শিয়া পরিচিতি

তৃতীয় পর্ব
=======
ইমামিয়া শিয়া বা ইমামপন্থী শিয়াদের  ৩৫ টি উপদল:
======
পূর্বে   উল্লেখ    করা   হয়েছে   যে,   প্রথম    যুগে     শিয়াগণ মূলত:   চারটি   গ্রুপে  বা  শ্রেণীতে   বিভক্ত    ছিল।  তারা হলো  (১)  মুখলিসীন  (২)  তাফদিলীয়া  (৩)  ছাব্বাইয়া  এবং (৪)  ঘালিয়া। চতুর্থ   গ্রুপটি হযরত আলী  ও তাঁর  বংশধরদের  মধ্যে  কোন  না  কোন  প্রকারে  খোদায়িত্ব  আরোপ করতো। এরা চরমপন্থী। এরা পরবর্তীতে ২৪ টি উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে  - যা এই মাত্র আলোচনা করা        হয়েছে।          তাদের        শেষোক্ত        দলের         নাম ইমামিয়াপন্থী শিয়া। এই  ঘালি উপদলটি পরবর্তীকালে আক্বীদা ও আমলের ক্ষেত্রে  পুণরায় ৩৫  টি  উপশাখায় বিভক্ত  হয়ে  যায়।  বক্ষমান  আলোচনায়  তাদের  শ্রেণী  বিন্যাস ও আক্বীদা বিশ্বাস পর্যালোচনা করা হলো।

১।    হাসানী   শিয়া:   এই      উপদলটি   ইমামিয়া    শাখার  একটি  দল।  এদের  আক্বীদা  হলো  -  ”হযরত  আলীর  পর    ইমামত    ও   নেতৃত্ব   শুধু   ইমাম    হাসান   ও     তাঁর  বংশধরগণের      মধ্যেই      সীমাবদ্ধ।      ইমাম      হোসাইন  রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু অথবা তাঁর বংশধরগণের মধ্যে কেউ এ  পদের  মালিক   নন”।  এদের    বিশ্বাস  মতে   হযরত ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু শহীদ হওয়ার পর তাঁর পুত্র  দ্বিতীয় হাসান   তাঁর স্থলাভিষিক্ত ছিলেন। ক্রমান্বয়ে এই   ধারা   তাঁর   পুত্র    আবদুল্লাহ,   তাঁর      পুত্র     নাফছে  যাকিয়া  ও  ইব্রাহীম  পর্যন্ত  চালু  ছিল।  শেষোক্ত  দু'জন  আব্বাসীয়  খলিফা    আল   মনসুর    এর  যুগে   আব্বাসীয় খিলাফতের  বিরুদ্ধে   বিদ্রোহ   ঘোষণা    করে  শাহাদাত  বরণ  করেন। আরব ও আজমে  তাদের  অনুসারী  ছিল  প্রচুর।   আব্বাসীয়      রাজতন্ত্রের    বিরুদ্ধে    তাঁরা   ছিলেন সোচ্চার।   ইমাম   আবু  হানিফা   রহমাতুল্লাহি  আলাইহি  নাফছে     যাকিয়াকে     গোপনে    সহযোগিতা    করতেন।  তাঁদের   শাহাদতের   অনেক   পরে   ১৯৫   হিজরী   সনে  হাসানী   শিয়া   গ্রুপটির   জন্ম  হয়।  এরা  উপরোক্ত  ছয় জনের ইমামতে বিশ্বাসী। এটা তাদের মনগড়া আক্বীদা - যা পরবর্তী যুগে গড়ে উঠেছে।

২।  হাকামিয়া শিয়া: হিশাম  ইবনে হাকাম নামীয় শিয়া নেতার    অনুসারীগণকে     হাকামিয়া      শিয়া    বলা    হয়। এদের    চরমপন্থী     আক্বীদা     হলো     -    ”ইমাম     হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু     আনহু   এর   পর    ইমাম   হোসাইন,    ইমাম জয়নুল আবেদীন, ইমাম বাকের, ইমাম জাফর সাদেক রাদ্বিয়াল্লাহু     আনহুমা   পর্যন্তই   ইমামতের   পদ   সমাপ্ত। এরপর  আর কোন  ইমাম নেই”।  এ প্রশাখার সৃষ্টি  হয় ১০৯ হিজরীতে।

৩। ছালিমিয়া শিয়া: হিশাম  ইবনে ছালিম নামের শিয়া  নেতার   অনুসারীরা   ছালিমিয়া    শিয়া     নামে   পরিচিত। ইমামদের   ক্ষেত্রে হাকামিয়া প্রশাখার আক্বীদা   পোষণ  করলেও        এরা      আক্বীদাগত      দিক      থেকে      পৃথক।  হাকামিয়া  প্রশাখার  আক্বীদা  হচ্ছে  -  ”আল্লাহ  তায়ালা  দীর্ঘ  দেহধারী  -  দৈর্ঘ্য,  প্রস্থ  এবং  উচ্চতা  বিশিষ্ট  এক  মহান সত্বা”।  কিন্তু  ছালিমিয়া শিয়াদের বিশ্বাস  হচ্ছে - ”মানুষের আকৃতিতেই  আল্লাহ আকৃতি ধারণকারী এক সত্বা”। ১১৩ হিজরীতে এদের উদ্ভব হয়।

৪।  শয়তানিয়া বা    নোমানিয়া   শিয়া: মোহাম্মাদ ইবনে নোমান     ছায়রাফী     নামের       নেতার     অনুসারীদেরকে শয়তানিয়া  শিয়া  বলা  হয়।  কেননা,  মোহাম্মাদ  ইবনে  নোমানের     উপাধী   ছিল    ”শয়তানুত    তাক”।   অবশ্য শিয়ারা তাকে বলতো - ”মোমেনুত তাক”। এই দলের ইমামতের   ক্ষেত্রে   ইমাম    জাফর   সাদেক    রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর ছেলে ইমাম  মুছা কাযেম রাদ্বিয়াল্লাহু  আনহু পর্যন্ত   ইমাম   স্বীকার   করে।   ছালিমিয়া   গোত্রের   ন্যায়  এরা আল্লাহকে মানুষের  আকৃতি  ধারণকারী  এক স্বত্বা বলে বিশ্বাস করে। এদের জন্ম হয় ১১৩ হিজরীতে।

৫।   জারারিয়া শিয়া: ১৪৫ হিজরীতে  এই নূতন   শিয়া   ফির্কার সৃষ্টি হয়। কুফার অধিবাসী জারার ইবনে আউন নামের      জনৈক       শিয়া      এদলের      নেতা।     হাকামিয়া শিয়াদের ন্যায়    এরা ইমাম জাফর  সাদেক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু    পর্যন্ত    ইমাম     মান্য    করে।    এই     দল    আল্লাহ তায়ালার    গুনাবলী    বা     ছিফাত        সমূহকে    অবিনশ্বর (কাদীম)     বলে     স্বীকার     করেনা     -     বরং     নশ্বর     বা  পরিবর্তনশীল     (হাদেছ)     বলে    মনে    করে।    আদিতে আল্লাহর  ছিফাত     ছিলনা  -  পরে   হয়েছে   বলে   এদের ধারণা।

৬। বাদাইয়া শিয়া: এরা  প্রথম  ছয়জন  ইমামকে  মানে (হযরত  আলী,    হাসান,  হোসাইন,   জয়নুল  আবেদীন,  ইমাম  বাকের  ও  জাফর  সাদেক  রাদ্বিয়াল্লাহু  আনহুম)  এদের   ধারণা  -   আল্লাহ  তায়ালা  প্রথমে   কোন  বিষয়ে সিদ্ধান্ত   নিয়ে    কাজটি      সৃষ্টি   করে   পরে    মুছলিহাতের পরিপন্থী মনে করে কখনও কখনও লজ্জিত হন। যেমন ইসলামের    প্রথম   তিন   খলিফা    নির্বাচিত    করে    পরে আল্লাহ     তায়ালা    লজ্জিত    হয়েছিলেন   (নাউযুবিল্লাহ)। এদের জন্ম ১৪৫ হিজরীতে।

৭।  মুফাউওয়াজা   শিয়া:  এরাও  ছয়  ইমামে    বিশ্বাসী। এদের    আক্বীদা  হচ্ছে   -   ”আল্লাহ  তায়ালা   মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু   আলাইহি  ওয়া সাল্লামের হাতে দুনিয়া সৃষ্টির দায়িত্ব   অর্পন   করে   দিয়েছেন”।   তাদের   কেউ   কেউ  আবার হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর উপর সৃষ্টির দায়িত্ব অর্পনের কথায় বিশ্বাস করে। আবার কেউ কেউ বলে - রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং হযরত     আলী     রাদ্বিয়াল্লাহু     আনহু      উভয়ের       উপরই যৌথভাবে  পৃথিবী  সৃষ্টির   দায়িত্ব   অর্পন  করা  হয়েছে। এদের জন্ম ১৪৫ হিজরীতে।

৮।   ইউনুছিয়া   শিয়া:   ইরানের   কুম   শহরের   বাসিন্দা  ইউনুছ   ইবনে   আবদুর    রহমান    নামীয়   জনৈক   শিয়া  নেতার অনুসারী এই  দল। এরাও ছয় ইমামে বিশ্বাসী। আল্লাহ সম্পর্কে এদের বিশ্বাস হচ্ছে - ”আল্লাহ তায়ালা প্রকৃত     ও     শাব্দিক    অর্থেই    আরশের    উপর    উপবিষ্ট আছেন    এবং    ফেরেস্তাগণ    উক্ত    আরশ    ধারণ    করে  আছে”।

৯।    বাকেরিয়া     শিয়া:   এই   দলের   বিশ্বাস    -   ”ইমাম বাকের    রাদ্বিয়াল্লাহু   আনহু    ইন্তেকাল   করেননি।   বরং  তিনি ভবিষ্যতে পুন: আত্মপ্রকাশ করবেন”।
                                                              (চলবে)

উস্তাজুল উলামা আল্লামা আবদুল জলীল রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর 'শিয়া পরিচিতি' থেকে প্রকাশিত হচ্ছে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন