ইসলামি সংস্কৃতির প্রকৃতি, তাৎপর্য ও এর পরিধি (২য় পর্ব)


ইসলামি সংস্কৃতির প্রকৃতি, তাৎপর্য ও এর পরিধি
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
------------
অ্যাডভোকেট মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার
+++++++++

সুতরাং সংস্কৃতি নবীগণ আলায়হিমুস্ সালামগণের মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ হতে আসা এক মহান নি’মাত যা দুনিয়াকে জান্নাতের মরূদ্যানে পরিণত করতে পারে। আর পক্ষান্তরে, অপসংস্কৃতি হলো শয়তানী চিন্তার বহিঃপ্রকাশ যা সৃষ্টির সেরা মানুষকে নিকৃষ্ট জীব-জানোয়ারের পর্যায়ে নামিয়ে দুনিয়াতে অশান্তি ও আখিরাতে কষ্টদায়ক ভয়াবহ্ নরক যন্ত্রণার জন্য প্রস্তুত করে। মানুষ নবীগণের শিক্ষায় সংস্কৃতিবান হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে। আর শয়তানী প্ররোচনায় নিজের মনগড়া বিশ্বাস ও আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে বিতারিত ইবলিসের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের কারণে আল্লাহর গজব ডেকে আনে। উল্লেখ থাকে যে, সেদিন আদম আলায়হিস্ সালামকে সম্মান না করার অপরাধে বিতাড়িত ইবলিস, তার হাজার হাজার বছরের ইবাদতের বদলা হিসেবে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে এমন একটি ক্ষমতা অর্জন করেছিল, যেন সে মানুষের একটি বিশাল অংশকেও প্ররোচনা দিয়ে তার সঙ্গী হিসেবে জাহান্নামে নিয়ে যেতে পারে। তার এই শক্তির মহড়া সেদিন থেকে শুরু হয়েছে এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত বহাল থাকবে।
এভাবে সৃষ্টির শুরু থেকে একদল নবীগণের আদর্শে সংস্কৃতিবান হয়ে জান্নাতের দিকে আর অপরদল শয়তানের অপসংস্কৃতিতে মগ্ন হয়ে জাহান্নামের দিকে অগ্রসর হতে থাকবে। আল্লাহর খলীফাগণ সত্যের দিকে আর শয়তান তার বিপরীতে নেতৃত্ব দিয়ে পৃথিবীর ধাবিত করবে। মানুষ যখন সৃষ্টিকর্তাকে বাদ দিয়ে, শয়তানের প্ররোচনায় নিজের ভালো-মন্দের বিধান নিজেরা তৈরী করে পৃথিবীতে অশান্তি-হানাহানি বাড়িয়ে দেয়, ঠিক তখনি আল্লাহ্ পাক তাঁর সে বান্দাদের ফিরিয়ে আনতে পাঠিয়ে দেন উক্ত অঞ্চলের মানুষের একই ভাষাভাষি কোন নবী রাসূল আলায়হিমুস্ সালামকে। এভাবে হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম থেকে হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম পর্যন্ত তিন লক্ষ ছয়ত্রিশ হাজার পর্যন্ত খলীফা প্রেরণের কথা আমরা জেনে আসছি। যেহেতু আল্লাহ্ তা‘আলা শ্রেষ্ঠ ও শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর আর কোনো নবী প্রেরণ করবেন না, সেহেতু তাঁর হাতেই দ্বীনের পূর্ণতা ঘোষণা করা হয়; যাতে করে মানুষ পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান ইসলামের সংস্কৃতি অতিক্রম করার কোনো প্রয়োজন না হয়।
প্রাক- ইসলামী বিশ্বের সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি
প্রাক-ইসলামী যুগ বলতে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর হাতে প্রতিষ্ঠিত পূর্ণাঙ্গ দ্বীন’র আগের সময়কে বুঝানো হয়। এ সময়কে আইয়্যামে জাহেলিয়াতও বলা হয়। এ সময়ের নবী ছিলেন হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম। হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালামের পাঁচশত বছর পরের এ সময় (৫১০-৬১০ খ্রিস্টাব্দ) সাধারণত: আইয়্যামে জাহেলিয়া বা অন্ধকারের যুগ’ হিসেবে পরিচিত। (P.k. Hitti, History of the Arabs)
হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম-এর পর তাঁর উম্মতগণ খোদায়ী বিধান ছেড়ে ধীরে ধীরে আবারো শয়তানের তাঁবেদার বনে যায়। তারা আল্লাহর কিতাব পবিত্র ইঞ্জীলকেও নিজেদের ইচ্ছা ও সুবিধানুযায়ী পরিবর্তন ও বিকৃত করে ফেলে। এভাবে পাঁচশ’ বছরের এ সময়ে ঈসায়ী ধর্মের আর কোনো অক্ষত-অবিকৃত নিদর্শনের অস্তিত্ব পাওয়া না যাওয়ায় ধর্মের নামে পৌত্তলিকতা এবং হিংসা ও হানাহানি এ ভয়াবহ রূপ লাভ করে। পরিশ্রুত মানবিক জীবন-যাপনের খোদায়ী বিধানের অবর্তমানে মানুষ নানা ধরনের অপসংস্কৃতি ও পাপাচারে অভ্যস্থ হয়ে পড়ে। জ্ঞান সাধনা, তথ্য অনুসন্ধান, সুস্থ বিনোদন, পরিবার ও সমাজব্যবস্থা সবকিছুই নির্বাসিত হয়েছিল দুনিয়া থেকে। সে যুগে শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রতি ইউরোপীয়দের কোন শ্রদ্ধাবোধ ছিল না। প্রাচীন গ্রীক গ্রন্থপাঠ করাকেও সহ্য করা হতোনা। শিক্ষিত লোক এবং পাঠাগার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে ঔ.ড. J.W. Draper তাঁর intellectual Development in Europe গ্রন্থে বলেন, ‘‘খ্রীষ্ট ধর্মের যুগে কোন উল্লেখযোগ্য সাহিত্য সৃষ্টি হয় নাই। পৃথিবীকে গোলাকার বলা ছিল অপরাধ। ঠিক সেই যুগের অজ্ঞতার কারণেই হিপাশিয়ার ঐুঢ়ধঃরধ দেহকে তাঁহার জ্ঞান পিপাসার জন্য আলোকজান্দ্রিয়ার গীর্জায় খন্ড-বিখন্ড করা হইয়াছিল। গ্যালিলিওকে রোমের গীর্জায় আত্মাহুতি দিতে হইয়াছিল। কোন লোকই নিজের সম্পদ, জীবন বা দেহের নিরাপত্তা রক্ষা করিয়া প্রচলিত মতবাদের উপর সন্দেহ পোষণ করিতে পারিতনা। ফলে কোথাও কোন আইন প্রণেতা, দার্শনিক ও কবির আবির্ভাব ঘটে নাই।’’ [কে. আলী, মুসলিম সংস্কৃতির ইতিহাস, আলী পাবলিকেশন, ঢাকা, ১৯৬৫, পৃ.-২০৭]
বাইবেলের বিকৃতরূপ তুলে ধরে গীর্জা ভিত্তিক স্বার্থান্বেষী পুরোহিতরা নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে সেদিন সংস্কৃতির বিকাশের সকল দরজা শক্তহাতে বন্ধ করে রেখেছিল। সেদিনকার ইউরোপের অন্ধকার যুগ সম্পর্কে রয়েছে অসংখ্য ঐতিহাসিক দলিল। অধ্যাপক কে. আলী তাঁর ‘মুসলিম সংস্কৃতির ইতিহাস’ গ্রন্থে অপর এক ঐতিহাসিকের সূত্রে বলেন, ‘‘মহান গ্রেগরি রোম হইতে সকল শিক্ষিত লোককে বহিস্কৃত করিয়াছিলেন এবং তাঁহার আদেশে অগাষ্টাস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত দর্শন শাস্ত্রের পাঠাগারে আগুন লাগাইয়া দেওয়া হইয়াছিল। তাঁহার কুশাসনে গ্রীক ও রোমান গ্রন্থ পাঠ ও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল।’’ লেক্ বলেন, সপ্তম শতাব্দিতে ইসলাম চিন্তার স্বাধীনতার দ্বার উন্মুক্ত করিয়া ইউরোপে জ্ঞান চর্চার ব্যবস্থা করে। প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের স্পেন বিজয়ের পূর্বে ইউরোপের জ্ঞান-বিজ্ঞান সুপ্তাবস্থায় ছিল। পুরোহিতদের মধ্যে শিক্ষা সীমাবদ্ধ থাকায় নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তাহারা শিক্ষা ও জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে নানা কুসংস্কার গড়িয়া তুলিয়াছিল। এইভাবে মধ্যযুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি বাধাপ্রাপ্ত হইয়াছিল।’’ [সূত্র. প্রাগুক্ত, পৃ. ২০৮] ঐতিহাসিকদের মতে, সে যুগে তুলনামূলকভাবে আরবের অবস্থা অনেক ভালো ছিল। সামগ্রিক সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় সত্ত্বেও শিল্প-সাহিত্য-জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে ইউরোপের চেয়ে অনেক অগ্রসর ছিল আরবরা। আরবদের উন্নত ভাষা সম্পর্কে পি.কে. হিট্টি HISTORY OF ARABS গ্রন্থে বলেন, ‘‘এই ভাষাই (আরবী) মধ্যযুগে বহু শতাব্দি ধরিয়া সভ্য বিশ্বের সর্বত্র শিক্ষা, সংস্কৃতি ও প্রগতি চেতনার বাহন ছিল।’’ তিনি বলেন, ‘‘পৃথিবীতে সম্ভবত, অন্য কোনো জাতি আরবদের ন্যায় সাহিত্য চর্চায় এতবেশী স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহ প্রকাশ করে নাই এবং কথিত বা লিখিত শব্দ দ্বারা এত আবেগাচ্ছন্ন হয়নাই।’’ হযরত জালালুদ্দিন সুয়ূত্বী তাঁর ‘আল-মুযহির’ ২য় খন্ডে বলেন, ‘‘কবিতা আরবদের সার্বজনীন পরিচয়ের স্বাক্ষরিত দলিল।’’
জ.অ. R.A. Nicholson তাঁর A Literary History of the Arbs গ্রন্থে আরবদের কবিতা প্রীতি সম্পর্কে বলেন, ‘সেই যুগে কবিতা কিছু সংখ্যক সংস্কৃতিমনা লোকের বিলাসিতার বস্তু ছিল না, বরং ইহা ছিল তাহাদের সাহিত্য প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম।’ [সূত্র. প্রাগুক্ত, পৃ. ২০৯, ২১০] প্রাক-
ইসলামী যুগের ‘উকাযের বার্ষিক মেলায় যে কবিতা উৎসব ও প্রতিযোগিতা চলতো তা আজ সকল কবিতাপ্রেমীদের জানা। সে যুগের এ বার্ষিক মেলায় সাতটি নির্বাচিত গীতি কবিতাকে সোনালী অক্ষরে লিখে কা’বা শরীফের দেয়ালে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো। এ সাতটি নির্বাচিত কবিতার নাম ‘সাব‘ই মু‘আল্লাক্বাহ্’। আধুনিক যুগেও প্রাচীন আরবের ওই সাব্‘ই-মু‘আল্লাক্বাহ্’ সেরা কবিতাগ্রন্থ এবং সে যুগের সেরা কবি ইম্রুল ক্বায়স আরবদের শেকেস্পিয়ার হিসেবে পরিচিত।
উল্লেখ্য, যখন ইউরোপে গীর্জার বাইরে জ্ঞানার্জনের রাস্তা বন্ধ রাখা হয়েছিল, সে সময়েও আরবের শ্রেষ্ঠ ও অভিজাত ক্বোরাঈশ বংশে হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব, হযরত আলী ইবনে আবী তালিব, হযরত উসমান ইবনে আফ্ফান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর মতো শিক্ষিত পুরুষ এবং হযরত হাফসা ও উম্মে কুলসূম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমার মতো শিক্ষিত নারী’র মর্যাদাপূর্ণ অবস্থা ছিল। আর এ সমস্ত শিক্ষিত ব্যক্তিদের পরবর্তী সময়ে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইসলামের বিধি-বিধান তথা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডকে লিপিবদ্ধ করণের কাজে ব্যবহার করেছিলেন।
শিক্ষা-সংস্কৃতির কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য স্থানের চেয়ে আরব’রা এগিয়ে থাকলেও সামগ্রিকভাবে সেখানকার সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। রাজনৈতিকভাবে কোন কেন্দ্রীয় শাসন না থাকায় গোত্র ভিত্তিক শাসনের এ যুগে গোত্রে-গোত্রে শত্রুতা ছিল বংশ পরম্পরায়। এক গোত্রের বিরুদ্ধে অপর গোত্রের প্রতিশোধ স্পৃহা এবং এর পরিণামে সমগ্র আরব বিশেষত: নজদ ও হিজায ছিল রক্তারক্তি ও হানাহানির এক নিয়মিত ময়দান। বহুধা বিভক্ত এ আরব সমাজে আইনের শাসনের পরিবর্তে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ বিধানই প্রচলিত ছিল সর্বত্র।
সামাজিকভাবে নানা প্রকারের কুসংস্কার সমগ্র আরবকে জাহেলিয়াতের গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত করে রেখেছিল। দেব-দেবীর সন্তুষ্টি পেতে বেদীমূলে নরবলি ছিল সে সমাজের স্বাভাবিক সংস্কৃতি। নারীদের কোন সামাজিক মর্যাদা সে যুগে আরব বা অন্য কোথাও কল্পনা করা যেত না। বহু পতœী ও বহুপতি প্রথা আরবের সংস্কৃতিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। মানুষকে ক্রীতদাস বানিয়ে পশুর মতো ব্যবহার করা হতো। সুদ, মদ, জুয়া, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, হত্যাসহ অসংখ্য পাপাচারে লিপ্ত ছিল মানুষ। কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণকে অপমানের চোখে দেখা হতো সামাজিকভাবে। তাই জন্মদাতা পিতা স্বহস্তে জীবিত কবর দিতো নিজের শিশু কন্যাকে। বিধবা বিয়ে ও সম্পত্তিতে নারীর অংশ কল্পনা করা যেত না। অধিকন্তু ধর্মীয় বিশ্বাসের আধ্যাত্মিকতাকে বাদ দিয়ে তারা বায়ু, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, পাথর, বৃক্ষ ও মূর্তির পূজাতে লিপ্ত ছিল। ড.W.Muir Zuvi Life of Muhammad গ্রন্থে বলেন, ‘স্বরণাতীত কাল হইতে মক্কা ও সমগ্র আরব উপদ্বীপ আধ্যাত্মিক আসারতার মধ্যে নিমজ্জিত ছিল-মূর্তি পূজাই ছিল তাহাদের ধর্ম’। [প্রাগুক্ত, পৃ. ৪]
কা’বা ঘরে ‘হুবল’সহ ছোট বড় ৩৬০টি মূর্তি স্থাপন করে তাদের পূজা করত এবং বলত যে, ‘‘আমরা কেবল ইহাদের পূজা এই জন্যই করিতেছি যে, ইহারা আমাদিগকে আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছাইয়া দিবে’। [আল-ক্বোরআন: ৩৯ঃ৩]
এ সম্পর্কে পবিত্র ক্বোরআনে অপর আয়াতে বলা হয় যে, ‘‘বেদুইন আরবদের মধ্যে কুফর ও মুনাফেক্বী বদ্ধমূল হইয়া গিয়াছিল।’’ [আয়াত ৯ঃ৯৮] মোটকথা, ‘হাজরে আসওয়াদ’ (কালো পাথর) চুম্বন এবং খানায়ে কা’বার তাওয়াফের মতো কিছু মৌলিক সংস্কৃতির অনুসরণের পাশাপাশি তাদের মধ্যে ছিল অসংখ্য অপসংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা। সে সময়ে হযরত আবদুল্লাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত আবূ বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুসহ কিছু কিছু সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি মূর্তিপূজা ও অন্যান্য পাপাচার মুক্ত সহজ-সরল জীবন-যাপন করলেও অধিকাংশরা ছিলো শির্ক ও অন্যান্য গর্হিত কাজে অভ্যস্ত। ঠিক এমন সময়েই ধরাপৃষ্ঠে আল্লাহর মনোনীত সর্বশেষ এবং পূর্ণাঙ্গ জীবন-বিধান হিসেবে ইসলামের সূচনা।
ইসলামের বিস্ময়কর সূচনা
‘ইক্বরা’ বা ‘পড়’ শব্দ দিয়ে ইসলামের প্রথম ঐশী বাণী পৃথিবীতে বিদ্যমান তৎকালীন সময়ের সকল অজ্ঞানতা ও অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল। শিক্ষার লক্ষ্য যাতে লক্ষ্যহীন হয়ে নিছক ভোগ-বিলাসের উপায়ে পরিণত না হয় সে জন্য প্রথম আয়াতেই এর নীতি নির্ধারণ করে বলা হয়েছে, ‘ইক্বরা’ বিস্মিরাব্বিকাল্লাযী খালাক্ব’- পড়! তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।’’ [সূরা আলাক্ব] এ আয়াতেই আমাদের শিক্ষানীতি যে ধর্ম নিরপেক্ষ হতে পারে না, তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালাম শুধু ‘ইক্বরা’ শব্দ বারবার বলার পরও তা হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজের মুখে উচ্চারণ করেননি। সম্পূর্ণ আয়াত অর্থাৎ ‘পড়–ন আপনার রবের নামে’ বলার পরই তিনি পড়তে শুরু করলেন। এ ঘটনা থেকেও ধারণা করা যায় যে, আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতি হবে ¯্রষ্টা নির্দেশিত কাঠামোকে অনুসরণ করে। এর পরের আয়াতেই বলা হয়েছে, ‘খালাক্বাল ইনসানা মিন আলাক্ব’ অর্থাৎ মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে ‘আলাক্ব’ তথা অপবিত্র তরল পদার্থ বা শক্রু থেকে; যা একদিকে মানুষকে তার সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে গবেষণার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে অন্যদিকে মানুষকে বানরের জাত বানানোর মতো অপমানকর ডারউইনের বিবর্তনবাদ (Theory of Evelution) কে বাতিল করে দিয়েছে। সৃষ্টির সেরা মানব যাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব ফেরেশতা ও জিন জাতির উপর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত; তাদেরকে ইতর প্রাণী বানরের সংস্করণ হিসেবে প্রদর্শন করা আর সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে বিভ্রান্তিতে ফেলা একই কথা। পৃথিবীতে অসংখ্য সৃষ্ট জীব-জানোয়ার রয়েছে, রয়েছে কীট-পতঙ্গ। এদেরও নিজস্ব জীবনধারা, আচার-আচরণ ইত্যাদি রয়েছে। তাদের এ জীবনাচারকে সংস্কৃতি বলা হয়না। সংস্কৃতি বলা হয় শুধু মানুষের বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও জীবন যাপন প্রণালীর সাথে সম্পর্কিত যাবতীয় কর্মকান্ডকে। ‘বানরের জাত’ প্রমাণের ব্যর্থ চেষ্টা মানুষের মানবিক মূল্যবোধকে অধঃপতিত করে বানর-শিয়াল-শুকরের আচরণে উৎসাহিত করবে। কারণ সংস্কৃতির নামে শিকড় সন্ধানের যে শ্লোগান বর্তমানে ওঠেছে সে সূত্র ধরে পিছনে যেতে যেতে বানরের বাঁদররামিটাই শুধু পাওয়া যাবে। ঐতিহ্য প্রিয় এ বানরের জাত কীভাবে একটি সুশৃঙ্খল সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাবে? কখনো সম্ভব নয়। তাইতো এ দুনিয়ায় ‘আশরাফুল মাখলূক্বাত’ মানুষগণ সৃষ্টি করে চলেছেন ‘সংস্কৃতি’; আর বানরের জাতরা জন্ম দিচ্ছে সংস্কৃতি ও বিনোদনের নামে অপসংস্কৃতি বিকাশের অসংখ্য সন্তান। এ সন্তানদের হাতেই আজ বাংলাদেশটা পরিণত হচ্ছে সন্ত্রাস-ধর্ষণ-অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার এক আঁধার জগৎ এবং বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও লক্ষ্যহীন হিং¯্র জন্তু-জানোয়ারের এক অভয়ারণ্য।
আশরাফুল মাখলূক্বাতের এ চরম অবনতি ঠেকাতেই সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ঐশী গ্রন্থ আল-ক্বোরআন মানব জাতিকে শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে সত্য, ঐতিহ্য ও উন্নয়নের পথ বের করার প্রতি ইঙ্গিত করেছে। সূরা আলাক্বের অন্য আয়াতেও বলা হয়েছে সে পড়ালেখার কথা এবং মানবজাতির মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানের কথা। বলা হয়েছে, ‘‘পড়–ন ওই প্রভুর নামে, যিনি মানুষকে সম্মানিত করেছেন, কলমের ব্যবহার শিখিয়েছেন এবং যা সে জানতোনা সবকিছু শিখিয়েছেন ইত্যাদি। যা ইসলামী সংস্কৃতির গতিপ্রকৃতিকে একটি সুন্দর রূপরেখার মাধ্যমে পরিচালনার পথ নির্দেশ করেছে। আল-ক্বোরআন সর্বশেষ ঐশী কিতাব। এরপর আর কোনো মৌলিক ধর্মগ্রন্থ আসবেনা বিধায় একে পরিপূর্ণতা দেওয়া হয়েছে। এতে সংযোজিত হয়েছে হযরত আদম থেকে হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম পর্যন্ত সময়ের উত্তম সংস্কৃতি এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত মানব সংস্কৃতির জন্য সম্ভাব্য কত উপাদান দরকার তার বর্ণনা। পূর্ববর্তী নবীগণ আলায়হিস্ সালাম ও শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এবং শেষ গ্রন্থ আল ক্বোরআনের শ্রেষ্ঠত্ব ও সমাপনী বিষয়ে নিজ নিজ উম্মতকে অবহিত করেছেন। আর ক্বোরআনেও বর্ণিত হয়েছে পূর্ববর্তী নবীগণের জীবন ও কর্ম। মোটকথা, এটা আল্লাহর অপরাপর কিতাবগুলোর বিবর্তিত সর্বশেষ রূপ’ যা সকল কালের মানুষের পথ নির্দেশনার জন্য নির্ধারিত। ক্বোরআন আরবী ‘ক্বারউন’ শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ হচ্ছে একত্রে সন্নিবেশিত করা। এর অন্য অর্থ হলো পাঠ করা বা আবৃত্তি করা। এতে সকল ধর্মের অবিকৃত উত্তম সংস্কৃতির সংযোজন হয়েছে এবং এ গ্রন্থ পাঠ করলে মানব জাতির পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস ও সংস্কৃতি আয়ত্ব করা সম্ভব হবে, তাই এর নামকরণ হলো আল-ক্বোরআন। ক্বোরআনের ভাষায় এর অন্যান্য নামও পাওয়া যায়। যেমন, আল-কিতাব অর্থাৎ স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রন্থ, আল ফোরক্বান অর্থাৎ ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্যকারী। এতে আল-হিকমত (বিজ্ঞান), আল-হুকুম (বিচার), আর-রহমত (কল্যাণ), আন্ নি’মাত (আর্শীবাদ), আন নূর (আলো), আল-হক্ব (সত্য) ইত্যাদি বলা হয়েছে, যা আল ক্বোরআনের পূর্ণতা নির্দেশক। হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম-এর বাণী ছিল, ‘এখনও আমার অনেক কথাই বলিবার রহিয়াছে, কিন্তু তোমরা তাহা উপলব্ধি করিতে পারিবে না। যাহা হইক, যখন তিনি সত্যের চেতনা শক্তি আসিতেছেন, তখন তিনিই তোমাদিগকে সকল সত্যের পথে পরিচালিত করিবেন’ যা শেষ নবীর আগমন, পূর্ণতা ও সত্যের বিবর্বিত রূপ’র একটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত।
ইসলামে পূর্ববর্তী সময়ের সংস্কৃতিকে যে লালন করা হয়েছে তার উজ্জ্বল প্রমাণ ক্বোরআনে রয়েছে। বলা হয়েছে, ‘তোমরা বল! আমরা আল্লাহর প্রতি এবং যাহা হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম ও হযরত ইসমাঈল ও হযরত ইসহাক্ব ও হযরত ইয়াক্বুব আলায়হিমুস্ সালাম এবং তদীয় বংশধরগণের প্রতি অবতীর্ণ হইয়াছিল এবং হযরত মূসা ও হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালামকে যাহা প্রদান করা হইয়াছিল এবং অন্যান্য নবীগণকে তাঁহাদের প্রতিপালক হইতে যাহা প্রদত্ত হইয়াছিল, তদসমুদয়ের উপর বিশ্বাস স্থাপন করিতেছি; তাঁহাদের মধ্যে কাহাকেও আমরা প্রভেদ করিনা এবং তাঁহারই প্রতি আত্মসমর্পণকারী।’’
[আল ক্বোরআন: ২: ১৩৬]
উক্ত আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, ইসলাম আল্লাহর বিধানসমূহের সর্বশেষ সংস্কারণ। এতে হযরত আদম-হযরত আলায়হিমাস্ সালাম থেকে হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম পর্যন্ত সময়ের বিবর্তনের সৃষ্ট সকল উত্তম সৃষ্টি সভ্যতাকে ধারণ করা হয়েছে। আর এ সময়ে শয়তানী মেধার কুফলে সৃষ্ট সকল অপসংস্কৃতিকেই শুধু বাদ দেওয়া হয়েছে। ইসলাম বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ে সকল ধর্মের সত্যকে লালন করে, ভ্রান্তি সংশোধন করে, সত্য-মিথ্যার প্রভেদকে সুস্পষ্ট করে পৃথিবীর সর্বশেস সময় পর্যন্ত কালের চাহিদা মেটানোর উপযোগী কল্যাণকর যে গ্রন্থ লালন করেছে তাই আল ক্বোরআন। আল ক্বোরআন’র এই চিরন্তন শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি অমুসলিম দার্শনিকরাও দিয়ে আসছেন। টলস্টয় বলেন, ‘ক্বোরআন মানবজাতির শ্রেষ্ঠ পথ-প্রদর্শক। এর মধ্যে আছে শিক্ষা, সভ্যতা, সংস্কৃতি, জীবিকা অর্জন ও চরিত্র গঠনের নিখুঁত দিক দর্শন। দুনিয়ার সামনে যদি এই একটি মাত্র গ্রন্থ থাকতো এবং কোন সংস্কারকই না আসতেন, তবু মানব জাতির পথ প্রদর্শনের জন্য এটাই ছিল যথেষ্ট।’
[সূত্র. দৈনিক আজাদী, চট্টগ্রাম ১৫/০১/২০০১ খ্রিষ্টাব্দ]
William Muir তাঁর Life of Muhammad গ্রন্থে’র ভূমিকায় বলেন, ক্বোরআনের ন্যায় পৃথিবীতে সম্ভবত, আর এমন একটি গ্রন্থও নাই, দীর্ঘ দ্বাদশ শতাব্দী ধরে যার ভাষা সম্পূর্ণ অবিকৃতভাবে সংরক্ষিত হয়ে আছে’। পৃথিবীতে ক্বোরআনের সমকক্ষ কোন গ্রন্তের অস্তিত্ব নেই, যাকে বিজ্ঞানের আলোকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্ভব। যাঁর অবিকৃতি সম্পর্কেও বিজ্ঞানের সূত্র প্রয়োগ সম্ভব। সম্প্রতি আবিস্কৃত ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’-এর ১৯ হরফ সংখ্যা দিয়ে কম্পিউটার পদ্ধতিতে ক্বোরআন-বিশ্লেষণের সূত্র অনুসন্ধানী অমুসলিম গবেষকদেরও আলোর পথ দেখাতে পারে।
মানব সমস্যার স্থায়ী সমাধান ছাড়া ও এর সাহিত্য মূল্য ও শ্রেষ্ঠত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত। এফ. আরবুথনট বলেন, ‘‘সাহিত্য শৈলীর বিচারে ক্বোরআন হইতেছে আধা-পদ্য ও আধা-গদ্যের সংমিশ্রণে বিশুদ্ধতম আরবীর নমুনা।’’ ‘দ্য- লা ভিনিসেটের উক্তি অনুযায়ী ক্বোরআন হইতেছে মুসলিম ধর্ম বিশ্বাসের সনদ ও গঠনতন্ত্র যাহা বর্তমান দুনিয়ার কল্যাণের প্রতিশ্রুতি এবং আখেরাতের মুক্তির আশ্বাস দিয়াছে। ক্বোরআনের সাহিত্যিক মূল্যমান সম্পর্কে ড. মরিস নামে আর একজন ফরাসী পন্ডিত বলেন, ‘ক্বোরআন বিজ্ঞানীদের জন্য একটি বিজ্ঞান সংস্থা, ভাষাবিদদের জন্য একটি শব্দ কোষ, বৈয়াকরণের জন্য ব্যাপকরণ গ্রন্থ, কবিদের জন্য একটি কাব্যগ্রন্থ এবং আইন বিধানের এক বিশ্বকোষ। প্রকৃতপক্ষে পূর্ববর্তী কোন গ্রন্থ ইহার একটি মাত্র সূরা’র সমকক্ষ বলিয়া ও বিবেচিত হয় নাই।’
[কে. আলী, মুসলিম সংস্কৃতির ইতিহাস, পৃ. ২৭-২৮]।

http://www.anjumantrust.org

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন