ইসলামি সংস্কৃতির প্রকৃতি, তাৎপর্য ও এর পরিধি (৩য় পর্ব)


ইসলামি সংস্কৃতির প্রকৃতি, তাৎপর্য ও এর পরিধি
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
------------
অ্যাডভোকেট মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার
+++++++++

সুতরাং ক্বোরআনের সাহিত্য মূল্য বিবেচনা করলেও এর সাংস্কৃতিক মর্যাদা অনুধাবন করা যায়।
সংস্কৃতি মানুষের বিশ্বাস ও কর্মকান্ডের সামগ্রিক একটি দিক। সুতরাং ইসলামের যাবতীয় বিশ্বাস ও বিধি-বিধানগুলোই ইসলামী সংস্কৃতি হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। পবিত্র ক্বোরআন হলো ইসলামী সংস্কৃতির মৌলিক তাত্ত্বিক গ্রন্থ এবং সুন্নাহ্ হচ্ছে এর বিশদ ব্যাখ্যা এবং ব্যবহারিক (Practical) ক্বোরআনের বক্তব্যগুলো ১১৪টি সূরায় বিন্যস্থ করা হয়েছে। এর ৯২টি মক্কী এবং ২২টি মাদানী সূরা। হিজরতের পূর্বে মক্কা জীবনে নাযিলকৃত সূরাগুলোতে আল্লাহর একত্ববাদ, ‘আল্লাহর গুণাবলী, মানুষের নৈতিক কর্তব্য, পরকালের শান্তিমূলক ইত্যাদি বিষয় এবং মাদানী সূরাতে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রবিধান, বিধি-নিষেধ, আইন-অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ের বর্ণনা রয়েছে। মক্কী জীবনে এ দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক সত্ত্বা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মানুষের প্রকৃত বিশ্বাস ও কর্তব্য সম্পর্কে সতর্ক ও আহ্বান করেছেন, আর মাদানী জীবনে তা রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। আর মদীনা রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করেই ইসলামী সংস্কৃতি পৃথিবীর দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। মক্কী জীবনে ধীরে ধীরে যে ক্ষুদ্র ইসলামী সমাজ গড়ে ওঠেছিল তা হিজরতের পর মদীনায় এসে ইসলামী রাষ্ট্রের রূপ নেয়। এখানে ইসলাম এক উদার বিশাল ¯্রােত ধারণ করে। পৌত্তলিক, ইহুদী, খ্রিষ্টান, অগ্নি উপাসকরাও এ রাষ্ট্রের মদীনা সনদে স্বাক্ষর করে ইসলামের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে সমর্থন দিয়েছিলো। এ মদীনা সনদ’ই পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান। মদীনা রাষ্ট্রই পৃথিবীর প্রথম রাষ্ট্র যেখানে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত গোত্রগুলো সাথে নিয়ে একটি শাসনের অধীনে আনা হয়। এ রাষ্ট্রে যার যার ধর্ম-সংস্কৃতি ও গোত্র-সংস্কৃতিকে সম্মান করা হয়েছে। ভিন্নমতাবলম্বীদের জান-মাল ইজ্জত ও ধর্ম-সংস্কৃতির সার্বিক নিরাপত্তা প্রদানের কারণেই ইসলাম একটি উদার আদর্শ হিসেবে পৃথিবীতে সুনাম কুঁড়াতে পেরেছে।
ইসলামি সমাজ ও ইসলামি রাষ্ট্রের মধ্যে সাংস্কৃতিক নীতির পার্থক্য দেখিয়ে কবি গোলাম মুস্তফা তাঁর ‘বিশ্বনবী’তে খুব সুন্দরই বলেছেন যে, ‘ইসলামি সমাজে দূর্গাপূজা চলা অসম্ভব আর ইসলামি রাষ্ট্রে দূর্গা পূজা বন্ধ করা অসম্ভব’। আসলেও তাই ইসলামি সমাজ মুসলমানদের একান্ত নিজস্ব পরিমন্ডল। আর ইসলামি রাষ্ট্র কাফের, বেদ্বীন মুসলমান, নাস্তিক সবার জন্য। এতে সবার সাংকৃতিক অধিকার সমান।
হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর এক দশকের রাষ্ট্রীয় জীবনে মানব সভ্যতার সর্বশেষ প্রয়োজনের দিকটিও বিবেচনা করে আল্লাহর বিধান আল ক্বোরআন এসেছে এবং রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে তিনি নিজের এ ক্বোরআনের ব্যাখ্যা ও নিজের সাংস্কৃতিক জীবনের যে আদর্শ রেখে গেছেন তাই সুন্নাহ্ হিসেবে পরিচিত। ক্বোরআন সুন্নাহ’র আলোকে পরবর্তী সময়ে ইসলামকে গবেষণার অবারিত সুযোগের মাধ্যমে একে কালজয়ী করা হয়েছে। বিদায় হজ্জের সময়ে তাই এই দ্বীন-ইসলামের পূর্ণতার গ্যারান্টি সম্বলিত আয়াত নাযিল হয়, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে সম্পূর্ণ করিলাম এবং তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন (পরিপূর্ণ জীবন বিধান) হিসেবে মনোনীত করিলাম’। [আল ক্বোরআন- ৬:৩]
সংস্কৃতি হল মানব সমাজের সামগ্রিক আচার-আচরণ। সুতরাং ইসলাম হচ্ছে আল্লাহর মনোনীত সেই পূর্ণাঙ্গ সংস্কৃতি বা দ্বীন যা পরবর্তীতে খোলাফায়ে রাশেদীন কর্তৃক আরো সুবিন্যস্থ হয়ে এবং বিভিন্ন মাযহাবের মাধ্যমে বৈচিত্র্য অর্জন করে এং বিভিন্ন সূফী ত্বরিকা এবং প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিত্য নতুন সৌন্দর্য লাভ করে প্রচারিত ও প্রসারিত হচ্ছে।
ইসলামী সংস্কৃতির রূপরেখা
ক্বোরআন, সুন্নাহ, এজমা’ ও ক্বিয়াস’ই ইসলামি সংস্কৃতির উৎস। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ হলো- ঈমান, নামাজ, রোযা, হজ্ব ও যাকাত। এগুলোকে আমরা ইসলামের মৌলিক এবং বাধ্যতামূলক সাংস্কৃতিক উপাদান বলতে পারি। সঠিক বিশ্বাস বা আক্বিদার উপরই ঈমানের বাস্তবতা নির্ভর করে। ঈমান হলো সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্, তাঁর ফেরেশতাসমূহ, কিতাবসমূহ (পূর্ববর্তী এবং বর্তমান), নবীগণ (পূর্ববর্তীসহ) পরকাল সম্পর্কে, তাক্বদীর তথা অদৃষ্টের ভালো-মন্দ আল্লাহর পক্ষ হতে এবং মৃত্যুর পর পুনরূত্থান সম্পর্কে সঠিক আক্বিদা (যথাযথ বিশ্বাস) প্রতিষ্ঠা। উপরোক্ত সপ্ত বিষয়ের যে কোনটিতে ব্যতিক্রম আক্বীদা পোষণকারী’র ঈমানের অস্তিত্ব প্রশ্নে সংশয় সৃষ্টি হয়। নামায, রোযা, হজ্ব ও যাকাত শুধুমাত্র ঈমানদারের জন্যই নির্ধারিত। নামায, রোযা, হজ্ব ইত্যাদি পূর্ববতী নবীগণ আলায়হিমুস্ সালাম-এর সময়েও পালিত হতো, তবে বর্তমানের মতো এতো সমৃদ্ধ ও সুসংহত ছিল না। নামায মুসলমানদের প্রধান সংস্কৃতি। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের একজন নামাজিকে দেখে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী লোক বুঝে নিতে পারে যে উনি মুসলিম। দৈনিক পাঁচওয়াক্ত শুক্রবারে জুমা এবং ঈদ-জানাযা ইত্যাদি নামাযের মাধ্যমে বিশষত জামাতসহ আদায়ের রীতি মুসলমানদেরকে সাংস্কৃতিকভাবে সুসংহত করেছে। মুসলমানদের এ সংস্কৃতি পালনের উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখেরাতে মুক্তি হলেও তা শারীরিক সুস্থতার জন্য হালকা যোগ ব্যায়ামের কাজও করে। এখানেই ইসলামী সংস্কৃতির সার্থকতা। রোযা পালনের মাধ্যমেও শারীরিক সুস্থতা ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিত হচ্ছে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান খালিপেটে থাকার একটি নিয়মিত ব্যবস্থাকে শারীরিক সুস্থতার জন্য অপরিহার্য মনে করছে। তাছাড়া ‘কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়, জীবনে যাদের হররোজ রোজা-ক্ষুধায় আসেনা নীদ’ এমন অভাবী-অনাহারী প্রতিবেশির ব্যথা অনুধাবনের একটা ব্যবস্থাও এই রোযা। আবার ইফতার পার্টি তো আজকাল সার্বজনীন উৎসবে পরিনত হচ্ছে। সুতরাং রোযা সাংস্কৃতি আমাদের সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার। হজ্ব’ বিশ্ব ইসলামী সংস্কৃতির একটি রূপ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এ উপলক্ষে মক্কায়ে মুয়ায্যামা ও মদীনা মুনাওয়ারায় সমবেত হয়ে একটি নির্দিষ্ট নিয়মে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষে কতিপয় নির্ধারিত কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। সবাই একই আওয়াজে গেয়ে যাচ্ছে ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লা-শরিকা লাকা লাব্বাইক… খানায়ে কা’বা তাওয়াফ করছে, চুমু খাচ্ছে হাযরে আসওয়াদে। সাফা-মারওয়া সা‘ঈ (দৌঁড়াদৌঁড়ি) করছে। ৯ যিলহজ্ব আরাফাতের ময়দানে বক্তব্য শুনে নামায পড়ছে দুই ওয়াক্তকে একত্র করে। রাত যাপন করছে মুয্দালিফা নামক পাহাড়ে এবং মাগরিব-এশা একত্রে আদায় করছে। আবার লক্ষ লক্ষ হাজী ফিরে আসছে মিনার তাঁবুতে। সেখানে শয়তানের কল্পিত প্রতিকৃতিতে তিনদিন পর্যন্ত পাথর ছুঁড়ে মারছে। কোরবানী দিচ্ছে। মাথা মুন্ডাচ্ছে। কি এক অপরূপ দৃশ্য। এ সংস্কৃতি সমগ্র বিশ্বের নানা রঙের নানা জাতের নানা মাযহাবের মুসলমানদেরকে এক কাতারে শামিল করে বিশ্বের সকল ঈমানদার ভাই-ভাই এ মূল্যবোধের সাক্ষ্য দিচ্ছে। যাকাত ইসলামি অর্থনীতি উন্নয়নের এক গতিশীল ব্যবস্থা। ধনীদের পুঞ্জীভূত অতিরিক্ত ধন-সম্পদ, টাকা পয়সা প্রতি বছরে একবার অভাবী ও বঞ্চিতদের অধিকারে ছেড়ে দেওয়ার এ সংস্কৃতি পৃথিবীর অন্য কোন বিধানে বিরল। ধনী-গরীবের ব্যবধান কমিয়ে সাম্য-মৈত্রী প্রতিষ্ঠার এ অঙ্গীকার শুধু ইসলামী সংস্কৃতিতেই রয়েছে। এখানে সংস্কৃতি পালনের উদ্দেশ্য একই সাথে দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতে মুক্তির নিশ্চয়তা দেয়। এখানেই অন্যান্যদের সাথে ইসলামের পার্থক্য।
উপরোক্ত ফরয সংস্কৃতির বাইরে রয়েছে অসংখ্য ওয়াজিব সুন্নাত, নফল মুবাহ ধরনের সংস্কৃতি। যা একজন সাধারণ ঈমানদারকে পরিপূর্ণ মুসলিম হয়ে কবরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যেভাবে ভয় করা উচিত এবং মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করোনা। [সূরা আল-ই ইমরান]
পরিপূর্ণ মুসলমান হয়ে কবরে যাওয়ার জন্য মুসলমানরা ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাত, নফল, মুবাহ্ সব ধরনের কর্মপালন করে আসছে। একজন মুসলিম কী করবে আর কী করবেনা তা নির্ধারণের জন্য হালাল এবং হারাম এ দু’ধরনের কর্মকান্ড নির্ধারিত আছে। যা করা ক্বোরআন-সুন্নাহ্ অনুসারে নিষিদ্ধ তাই হারাম। যা হারমা নয় তাই হালাল। এগুলোই প্রকৃত অর্থে গ্রহণযোগ্য সংস্কৃতি হিসেবে পালিত হবে। এ ছাড়া মুবাহ্ এবং মাকরূহও রয়েছে, যা করাতে গুনাহ্ নেই বরং নিয়ত গুণে সাওয়াব আছে তা মুবাহ, যা না করা উত্তম তবে গুনাহ্ নয় তা মাকরূহ। অবশ্য মাকরূহ ধরনের কাজগুলো তাহরীমী ও তানযীহী এ দু’ভাগে বিভক্ত। তাহরীমিকে চরম অপছন্দনীয় (গুনাহ্) এবং তানযীহীকে অপছন্দনীয় গণ্য করা হয়। সুতরাং ইসলামি সংস্কৃতির পরিধি বৃদ্ধিতে কোন কাজটি অপছন্দনীয় ও অপছন্দনীয়, কোনটি ইবাদত আবার কোনটি নিষিদ্ধ, কোনটা না করা উত্তম বিবেচনা করতে হবে। ইসলামী সংস্কৃতির রূপরেখা অনুধাবনে আরো কয়েকটি অবিচ্ছেদ্য বিষয়কে বিবেচনা করতে হবে। একজন মুসলমানের যাবতীয় সংস্কৃতির ভিত্তি তাওহীদ রেসালত ও আখিরাত’র প্রতি দৃঢ় আস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহর একত্ববাদ এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনাদর্শ ধারণ করেই আখেরাতে মুক্তি সম্ভব। এ মূল্যবোধ ধারণ করেই ইসলামী সংস্কৃতির কাঠামো নির্মিত হয়ে আসছে।
হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর খোলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবা-ই কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমের মাধ্যমে এ ব্যবস্থা আরো প্রসারিত হয়েছে। এরপর থেকে ইজতিহাদের মাধ্যমে সমসাময়িক পরিস্থিতি ও সমস্যার আলোকে সমাধান দিতে এবং ইসলামের এ ব্যবস্থাকে আরো গতিশীল করতে জন্ম হয় হানাফী, শাফে‘ঈ, মালেকী ও হাম্বলী- এ চারটি মাযহাব। ঈমান আক্বীদার ক্ষেত্রে এ চার মাযহাবের কোন পার্থক্য নেই। শুধুমাত্র ফরয-ওয়াজিব-সুন্নাত-নফল সংস্কৃতিগুলো পালনের প্রক্রিয়ার মধ্যে সামান্য পার্থক্য এদের মধ্যে রয়েছে। এ পার্থক্য মূল কাঠামোতে নয় বরং অতি কাঠামো বা উপরি কাঠামোতে (Super structure) হওয়ায় মুসলমানদের নির্ধারিত মৌলিক সংস্কৃতিতেও বৈচিত্র এসেছে। যে যার পছন্দ অনুসারে একই সুন্নি আক্বিদায় বিশ্বাস স্থাপনের পর ভিন্ন ভিন্ন মাযহাব অনুসরণ করতে পারে।
নিজ নিজ মাযহাব অনুসারে নি¤œস্বরে অথবা উচ্চস্বরে বলছে মাযহাবের পার্থক্য ইসলামের জন্য কল্যাণকর। এরা পরস্পর ঝগড়া-ফ্যাসাদে লিপ্তও নয়। কিন্তু আক্বিদাগত বিভ্রান্তির কারণে যে সব উপদল ইসলামের নামে সৃষ্টি হয়েছে সেগুলো ইসলামের মূলধারার সাথে বিরোধ সৃষ্টি করে। শান্তি ভঙ্গ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। ইসলামের দৃষ্টিতে সঠিক রাস্তা মাত্র একটিই এবং একটি দলই জান্নাতে যাবে, বাকিরা বিভ্রান্ত হিসেবে দোযখী হবে। এ সংক্রান্ত একটি বহুল প্রচারিত হাদিস হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘বনী ইসরাইল বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছিল আমার উম্মত তিয়াত্তর দলে বিভক্ত হবে। বাহাত্তর দলই জাহান্নামে যাবে, একদল যাবে জান্নাতে। সাহাবা-এ কেরাম আরয করলেন, এয়া রাসূলাল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়কা ওয়াসাল্লাম কোন্ দলটি জান্নাতে যাবে? এরশাদ হলো, ‘মা’- আনা আলাইহি ওয়া আসহাবী, ‘আমি এবং আমার সাহাবীদের দল।’ [তিরমিযী]
উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় মোল্লা আলী ক্বারী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর মিরক্বাত শরহে মিশকাত এ নাজাত প্রাপ্ত দলটিকে ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত’ বা সুন্নি মুসলমানদের দল হিসেবে চিহ্ণিত করেছেন। হযরত বড়পীর গাউসুল আ’যম আব্দুল ক্বাদের জিলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাঁর ‘গুনিয়াতুত্ তালেবীন’-এ উক্ত নাজাতপ্রাপ্ত দলকে ‘সুন্নী জামা‘আত’ বলে উল্লেখ করেন এবং বাকি ৭২টি বাতিল ইসলামের তালিকাও তিনি প্রণয়ন করেন। এ বাতিল দলে রাফেজী, খারেজী, শিয়া, মু’তাযিলা, ক্বদরিয়া, জবরিয়া এভাবে ৭২টি দলের নামে রয়েছে। শিয়ারা অধিকাংশ সাহাবীকেই গালাগালি করার ধৃষ্টতা দেখায়। সুতরাং তারা সাহাবীদের অনুসারী হবার প্রশ্নই উঠেনা। পরবর্তীতে এ দলগুলো আরো বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে ইসলামের সাংস্কৃতিক ঐক্য নষ্ট করেছে। এ সমস্ত বাতিল সম্প্রদায়ের সাথে ইসলামের মূলধারা সুন্নিয়তের অনুসারীদের রয়েছে সাংস্কৃতিক সংঘাত। বর্তমানে আছে শিয়া সম্প্রদায়, খারেজীদের নব্য সংস্করণ ওহাবী সম্প্রদায়, কাদিয়ানী সম্প্রদায় এবং মু’তাযিলাদের নব্য সংস্করণ মওদুদী সম্প্রদায়। ইসলামি আইনে শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য বিদ্যমান। উত্তরাধিকার আইন, পারিবারিক আইনসহ অনেক ক্ষেত্রে এ পার্থক্য সুস্পষ্ট। শুধু তাই নয়, শিয়া’রা সাময়িক বিয়ে অর্থাৎ নেকাহ-ই মাত্‘আহ্ (Contact Marriage) কে নিজেদের সংস্কৃতির অংশ করে নিয়েছে, অথচ এটা নিষিদ্ধ হয়ে গেছে হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর যুগেই। কারণ, এটা নারী জাতিকে ভোগের পণ্যে পরিণত করে। শিয়ারা একদিকে ইসলামের দাবীদার অন্যদিকে খ্রিস্টান ইহুদীদের সাময়িক বিয়েকে লালন করে যাচ্ছে। সুন্নিরা ১০ মহররম পবিত্র আশুরা উপলক্ষে ফাতেহা-মাহফিল করে, তবাররুকের আয়োজন করে, শোহাদায়ে কারবালা’র তাৎপর্য শীর্ষক ওয়াজ-নসীহতের ব্যবস্থা করে, ওরস শরীফ উদ্যাপন করো আহলে বায়তের মর্যাদা তুলে ধরে। আর শিয়ারা কারবালার অনুসরণের নামে বুকে ছুরি চালানোর মতো অতি গর্হিত মাতম সংস্কৃতি পালন করে, যা সুন্নিরা নিন্দনীয় মনে করে। আশুরার মেলার নামে এরা কল্পিত এজিদ ও ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর মূর্তি তৈরি করে। শিয়ারা ইফতার করে এশা’ নামাযের সময়ে- অথচ সুন্নিরা করে সূর্যাস্তের পরপর। এরা ক্বোরআনের অনেক সূরাকে অস্বীকার করে আর অধিকাংশ হাদিসকেই বানোয়াট মনে করে। এ বিস্তর সাংস্কৃতিক পার্থক্য শিয়াদেরকে আলাদা একটি ধর্ম-সম্প্রদায়ে রূপান্তরিত করেছে এবং বিশ্বব্যাপী সুন্নিদের সাথে তাদের সংঘাতকে অনিবার্য করে রেখেছে। সমাজ পৃথক হলে সংস্কৃতিও পৃথক হতে পারে। শিয়াদের সমাজও পৃথক হয়ে আছে।
শুধু শিয়ারা কেন, ক্বাদিয়ানীরাও আলাদা সমাজে বসবাস করে। তাদের মসজিদেও প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। তারা গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানীকেও নবী মানে বিধায় সুন্নিদের সাথে সংঘাত চলছে। হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম শেষ নবী-এরপর অন্য কোনো নবী আসতে পারে না, এরপর ওলী, পীর, মুর্শিদ, মুজাদ্দিদ (সংস্কারক) এবং ইমামগণই নবীগণের উত্তরসূরী হয়ে দায়িত্ব পালন করবেন অথচ এরা এ মৌলিক বিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত করায় আলাদা ধর্ম-সম্প্রদায় হিসেবে গণ্য হচ্ছে। এদের সমাজ ও বিশ্বাসের পার্থক্য সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে, ভিন্নতা সৃষ্টি করেছে। ওহাবী সম্প্রদায় খারেজীদের উত্তরসূরী কট্টর-উগ্রপন্থী একটি নব্য উপদল। সউদী আরব (নজদ)’র ক্ষমতা দখল করে প্রায় ৭০ বছর যাবত এরা সুন্নি পরিচয়ে সুন্নিদের সাথে আক্বিদাগত সংঘাতে লিপ্ত রয়েছে। মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব নজদী ও মুহাম্মদ ইবনে সউদকে হাতে নিয়ে, আর্থিক ও সশস্ত্র সহযোগিতা দিয়ে আরব জাতীয়তাবাদের শ্লোগানের আড়ালে তুর্কী ভিত্তিক সুন্নি খেলাফতের অবসান ঘটানোর কৌশল হিসেবে ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদীরা দীর্ঘ এক শতাব্দির প্রচেষ্টায় নজদ ভিত্তিক ‘ওহাবী আন্দোলনকারী’দের ক্ষমতায় বসায়। ওহাবীদের নজদ ভিত্তিক উত্থান নবীজি হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র ভবিষ্যৎবাণী ‘নজদ থেকে শয়তানের শিং বের হবে’ (আল হাদিস) -এর যথার্থ বাস্তবায়ন। তাদের উত্থান মুসলমানদের বর্তমান ভয়াবহ পরিণতির প্রধান কারণ। তাদের কারণে তুর্কি খেলাফত ধ্বংস হলো এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম হয়। আজ পঞ্চাশ বছর ধরে ফিলিস্তিনসহ পৃথিবীর কোন নির্যাতিত দেশের পক্ষে এ সউদী আরব দাঁড়াতে পারেনি। কারণ, মুসলমানদের পক্ষে দাঁড়াতে গেলে ব্রিটিশ আমেরিকানদের বিরুদ্ধে যেতে হবে। যারা ক্ষমতায় বসিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে গেলে ফাঁস হয়ে যাবে অনেক তথ্য, অধিকন্তু হারাতে হবে ক্ষমতা। তাই, তারা বরাবরই খ্রিস্টান ইহুদীদের স্বার্থ রক্ষা করে ‘শয়তানের শিং’ হবার সত্যতা প্রমাণ করেছে। যে জজিরাতুল আরব থেকে ইহুদী-খ্রিস্টানদের বাইরে রাখার নির্দেশ রয়েছে, সেখানেই আজ ইহুদী-খ্রিস্টান তথা আমেরিকান পুরুষ-মহিলা সৈনিকদের মেহমানদারী করা হচ্ছে। এরা ক্ষমতায় এসেই সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের আশ্রয় নিয়েছিল ভয়াবহভাবে। মুছে দিতে চেয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্যকে।
পৃথিবীর দেশে দেশে যখন সাংস্কৃতিক ইতিহাস সংরক্ষণের লক্ষে পুরোনো স্থাপনা, স্থাপত্য, নাম ফলক তথা বিভিন্ন নিদর্শন আবিস্কার, সংরক্ষণ করছে। পুরোনো নিদর্শন সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জন্য সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান জাদুঘর প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। সেখানে ওহাবীরা ক্ষমতায় এসেই প্রথমে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবা-ই কেরাম ও আহলে বায়তের স্মৃতি বিজড়িত তেরশ’ বছর আগের নজদ-হেযাযকে ইবনে সউদ এর নামানুসারে পরিবর্তন করে ‘সউদী আরব’ নামকরণ করলো। ‘নজদ থেকে শয়তানের শিং বের হবে’ এ ভবিষ্যৎ বাণী যাতে আর জীবিত না থাকে এ জন্য ‘নজদ’ স্থানটিকে ‘রিয়াদ’ বানানো হলো। রাসূল করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র রওযা মুবারকটি ধ্বংস করতে না পারলেও ওখানকার তেরশ’ বছরের স্মৃতিবাহী সকল মাযার-খানক্বাহ্ এমনকি মসজিদ পর্যন্ত মাটির সাথে মিশিয়ে নজীরবিহীন সাংস্কৃতিক সন্ত্রাস চালানো হলো। ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, ওরস-ফাতেহাসহ সূফী দর্শন ভিত্তিক সংস্কৃতি কঠোর হস্তে দমন করা হলো এবং এসব সংস্কৃতির সমর্থকদেরও উচ্ছেদ করা হলো-মাতৃভূমি থেকে। আগের আরব আর সউদী আরব সাংস্কৃতিকভাবে বহুযোজন দূরে অবস্থান করছে মক্কা শরীফ দারুল ইলম কোম্পানী কর্তৃক প্রকাশিত। মদীনা শরীফের নতুন ও পুরাতন নিদর্শনাবলীর ইতিহাস সংক্রান্ত ৩৩৯ পৃষ্ঠা বিশিষ্ট একটি বইয়ে ৭০-৮০ বছর আগের বিভিন্ন মসজিদ, মাযার-গুম্বুজ ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ছবিসহ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরের ছবিসহ বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে ওহাবী শাসকদের সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের ইতিহাস।
আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ ইয়াসিন আল খাইয়্যারী আল মাদানী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি কর্তৃক লিখিত ‘তারীখু মা‘আলিমিল মদীনাতিল মুনাওয়ারাহ্ নামক এ প্রামাণ্য গ্রন্থটির ১৯৯১ সালে মক্কা শরীফ থেকে প্রকাশিত তৃতীয় সংস্করণ চট্টগ্রামের মাওলানা কাজী মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন আশরাফি’র ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে আমি (লেখক) নিজেও দেখেছি। এছাড়াও দৈনিক আজাদী চট্টগ্রাম’র চীফ রিপোর্টার মুহাম্মদ ওবায়দুল হক গত ১৪ মার্চ ২০০২ তারিখে চট্টগ্রামের মুফতি ওবাইদুল হক নঈমী ও আমাকে (লেখক) একটি করে সেদিন মাত্র প্রকাশিত হওয়া একটি বই ‘সফরনামা’: আরব ও হেজায’-এর কপি সরবরাহ্ করেন। এ বইটি তাঁর দাদা হাটহাজারী থানার ধলই (হাধুরখিল) নিবাসী মাওলানা এয়ার মুহাম্মদ সাহেবের নিজ হাতে আজ থেকে ৮৮ বছর আগে লিখিত তাঁর নিজের আরব-হেজাজ সফরের বর্ণনা হিসেবে একটি ঐতিহাসিক ও প্রামাণ্য দলিল বটে। ১৫ জুন ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ (১৩২০) অপরাহ্ণ ৪ ঘটিকায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে ভারত, মিসর, সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, আরব ও হেজাজের বিভিন্ন নিদর্শন যেয়ারতে যাওয়ার ধারাবাহিক বর্ণনার সময়, দূরত্ব, যানবাহনের প্রকৃতি ও ভাড়াসহ পুঙ্খানুপুঙ্কভাবে তিনি বর্ণনা করেছেন এতে এমন একটি সুস্পষ্ট নির্ভরযোগ্য দলিল দেখা যাচ্ছে, আজ থেকে মাত্র ৭০-৮০ বছর আগেও সেখানে অসংখ্য গুম্বুজওয়ালা মাযার ছিল। মাওলানা এয়ার মুহাম্মদ সাহেব ওহুদ প্রান্তরে হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দাঁঁত মুবারক শহীদ হবার স্থানটিকে গুম্বুজওয়ালা ঘর হিসেবে সংরক্ষিত আছে বলে উল্লেখ করেছেন। সেখানকার হযরত আমির হামযা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র মাযারকেও গম্বুজ ও লোহার গ্রীলওয়ালা মাযার ঘর বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি এরূপ অসংখ্য মাযারের অবকাঠামোগত বর্ণনা করেছেন, যা এরপরই ১৯৩২ সনের দিকে ‘সউদী আরব’ প্রতিষ্ঠার সময় ধ্বংস করা হয়েছে। উহুদের শহীদের মাযার-মসজিদের ছবি মক্কা শরীফ থেকে প্রকাশিত ওই বইটিতেও দেখেছি। শুধু তাই নয়, এয়ার মুহাম্মদ সাহেব প্রণীত সফরনামায় দেখা যায়, মক্কা শরীফে খানায়ে কা’বার সাথে জবলে আবী ক্বোবাইস পাহাড়ের পাদদেশে ‘হযরত গাউসুল আ’যম আবদুল ক্বাদের জীলানী মসজিদ’ ছিল যেখানে তিনি নামায আদায় করেছেন ১৯১৪ সনে। যার অস্তিত্ব বর্তমানে কল্পনাতীত। এরূপ অসংখ্য মসজিদ ও মাযার ভাঙ্গা হয়েছে শুধুমাত্র শির্ক-বিদ‘আত ও হারাম থেকে মানুষকে রক্ষার মিথ্যা অজুহাতে।
[সূত্র. মৌলভী হাজি এয়ার মোহাম্মদ কর্তৃক ২৫ মাঘ ১৩৩০ বাংলা সনে প্রথম সংস্করণ হিসেবে প্রকাশিত গ্রন্থ ‘সফরনামা আরব ও হেজায’র ১১ মার্চ ২০০২ তারিখে কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেস, চট্টগ্রাম হতে সাংবাদিক ওবায়দুল হক প্রকাশিত দ্বিতীয় সংস্করণ সংখ্যা]।

http://www.anjumantrust.org

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন