্পর্কে। অপসংস্কৃতির উৎস ও বিকাশ কিভাবে হলো- এ প্রশ্নটিকে আমরা সূত্রবদ্ধ করে দেখাতে চাই। আর এর সহজ উত্তর হলো এই যে, এ অপসংস্কৃতির উৎস এর বিকাশ মানুষের আদি শত্রু ইবলীসের মাধ্যমে। আল্লাহর বিধান ও নির্দেশের প্রতি বিনা প্রশ্নে অনুগত হওয়ার ফেরেশতা সূলভ আচরণ এবং এর বিপরীতে আনুগত্য প্রত্যাখ্যানকারী অহংকারী শয়তানী আচরণ এ উভয় বৈশিষ্ট্যই পরবর্তীতে বিকশিত হয় এ পৃথিবীতে। হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম এবং তাঁর পরবর্তী নবীগণ তথা আল্লাহর প্রতিনিধিদের মাধ্যমে এ ফেরেশতা মনোভাবের বিকাশ ঘটতে থাকে, যাঁর নামই সংস্কৃতি বা ইসলামী সংস্কৃতি। আর পরবর্তীতে ইবলিস শয়তানের প্ররোচণায় ¯্রষ্টা বিস্মৃত পথভ্রষ্ট মানব সমাজের মাধ্যমে প্রসারিত বিশ্বাস ও আচার-আচরণই হলো অপসংস্কৃতি।

http://www.anjumantrust.org

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন