খাঁটি সৈয়্যদ-বংশের আকাশে উদিত উজ্জ্বল চাঁদ
হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি বিশ্বনবী হযরত
মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম- এর ৩৭তম বংশীয় হযরত সৈয়্যদ সদর শাহ্ রাহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হির ৪র্থ পুত্র। আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হি উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, বিশুদ্ধ বর্ণনা মতে ১৮৫৭ ইংরেজী সালে পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে হাজরা জিলার সিরিকোট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬১ ইংরেজী সালে মহান ওলী এ পার্থিব জীবন থেকে পর্দা করেন । তিনি রসূলে পাকের ৩৮তম বংশধর । [হালাতে মাশওয়ানী ইত্যাদি|
পারিবারিক ঐতিহ্য
শাহানশাহে সিরিকোটের পূর্বপুরুষের এক বিখ্যাত মহান সাধক হযরত বান্দা নাওয়ায গেসূদরায রাহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হি। ইসলামের বাণী প্রচারের নিমিত্তে ভারত থেকে আফগানিস্তানে তাঁর শুভাগমন ঘটে। তাঁরই বংশের সৈয়্যদ গফুর শাহ্ রাহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হি নামের একজন ইসলাম প্রচারক মহান বুযুর্গ পাকিস্তানের সীমান্ত প্রদেশের শেতালু সিরিকোটে এসে বসতি স্থাপন করেন। তাঁর অক্লান্ত শ্রম ও প্রচেষ্টার ফলে এতদঞ্চলে ইসলামের আলোর বিকিরণ ঘটে। এ কারণে তাঁকে ‘ফাতেহে সিরিকোট’ (সিরিকোট বিজয়ী) হিসেবে স্মরণ করা হয়। তাঁরই ১৩শ প্রজন্মে বিকশিত হন হযরত সদর শাহ্ আলায়হির রাহমাহ্। হুযূর ক্বেবলা শাহান শাহে সিরিকোট তাঁরই পবিত্র বংশধর, উত্তরসূরী। তাঁর ঔরসে
জন্মগ্রহণ করেন হুযুর ক্বেবলা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব
শাহ্। তাঁরই ঔরসজাত হলেন বর্তমান হুযুর ক্বেবলা
সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ ও হুযূর ক্বেবলা সৈয়্যদ
মুহাম্মদ সাবির শাহ্ দামাত বরকাতুহুমুল আলিয়া।
[হালাতে মাশওয়ানী, লোকাল গভর্ণম্যান্ট এ্যাক্ট ৩৩ (বরাত ১৫) ১৮৭১ ইংরেজী)
শিক্ষা গ্রহণ
হুযুর ক্বেবলা শাহান শাহে সিরিকোট হযরত সৈয়্যদ
আহমদ শাহ্ শৈশবেই পবিত্র কোরআন হিফয (মুখস্থ)
করে হাফেয হন। তারপর স্বদেশে ও বিদেশে দ্বীনী শিক্ষার বিভিন্ন সুক্ষাতিসুক্ষ্ম বিষয়ে অসাধারণ পান্ডিত্য অর্জন করেন এবং উচ্চতর ডিগ্রী লাভ করেন। এসব ডিগ্রীর মধ্যে একটি ১৮৮০ ইংরেজী সালে শ্রেষ্ঠত্বের জন্য প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ‘ফাযিল' সনদ অন্যতম। সনদটিতে ১২৯৭ হি. শা'বান মাস উল্লেখ আছে। উল্লেখ্য, স্থানীয় পর্যায়ে ও পারিবারিকভাবে তিনি ইলমে ক্বিরআত থেকে শুরু করে নাহ্ভ, সরফ, উসূল, ফিকাহ্, আক্বাইদ, দর্শন, ইলমে হাদীস, ইলমে তাফসীরসহ ধর্ম তথ্যের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় অসাধারণ ব্যুৎপত্তি ও পান্ডিত্য অর্জন করেন। তারপর উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে গিয়ে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করেন। আর পরিণত বয়সে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের ভান্ডার আহরণ করেন- ওলী-ই কামিল, ইলমে লাদুন্নীর ধারক, খাজা-ই খাজেগান, খলীফা-ই শাহে জীলান হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌরভী রাহমাতুল্লাহি
তা'আলা আলায়হি থেকে, তাঁর হাতে বায়'আত গ্রহণ করে।
আদর্শ ও বরকতমন্ডিত কর্মজীবন
নবীকুল সরদার হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ বাস্তবায়ন তাঁর
স্বভাবজাত। তা তাঁর কর্ম জীবনে অনায়াসে ফুটে ওঠেছে।
আল্লামা সিরিকোটি তাঁর সহোদরের সাথে সুদূর দক্ষিণ
আফ্রিকায় ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন এবং
প্রতিষ্ঠিতও হন। এখানে লক্ষণীয় যে, ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করে প্রচুর অর্থবৈভব আহরণ করে বিলাসবহুল জীবন যাপন করা এ মহান ওলীর মুখ্য উদ্দেশ্য নয়, বরং পাশাপাশি দ্বীনের আদর্শ প্রচারসহ অন্যান্য দ্বীনী কর্মকান্ডে আত্মনিয়োগ করা তাঁর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য । তাই তিনি যেখানেই গিয়েছেন এ মহান ব্রত পালনে তৎপর ছিলেন। প্রথমে আফ্রিকার দিকে দেখা যাক। তিনি আফ্রিকার ক্যাপটাউন, জাঞ্জিবার ও মোমবাসা শহরে অবস্থানকালে সেখানকার জনগণের মাঝে দ্বীনী দাওয়াত পৌঁছান। এসব অঞ্চলে শিয়া সম্প্রদায়ের দৌরাত্ম্য আগে থেকে বিরাজিত ছিলো। কিন্তু শাহানশাহে সিরিকোট ওই সম্প্রদায়টির ভ্রান্ত মতবাদ হতে সাধারণ মুসলমানদের রক্ষা করে সেখানকার মানুষকে সুন্নী-হানাফী মাযহাবে দীক্ষিত করেন।
সেখানকার ইতিহাসের প্রমাণ্য গ্রন্থ হতে জানা যায় যে,
তিনিই সেখানে সর্বপ্রথম মসজিদ নির্মাণ করেন।
[তাযকিরাহ্-ই আকাবিরে আহলে সুন্নাত (পাকিস্তান) কৃত: আল্লামা মুহাম্মদ আবদুল হাকীম শরেফ ক্বাদেরী, লাহোর, মুদ্রণ ও পরিবেশনায়, লাহোর ফরীদ বুক স্টল- ২০০০ ইংরেজী, পৃষ্ঠা ১৬৯।
দ্বিতীয়ত: এর পর ১৯১২ ইংরেজী সালে স্বদেশে (পাকিস্তান) ফিরে আসেন শাহানশাহে সিরিকোটি হযরত সৈয়্যদ হযরত আহমদ শাহ্ সিরিকোটি। এখানে এসে তিনি হযরত আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী
রাহমাতুল্লাহি তা'আলা আলায়হির হাতে ক্বাদেরিয়া
ত্বরীকায় বায়'আত গ্রহণ করেন। এদিকে আপন পীর
মুরশিদের বাড়ির সন্নিকটে বাজারে দোকান খুলে ব্যবসাও করতে থাকেন। একই সাথে সময় সুযোগ পেলেই নিজের পীর মুরশিদের খিদমতে নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন।
সেখানেও একটি মসজিদের নির্মাণ কাজে সাহায্য করেন। তদ্সঙ্গে আপন পীর-মুরশিদের কৃপাদৃষ্টি অর্জনের চেষ্টা করতেন তিনি। পীরের দরবারের কোন কাজ সমাধাকে ত্বরীক্বতের উত্তম রিয়াযত মনে করতেন। সুতরাং দরবারের জন্য বিশেষ প্রয়োজনীয় কাজ জ্বালানী কাঠ সংগ্রহটি সমাধা করতে তিনি মনস্থির করলেন। আঠার মাইল দূরের সিরিকোট পাহাড় হতে লাকড়ি সংগ্রহ করে নিজ কাঁধে করে, পায়ে হেঁটে পীরের বাড়িতে নিয়ে আসার খিদমতে তিনি নির্দ্বিধায় আত্মনিয়োগ করেন। নিজের বংশমর্যাদা,
ব্যক্তিগত যশখ্যাতি, জ্ঞানগত ও সফল ব্যবসায়ী সুলভ
আত্মমর্যাদা- সবই তিনি বিলীন করে দেন। নিজের
আমিত্বকে খোদার রাহে বিলীন করার এ যে, এক বিরল দৃষ্টান্ত।
অথচ তাঁর মহান মুর্শিদ তাঁকে এ কঠিনতর কাজটি করতে নির্দেশ দেননি; বরং সঙ্গে সঙ্গে তা করতে এক দিকে মৌখিকভাবে বারণ করলেন, অন্যদিকে তা থেকে বিরত থাকারও একটি অলৌকিক ব্যবস্থা হয়ে গেলো। মাত্র কিছু দিন যেতে না যেতে তাঁর কাঁধে আকস্মিক এক ফোঁড়া উঠে গেলো। আরোগ্য হতে লাগলো দীর্ঘ নয় মাস। ফলে তিনি একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও একাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
তৃতীয়ত: সুদূর বার্মা সফর ও সেখানে বরকতপূর্ণ
অবস্থান। অতঃপর পীরের নির্দেশে ১৯২০ ইংরেজী সালে শাহানশাহে সিরিকোট বার্মার উদ্দেশ্যে স্বদেশ ত্যাগ করেন এবং সেখানে প্রায় ষোল বছর অবস্থান করেন। সেখানকার বিভিন্ন মসজিদে ইমাম ও খতীবের দায়িত্ব পালন করেন এবং সাথে সাথে সাধারণ মুসলমানদের ইসলামের সঠিক রূপরেখার (সুন্নী মতাদর্শ) দিক-নির্দেশনা দান করেন।
এভাবে তাঁর অগণিত কারামতও রয়েছে। কলেবর বৃদ্ধি
এড়ানোর জন্য এখানে উল্লেখ্য করা গেলো না। তাঁর পূর্ণাঙ্গ জীবনী গ্রন্থে এগুলোর আরো অনেক কিছু উল্লেখ করা যাবে। ইনশাআল্লাহ্।
(মাসিক তরজুমান,জ্বিলক্বদ ১৪৪১হি)
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন