অবলম্বন করি। ঐ বুজুর্গের তাওয়াজ্জুহের বরকতে, নকশবন্দ তরীকার খাজেগানদের জযবা যা ফানার মাকামে ‘সিফাত’ সমূহের মূলতত্ত্বে মিলিত হ’য়েছে— হাসিল হয় এবং অন্য তরীকার শেষবস্তু, যা নকশবন্দীয়া তরীকার বুজুর্গগণ প্রারম্ভেই প্রবিষ্ট ক’রেছেন, তার দ্বারা পরিতৃপ্ত হই। যখন এই জযবা সুদৃঢ় হয়, তখন সুলূকের মধ্যে স্থিরতা আসে এবং আমি এই রাস্তায় হজরত ‘আলী কাররামাল্লাহু তায়া’লা অজহাহুর রূহানী প্রতিপালনের মাধ্যমে, সর্বশেষ স্থানে উপনীত হই। অর্থাৎ আমার ঊর্ধ্বারোহণ ঐ ইসম পর্যন্ত হয়, যা আমার প্রতিপালনকারী। অতঃপর হজরত খাজা নকশবন্দ র. এর রূহানী সহায়তায় এই ইসম থেকে ‘কাবেলিয়াতে উলার’ দর্জা পর্যন্ত উন্নীত হই, যাকে ‘হাকীকতে মোহাম্মদী’ (আলাসাহিবিহাস্ সালাত, ওয়াসসালাম ওয়াত্তাহিয়্যাতু) হিসাবে বিবেচনা করা হয়। পরে এস্থান থেকে হজরত ফারুক (রাজিয়াল্লাহু আনহুর) রূহানী সাহায্যে আরো উঁচু মাকামে উন্নীত হই। মনে রাখতে হবে যে, এই যোগ্যতা এই মাকামেরই বিশেষ বৈশিষ্ট্য এবং আগের স্তরটি সাধারণ স্তর। এই মাকামকে আক্তাবে মোহাম্মদী বলা হয়। খাতেমুর রসুল সল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের রূহানী তরবিয়াতের (প্রতিপালনের) মাধ্যমে এই মাকামে উন্নীত হই। এই মাকামে উপনীত হওয়ার সময় এই দরবেশ, হজরত খাজা আলাউদ্দীন আত্তারের র. যিনি হজরত খাজা নকশবন্দ র. এর খলীফা এবং কুতুবে ইরশাদ ছিলেন; রূহানী সাহায্যও লাভ করে। এই স্তর কুতুবগণের সর্বশেষ উন্নীত হওয়ার মাকাম এবং দায়েরায়ে যিল্লিয়া (প্রতিবিম্বজাত বৃত্ত) এই মাকামে পৌঁছানোর পর সমাপ্ত হয়। তারপর শুরু হয় নির্ভেজাল আসলের’ মাকাম অথবা আসর ও ছায়ার সংমিশ্রণ। আফরাদগণের একটি দল এই সম্পদ লাভের যোগ্য। অবশ্য কোনো কোনো কুতুব, আফরাদদের সোহবতের কারণে এই বিশেষ মাকামে উন্নীত হয়ে থাকেন এবং আসলকে প্রতিবিম্বমিশ্রিত রূপে অবলোকন করেন। কিন্তু মূল আসলে পৌঁছানো, অথবা মূল আসলকে তার স্তরের পার্থক্য অনুসারে অবলোকন করা, কেবলমাত্র আফরাদদেরই বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এটা আল্লাহতায়ালার অনুগ্রহ, তিনি যাঁকে চান, তাঁকে এই নেয়ামত দান করন। আর আল্লাহ্ই অনুগ্রহের মালিক।
১. আল্লাহতায়ালার গুণবাচক নাম। প্রত্যেক মানুষ আল্লাহ্ এক এক সিফাতের মূল থেকে সৃষ্ট। সেইজন্য উক্ত সিফাত-ই তাঁর প্রতিপালনকারী-ইসম বা নাম।
২. হজরত খাজা আলাউদ্দীন আত্তারের আসল নাম- মোহাম্মদ ইবন মোহাম্মদ। তিনি হজরত খাজা বাহাউদ্দীন নকশবন্দ রহ. এর খলীফাদের অন্যতম ছিলেন। হজরত নকশবন্দ রহ. স্বীয় জীবদ্দশায় তাঁর অনেক মুরীদগণের তরবিয়াতের দায়িত্ব তাঁর উপর অর্পণ করেন। তিনি ইলমে শরীয়তে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন এবং সুন্নতের অনুসরণ ও অনুকরণে দৃঢ়চিত্ত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি ৮০২ হিজরীতে, ২রা রজব, বুধবার রাতে ইন্তিকাল করেন। তাঁর রওজা মোবারক ‘মা-অরাউন্নাহার’ নামক স্থানের ‘জাফানিয়াতে’ অবস্থিত।
৩. কুতুবগণের পথ প্রদর্শক।
এই দরবেশ ‘আকতাবের’ মাকামে উপনীত হলে, সরোয়ারে দীন ও দুনিয়া (আলায়হিস্ সালাত্ ওয়াস্ সালাম) তাঁকে ‘কুতুবে ইরশাদের’ ভূষণে ভূষিত করেন এবং এই পদে অধিষ্ঠিত করেন।
তারপর আল্লাহতায়ালার বিশেষ অনুগ্রহে আরো উঁচু মাকামে উন্নীত হই এবং এক সময় মিশ্রিত প্রতিবিম্বের আসলে উপনীত হই। এই মাকামেও বিগত মাকামগুলির ন্যায় ফানা ও বাকা (বিলীনত্ব এবং স্থায়ীত্ব) হাসিল হয়। অতঃপর সেখান থেকে আসল মাকামে উন্নীত হয়ে ‘আসলের আসল’ বা মূলের মূলে উপনীত হই। এই শেষ উরুজের (ঊর্ধ্বারোহণের ) সময়, যদদরা আসল মাকামে উন্নীত হওয়া বোঝা যায়, আমি হজরত গাওসুল আজম মহীউদ্দীন শায়েখ আব্দুল কাদিরের (কাদ্দাসাল্লাহু তায়ালা সিররুহু) রূহানী মদদ প্রাপ্ত হই, যিনি তাঁর অলৌকিক ক্ষমতাবলে এই মাকাম অতিক্রম করিয়ে আসলের আসলে বা মূলের মূলে পৌঁছিয়ে দেন। তারপর সেখান থেকে আমাকে দুনিয়ার দিকে প্রত্যাবর্তিত করানো হয়। ফলে পূর্বেকার মাকামগুলি আবার ফিরে আসতে থাকে।
আর এই দরবেশের নেস্বতে ফরদিয়াত, যা শেষ উরুজের মাকামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, সে তার পিতার নিকট থেকে হাসিল করে। আর তাঁর পিতা হাসিল করেন; জযবা সম্পন্ন, অলৌকিক শক্তির অধিকারী এক বুজুর্গের ( হজরত শাহ কামাল র.) কাছ থেকে। কিন্তু নিজের দুর্বল অন্তর্দৃষ্টির কারণে এবং এই নেসবতের ক্ষীণ প্রকাশের ফলে সুলূকের রাস্তা অতিক্রম করার পূর্বে এই ফকীর উক্ত !নেসবত’ সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেনি। এমনকি সে আদৌ জানতো না যে, সে ঐ মর্যাদামণ্ডিত নেসবতের অধিকারী।
বস্তুতঃ এই দরবেশ নফল ইবাদাত করার যোগ্যতা, বিশেষতঃ নফল নামাজ পড়ার অনুমতি, তাঁর পিতার সাহায্যে লাভ করেন। আর তিনি অনুমতি লাভ করেন, তাঁর চিশতীয়া তরীকার শায়েখ হজরত শায়েখ আবদুল কুদ্দুস গংগুহী র. এবং তাঁর পুত্র শাহ রুকনুদ্দীনের র. কাছ থেকে।
ইলমে লাদুন্নী লাভঃ বস্তুতঃ এই দরবেশ হজরত খিযির (আলায়হিস সালাত্ ওয়াস্ সালামের) রূহানী সাহায্যে ইলমে লাদুন্নী হাসিল করে। কিন্তু এই অবস্থা ততোদিন বজায় থাকে, যতোদিন না আমি কুতুবদের মাকাম অতিক্রম করি। অতঃপর উক্ত মাকাম অতিক্রম করে উচ্চতর মাকামে উন্নীত হওয়ার পর স্বীয় হাকীকতের মাধ্যমে ইলম বা জ্ঞানলাভ হতে থাকে। অর্থাৎ স্বীয় সত্তার মধ্যে স্বতঃস্ফুর্তভাবে ইলম বা জ্ঞানলাভ হতে থাকে। এমতাবস্থায় অন্য কোনোকিছুই এই নিয়মের অন্তরায় সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় না।
নুযুল (অবরোহণ) ও অন্যান্য তরীকার মাশায়েখদের বর্ণনা প্রসংগেঃ এই দরবেশ নুযুলের সময় যা সায়ের আনিল্লাহ বিল্লাহ্ বা আল্লাহর নিকট থেকে সায়ের বা আত্মিক ভ্রমণ হিসাবে পরিচিত, অন্যান্য তরীকার মাশায়েখদের মাকামসমূহও অতিক্রম করার সৌভাগ্যলাভ করে এবং প্রত্যেক মাকাম থেকে সে প্রচুর ফায়দাপ্রাপ্ত হয়। প্রত্যেক মাকামের মাশায়েখগণ আমাকে সহযোগিতা করেন এবং স্ব-স্ব নেস্বতের সারবস্তু আমাকে প্রদান করেন। সর্বপ্রথম আমি চিশতীয়া তরীকার সম্মানিত বুজুর্গদের মাকাম অতিক্রম করি এবং সেখান থেকে বহুকিছু হাসিল করি। এই সমস্ত মাশায়েখদের মধ্য থেকে আমি সবচেয়ে বেশী সাহায্য প্রাপ্ত হই, হজরত খাজা কুতুবুদ্দীন র. এর রূহানী ফয়েয দ্বারা। সত্যকথা এই যে, এই বুজুর্গ এই মাকামের একজন বিশেষ ব্যক্তিত্ব। বরং এই মাকামের তিনিই নেতা।
অতঃপর আমি কুবরাবীয়া তরীকার বিশিষ্ট বুজুর্গদের মাকাম অতিক্রম করি। চিশ্তীয়া ও কুবরাবীয়া মাকাম দুইটি উরুজের হিসাবে সমমর্যাদাসম্পন্ন। কিন্তু নুযুলের সময় উক্ত মাকামটি তরীকতের এই রাজপথের ডানে এবং প্রথমটি এই সিরাতুল মুস্তাকীমের বামপাশে অবস্থিত। আর রাজপথ বা সিরাতুল মুস্তাকীম তাকেই বলে, যার মাধ্যমে কুতুবদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ফরদিয়াতের মাকাম পর্যন্ত উন্নীত হন এবং অবশেষে নিহায়াতুন নিহায়াহ্ বা চরমপ্রান্তে উপনীত হন। আফরাদদের চলার পথ স্বতন্ত্র। কুতুব হওয়া ব্যতীত এই রাস্তায় চলা অসম্ভব। উক্ত মাকামটি, মাকামে সিফাত ও উক্ত রাজপথের মধ্যে অবস্থিত। যেন এই মাকামটি, উক্ত দুই মাকামের মধ্যে মিলনক্ষেত্রস্বরূপ, যা দুই দিক থেকে ফয়েয ও বরকত লাভ করে থাকে। আর প্রথম মাকামটি এই রাজপথের অপরদিকে অবস্থিত, যার সঙ্গে মাকামে সিফাতের ক্ষীণ সম্পর্ক বিদ্যমান।
অতঃপর আমি সোহরাওয়ার্দীয়া তরীকার সম্মানিত বুজুর্গদের মাকাম অতিক্রম করি যার নেতা ছিলেন হজরত শায়েখ শিহাবউদ্দীন (কাদ্দাসাল্লাহু আসরারাহুম)। এই রাস্তাটি সুন্নতের অনুসরণের নূরে উজ্জ্বল এবং মুশাহিদার জ্যোতিতে উদ্ভাসিত। ইবাদতের তওফীক লাভ করা এই মাকামের অনুকূল অবস্থা। কিছু সালেক, যাঁরা এখনো এই মাকাম পর্যন্ত পৌঁছতে পারেননি, অথচ তাঁরা নফল ইবাদতে ব্যস্ত এবং তাতেই সন্তুষ্ট, তারাও এই মাকামের সাথে সম্পর্ক রাখার ফলে, এই মাকামের কিছু অংশ পেয়ে থাকেন। মূলতঃ নফল তাছাড়া অন্যান্যরা চাই তিনি মুবতাদী (প্রারম্ভিক সাধক) হোন অথবা মুন্তাহী (সুলূক সমাপ্তকারী অলি), এই মাকামের সাথে সম্পর্ক রাখা হেতু উক্ত নেয়ামত পেয়ে থাকেন।
আর এই সোহরাওয়ার্দী মাকাম বিস্ময়কর নেয়ামতে পরিপূর্ণ। যে নূর এই মাকামে পরিদৃষ্ট হয়, অন্যান্য মাকামসমূহে তা খুব কমই দেখা যায়। এই মাকামের মাশায়েখগণ রসুলুল্লাহ স. এর পূর্ণ অনুসরণের ফলে অত্যন্ত উচ্চ মর্তবার অধিকারী এবং এই কারণে তাঁরা সমকালীন অন্যান্য তরীকাপন্থী মাশায়েখদের মধ্যে বিশেষ সম্মানিত। উক্ত বুজুর্গগণ এই মাকামে যা লাভ করেছেন, তা অন্য কোথাও পান না; যদিও উরুজের দৃষ্টিতে ঐ মাকামগুলি, এই মাকাম থেকে অধিক উন্নত।
অতঃপর আমি জযবার মাকামে অবতরণ করি। এই মাকামটি অসংখ্য প্রকার জযবা দ্বারা পরিপূর্ণ। তৎপর সেখান থেকেও নীচে অবতরণ করি। নীচে অবতরণের সর্বশেষ স্তর মাকামে কলব, যা ‘হাকীকতে জামে’আ’ বা সমস্ত মূলতত্ত্বে একত্রিতকারী। ইরশাদ ও তাকমীলের দায়িত্ব এই মাকামে অবতরণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। শেষ পর্যন্ত আমি এই মাকামে অবতরণ করি। এই মাকামে স্থিতিশীল হওয়ার আগেই পুনরায় আমার ‘উরুজ নসীব হয়। এই সময় আমি আসলকে ছায়ার ন্যায় পিছনে ফেলে আসি। এই উরুজের ফলে (যা কলবের মাকামে নসীব হয়) আমার পূর্ণ পরিপক্কতা লাভ হয়।
_______________
মাবদা ওয়া মা'আদ
হজরত মুজাদ্দেদে আলফে সানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি
অনুবাদ: ড. আ ফ ম আবু বকর সিদ্দীক
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন