দিনের সময় সূচী বানিয়ে নিন
প্রিয় প্রিয় ইসলামী ভাইয়েরা! সম্ভবপর হলে নিজের দৈনন্দিন জীবনের সময়সূচি বানিয়ে নিন। ইশার নামায আদায় করার পর দুই ঘন্টার মধ্যেই শুয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুন। রাত্রিবেলায় অনর্থক আড্ডা দেয়া, গল্প গুজবে হােটেল রেস্তোরা সরগরম করে তােলা, শরয়ী প্রয়ােজন ছাড়া বন্ধু বান্ধবদের মজলিসে সময় নষ্ট করা খুবই ক্ষতিকারক। তাফসীরে রূহুল বয়ান ৪র্থ খন্ডের ১৬৬ পৃষ্ঠাতে উল্লেখ আছে, লুত عَلٰی نَبِيِّنَا وَعَلَيۡهِ الصَّلٰوةُ والسَّلَامُ এর জাতির ধ্বংস হওয়ার কারণ এটিও একটি ছিল যে, তারা চৌরাস্তায় বসে লােকদের সাথে ঠাট্টা মশকরা করত।
প্রিয় ইসলামী ভাইয়েরা! আল্লাহর ভয়ে প্রকম্পিত হােন। বন্ধু যতই অন্তরঙ্গ হােক না কেন, তার সঙ্গ পরিহার করুন। আল্লাহর স্মরণ থেকে বিরত রাখে এরূপ মজলিস বর্জন করুন। রাত্রিবেলায় ধর্মীয় কার্যাবলী সেরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ুন। কেননা রাত্রি বেলার বিশ্রাম দিনের বেলার বিশ্রামের তুলনায় স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী এবং জীবনের স্বভাবগত চাহিদাও তা।
মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনের ২০ পারার সূরাতুল কাসাস এর ৭৩ নং আয়াতে ইরশাদ করেন,
وَ مِنۡ رَّحۡمَتَهٖ جَعَلَ لَكُمُ الَّيۡلَ وَ النَّهَارَ لِتَسۡكُنُوۡا فِيۡهِ
وَلِتَبۡتَغُوۡا مِنۡ فَضۡلِهٖ وَلَعَلَّكُمۡ تَشۡكُرُوۡنَ۞
কানযুল ঈমান থেকে অনুবাদ : এবং তিনি নিজ করুনায় তােমাদের জন্য রাত ও দিন সৃষ্টি করেছেন যেন রাতে আরাম করাে এবং দিনে তার অনুগ্রহ তালাশ করাে। (অর্থাৎ জীবিকা অর্জন করাে) আর এজন্য যে তােমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে।
প্রখ্যাত মুফাসসির, হাকিমুল উম্মত, হযরত মুফতী আহমদ ইয়ার খান رَحۡمَةُ اللّٰهِ تَعَالٰی عَلَيۡهِ তাফসীরে নুরুল ইরফানে ৬২৯ পৃষ্ঠায় এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন। এ থেকে বুঝা যায় যে, রােজগারের জন্য দিন আর আরামের জন্য রাতকে নির্ধারিত করা উত্তম। রাতে বিনা কারণে জাগ্রত থাকবে না আর দিনে বেকার থাকবে না। যদি কোন সমস্যার কারণে দিনের বেলায় ঘুমায় আর রাতের বেলায় রােজগার করে তবে ক্ষতি নেই। যেমন রাতের বেলায় চাকুরীরত চাকুরে ইত্যাদি।
সকালে ফযীলত
সময় সূচি নির্ধারণের সময় কাজের ধরনও প্রকৃতির প্রতি লক্ষ্য রাখবেন। যেমন যে ইসলামী ভাই রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে যান সকাল বেলায় তার মন মস্তিষ্ক সতেজ থাকে। তাই জ্ঞান চর্চার জন্য সকাল বেলার সময়ই যথােপযুক্ত।
সকাল বেলার ফযীলত সম্পর্কে রাসূল صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم এর একটি দুআ ইমাম তিরমিযী বর্ণনা করেন, রাসূল صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم আল্লাহ তাআলার নিকট দুআ করে বলেন, হে প্রভু! আমার উম্মতের জন্য সকাল বেলার সময়ে বরকত দান করুন। (তিরমিযী, খন্ড-৩য়, পৃ-০৬, হাদীস নং-১২১৬)।
প্রখ্যাত মুফাসসির, হাকিমুল উম্মত, হযরত মুফতী আহমদ ইয়ার খান رَحۡمَةُ اللّٰهِ تَعَالٰی عَلَيۡهِ আলােচ্য হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেন, আলােচ্য হাদীসের মর্ম হচ্ছে, হে মালিক! আমার উম্মতের সে সব দ্বীনি ও দুনিয়াবী কাজে বরকত দান করুন যা তারা সকাল বেলায় সম্পাদন করে থাকে। যেমন সফর, জ্ঞানার্জন, ব্যবসা বাণিজ্য ইত্যাদি। (মেরাতুল মানাজিহ, খন্ড-৫ম, পৃ-৪৯১)।
সকালে ঘুম থেকে উঠার পর থেকে রাতে শােয়ার আগ পর্যন্ত প্রতিটি কাজের সময় নির্ধারণ করে সে নির্ধারিত সময় মােতাবেকই সব কাজ সম্পাদন করার চেষ্টা করবেন। যেমন তাহাজ্জুদ, জ্ঞান চর্চা, মসজিদে প্রথম তাকবীরের সাথে জামাআত সহকারে ফজরের নামায আদায়, (অনুরূপ অন্যান্য নামাযও) ইশরাক, চাশত, নাশতা, জীবিকা উপার্জন, দুপুরের আহার, পারিবারিক কাজ, সান্ধ্যকালীন কাজ, সংসর্গ, (যদি তা সম্ভবপর না হয় তবে নিঃসঙ্গতাই শ্রেয়) ধর্মীয় প্রয়ােজনে ইসলামী ভাইদের সাথে যােগাযােগ ইত্যাদি কাজের জন্য সময় নির্ধারণ করে সে সময় মােতাবেকই সব কাজ করার চেষ্টা করবেন। আর যারা নির্ধারিত সময় মােতাবেক কাজ করার অভ্যস্ত নন। তাদের রুটিন মােতাবেক কাজ করতে প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হতে পারে, কিন্তু যখন তারা রুটিন মােতাবেক কাজ করার অভ্যাস গড়ে তুলবেন, তখন এর সুফল তারা নিজেরাই দেখতে পাবেন।
“দিন লহু মে খােনা তুঝে শবে সুবহে তক ছােনা তুঝে,
শরমে নবী, খওফে খােদা ইয়ে ভি নিহি ওহ ভি নিহি
রিযকে খােদা খায়া কিয়া ফরমানে হক টালা কিয়া
শুকরে করম তারাছে যা ইয়ে ভি নিহি ওহ ভি নিহি।”
(হাদায়েখে বখশিশ)।
صَلُّوۡا عَلَى الۡحَبِيۡب
صَلَّى اللّٰهُ تَعَالٰى عَلٰى مُحَمَّد
প্রিয় প্রিয় ইসলামী ভাইয়েরা! সুন্নাতের ফযীলত এবং কয়েকটি সুন্নাত ও আদাব বর্ণনা করে রিসালা শেষ করার চেষ্টা করছি। তাজদারে রিসালাত صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم ইরশাদ করেছেন, যে আমার সুন্নাতকে ভালবাসল সে আমাকে ভালবাসল, আর যে আমাকে ভালবাসল সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে। (মিশকাতুল মাসাবিহ, খন্ড ১ম, পৃ-৫৫, হাদীস নং-১৭৫, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, বৈরুত)।
“সুন্নাত আম করে দ্বীনা কা হাম কাম করে, নেক হাে যাঁয়ে মুসলমান মদীনে ওয়ালে।”
صَلُّوۡا عَلَى الۡحَبِيۡب
صَلَّى اللّٰهُ تَعَالٰى عَلٰى مُحَمَّد
(১) শােয়ার আগে বিছানা ভালভাবে ঝেড়ে নিন, যাতে বিছানাতে কোন বিষাক্ত কীট পতঙ্গ থাকলে তা বের হয়ে যায়।
(২) শােয়ার পূর্বে এ দোয়াটি পড়ে নেবেন।
اَللّٰهُمَّ بِاسۡمِكَ اَمُوتُ وَاَحۡیٰ
হে আল্লাহ! আমি আপনার নাম নিয়েই মরি এবং জীবিত হই। (অর্থাৎ ঘুমাই এবং জাগ্রত হই) (বুখারী, খন্ড-৪র্থ, পৃ-১৯৬, হাদীস নং-৬৩২৫) ।
(৩) আসরের পর ঘুমাবেন না। কেননা এতে জ্ঞান লােপ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। রাসূলুল্লাহ صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আসরের পর ঘুমায়, ফলে তার জ্ঞান লােপ পায়, তখন সে নিজকেই দোষারােপ করে। (মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস নং-৪৮৯৭, খন্ড ৪র্থ, পৃ-২৭৮)।
(৪) দুপুরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়া মুস্তাহাব। (আলমগীরী, খন্ড-৫ম, পৃ ৩৭৬)
সদরুশ শরীয়া, বদরুত তরিকা হযরত আল্লামা মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ আমজাদ আলী আজমী رَحۡمَةُ اللّٰهِ تَعَالٰی عَلَيۡهِ বলেন, যারা রাত্রি বেলায় ইবাদতের জন্য জাগ্রত থাকে, রাত্রে নামায পড়ে, আল্লাহর জিকির করে। অথবা ধর্মীয় কিতাবাদি অধ্যায়নে রত থাকে, তাদেরই দুপুরে বিশ্রাম নেয়া উচিত। যাতে রাত্রি জাগরনের কারণে যে দূর্বলতা সৃষ্টি হয়, বিশ্রামের দ্বারা তা দূরীভূত হয়ে যায়। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড ১৬শ, পৃ-৭৯, মাকতাবাতুল মাদীনা)।
(৫) দিনের প্রথম প্রহরে কিংবা মাগরিব ও ইশার মধ্যবর্তী সময়ে ঘুমানাে মাকরূহ। (আলমগীরী, খন্ড-৫ম, পৃ-৩৭৬)।
(৬) পবিত্রতা ওযু সহকারে ঘুমানাে মুস্তাহাব। (৭) ডান হাতকে গালের নিচে রেখে কিবলামুখী হয়ে ডান কাতে ঘুমাবেন অতঃপর বাম কাতে ঘুমাবেন। (প্রাগুক্ত)
(৮) শােয়ার সময় কবরে শােয়ার কথা স্মরণ করবেন। কেননা সেখানে একাকী শয়ন করতে হবে। নিজের আমল ছাড়া অন্য কিছু সেখানে আপনার সাথে থাকবে না।
(৯) শােয়ার সময় আল্লাহ তাআলার স্মরণে মগ্ন থাকবেন এবং ঘুম না আসা পর্যন্ত তাহলিল, তাসবিহ ও তাহমিদ তথা سُبۡحٰنَ اللّٰهِ বা اَلۡحَمۡدُ لِلّٰه বা لَا اِلٰهَ اِلَّا اللّٰهُ বা اَللّٰهُ اَكۡبَرُ কেননা যে অবস্থাতে মানুষ ঘুমায় সে অবস্থাতেই সে ঘুম থেকে ওঠে। আর যে অবস্থাতে মানুষ মৃত্যুবরণ করে সে অবস্থাতেই সে কিয়ামত দিবসে পুনরুজ্জীবিত হবে। (প্রাগুক্ত)।
(১০) ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর এ দুআটি পাঠ করবেন। اَلۡحَمۡدُ لِلّٰهِ الَّذِیۡ اَحۡيَانَا بَعۡدَمَا اَمَاتَنَا وَاِلَیۡهِ النُّشُوۡرُ অর্থাৎ সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি আমাদেরকে মৃত্যু দেয়ার পর জীবন দান করেছেন এবং তারই নিকট আমাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে। (বুখারী, খন্ড-৪র্থ, পৃ ; ১৯৬, হাদীস নং-৬৩২৫)।
(১১) ঘুম থেকে উঠার পর সারাদিন তাকওয়া পরহেজগারী অবলম্বন করার এবং কাউকে কষ্ট না দেয়ার দৃঢ় সংকল্প করে নেবেন। (ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী, খন্ড-৫ম, পৃ-৩৭৬)।
(১২) ছেলে মেয়েদের বয়স যখন দশ বছরে উপনীত হবে তখন তাদের পৃথক পৃথক শােয়ানাের ব্যবস্থা করবেন। বরং দশ বছরের ছেলেকে তার সমবয়সী ছেলের সাথে কিংবা তার চেয়ে বয়সে বড় পুরুষের সাথেও শয়ন করতে দেবেন না। (দুররে মুখতার, রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৯ম, পৃ-৬২৯)।
(১৩) স্বামী স্ত্রী যখন খাটে ঘুমায় তখন ১০ বছরের সন্তানকে একসাথে শােয়াবেন না। ছেলে যখন বালেগ হয়ে যায় তখন প্রাপ্তবয়স্কের হুকুমের আওতায় চলে আসে। (১৪) ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর মিসওয়াক করবেন।
(১৫) রাতে ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে তাহাজ্জুদ আদায় করা বড়ই সৌভাগ্যের বিষয়।
সায়্যিদুল মুবাল্লেগীন হযরত মুহাম্মদ صَلَّی اللّٰهُ تَعَالٰی عَلَيۡهِ وَاٰلِهٖ وَسَلَّم ইরশাদ করেছেন, ফরজ নামাযের পর সর্বোত্তম নামায হচ্ছে তাহাজ্জুদের নামায। (সহীহ মুসলিম, পৃ-৫৯১, হাদীস নং-১১৬৩)।
_______________
কিতাব: অমূল্য রত্ন
লেখক : আমীরে আহলে সুন্নাত মাওলানা মুহাম্মদ বিলাল মুহাম্মদ ইলইয়াস আত্তার কাদেরী রযবীয়া (দা.)
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন